বিস্মৃতপ্রায় কবি উৎপলকুমার বসু
নির্মল বর্মন
"বসন্ত কত দেরি ? আর কত ক্লান্তি নিয়ে কেটে যাবে এত হিম রাত
চারণ খড়েরা বলে: একদিন ছিল, ছিল এমন প্রভাত--
আশ্বাসে বেঁচে থাকো । মৃগশিরা তুমি আর আমি"
অথবা
"নৌকায় বেশিদূর বেড়ানো হল না
ভালোবাসা জোরালো হল না
খালপারে বিবাদ হল না"
উৎপলকুমার বসু
কবি উৎপলকুমার বসু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে উক্ত কবিতা ভাবনার প্রেক্ষিতে সুরোরিয়ালিস্টিক কবি ছিলেন । তাঁর স্বভাব ছিল খানিকটা জীবনানন্দের ধাঁচে। উৎপলকুমার বসু কৃত্তিবাস পত্রিকা গোষ্ঠীর হাংরি জেনারেশনের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। ১৯৩৯ সালে ৩ রা আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন।
যোগমায়া দেবী কলেজের জুলজির অধ্যাপক উৎপলকুমার বসু হাংরি আন্দোলনের কারণে ১৯৬৪ সালে গ্রেফতার হন, সঙ্গে সঙ্গে চাকরিটাও চলে যায়। অন্যায় ভাবে বরখাস্ত করেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। দুঃখে, অভিমানে ১৯৬৫ সালে লন্ডন চলে যান , সেখানে শিক্ষকতা শুরু করেন ,লন্ডনে বিবাহ করেন। ৩ রা অক্টোবর ২০১৫ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কবি উৎপলকুমার বসুর রচিত কাব্যগ্রন্থ গুলি হলঃ-" চৈত্রে রচিত কবিতা" ১৯৬১ ; "পুরী সিরিজ" ১৯৬৪; "আবার পুরী" ১৯৭৮ ; "লোচন দাস কারিগর" ১৯৮২ ; "খন্ড বৈচিত্রের দিন" ১৯৮৬ ; "শ্রেষ্ঠ কবিতা" ১৯৯১; "সলমাজরির কাজ" ১৯৯৫;
"পদ্য সংগ্রহ" ১৯৯৬ ; "কবিতা সংগ্রহ" ১৯৯৬ ; "কহবতীর নাচ " ১৯৮৭; "নাইট স্কুল" ১৯৯৯ ; "টুসু আমার চিন্তামণি" ২০০০ ; "পোপের সমাধি" ইত্যাদি।
কবি উৎপলকুমার বসু ১৩৬০ সালে কৃত্তিবাস পত্রিকায় "প্রান্তরের পাখি" কবিতায় জীবনানন্দীয় সুররিয়ালিস্টিক কবির মতো পাখির গানের মাধ্যমে বসন্তের আবির্ভাব পার্থনা করে পাঠককে আনন্দ দান করবার চেষ্টা করেছিলেন । উদাহরণ---
"তবু এই হেমন্তের প্রান্তরে রিক্ততায় পাখি এক আসে ;
পাত্র যত ভরে তোলে কোলাহলে সকালের ঘাসে--
স্মৃতি তার পড়ে থাকে বিস্ময়ের চিহ্নের মতন---
ফাল্গুন পলাশে আর মানুষের চোখের গভীরে, নাচে তার মন!
