জ্বলদর্চি

বিশিষ্ট ক্রিকেটার ও জাতীয় নির্বাচক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিলেন শুভ্রাংশু শেখর আচার্য্য

বিশিষ্ট ক্রিকেটার ও জাতীয় নির্বাচক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিলেন শুভ্রাংশু শেখর আচার্য্য


'‘বাংলা দলের স্বার্থেই আরো বেশি করে দলে বাংলার মাটির সাথে যুক্ত খেলোয়াড়দের থাকা জরুরি’' - সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়

৩৩ বছরের দীর্ঘ খরা কাটিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে বাংলার সেরা সাফল্য এসেছিল তাঁর অধিনায়কত্বেই। ১৯৮৯-৯০ সালে বাংলা রঞ্জি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এক সময়ে দেশের সেরা উইকেটকিপার। পরবর্তীতে যিনি একজন সফল ক্রিকেট কোচ, ক্রীড়া সমালোচক ও লেখক। জাতীয় দলের নির্বাচক হিসেবে বাংলা তথা পূর্বাঞ্চলের জন্য যাঁর অবদান অনস্বীকার্য। এক সময় যেখানে দক্ষতার সাথে সামলেছেন প্রশাসকের দায়িত্ব সেই ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল যাঁর আজীবনের অবদানকে স্বীকৃতি জানিয়েছে জীবনকৃতি সম্মান দিয়ে, তিনি সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ময়দান যাকে চেনে ‘মাধু’ নামে। তিনি তাঁর ব্যস্ত রোজনামচার মধ্যে থেকে কিছুটা সময় বের করলেন জ্বলদর্চির জন্য। ফোনেটিক সাক্ষাৎকার নিলেন শুভ্রাংশু শেখর আচার্য্য।

শুভ্রাংশু – আপনার ক্রিকেট খেলার শুরুটা কিভাবে হয়েছিল?

সম্বরণ – ছোট থেকে খেলাটার প্রতি একটা আকর্ষণ তো ছিলই। সেই টানে পাড়ার গলিতে আমাদের ছোটদের যে ক্রিকেট ক্লাব ছিল ‘গোল্ডেন ক্রিকেট ক্লাব’ সেখানে টেনিস বলে প্রথম ক্রিকেট খেলতে শুরু করি। এরপর যখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন স্কুল-ক্রিকেট টিমে চান্স পাই ও নিয়মিত ইন্টার স্কুল খেলতে শুরু করি। সেই সময় সিএবিতে সামার স্কুল ক্রিকেট হত যেখানে আমি ওই ছোট বয়স থেকেই বেশ অদ্ভুতভাবে বড়দের সাথে ক্রিকেট খেলতে থাকি। এভাবেই আমার ক্রিকেটের শুরু।

শুভ্রাংশু – আপনার পরিবারের মধ্যে কেউ কি আপনার আগে ক্রিকেট খেলার সাথে যুক্ত ছিলেন? 

সম্বরণ – একেবারেই না। আমাদের পরিবারের সবাই প্রায় শিক্ষা জগতের সাথে যুক্ত। ফলে খেলাধুলার সঙ্গে কোনপ্রকারের সম্পর্ক ছিলই না বলা চলে। আমিই প্রথম যে কিনা খেলতে খেলতে এই খেলার জগতের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ি।
শুভ্রাংশু – একটা বিষয় খুব জানতে ইচ্ছে করছে। শিক্ষানবীশ প্রায় সকল ক্রিকেটারই হয় দুধর্ষ ব্যাটসম্যান হতে চায় নয় দুরন্ত বোলার। আপনি বেছে নিয়েছিলেন উইকেটকিপিং। কেন ? ছোট থেকেই কি কিপিং করতে ভালবাসতেন ?

সম্বরণ – আসলে উইকেটের পেছনে দাঁড়ালে অনেক বেশি বল ধরার সুযোগ পাওয়া যেত। ছোটবেলায় এই ক্রমাগত বল ধরতে পাওয়া ব্যাপারটা আমার কাছে খুব আনন্দের ছিল যা কিনা পরবর্তীতে আমায় কিপিং এর দিকে ঠেলে দেয়।

শুভ্রাংশু – ১৯৩৮-৩৯ সালে বাংলা প্রথমবার রঞ্জি ট্রফি জিতেছিল, তারপর প্রায় ৫১ বছর পর ১৯৮৯-৯০ সালে আবার আপনার হাত ধরে ট্রফি ফিরে এসেছিল বাংলায়। এই অনুভুতিটা কেমন ছিল ?

