জ্বলদর্চি

আমেরিকার আদিম মানুষের খোঁজে-৪ /মলয় সরকার

আমেরিকার আদিম মানুষের খোঁজে 

মলয় সরকার

পর্ব-৪ (চতুর্থ পর্ব)

শিল্পক্ষেত্রের প্রসঙ্গে বলি, পরে একসময় সন্ধান পেয়েছিলাম, আমাদের দেশে ওডিশায়, পুরী থেকে মাত্র কুড়ি কিমি দূরে, বিখ্যাত ওড়িশি নাচের শিল্পগুরু পদ্মবিভূষণ কেলুচরণ মহাপাত্রর, এবং গোটিপুয়া নৃত্যশিল্পগুরু পদ্মশ্রী মাগুনী চরণ দাসের জন্মস্থান, রঘুরাজপুরে এরকমই একটি শিল্পগ্রাম রয়েছে।প্রচুর শিল্পীপরিবার একত্রে এখানে অঙ্কন ও এই ধরণের বিভিন্ন শিল্পে যুক্ত রয়েছেন।তাঁদের ব্যবহারও খুবই আন্তরিক।কিন্তু সরকারী প্রচারের অভাবে তাঁদের খুবই কঠিন আর্থিক অবস্থা।যাই হোক, এঁদের শিল্পও খুবই উচ্চমানের।আছে, আমাদের দেশেও এরকম অনেক, আমরা খেয়াল করি না।এ প্রসঙ্গে পরে আলোচনা করা যাবে।

ক্যানিওন রোডে রাস্তাঘাট সমস্তই খুব ঝকঝকে সাজানো। অবশ্য শিল্পীরা যেখানে আছেন, তাঁদের গ্যালারী তো অপরিচ্ছন্ন হতে পারে না।শিল্পীর কাজই তো হল, মর্ত্যলোকে সৌন্দর্যের অন্বেষণ এবং সৌন্দর্যের সৃষ্টি। কাজেই চারিদিকে সমস্ত পরিবেশের মধ্যে একটা নান্দনিক বোধে মন সত্যই অন্য এক মাত্রায় পৌঁছে যায়।ইচ্ছা করছিল না এই স্বর্গ ছেড়ে যাই।

এখান থেকে সামনেই, পায়ে হেঁটে আসা পথ, এলাম প্লাজায় । এই প্লাজার ব্যাপারে আমি আগে আমার মেক্সিকোর ভ্রমণ কাহিনীতে বলেছি যে, এগুলি স্প্যানিশ শহরের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এগুলি শহরের ঠিক মাঝে কেন্দ্রীয় স্থানে হয় একটি চৌকো ঘেরা জায়গা, যেটির মাঝে থাকে একটি পার্কের মত, গাছ, মনুমেন্ট,  কিছু মূর্তি,মানুষের বসার বা একটু ঘুরে বেড়ানোর জায়গা।সেটি আলো, ফোয়ারা ইত্যাদি দিয়ে সাজানো, যার চারিদিকে থাকে রাস্তা এবং তার পাশে থাকে নানা রকম চোখধাঁধানো দোকানের সারি, খাবার দোকান ইত্যাদি।এই প্লাজাটি ১৮২১ সালে তৈরী হয়। এখানে মাঝে মাঝে বসে কনসার্ট। আর এটা তো জানা কথাই, যে, যেখানে মেক্সিকান বা স্প্যানিশ, সেখানেই গান বাজনার চল থাকবেই। মেক্সিকোয় দেখেছি রাস্তায় রাস্তায়, সাধারণ হোটেলেও গাইয়ে বাজিয়েরা গান বাজনা করছে। ওরা খুবই সঙ্গীতপ্রিয়।

