জ্বলদর্চি

পুরুলিয়া জাদুঘর ও প্রাচীন জৈন সংস্কৃতি কেন্দ্র 'পাকবিড়রা' /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ৬৫

পুরুলিয়া জাদুঘর ও প্রাচীন জৈন সংস্কৃতি কেন্দ্র 'পাকবিড়রা'

সূর্যকান্ত মাহাতো


 শেষ 'জৈন তীর্থঙ্কর' 'মহাবীরের' জন্ম যদি ৫৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ (আনুমানিক) ধরা হয় তাহলে এই বছর চৈত্র মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী তথা ২০২৩ সাল ২৫৬৩ বছর পূর্ণ করল। আবার অন্য একটি মত অনুযায়ী জন্ম সাল ৫৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ধরলে ৫৯ বছর বেড়ে গিয়ে তা ২৬২২ বছরে পড়ল। একটা সময় বাংলার এই জঙ্গলমহলে 'জৈন সংস্কৃতি' বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছিল। শেষ জৈন তীর্থঙ্কর হিসেবে খোদ মহাবীরই একদিন ধর্ম প্রচারে এসে পা রেখেছিলেন জঙ্গলমহলে। পুরুলিয়া জেলার একটি প্রাচীন জৈন সংস্কৃতি কেন্দ্র হল 'পাকবিড়রা'। কিন্তু সেই জৈন সংস্কৃতি এখন ক্ষয়ে যাওয়া ইতিহাস। পদে পদে আজ লঙ্ঘিত হয়ে চলেছে জৈন 'ধর্মনীতিসমূহ'গুলো।

"জঙ্গলমহলে মহাবীরের আগমনের কথা বার বার শোনা যায়। তাকে কুকুর লেলিয়ে তাড়ানোর কথাও শোনা যায়। কিন্তু মহাবীর এই জঙ্গলমহলের ঠিক কোন স্থানে এসেছিলেন তার কি কোন নির্দিষ্ট নাম উল্লেখ আছে বা জানা গেছে?" জানতে চাইলেন এক ভাই।
"অবশ্যই। তিনি পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ার যে সকল স্থান পরিভ্রমন করেছিলেন সেইসব গ্রামের নাম উল্লেখ রয়েছে তো 'আচারঙ্গ সূত্রে'। সেখানে যে গ্রাম নামগুলোর উল্লেখ আছে তা হল, সুখলাড়া, লৌলাড়া, লাড়রা, পোদলাড়া, বহুলাড়া ইত্যাদি।"

"একটু আগে তুমি বললে, জৈন ধর্মনীতি সমূহগুলো লঙ্ঘিত হচ্ছে। সেটা কীভাবে?"

"জৈন ধর্মের মূলনীতি হল, 'চতুর্যাম' এবং 'সর্বপ্রাণবাদ তত্ব'। অথচ পাকবিড়রায় এসে তুমি কী দেখলে? এই 'অহিংসা', 'অস্তেয়' ও প্রাণী হত্যার মতো ঘটনাগুলো আজ একাধিক তীর্থঙ্কর মূর্তির সামনেই তো ঘটে চলেছে।"

"বুঝলাম না। আরো একটু পরিষ্কার হতে চাই।"

"দশম, একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে জৈন তীর্থঙ্করদের যে মূর্তিগুলো গড়ে উঠেছিল আজ সেগুলো ধর্মান্তরিত হয়ে 'ভৈরব', 'কাল ভৈরব', কোথাও  'শিব' দেবতা রূপে পূজিত হয়ে চলেছেন। কোথাও তাদের নির্গ্রন্থ শরীরকে দুধ মাখিয়ে স্নান করানো হচ্ছে। মাথায়, কপালে ও পায়ে সিন্দুরের প্রলেপ লাগানো হচ্ছে। কোথাও বা আবার বিশেষ সময়ে তাদের সামনে 'পশু বলি'ও হচ্ছে। চিরকাল অহিংসার পূজারী, প্রাণী হত্যার ঘোর বিরোধী তীর্থঙ্করদের সামনেই পশু বলির শোণিত ধারা বয়ে চলেছে। এটা কি ধর্মীয় নীতির লঙ্ঘন নয়?"