সম্বরণ – ৩৮-৩৯ এ বাংলার যে রঞ্জি জেতার কথা আপনি বললেন সেটা ছিল প্রি-ইন্ডেপেন্ডেন্ট রঞ্জি। সেই বাংলা টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন টম লংফিন্ড। যিনি পরবর্তীতে ইংল্যান্ড ক্যাপ্টেন টেড ডেক্সটারের শ্বশুরমশাই। টম লংফিন্ড বাংলার হয়ে খেললেও ছিলেন তো ব্রিটিশ। যে ব্রিটিশরা এসেছিল আমাদের দেশ শাসন করতে। বাংলায় কথা বলা আমার কাছে সেই ট্রফি প্রকৃত অর্থে বাংলার বলে মনে হয় না। তাই ৯০তে ট্রফি জেতাটা আমার কাছে অনেক বেশি আনন্দের। ৫১ বছর বাদে বলে নয় বরং একজন বাঙালী হিসেবে, একজন বঙ্গসন্তান হিসেবে ওই মুকুটটা পাওয়া আমার কাছে অনেক বেশি গর্বের।

শুভ্রাংশু – ৯০’তে আপনাদের জেতার পর আর বাংলা রঞ্জি জেতেনি। এর কারণ কি বলে আপনার মনে হয় ?

সম্বরণ – দুঃখজনকভাবে তারপর বাংলা আর রঞ্জি জিততে না পারলেও বিগত কয়েকবছর যেমনভাবে ক্রমাগত ভালো খেলছে তাতে যে কোন সময় ট্রফি জিততেই পারে। আমি তো যথেষ্ট আশাবাদী।
শুভ্রাংশু – বাংলা টিমে অবাঙালি খেলোয়াড়ের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াটা কি কোনোভাবে দলের ওপর প্রভাব ফেলছে বলে আপনার মনে হয় ?

সম্বরণ – নিশ্চয়ই। বাংলা ড্রেসিংরুমে এখন বাংলায় কথা বলা হয় না। এই ব্যাপারটা শুধু রঞ্জি টিমের ড্রেসিং রুমে নয়, আন্ডার নাইনটিন, আন্ডার সিক্সটিন সব ড্রেসিংরুমেই এক চিত্র। আমি তো বহুবার বলেছি, লিখেছি এটা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার। বাংলা দলের স্বার্থেই আরো বেশি বেশি করে দলে বাংলার মাটির সাথে যুক্ত বা ‘সান অব দ্য সয়েল’ খেলোয়াড়ের থাকা জরুরি।

শুভ্রাংশু – খেলোয়াড় বা বাংলার অধিনায়ক হিসেবে বঙ্গ ক্রিকেটে আপনার অবদান অপরিসীম, পাশাপাশি নির্বাচক হিসেবেও বাংলা ক্রিকেট আপনাকে ভুলতে পারবে না। ভারতীয় ক্রিকেটে নতুন যুগের সূচনা যার হাত ধরে সেই সৌরভ গাঙ্গুলীর নির্বাচন আপনার হাত ধরেই। এবং এমন একটা সময়ে যখন বাংলা থেকে প্রায় কোনো ক্রিকেটারই সুযোগ পেত না জাতীয় দলে। এটা কিভাবে সম্ভব করলেন ?

সম্বরণ – বাংলার ক্রিকেটাররা জাতীয় দলে যে সুযোগ কেন পেত না সে ইতিহাস বলতে গেলে তিনশ পাতার বই হয়ে যাবে। আমি নির্বাচক হওয়ার আগে বাঙালিরা জাতীয় দলে খেলবে এটা ভাবাই যেত না। নির্বাচক হওয়ার পর আমি চেষ্টা করেছি অন্য নির্বাচকদের বোঝাতে কোনো আঞ্চলিক পক্ষপাতিত্ব না করে যারা যোগ্য তারাই কেবল সুযোগ পাক। কেন দলে শুধু মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোর বা কর্ণাটক থেকে খেলোয়াড়রা সুযোগ পাবে। এবং শেষ পর্যন্ত আমি আমার ক্রিকেটীয় যুক্তি দিয়ে অন্যান্য নির্বাচকদের তা বোঝাতে পেরেছি। ১৯৯৩ তে সৌরভ যখন সুযোগ পায় তখন সে জাতীয় দলে খেলার যোগ্য ছিল বলেই পেয়েছে। তারপর তো বাকিটা ইতিহাস। আসলে নির্বাচক হিসেবে আমি আমার কাজটা সবসময়ই সততার সঙ্গে করে যাওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছি।
শুভ্রাংশু – সৌরভ গাঙ্গুলীর নির্বাচনের পর কোনরকম বিরূপ মন্তব্য বা ঘটনা কি ঘটেছিল যা আপনাকে আঘাত করেছিল ?

