জ্বলদর্চি

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র/ চতুর্দশ পর্ব/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র                      চতুর্দশ পর্ব    

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
                                                                     

উত্তরে শল্য বললেন "তার অর্থ দ্যূতসভায় দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার জবাবে মধ্যমপাণ্ডব সমরাঙ্গনে দুঃশাসনকে নিহত করে তার রুধির পান করেছে আর তোমার প্রাণাধিক পুত্র বৃষকেতুকে নিহত করে বালক অভিমুন্যকে সপ্তরথী মিলে যে অন্যায় সমরে হত্যা করা হয়েছিল গাণ্ডীবধন্বা অর্জুন তার প্রতিশোধ নিয়েছে"। 
শল্যের বিদ্রুপাত্মক বাক্যে তিক্ত হাস্যে কর্ণ বললেন "মদ্ররাজ, জীবনে বহু দুঃখ আঘাত সহ্য করেছি আর আজ যুদ্ধক্ষেত্রে নিজপুত্রের পরমগতি লাভে বিচলিত হব এ আপনি কি করে আশা করলেন? আমি ভাবাবেগের প্রাবল্যে বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী চিন্তায় মনে মনে ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি, কিন্তু আমার মস্তিষ্কে রণকৌশলের চিন্তা বিনষ্ট হয় নি। আপনার অনুমান অভ্রান্ত, যুদ্ধশেষের আর অধিক বিলম্ব নাই। আজ সূর্যাস্তের পূর্বে হয় আমি না হয় অর্জুন জীবিত থাকবে। আপনি সত্ত্বর অর্জুনের কাছে নিয়ে চলুন তবে তার পূর্বে একবার পান্ডব জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠিরের কাছে যেতে চাই। 
শল্য যুধিষ্ঠিরের কাছে রথ নিয়ে যাওয়ার পরে প্রবল বিক্রমে কর্ণ তাঁকে আক্রমণ করলেন এবং যুধিষ্ঠির পরাজিত হয়ে কোনক্রমে শিবিরে পলায়ন করে প্রাণ রক্ষা করলেন। অবশ্য কর্ণের ইচ্ছে ছিল না যুধিষ্ঠিরকে নিহত করার। তিনি শুধু তাঁকে দুর্যোধনের কথামতো বন্দী করতে চেয়ে ছিলেন কিন্তু তিনি পলায়ন করায় বন্দী করতে পারলেন না। এছাড়াও পান্ডব জননী কুন্তীকে তিনি কথা দিয়েছিলেন অর্জুন ছাড়া অন্য কোন পান্ডবের তিনি ক্ষতি করবেন না। যুধিষ্ঠির পলায়ন করার পরে কর্ণের সারথি শল্য ত্বরিতগতিতে রথ নিয়ে যেয়ে স্থাপন করলেন অর্জুনের সম্মুখে। পুত্র শোকাতুর কর্ণ তাঁর সর্বশক্তি প্রয়োগ করে অর্জুনকে আক্রমণ করলেন। অবশ্য কর্ণ যে মরিয়া হয়ে আক্রমণ করবেন সে কথা শ্রীকৃষ্ণ পূর্বেই অনুমান করেছিলেন। এই যুদ্ধের প্রথম দিকে কর্ণ প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ শুরু করলেন যার প্রতাপে পান্ডব পক্ষের বহু যোদ্ধা ও পদাতিক সৈন্য হতাহত হল। বহুতর গজ, অশ্ব নিহত হল, এমনকি কর্ণের শরাঘাতে অর্জুনও ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। অর্জুনের এই অবস্থা দেখে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে উত্তেজিত করার অভিপ্রায়ে বললেন "তুমি কি আজ মোহগ্রস্ত হয়েছো না দুর্বলতা অনুভব করছ? তোমার নিক্ষিপ্ত সকল অস্ত্রই অঙ্গরাজ অনায়াসে প্রতিহত করছেন। ইতিপূর্বে অর্জুন নিক্ষেপিত ব্রহ্মাস্ত্র কর্ণ ব্যর্থ করেছেন পরশুরাম প্রদত্ত অস্ত্রে। পুনরায় অর্জুন ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন কিন্তু সে অস্ত্রও কর্ণ অবলীলায় প্রতিহত করলেন। এই ব্রহ্মাস্ত্র ব্যর্থ হলো দেখে অর্জুন প্রজ্জ্বলিত অগ্নি বিকিরণকারী এক অস্ত্র প্রয়োগ করলেন যার আঘাতে শত সংখ্যক অস্ত্র নির্গত হয়ে কৌরব শিবিরের অসংখ্য সেনা বিনষ্ট করলো।     
      