-----_-------+---------------+---------+-----
মৃগশিরা ! ভাবো মনে একদিন অয়নান্ত সূর্যের তাপে
এত নীলে- এত গানে- গানের আলাপে
ঘাস থেকে ঘুম ভেঙ্গে উঠবেই সোনার সকাল;
পাখির ইচ্ছা যেন হয়ে যাবে বসন্তের কাল"।
কবি প্রকৃতির প্রতি অসাধারণ ভালোবাসা ছিল, তাই ১৩৬৫ সালে কৃত্তিবাস পত্রিকায় 'একটি কবিতা' নামক কবিতায় পাই----
"ওরা চলে যায় ঋতু, বসন্ত ফুলের শোভা , অন্তিম তুষার
রাজহংসটির শেষ অস্থিরতা উড়ে যায় কমল সাগরে
এখনো মর্ত্যের থেকে নীলাঞ্জন একটি সোনালী রেখা
যাকে দেবে বলেছিল সেও দেখ অমর্ত্য ফুলের
সৌরভে মগ্ন আছে । যারা চলে যায় তারা ব্যবহৃত পুরনো সংসার।
-----------------------------------------------
তবু কি জেনেছ পুরানো স্মৃতির ভার
দুর্বল পাষাণ ! নক্ষত্র ছায়ায় কাঁপে জোনাকির কল্পিত গাঁথায়"।
কবি উৎপল কুমার বসুর কবিতায় জীবনানন্দের মতো ইন্দ্রিয় সচেতনতার পরিচয় যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায় "একটি কবিতা" কবিতাতে প্রকাশিত হয়েছিল আশ্বিন ১৩৭০ বঙ্গাব্দে । যেমন--
"জানালার পাশে আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি - চোখ মেলে কিছুই দেখছি না
শুধু, শুনছি অদ্ভুত পাশের শব্দ পেলে কারা গেল - কারা আসে
তুমি ক্রমাগত নীল আকাশের ডোম থেকে তাজমহলের মতো সাদা হাঁস বাতাসে ছাড়ছ
মনে হল আমাদের কোনো শ্রম বৃথা নষ্ট হবে না এবার
সামান্য আঙুল নেড়ে আমি বুঝি উজ্জ্বল, চক্ষুষ্মান, প্রতিশ্রুতিময় কবিতা
লেখার দিকে ফিরে যাব।
জানালার পাশে আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি - তুমি ক্রমাগত নীল
আকাশের ডোম থেকে তাজমহলের মতো শাদা হাঁস বাতাসে ছাড়ছ"
কবি উৎপলকুমার বসু'র "ওগো লুডোখেলা" কবিতায় অস্তিত্বের সংকট ও সমাজ ব্যবস্থার অসহায় দুর্বল জনগণের আটপৌরে জীবনযাপনের ঘটনাক্রম কবি ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবেই--++
"মুখ তুমি তাকিয়ে রয়েছো ঠান্ডা ভাতের থালার দিকে
কি দেখছ তুমি জানো আর জানে আধহাতা ডাল
নুনের সঙ্গে ভিজে মাখামাখি, চালে হলুদ কাঁকর,
ধানের পোড়াটে খোসা , তুমি জানো, যথার্থই জানো
এদের ভিতরে কোন সাংবিধানিক দূতীপনা খেলে যাচ্ছে
-----------------+----------------------------------------
নিজস্ব বিশ্বাসে কাঁপছে- ভাত , ঝোল , নুনের আঙ্গুল,
যে বিশ্বাসে কাঁপে নীল গুটিগুলি লাল খেলাঘরে"।
কবি বসু আনন্দের দিনে গ্রহণ বিসর্জনের নীতি গ্রহণে কোনটি গ্রহণ করবেন তা নিয়েই জটিল দ্বন্দ্বের স্বীকার , আসলে অস্তিত্বের সংকটে এই প্রশ্ন আসা প্রতিটি নাগরিক স্বাভাবিক ভাবনা সুতরাং বিষয়টি যথেষ্ট অনুধাবনযোগ্য--
"সমস্ত রাত্রি ধরে
বিবাহের আয়োজন চলেছে এখানে।
এদিকের বিবাহ ফুরালে
অন্য কোন বিবাহের উৎসবের জোয়ারভাঁটার দিকে চলে যাব
খাঁড়ি মোহনার দিকে। এতগুলি উৎসবে আমাদের উপহার শেষ হয়ে যাবে
একদিন । সমস্ত গাছের পাতা শূন্য হয়ে ঝরে যাবে, মুছে যাবে জলপাই বনে।
মেঘ ও আলোর খেলা অথচ উৎসবগুলি বাকি থেকে যাবে বহু
ভিখারির মতো কোনো উৎসবে যাব না আমি। খুঁটে দেব
মরা প্রজাপতিরাশি আমার মস্তিষ্ক থেকে
তা কি গ্রহণীয় মনে হবে? তা কি বর্জনীয় মনে হবে তোমাদের"?
বস্তুত : কবি উৎপলকুমার বসু এই জিজ্ঞাসা আধুনিক মানবের যা ছক ও ছবি, কবি তাঁর বর্তমান সময় ও সমাজের দর্পণে তুলে ধরেছেন । এজন্যই তিনি চিরন্তন শাশ্বত সুন্দর। কবি উৎপলকুমার বসু হাংরি ভাবনায় ভর করে কবিতাকে নিরাসক্ত ও নির্লিপ্তভাবে বস্তু স্বভাবের যথাযথ বর্ণনা দিয়েছেন। সকলে নয় , কেউ কেউ কবি বসু'র কবিতাকে "আকারসর্বস্ব" কবিতা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করলেও তাঁর কবিতার ছায়ায় কায়ায় বাস্তবসত্য উদ্ভাসিত হয়েছে।
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
0 Comments