সকালে যখন গেলাম, ছুটির দিন, লোকজন বেশ ভিড় করেছে দোকানে দোকানে,অনেকেই পার্কে আলস্য ভাবে ঘোরাঘুরি করছে বা বসে আছে। এর মাঝে রয়েছে একটি স্তম্ভের মত মনুমেন্ট।বসার জন্য রয়েছে চতুর্দিকে হেঁটে বেড়ানোর রাস্তার পাশে পাশে যথেষ্ট ছোট ছোট বেঞ্চ বা চেয়ার।অনেকে শিশুদের প্যারাম্বুলেটরে করে এনেছেন বা কেউ কুকুর কিংবা দৌড়ে বেড়ানোর মত শিশুদের এনেছেন।এ ছাড়া রয়েছে একটি বাঁধানো গোলাকার ছাদঢাকা মঞ্চ। এটি আসলে ব্যাণ্ডস্ট্যাণ্ড। প্লাজার এটিও একটি বৈশিষ্ট্য। এরা নিজেরা খুব সঙ্গীত প্রিয় বলে প্লাজাতে ব্যান্ড স্ট্যাণ্ড থাকেই। চতুর্দিকে ঝকঝকে রোদে যেন এক মেলা বসে গেছে। প্লাজার মাঝে রয়েছে অনেক গাছ।চতুর্দিকে বেশ বড় বড় দোকান। অনেকেই কেনাকাটা করছে। 

হঠাৎ একদিকে দেখি, রাস্তার পাশে একটি টানা লম্বা ঢাকা ফুটপাথে সারি সারি বসে আছে স্থানীয় আদিবাসী শিল্পীরা তাদের নানা শিল্প কর্ম নিয়ে। তার মধ্যে রূপো ও নানা রকম পুঁতির বা অন্য অনেক কিছু দিয়ে তৈরী গয়নাই বেশি। এ ছাড়াও রয়েছে অনেক কিছু হস্ত শিল্প। তার বিক্রেতারা সব শীতে একেবারে জবুথবু , আপাদমস্তক কম্বল, জাব্বাজোব্বা ঢেকে বসে আছে, কেউ চেয়ারে বা কেউ মাটিতে। এদের দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের পার্বত্য উপজাতিদের মত।আমরা আগ্রহী হয়ে গেলাম দেখতে। বেশ সুন্দর দেখতে, তবে আমাদের নেওয়ার মত কিছু মনে হল না।

প্রসঙ্গক্রমে বলি, এখানেই আলাপ হল স্থানীয় এক শিক্ষিত মহিলার সঙ্গে। আমি এদের কিছু জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করছি দেখে নিজেই এগিয়ে এসে আলাপ করলেন। তিনি শোনালেন অনেক কথা।

তাঁর কাছেই জানলাম,এখানে যে আদিবাসীরা ছিল বা আছে তারা আপাততঃ অনেক কমে গেছে। তবে তারা হল Apache ও Navajo গোত্রের।এরা এই অঞ্চলে সবচেয়ে প্রাচীন।

একমাত্র নিউ মেক্সিকোতেই রয়েছে প্রায় ২৩ ধরণের উপজাতি।এদের প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের ভাষা , সংস্কৃতি, রাজনীতি বা আইনকানুন , নিয়ম, জীবনচর্যা সব আলাদা। 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
বর্তমানের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৫০ লক্ষ আদিম মানুষ আজও আমেরিকায় বাস করেন।তার মধ্যে অনেকেই এখন সরকার নির্ধারিত রিজার্ভেশনে থাকেন না, বাইরে থাকেন।( প্রায় ৭৮%)। আর সবচেয়ে বেশি বসতি আছে আজও আলাস্কা, নিউ মেক্সিকো,  উত্তর ও দক্ষিণ ডাকোটা, মন্টানা ইত্যাদি জায়গায়।
তাই আমার এই নিউ মেক্সিকোয় আসা।এদের আমরা পরে দেখতে যাব নিউ মেক্সিকোর বিভিন্ন জায়গায়। সেসব কথা পরে হবে।
অনেক ধন্যবাদ জানালাম, ভদ্রমহিলাকে।

