আমেরিকার আদিম মানুষের খোঁজে
মলয় সরকার
পর্ব-২ ( দ্বিতীয় পর্ব)
এই সাদা বালির বালিয়াড়ি পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে বড় এই ধরণের বালিয়াড়ি যা ২৭৫ বর্গ কি মি জুড়ে বিস্তৃত।
এরকম একটা আশ্চর্য জিনিস যে পৃথিবীর বুকেই জলজ্যান্ত ভাবে রয়েছে ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠছে।চোখে দেখে তো নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছি না।
এটা কিন্তু সাধারণ বালি নয়।এটা হল জিপসাম নামে একটি রাসায়নিক। এর আসল রাসায়নিক নাম হল CaSO4,2H2O।অর্থাৎ ক্যালসিয়ামের একটি যৌগ, ক্যালসিয়াম সালফেট। প্রাকৃতিক ভাবে তৈরী এত বড় একটা জিপসামের একত্র ক্ষেত্র হিসাবে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড়।এই মরুভূমির নাম চিহুয়াহুয়ান মরুভূমি।
অস্ত সূর্যের রক্তিম আলোয় এবং দিনের বিভিন্ন সময়ে আকাশের আলোর বিভিন্ন অবস্থায় এর উপরে নানা মোহময় সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। শুধু তাই নয়, হাওয়া দিলেই এই সাদা বালি উড়ে গিয়ে এই ক্ষেত্রের উপরে নানা সুন্দর নক্সার সৃষ্টি করে।এই হাওয়ার জন্য এটি উত্তরপূর্বে অল্প সরে সরে যাচ্ছে, যে সরণ প্রায় বছরে ৩০ ফুট মত।
আমরা এগোলাম। যত দূর চোখ যাচ্ছে দেখি সাদায় সাদা পাহাড় চোখ ঝলসে যাচ্ছে।বহু ছেলে মেয়ে এবং সঙ্গে বয়স্করাও এই ঝুরঝুরে বালির পাহাড়ে মেতে উঠেছে নানা খেলায়। অনেকে গড়াগড়ি খাচ্ছে, কেউ কেউ গড়িয়ে নামছে পাহাড়ের উপর থেকে। কেউ আবার, দেখলাম একটা গামলার মত জিনিসের মধ্যে বসে উপর থেকে পাহাড়ের ঢালু গা বেয়ে গড়িয়ে আসছে।এইটা নাকি ভিজিটিং সেন্টার থেকে ভাড়া নেওয়া যায় বা কেনা যায়।
এখানে একটা কথা বলে রাখি, এর পাশেই কিন্তু রয়েছে আমেরিকার একটি মিলিটারী ঘাঁটি। সেখানে কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ।এই মিলিটারী ঘাঁটি তৈরী হয় ১৯৪৫ সালে। এখানেই ১৬ই জুলাই ১৯৪৫ এ প্রথম এটম বোমা ফাটিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল।এই জায়গাটা নাকি মহাকাশ থেকেও দেখা যায় এবং মহাকাশযান কলম্বিয়া এখানেই অবতরণ করেছিল।
সে যাক, আমরাও মনে মনে ছটফট করছি এই বালিতে গড়াগড়ি খাওয়ার জন্য। এখানে লেখা আছে এই বালির মধ্যে কেউ গাড়ি চালাবেন না বা কোনরকম ক্ষতির চেষ্টা করবেন না। নির্দিষ্ট জায়গা দিয়েই গাড়ি চালাতে হবে।
হঠাৎ চোখে পড়ল, দূরে এক ভদ্রলোক কিছু বলতে চাইছেন। কাছে গিয়ে দেখি উনি পার্কের গাইড। দর্শকদের এই সাদা বালির মরুভূমির সম্বন্ধে বলবেন।আমরা গিয়েছি চারজনে। আমি আমার স্ত্রী, ছেলে আর মেয়ে। ভাবলাম, শুনেই নিই কি বলছেন।
উনি বোঝাচ্ছিলেন,কি করে এই সাদা বালির মরুভূমির উৎপত্তি হল।
অতীতে প্রায় ১২০০০ বছর ধরে বৃষ্টির জলে ধুয়ে এই টুলারোসা উপত্যকায় এই জিপসাম জমা হয়েছে। এখানকার ঊষ্ণতা ও শুষ্কতাই এখানে এই মরুভূমির সৃষ্টি করেছে। এই জিপসাম, সার, প্লাস্টার, শ্যাম্পু তৈরী ইত্যাদি নানা কাজে লাগে।
এখানে যে আদিম মানবের অস্তিত্বের ছাপ পাওয়া গেছে তা প্রায় ২৩০০০ বছর আগেকার।
এর ভিতর দিয়ে যে রাস্তাটা আছে তা প্রায় আট মাইল মত লম্বা।এর ভিতর পিকনিক করার জায়গাও আছে।
এর ভিতর যথেচ্ছ হেঁটে বেড়ানো যায়।পায়ে চলা পথও রয়েছে এখানে।এই বালিগুলো হাতে নিয়ে দেখলাম, ঠিক বালির মত নয়। এটি খুব গুঁড়ো গুঁড়ো নুনের দানার মত।