সম্বরণ – বিরূপ অনেক মন্তব্যই আমায় শুনতে হয়েছে। তার মধ্যে একটা বলি। সে সময় মুম্বাই এর ‘আফটারনুন’ নামের একটি সান্ধ্য পত্রিকা হেডিং করেছিল “ দিস ম্যান ইজ স্পয়েলিং দ্য হোল শো”। সেই কাগজের কাটিংটা আমি রেখে দিয়েছি আজও। তো সেই বোম্বে প্রেস আমার নির্বাচক হিসেবে মেয়াদ ফুরোনোর পর ডেকে ‘বেস্ট সিলেকটর’ অ্যাওয়ার্ড দিয়েছিল। একদিন যারাই আমার সমালোচনা করেছিল তারাই আবার আমায় পরে সম্মানিত করেছিল।

শুভ্রাংশু – আপনি যখন খেলছেন তখন আপনার মতো উইকেটকিপার সারা দেশে বিরল। আপনার ধারেপাশেও কেউ নেই অথচ তাও আপনার জাতীয় দলে সুযোগ হয়নি। এই যে আক্ষেপ তা কি কোনওভাবে নির্বাচক হয়ে মেটানোর চেষ্টা করেছিলেন ?

সম্বরণ –অবশ্যই। আমার মনে হয়েছিল আমি তো সুযোগ পাইনি কিন্তু আমার পরবর্তী বাংলার বা বলা ভালো পূর্বাঞ্চলের খেলোয়াড়রা যেন কোনওভাবে বঞ্চিত না হয়। এবং নির্বাচক হয়ে আমি সেই চেষ্টাই করে গিয়েছি এবং কিছুটা হলেও সফল যে হয়েছি তা আপনারা জানেন।

শুভ্রাংশু – এখনও আপনার চূড়ান্ত ব্যস্ত রোজকার জীবন। টিভি অ্যানালিস্ট, কাগজে কলাম লেখা, কোচিং, প্রশাসনিক কাজকর্ম সামলানো, পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করা-- এত কিছুর জন্য সময় বের করেন কি করে? 

সম্বরণ – আসলে ক্রিকেটটা আমার প্যাশন। সবুজ ঘাসই আমার জীবন। এবং সারা জীবন এই খেলার মধ্যেই ডুবে থাকতে চাই। তাই সময় ঠিক বেরিয়েই যায়।

শুভ্রাংশু – আমি যতটুকু জানি আপনি হলেন দক্ষিণ কলকাতার মানুষ আর ক্রিকেট শিখতে আসতেন উত্তর কলকাতায় –

সম্বরণ – হ্যাঁ। উত্তর কলকাতায় কার্তিক বসুর কাছে শিখতে আসতাম। ক্রিকেটের এ বি সি ডি ওনার কাছেই শেখা। উনিই হলেন আমার ক্রিকেট গুরু। আজ আমি যা হতে পেরেছি তা ওনার জন্যই। উনি ছাড়া আমি কিছু করতেই পারতাম না।
শুভ্রাংশু – উত্তর ও দক্ষিণ দুই কলকাতাতেই জীবনের অনেকখানি সময় আপনি কাটিয়েছেন। কোন কলকাতা আপনাকে বেশি টানে ?

সম্বরণ – কলকাতাকে উত্তর বা দক্ষিণ এভাবে আমি দেখি না তবে খেলা শেখার জন্য উত্তর কলকাতায় আমায় আসতে হলেও আজও দক্ষিণ কলকাতাই আমায় বেশি টানে। কারণ এখানেই আমার জন্ম, আমার বেড়ে ওঠা। দক্ষিণ কলকাতা আমার কাছে অদ্ভুত এক শিহরণ।

শুভ্রাংশু – আমরা খেলোয়াড়, নির্বাচক, কোচ সম্বরণকে তো জানি। খাদ্যরসিক সম্বরণ কেমন ?

সম্বরণ – আমি খুব মাছ প্রিয় লোক। মাংস আমার খুব একটা পছন্দের নয়। আর পূর্ববঙ্গের ছেলে হওয়ার কারণে ইলিশ আমার সবচেয়ে পছন্দের হলেও যে কোন মাছই কিন্তু আমার পছন্দের।

শুভ্রাংশু – নতুন বা উঠতি খেলোয়াড় যারা তাদের আপনি কি উপদেশ দেবেন ?

সম্বরণ – একটাই উপদেশ, খেলাটাকে উপভোগ করতে হবে। যে কাজই তুমি কর তার জন্য যদি তোমার ডেডিকেশন, প্যাশন না থাকে তাহলে কখনই সাফল্য আসবে না। খেলার জন্য খেলছি এই মনোভাব থাকলে হবে না। খেলাটাকে ভেতর থেকে ভালোবাসতে হবে।

শুভ্রাংশু – সম্বরণদা আপনাকে শেষ প্রশ্ন। তিরিশ পেরোনো জ্বলদর্চি পত্রিকার উদ্দেশ্যে আপনি কি বার্তা দিতে চান ?

সম্বরণ – জ্বলদর্চির জন্য আমার অশেষ শুভেচ্ছা রইল। আশা করব ভবিষ্যতে এই পত্রিকা আরও এগিয়ে যাবে, নতুন দিশা দেখাবে।

শুভ্রাংশু – আপনার এতখানি ব্যস্ত সময়ের মধ্যেও আপনি জ্বলদর্চির জন্য যে সময়টুকু দিলেন তার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

সম্বরণ – ধন্যবাদ।
--------------------------------------------------------------
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇



Post a Comment

0 Comments