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



               
কিন্তু এই সময়ে এক দুর্ঘটনা ঘটল। বারংবার সবলে গান্ডীব ধনুতে জ্যা আকর্ষণ কালে ধনুকের তন্তু ছিন্ন হয়ে গেল। নূতন জ্যা রোপন করার অবসরে কর্ণের বানাঘাতে অর্জুন ও শ্রীকৃষ্ণ দুজনেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলেন। ইত্যবসরে ধনুকে নতুন জামা রোপন করে অর্জুন বানাঘাতে কর্ণের সারথি শল্যকে আহত করলেন এবং কর্ণের অগ্র, পশ্চাৎ বাম ও দক্ষিনে যেসকল যোদ্ধা রক্ষক ছিলেনও সকলেই নিহত হলেন। কর্ণ অসহায়তা বোধ করলেন।                                    
এই সময়ে একটি ঘটনা ঘটল। পাণ্ডবেরা খান্ডব বন দহনকালে অর্জুনের শরে নাগরাজ তক্ষকের স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেছিলেন। মাতার মৃত্যুর প্রতিশোধ স্পৃহায় নাগরাজ তক্ষকের পুত্র অশ্বসেন আজকের যুদ্ধে কর্ণের অলক্ষ্যে তার তুণীরে নাগকুর সর্বাপেক্ষা কালান্তক অস্ত্র স্থাপন করলেন। কর্ণ যে সময়ে পশ্চাদস্ত তূণীর থেকে অস্ত্র গ্রহন করছিলেন সেসময়ে অশ্বসেন তাঁর হস্তে সেই মারাত্মক মারন অস্ত্র ধরিয়ে দিলেন এবং কর্ণ সেই অস্ত্র ধনঞ্জয়ের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। সেই মারণাস্ত্র যখন কর্ণ নিক্ষেপ করলেন তখন অর্জুনের রথের সারথি শ্রীকৃষ্ণ সেই অস্ত্রের শক্তি অনুধাবন করে অনন্যোপায় হয়ে পায়ের চাপে রথকে ভূমিতে প্রোথিত করে দিয়ে অর্জুনের জীবন বাঁচালেন। ফলে অস্ত্র এসে অর্জুনের মণিময় স্বর্ণকিরীট দগ্ধ করে চলে গেল কিন্তু অর্জুনকে আহত বা নিহত করতে পারলো না। এই অস্ত্রের কার্যকারিতা দেখে স্বয়ং কর্ণ নিজেও বিস্মিত হয়ে গেলেন। এ কোন অস্ত্র, কোথা থেকে তাঁর তূণীরে প্রবেশ করল? এই সময়ে অশ্বসেন কর্ণকে দেখা দিয়ে বললেন "আমি পুনরায় তোমাকে অন্য এক অস্ত্র দিচ্ছি যার সাহায্যে তুমি অর্জুনকে বধ কর" অশ্বসেনকে দেখে ও তার কথা শুনে কর্ণ বললেন "তোমার সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ কিন্তু আমি যদি আমার নিজের অস্ত্রের সাহায্যে অর্জুনকে পরাজিত ও নিহত করতে না পারি তাহলে তোমার সাহায্য নিয়ে আমি তাকে পরাজিত করলে আমি তো শঠতার আশ্রয় নিয়েছি বলে ঘোষিত হব, সে ক্ষেত্রে আমার ন্যায়-নীতি বিসর্জিত হবে। অপরের সাহায্যে যুদ্ধ জয় করার থেকে পরাজয় বরণ করা আমি শ্রেয় মনে করি। তুমি তোমার নিজকার্য সাধনের জন্য আমার সাহায্য না নিয়ে স্বস্থানে প্রত্যাগমন কর। তোমার মঙ্গল হোক"।            
ইতিমধ্যে যদুপতি শ্রীকৃষ্ণ অশ্বসেনের পরিচয় অর্জুনকে প্রদান করতে অর্জুন বাণাঘাতে অশ্বসেনকে নিহত করলেন। এই অবসরে যদুপতি রথচক্রকে একক প্রচেষ্টায় পুনরায় উপরে উত্তোলন করলেন।                               