"হ্যাঁ।" পাকবিড়রা জৈনকেন্দ্রে আমি সেরকমটাই প্রত্যক্ষ করলাম। আমি যেদিন গিয়েছিলাম সেদিন সোমবার ছিল বলে সেদিন ব্রাহ্মণ পুরোহিত দিয়ে দীর্ঘ সাড়ে সাত ফুটের তীর্থঙ্কর মূর্তিকে 'ভৈরব' রূপে পূজা করা হচ্ছে। দুধ দিয়ে তার শরীর ধুয়ে দেওয়া হচ্ছে। একাধিক পুণ্যার্থী এসেছেন পুজোর অর্ঘ্য নিয়ে।

পুরুলিয়া জেলার জৈন তীর্থস্থান গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, 'পাকবিড়রা'। বিনয় ঘোষ 'পাকবিড়রা' পরিদর্শন করে একে 'জৈন কালচার কমপ্লেক্সের' বিশাল বড় কেন্দ্র বলে উল্লেখ করেছেন।(পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা -৪৪৩) তবে বিনয় বাবুর 'পাকবিড়রা' পরিদর্শনেরও একশ বছর আগে একজন 'ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ববিদ' এই স্থান ভ্রমণ করেছিলেন। তিনিই প্রথম ইতিহাসের আলোয় এনেছিলেন এই স্থান। এই স্থানের ঐতিহাসিক গভীরতাও উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি হলেন 'জে ডি বেগলার'। এই স্থান পরিদর্শন করে তিনি এখানে ঠিক কি কি দেখেছিলন তার উপর ভিত্তি করে একটি রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন "এ ট্যুর ফর্ম দ্য বেঙ্গল প্রোভাইন্স" গ্রন্থে। বিনয় ঘোষ ও গণেশ মাহাতো পাকবিড়রার সেই রিপোর্টটির একটি ভাবানুবাদ করেছেন। আড়াইশো বছর আগে বেগলার সাহেব ঠিক কী দেখেছিলেন সেটা আগে দেখে নেওয়া যাক।
বেগলার সাহেব পাকবিড়রায় গিয়ে অনেকগুলো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ও অসংখ্য জৈন মূর্তি দেখেন। মূর্তি গুলো একটি চালাঘরে সংরক্ষিত ছিল। একটি ভেঙে পড়া মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপর চালা ঘরটি অবস্থিত। প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো একটি সাড়ে সাত ফুটের বিশাল নগ্ন জৈন মূর্তি দেখেন। মূর্তির পাদপিঠে পদ্মের প্রতীক অঙ্কিত। দেওয়ালের পাশে আরো ছোট বড় অজস্র মূর্তি রয়েছে। দুটি ছোট মূর্তিও ছিল। সেখানে 'ষাঁড়ের' চিহ্ন ও 'পদ্ম' চিহ্ন অঙ্কিত। একটি ছোট চৈত্যের চারদিকে আছে চারটি পশু। 'সিংহ', 'হরিণ', 'ষাঁড়' ও 'মেষশাবক'(ভেঁড়া) এর মূর্তি আঁকা। মানুষের মূর্তিগুলোর মাথায় মালা মুখে একটি হাঁসের ছবি। তিনি এখানে খননকার্যও করেছিলেন। সেই খননে তিনি পাঁচটি বৌদ্ধ মূর্তি আবিষ্কার করেছিলেন। তার মধ্যে একটি মূর্তি ছিল, একটি খেজুর জাতীয় গাছের নিচে এক পুরুষ ও এক নারী মূর্তি বসে আছেন। 