এখানে আর একটি জিনিস লক্ষ্য করলাম, তা হল, এখানকার ঘর বাড়ি সমস্ত কিছুর ঢং কিন্তু আলাদা। এদের পূর্বপুরুষ যেমন ঘরবাড়ি তৈরী করত মোটা মাটির দেওয়াল দিয়ে, সঙ্গে থাকত থাম বা কড়ি বরগার জন্য মোটা মোটা কাঠ, আজও সেই ধারাটিই অক্ষত রয়েছে। যদিও এদের উপর দিয়ে বয়ে গেছে বিদেশী স্পেনীয় শাসন এবং চলছে বর্তমান আমেরিকান শাসন, কেউই কিন্তু এই ঘরবাড়ির ধারাটির পরিবর্তন করে নি। সমস্ত কিছু পাল্টেছে, আধুনিক উপকরণের খামতি নেই, কিন্তু বাড়ি তৈরীতে সেই ঐতিহ্যের কোন পরিবর্তন করা হয় নি। শুধু তাই নয়, সরকারী নিয়ম হচ্ছে, এই শহরের চৌহদ্দির মধ্যে কোথাও কেউ এই ধারার লঙ্ঘন করতে পারবে না, সে যে-ই হোক। 

ফলে প্রতিটা বাড়িই দেখে মনে হচ্ছে গ্রামীন মাটির বাড়ি। ঢংও তাই।মোটা কাঠের থামের বাড়ী, কড়িবরগার কিছুটা অংশ ছাদের থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছে।দরজা জানালাগুলোও মোটা কাঠের তৈরী, আমাদের দেশের পুরানো দিনের গ্রামের বাড়ির মত। দরজায় খিল বা শিকল দিয়ে আটকানোর ব্যবস্থা।গোটা অঞ্চলে কোন বাড়ির অন্য কোন রঙ নেই।এটাও নিয়ম। শুধু মাটির রঙের মোটা লেপা দেওয়ালের বাড়ি আর তাতে কালো কাঠের থাম।বাড়ির দেওয়ালগুলোর উচ্চতাও সমান নয়।কখনও উঁচু কখনও নীচু।আমরা যারা সভ্য সমাজের বাড়ি দেখে অভ্যস্ত , তাদের কাছে এই, না গ্রাম,না শহরের চিত্র একটু অন্য রকম লাগবে বৈকি।

এখান থেকে আমরা খাওয়া দাওয়া সেরে নেওয়ার জন্য গেলাম পাশেই একটা হোটেলে। সেখানে গিয়ে আদব কায়দা দেখে মনে হল, আমাদের এখানকার কোন সাধারণ চালু হোটেলের মত। পাশাপাশি বেঞ্চ পাতা আছে আর তাতে বসে খাচ্ছে অগুনতি লোক। এগুলো আমাদের দেশে দেখলে আশ্চর্য হতাম না, কিন্তু এখানে, আমেরিকার মত দেশে !  যাকগে, এখানকার আদব কায়দাই দেখি। একটি ছেলে অর্ডার নিতে এল। অর্ডার মত জিনিস দেওয়ার পর দেখলাম, ওমা , ওরা দিয়েছে ভাত আর বড় বড় বিনসের ডাল মত একটা তরকারী।এ তো আমাদের দেশের ভাত ডাল!
 
আমাকে ছেলে বলল, ওদের খাওয়া, বিশেষ তফাত নয় আমাদের থেকে। ওদের বলতে, মেক্সিকানদের। আর এরা তো আদপে মেক্সিকানই ছিল, পরে না হয় আমেরিকার সঙ্গে জুড়েছে। তাই খাওয়াদাওয়া সেই আগের মতই রয়েছে। এ ছাড়া দেখলাম ঝুলছে বড় বড় বিশালকায় লাল শুকনো লঙ্কার একটা গোছা, আসলে সেটাই ডেকোরেশন।এই লঙ্কার গোছা ঝুলতে, পরেও দেখেছি অন্যান্য জায়গায়। শুনলাম এর নাম Chile Ristras। এগুলো ঝোলানোর যে কয়েকটি কারণ সেগুলি হল, ১) ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়, ২)ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ৩) তা ছাড়া এটি নাকি পরিবারের বা ঘরের সুখশান্তি ও সৌভাগ্যের প্রতীক।