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
এখানে রয়েছে, শুকনো বড় বড় ঘাসের ঝোপের মত টুকরো টুকরো, এখানে ওখানে, অল্প স্বল্প ঝোপ।সবই যেন কেমন শুকনো।এগুলি আবার সাদা বালিকে ধরে রাখতে খুব সাহায্য করে।এর মাঝে কোথাও কোথাও কাঠের পাটাতন বসিয়ে হাঁটার জন্য Boardwalk Trail ও করা আছে।
এর মধ্যেও কিন্তু কিছু প্রাণী থাকে শুনলাম । আমি তো ভেবেছিলাম, এর মধ্যে কোন প্রাণীই বাঁচতে পারে না। কিন্তু দেখেছি এর আগে মরুভূমিতে, কঠিন পাথরের মাঝেও কোন না কোন তৃণ জাতীয় প্রাণের আগে জন্ম হয়। পরে পরে আসে বড় প্রাণ। এখানে এই মরুভূমিতে তৃণজাতীয় প্রাণের সাথে সৃষ্টি হয়েছে বেশ কিছু প্রাণীর, যারা এই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে দিব্যি বেঁচে রয়েছে এবং বংশাবলীর ধারা বজায় রেখেছে।এখানে পাওয়া যায় মাছ, পাখী ,সাপ বা কিছু সরীসৃপ , কিছু উভচর শ্রেণীর এবং ইঁদুর জাতীয় কিছু প্রাণী।বেশ কিছু অমেরুদণ্ডী প্রাণীও এখানে পাওয়া যায়।এখানে যে একমাত্র মাছটি পাওয়া যায় তা হল White Sands Pupfish।এটি ১.৫-২.৫ ইঞ্চি মত লম্বা হতে পারে। এর চোখ ঘন কালো এবং গায়ে চকচকে রুপোলী আঁশ আছে। অল্প বৃষ্টির অগভীরজলেই এরা খেলা করে বেড়ায়।এরা বিগত ১২০০০ বছর ধরে বিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বেঁচে আছে এবং এই মাছ পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।
রেঞ্জার গাইড আমাদের নিয়ে গেলেন কিছু বড় ঝোপ ধরণের গাছের কাছে এবং দেখালেন সেই সব গাছেও ছোট ছোট ফল রয়েছে। এই সমস্ত কাঠবিড়ালী বা ইঁদুর জাতীয় প্রাণীগুলো নাকি এই ফল এবং গাছের পাতা শিকড় খেয়েই বেঁচে থাকে।এই অঞ্চলের আশে পাশে খুব বেশি না হলেও অল্প মনুষ্য বসতি আছে, প্রায় হাজার দেড়েকের মত।
এখানে বৃষ্টি হয় জুনের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বরের প্রায় শেষ পর্যন্ত। তবে তা খুব বেশি নয়, বার্ষিক গড়ে ১০ ইঞ্চির মত।বৃষ্টি হলে এই সমস্ত নুনের কেলাস বা দানা গলে যায় এবং আবার পরে রোদ উঠলে বা বাতাস শুকনো হলে শুকিয়ে দানা দানা হয়ে যায়।
সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে গোল করে ঘিরে গাইডের কথা শুনছিলাম আর আশ্চর্য হচ্ছিলাম।এখানে তাপমাত্রাও যেমন বেশি ,তেমনই কম।সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩.৯ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড থেকে সর্বনিম্ন -৩১.৭ ডিগ্রী পর্যন্তও হতে পারে। রোদের সময় রোদের তেজও প্রচণ্ড, এমনকি অন্য সময়েও। মরুভূমির রঙ সাদা হওয়ার জন্য রোদের তেজও বেশি লাগে , ফলে চামড়ার উপরেও তা বিক্রিয়া করতে পারে। তাই আমরা সতর্ক হয়ে বড় টুপি এবং রোদের ক্রিম মেখেই গিয়েছিলাম।
এখানে এসে আমাদের যেন বয়স কমে গেল। মনে হচ্ছে,হুড়োহুড়ি করি ছোটদের মতই। সাদা বালির উপর গড়াগড়ি দিলাম। হাঁটলাম এখান থেকে ওখান। এত ফাঁকা জায়গায় হঠাৎ এসে মন যেন একেবারে উন্মুক্ত হয়ে গেল।
আকাশে তখন মেঘ আর রোদের খেলা চলেছে।’ নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই–” দেখতে দেখতে দিন কাবার হয়ে সূর্য পৌঁছে গেল পশ্চিম আকাশে। পড়ন্ত রোদে সত্যিই এই সাদা বালির মরুভূমির অদ্ভুত এক রূপ চোখে পড়ল, যা ঠিক বলে বোঝানো যাবে না।ক্যামেরা বন্দী করতেও পারি নি সেই সৌন্দর্য, শুধু মন ক্যামেরায় বন্দী করলাম, প্রাণ ভরে।