তিনি এখানকার মন্দির ও দেব দেউলগুলো সম্পর্কে বলেছেন, এখানে লাঞ্ছন চিহ্ন বিশিষ্ট মূর্তি সহযোগে একাধিক মন্দির ছিল। কিন্তু তিনি সেগুলো দেখতে পাননি। কেবল ধ্বংসাবশেষ দেখেছেন। এখানে বিশাল বড় মূর্তিটি দেখে তিনি অনুমান করেছিলেন এখানে একসময় বেশ বড় আকারের একটি মন্দির ছিল। যেখানে গর্ভগৃহ, নাটমন্দির, মহামন্ডপ হয় তো সব কিছুই ছিল। ধ্বংস প্রাপ্ত যে মন্দিরের উপর তিনি চালাঘরটি দেখেছিলেন সেটা ছিল একটি  ইঁটের মন্দির। মন্দিরের মুখ ছিল উত্তর দিকে। সামনে একটি মহামন্ডপ ছিল। বেগলার সাহেব একটি ইঁটের মন্দির সেইসময় প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলেন। এর মুখ পুব দিকে। মন্দিরের উপরের অংশ কমতে কমতে একটি জায়গায় মিলিত হলে যেমন হয় ঠিক সেই রূপ আকৃতি। ভিতর ও বাইরেটা মসৃণ। কাদা দিয়ে গাঁথা। পিরামিডের আকার। ভিতরে কোন ছাদ নেই। কোন উপাস্য মূর্তিও ছিল না। এই মন্দিরের ঠিক উত্তরে আরো চারটি মন্দির সারিবদ্ধ ভাবে ছিল। তিনটি দাঁড়িয়ে আছে। একটি ভেঙে পড়েছিল। সবগুলোই এক কক্ষ বিশিষ্ট। উত্তর দিকে মুখ। সামনের মন্ডপ ধ্বসে পড়েছে। এই চার মন্দিরের উত্তরে আরো পাঁচটি মন্দির ছিল। তবে সেগুলো সারিবদ্ধ ভাবে ছিল না। তাদের দুটি পাথরের এবং তিনটি ইটের।  তিনটি ইঁটের মূর্তিও ভেঙে পড়েছে। পাথরের একটি মূর্তি তখনও সম্পূর্ন ছিল। এই পাঁচটি মন্দিরের উত্তরে আরো চারটি মন্দিরের সারি ছিল। তিনটি পাথরের এবং একটি ইঁটের। এদের সবগুলোই ভাঙা। যে ইঁটের মন্দিরটি আছে তার পূর্ব দিকে দুটি ইঁটের মন্দিরের ধ্বংস স্তুপ আছে। এই ধ্বংস স্তুপের দক্ষিণে আরো তিনটি পাথরের মন্দির ছিল। ভেঙে পড়ে কেবল তলার দিকের কিছুটা অংশ আছে। সবগুলোই এক কক্ষ বিশিষ্ট। মন্দিরের পাশে কতকগুলো পুকুর দেখেছিলেন। সেগুলোতে পাথর বাঁধানো ছাউনি ও ঘাট ছিল। বেগলার সাহেব সেই ছাউনি বা ঘাটের ভেঙে পড়া অংশ দেখেছিলেন।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



আজ পাকবিড়রায় গিয়ে কেবল তিনটি জৈন মন্দির দেখলাম। তবে সেগুলো নাকি বেশ কয়েক বছর আগে পুনর্ণির্মিত। তবে সেই প্রাচীনতা কিংবা মৌলিকতার কোন ছাপ নেই। অদক্ষ হাতে তৈরি। কেবল পাথর সাজিয়ে বানানো। পুকুরগুলো এখনো আছে। সেই বাঁধানো ঘাট কিংবা ছাউনি আজ আর কোন কিছুই নেই।