নিজের জীবন ফিরে পেয়ে অর্জুন পুনরায় বীরবিক্রমে ক্রমাগত শর নিক্ষেপ করে কর্ণকে পর্যুদস্ত করে তাঁর কিরীট, বর্ম খন্ড-বিখন্ড করে তাঁর বুকে এক শক্তিশালী তীর নিক্ষেপ করলেন। সেই তীরের আঘাতে মর্মান্তিক যাতনা অনুভব করে কর্ণ বুক চেপে ধরলেন। কর্ণের এই অবস্থা দেখে অর্জুন রণনীতি অবলম্বন করে শর নিক্ষেপ থেকে নিজেকে বিরত করলেন। অর্জুনকে শরনিক্ষেপে বিরত দেখে যদুপতি শ্রীকৃষ্ণ বললেন "ফাল্গুনী, এ তুমি কি করছ? তোমার প্রবল প্রতিপক্ষ যখন ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়বে সেই সময় থাকে ক্রমাগত আক্রমণ করে পরাজিত করতে হয় - যুদ্ধবিদ্যার এই প্রাথমিক নীতি কি তুমি বিস্তৃত হয়েছ"? কর্ণ সামান্য সুস্থ হয়েই পূর্ণোদ্যমে যুদ্ধ করবেন। বাসুদেবের তিরস্কারে অর্জুন নিজের দুর্বলতা ত্যাগ করে পুনরায় শরজালে চারিদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দিলেন। কর্ণও পূর্বের আঘাত সহ্য করে পুনরায় যুদ্ধ শুরু করলেন। কিন্তু বিধি বাম! 
এই সময়ে অকস্মাৎ কর্ণের রথের বামদিকের চাকা ভূমিতে প্রোথিত হয়ে গেল। কর্নের মনে পড়ে গেল ব্রাহ্মণের অভিশাপের কথা। একবার কর্ণ অসাবধানতাবশত এক ব্রাহ্মণের একটি দুগ্ধবতী গাভীকে হত্যা করার পরে ব্রাহ্মণ তাঁকে অভিশাপ দিয়ে বলেছিলেন 'আমার দুগ্ধবতী গাভীকে তুমি যেমন অসহায় অবস্থায় হত্যা করলে তোমার মৃত্যুর সময় তোমার রথচক্র ভূমিতে নিমজ্জিত হয়ে অসহায় ভাবে তোমার মৃত্যু ঘনিয়ে আসবে। এই সময়ে কর্ণের আরও একটা অভিশাপের কথা স্মরণে এল। সেটি গুরু ভার্গবের অভিশাপ। দ্রোনের কাছে অস্ত্রশিক্ষা লাভে বঞ্চিত হয়ে কর্ণ হিমালয়ে যেয়ে গুরু পরশুরামের কাছে ব্রাহ্মণ পরিচয় দিয়ে সব অস্ত্র শিক্ষা লাভ করেন, কারণ ভার্গব সমস্ত ক্ষত্রিয়কুলকে ঘৃণা করতেন। একদিন গুরু নিদ্রায় অচেতন থাকাকালীন গুরুর কষ্টের কথা চিন্তা করে তাঁর মাথাটি কর্ণ নিজের কোলের উপর স্থাপন করেন। ইত্যবসরে এক বজ্রকীট কর্ণকে দংশন করে। এমতাবস্তায় বজ্রকীটকে মারতে গেলে ভার্গবের নিদ্রায় ঘটবে চিন্তা করে তিনি প্রাণপণ শক্তিতে বজ্রকীটের দংশন সহ্য করেন। দংষ্ট্রস্থল থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ে গুরুর শরীরে স্পর্শ করায় তাঁর নিদ্রা ভেঙে যায় এবং তিনি দেখলেন কর্ণের শরীর থেকে রক্ত তার শরীরে লেগেছে। এমতাবস্থায় তিনি ধ্যানে জানতে পারেন কর্ণ নিজের ক্ষত্রিয় পরিচয় গোপন করে তাঁর কাছে সমস্ত অস্ত্রশিক্ষা লাভ করেছে। কর্ণের মিথ্যা পরিচয় দানের জন্য তিনি অভিশাপ দেন "কর্ণ, তুমি ব্রাহ্মণের মিথ্যা পরিচয়ে আমার কাছে সমস্ত প্রকার অস্ত্রের শিক্ষা লাভ করেছ, কিন্তু মিথ্যা পরিচয় দানের জন্য আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি রণাঙ্গনে আমার নিকটে অধীত অস্ত্র নিক্ষেপকালে সেই অস্ত্রের মন্ত্র তোমার বিস্মৃতি হবে এবং অস্ত্র কার্যকরী হবে না"। যার ফলে এতকাল তিনি যে সকল অস্ত্র অর্জুন বধের জন্য নিজের কাছে রেখে ছিলেন সেগুলি প্রয়োগ কৌশল তার স্মরণে এলনা এবং কার্যকরী হল না।                       
কর্ণ তারপরে রথচক্র মেদিনী থেকে উত্তোলনের আপ্রাণ চেষ্টা করলেন কিন্তু কিছুতেই তা উত্তোলন করতে পারলেন না। তখন তিনি তৃতীয় পাণ্ডবকে লক্ষ্য করে বললেন "অর্জুন তোমাকে যথার্থ বীর বলে জানতাম। যথার্থ বীর কখনো দুর্দশাগ্রস্ত বিপক্ষের প্রতি অস্ত্র নিক্ষেপ করে না। তুমি আমাকে সামান্য সময় দাও যাতে রথকচক্র মেদিনীগ্রাস থেকে উদ্ধার করতে পারি। ধর্মের নীতি অনুসারে এই সময়ে যুদ্ধ স্থগিত রাখা উচিত"।                     
                                                  ………….পরবর্তী সংখ্যায় দেখুন

Post a Comment

0 Comments