এই সব দেখতে দেখতে আচ্ছন্ন হয়ে আছি এমন সময় হঠাৎ ঘণ্টা পড়ল ,সময় শেষ ,এবার বেরোতে হবে। গাড়ীতে মাইকে এনাউন্স করছে।বালির পাহাড় থেকে নেমে যেতে যেতে যেন বড় তাড়াতাড়িই অন্ধকার হয়ে এল চারিপাশ। এখানে তো কোন আলোর ব্যবস্থা নেই।খুব খারাপ লাগছিল চলে আসতে।
আমরা গাড়িতে উঠে ফিরে আসতে যাব, এমন সময় হল বিপত্তি। আবছা অন্ধকারে , যদিও গাড়ির আলো ছিল, তবু বেকায়দায় গাড়ির চাকা গিয়ে পড়ল সেই সাদা নুনের মত বালির মধ্যে। হঠাৎ এই বালির উপর চাকা চলে যাওয়াতে , আমার ছেলে গেল ঘাবড়ে। কি জানি, আমেরিকার অনেক জায়গারই নিয়ম খুব কড়া তো, আর চার ধারে সব সময় রেঞ্জারের গাড়ীর পাহারা। যদি কারোর চোখে পড়ে যায়, নির্ঘাৎ করবে ‘ফাইন’। তাই ও তাড়াতাড়ি গেল গাড়িকে এর থেকে বের করে আনতে।
কিন্তু কিছুতেই আর সেটা সম্ভব হচ্ছে না, যতই এগোতে পিছোতে যায় ততই ঝুর ঝুর করে আরও বালি এসে জড়িয়ে ধরে চাকাকে। ঢালু পাহাড়ের দিক থেকে গুঁড়ো বালি আরও এগিয়ে আসে।বালিও যেন বাচ্চা ছেলের মত মজার খেলায় মেতেছে।এই দেখে ও তো আরও চেষ্টা করে। এদিকে চারদিক থেকে সমস্ত গাড়ি বেরিয়ে চলে যাচ্ছে। সন্ধ্যের অন্ধকার যেন গভীর হয়ে ভূতের মত জড়িয়ে ধরছে। এমন হল যে, এক হাত তফাতে লোকের মুখ দেখা যাচ্ছে না। রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। দূরে টিম টিম করে কোন লাল আলো দেখা যাচ্ছে চলে যাওয়া গাড়ীর।
এমন অবস্থা, একসময় যে, অত বড় অন্ধকার মরুভূমিতে আমরা মাত্র চারজন ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা মানুষ আর একটি আটকে যাওয়া গাড়ি ছাড়া আর কেউ নেই। ছেলের মুখ চোখ ঘেমে নেয়ে একাকার, আমাদেরও। ভাবছি এই অন্ধকারে সারা রাত কাটাতে হবে না কি। খাবার দাবারও বেশি কিছু নেই। আমার স্ত্রীর হাতে তৈরী কেক কিছু রয়েছে আর অল্প জল। তাই দিয়ে কি আর চলবে! কি করা হবে ভাবছি।
হঠাৎ দেখি, শেষবারের মত রেঞ্জারের গাড়ি টহল দিতে এসেছে অন্ধকারের মধ্যে। যা থাকে কপালে, বলে, ফাইনের তোয়াক্কা না করেই তাকে ধরতে হল, যে আমরা আটকে গেছি। ভয়ে বুক দুরু দুরু, কি হয় কি হয়! কি জানি কি শাস্তি হয়, এই বালিতে গাড়ি তোলার অপরাধে!
ও মা! সবাই কে চমকে দিয়ে, সেই টহলদার গাড়ি থেকে তড়াক করে লাফিয়ে নামল এক লম্বা চওড়া দীর্ঘদেহী রেঞ্জারের পোষাক পরা মহিলা। বয়স বেশ অল্প বলেই মনে হল। তবে চেহারা একেবারে শক্তপোক্ত। সে তো নেমেই সব শুনে নিল প্রথমে। তার পর খুঁটিয়ে দেখল গাড়ির চারপাশ ঘুরে। তারপর বলা নেই কওয়া নেই, আমাদের একটু দূরে সরিয়ে দিয়ে ধড়াস করে মাটিতে শুয়ে পড়ে গাড়ির চাকায় আটকে যাওয়া বালির স্তুপ প্রথমে হাত দিয়েই সরাতে আরম্ভ করল।আমরা তো তার কাণ্ড দেখে হতভম্ব।
কিন্তু কিছুক্ষণেই বুঝল, এ তার দু হাতের ‘কম্মো’ নয়।তখন নিজের গাড়ি থেকে নামিয়ে আনল একটা বেলচা। সেটা দিয়েই সব বালি সরাতে চেষ্টা করল।চারি দিকে তখন নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, আমরাই কেবল অন্ধকারে কটি প্রাণী।অতবড় জনপূর্ণ মরুভূমি ধু ধূ অন্ধকারের কালো চাদরে মুড়ে ভয়ংকর চেহারা নিয়েছে।
এর পরেই ঘটল সেই ঘটনাটা-
ক্রমশঃ-
1 Comments
দারুন লেখা। চলুক
ReplyDelete