বেগলার সাহেব যে বিশাল আকারের দৃষ্টি আকর্ষণকারী জৈন তীর্থঙ্কর এর নগ্ন মূর্তি দেখেছিলেন। তার উচ্চতা সম্পর্কে বলেছেন, 'সাড়ে সাত ফুট'। এটাকে পরবর্তীকালে প্রায় সব লেখকই মান্যতা দিয়েছেন। কিন্তু মূর্তিটি ঠিক কোন জৈন তীর্থঙ্করের তা নিয়ে বরং নানা মতভেদের কথা উঠে এসেছে। আসলে জৈন তীর্থঙ্করদের মূর্তিগুলো চেনার মূল উপায় হল মূর্তির দুপাশে দুটি সিংহ থাকবে। মধ্যিখানে ঠিক পায়ের নিচে অঙ্কিত থাকবে তাদের লাঞ্ছন চিহ্ন বা symbol। সেটি দেখেই কোন তীর্থঙ্কর সেটা চেনা যায়। যেমন মাঝখানে 'ষাঁড়' থাকলে সেটি 'আদিনাথ' বা 'ঋষভদেব'। 'সাপ' থাকলে 'পার্শ্বনাথ' , 'চাঁদ' থাকলে 'চন্দ্রপ্রভ' ইত্যাদি।

"এই চকচকে কালো পাথরে নির্মিত বিশাল মূর্তি সম্পর্কে একাধিক মতগুলো কী কী?" জানতে চাইল ভাই।

"এই মূর্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে  বিশিষ্ট লেখক 'সুভাষ রায়' বলেছেন, সম্ভবত এটি শীতলনাথের(দশম তীর্থঙ্কর)(পুরুলিয়ার জাদুঘর পাকবিড়রা,পৃষ্ঠা ১৪৪)। 'বিনয় ঘোষ' একটি প্রশ্ন চিহ্ন রেখে বলেছেন, এই মূর্তি 'পদ্মপ্রভ'(ষষ্ঠ তীর্থঙ্কর) এর (পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৪৪) আবার 'তরুণদের ভট্টাচার্য' বলেছেন, এটি তীর্থঙ্কর 'শ্রেয়ংশনাথের'।(পুরুলিয়া, পৃষ্ঠা- ৩৭৬ )। আবার কুপল্যান্ড বলেছেন, এটি 'vira'। 'vira' বলতে তবে কী তিনি মহাবীরকে উল্লেখ করেছেন! যাই হোক ওখানকার কেয়ারটেকার নিমাই মাহাতও আমাদেরকে ওই মূর্তি 'পদ্মপ্রভ' বলেই পরিচয় করালেন। সে তো তুমি শুনলে। মূর্তির পাদপিঠে পদ্মের চিহ্ন অঙ্কিত। বেগলার সাহেবও পাদপদ্মের কথা লিখেছেন। কিন্তু কোন জৈন তীর্থঙ্কর সে কথা উনি উল্লেখ করেননি। তবে 'পদ্ম' থেকে 'পদ্মপ্রভ' এমন ধারণা করলে ভুল হবে । কারণ এখানকার সব তীর্থঙ্কর মূর্তিগুলোই দেখো পদ্মের উপর দণ্ডায়মান।"
তরুণ দেব ভট্টাচার্য বলেছেন বেগলার সাহেব এখানে মোট ২১ টি মন্দিরের ধংসাবসেস দেখেছিলেন। যার মধ্যে ১৯টি পাথরের।(পুরুলিয়া, পৃষ্ঠা - ৩৭৫) গনেশ মাহাত বেগলার সাহেবের যে ভাবানুবাদ করেছেন সেখানে ১২টি পাথরের মন্দিরের কথা উল্লেখ করেছেন। এবং ৬টি ইঁটের মন্দির। (পুঞ্চার প্রত্নস্থল / গনেশ মাহাত) পরে পাঁচটি মন্দির পুনর্ণির্মিত হয়েছিল বলে তরুণ ভট্টাচার্য তার "পুরুলিয়া"  বইয়ে (পৃষ্ঠা - ৩৭৬) উল্লেখ করেছেন। তবে এখন কেবল তিনটি পরবর্তী কালে নির্মিত পাথরের মন্দির রয়েছে।
চলবে...

Post a Comment

0 Comments