যাক, খাওয়া দাওয়া সেরে গেলাম কাছেই লরেটো চ্যাপেলে।  এটি এখানকার দর্শনীয় জিনিসের মধ্যে একটি।এখানে বিখ্যাত হল, একটি ঘোরানো সিঁড়ি। এটি আসলে একটি রোমান ক্যাথলিক চার্চ।বর্তমানে এটি একটি মিউজিয়াম , বিবাহের কাজে বেশি ব্যবহৃত হয়।গথিক স্থাপত্যে লম্বা ছুঁচালো উঁচু চূড়া সম্বলিত এই গীর্জা তৈরী হয় ১৮৭৮ সালে। এটি একটি স্কুলের সংলগ্ন হিসাবে তৈরী হয়েছিল । সেই স্কুলটি ১৮৫৩ সাল থেকে  ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত চলেছিল। পরবর্তী কালে এটি ব্যক্তিগত মালিকানায় মিউজিয়ামে রূপান্তরিত হয়।
এই চ্যাপেলে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক এবং অদ্ভুত হল এর ভিতর একটি হেলিক্স ধরণের ঘোরালো সিঁড়ি রয়েছে,যাতে মাঝে কোন থাম বা কিছু নেই। এটি ২০ ফুট উঁচুতলা থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে,।এটি শুধুমাত্র কাঠ দিয়ে তৈরী তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, এতে কোন আঠা, পেরেক বা কোন ধাতব জিনিস ব্যবহার হয় নি। শুধু তাই নয়, এটি সম্পূর্ণ হাতে তৈরী।কোন বৈদ্যুতিক বা আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়াই এটি তৈরী হয়েছে। ফলে শিল্পের এটি এক সুন্দর নিদর্শন।

এর সম্বন্ধে নানা গল্প আছে, যেমনটি আছে আমাদের পুরীর জগন্নাথের মূর্তি বানানোর ব্যাপারে বা অন্যত্র। যদিও এটি তৈরী শুরু করেছিলেন যে প্রধান শিল্পী, তাঁর অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর পর সবাই চিন্তায় পড়েন, কি করে এটি শেষ হবে। তখন সবার প্রার্থনার ফলে, সেন্ট জোসেফ নাকি এসে একরাত্রের মধ্যে এটি তৈরী করেছেন। কারণ কে যে এটি শেষ করেছিলেন, তাঁর নাম জানা যায় নি, তিনি নাকি মজুরী না নিয়েই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন।

সে যাই হোক, আমরা যখন গিয়ে উপস্থিত হলাম দেখি অনেক দর্শক বা ভক্ত নীচে অপেক্ষা করছেন উদ্গ্রীব হয়ে। কিসের জন্য এই অপেক্ষা ,না বুঝে আমরাও অপেক্ষা করতে লাগলাম।হলটি একটি ছোট জায়গা এবং সরু মত।দেওয়ালে রঙীন স্টেন্ট কাঁচের কারুকাজ। পুরো হলটিতে কাঠের কাজ বা ছবি দেখার মতই।

এই সিঁড়িটিকে Ripley’s Believe it or Not বইতে বলা হয়েছে ”The longest of its kind without a supporting pole” । এর উপর ভিত্তি করে ১৯৯৮ সালে একটি The Staircase নামে একটি  টেলিভিশন ফিল্মও  তৈরী হয়।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দেখি অপেক্ষাকারী লোকজন খুব উত্তেজিত হয়ে গুঞ্জন আরম্ভ করল। আমরা সিঁড়ির দিকে তাকাতে দেখি, উপর থেকে তিনটি পরীর মত সুন্দরী সন্যাসিনী তাঁদের আকাশী রঙের পোষাকে সজ্জিত হয়ে ধীরে ধীরে সহাস্যমুখে হাত নাড়তে নাড়তে নীচে নামছেন। তাঁদের হাত নীচে জনতার উদ্দেশ্যে আশীর্বাদের ভঙ্গীতে। তাঁরা ধীরে ধীরে নেমে একেবারে নীচের থেকে একটু উপরে পরপর তিনজনে সুন্দর ভাবে দাঁড়ালেন। জনতা তাঁদের দেখে খুব তৃপ্তি পেল। কিছুক্ষণ বাদে তাঁরা উঠে গেলেন আবার।ভক্তরা খুব তৃপ্ত হয়েছেন বোঝা গেল।

এখান থেকে আমরা এগোলাম পরবর্তী লক্ষ্যে–

সঙ্গে থাকুন পরের পর্বের জন্য–   ক্রমশঃ

Post a Comment

0 Comments