নিম্নবিত্তের পয়লা
শঙ্খজিৎ
আমাদের পারিবারিক নববর্ষের উদযাপন আর পাঁচটা বাঙালি জীবনের লুচি-ছোলার ডাল আর দুপুরের সাদাভাত-খাসির মাংস-মিষ্টিদই-এর গন্ধে ভরে থাকলেও এর মধ্যে মধ্যেই ছিল দুঃখ আর ক্লান্তির পোষাকটা নিয়ে আর একটু এগোনোর গ্লানি। যেমন ধরুন চৈত্রের মাঝদুপুরে কোনো মুদিওলার দোকান থেকে আসা হালখাতার চিঠিই হয়ে উঠত পারিবারিক অশান্তির যথেষ্ট কারণ। মা-কাকিমাদের চোখ ফাঁকি দিয়েই নিম্নবিত্ত বাপ-কাকারা সংসারকে টেনে নেওয়ার অবিশ্রাম যাত্রাপথের সবটা নিজের আয় দিয়ে পূরণ করতে পারতেন না। এই অপারগতার গভীর দীর্ঘশ্বাস থেকেই ঋণ। ঋণ থেকে হালখাতার সাদা কাগুজে-লাল কালির চিঠি। আর এই এক চিঠির ভিতরেই অনেকটা চিৎকার। তাই বছরের পয়লা দিনের সন্ধ্যায় এক খুঁপড়ি* মিহিদানার স্বাদ যে সবসময় মিষ্টি হত না,তা বলাই বাহুল্য।
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
এর সঙ্গে ক্যালেন্ডার। না জানি কত দুঃখের দিনগোনার টাইমমেশিন এই ক্যালেন্ডার। নতুন দোকানগুলোতে যেমন রঙিন সব দেব-দেবতার ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডার,পুরোনো সাবেকী দোকানের সন্-তারিখের তালিকা যেন রগরগে—শুধুই তারিখ লেখা! বার-মাস-তিথি সমেত একটা শুষ্ক আবহ। সে একটা আশ্চর্য সময় ছিল,বঙ্গাব্দ আকবরের না শশাঙ্কের—তা নিয়ে ফেসবুকে জাত-ধর্ম তুলে খেয়োখেয়ি হত না,কৃত্রিম কোনো শোভাযাত্রা করেও নতুন বছর শুরু করতে হত না;আমরা বরঞ্চ নতুন বছরের প্রথমদিনটা কে সেলিব্রেট করেছি এভাবেই যে পুজো(শারদোৎসব)-র মতো এই দিনেও একটা নতুন জামা জুটবে। হাতকাটা গোছের সেলের ওই পোষাকের জন্য তীব্র আকুতি না থাকলেও পোষাকের ভিতর থেকে আসা গন্ধগুলোর কাছে এখন এই বেকারবেলার মধ্যাহ্নে বারবার ছুটে যেতে ইচ্ছে করে।
নতুন বছর শুরু দিন যত না বেশী আনন্দের ছিল তার চারগুণ আনন্দ হত আগের দিন চড়ক সন্ধ্যায় পাটা-ভাঙার পর কাদাখেলা এবং রাতে স্নানের পর। চড়কের পরের দিন সন্ন্যাসীদের মৎস্যমুখ বা আঁশপান্না। চারদিন প্রতীকী ব্রহ্মচর্যের পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার রিপুজ উৎসব আঁশপান্না। আমাদের বাড়ির কেউ সন্ন্যাসী হলে সাধারণত আমাদের বাড়িতেই দুপুরে আঁশপান্না হত। বাকি সন্ন্যাসী-সহোচরেরা চারদিন পর পরমশান্তিতে মাছ-মাংস খাবে—আর কিছুই নয়। একটু বড় হয়ে আমরা যখন চড়কে সন্ন্যাসী হতে লাগলাম কয়েকবছর নববর্ষের দিনে রাত্রিকালীন আঁশপান্না হয়েছে স্থানীয় ক্লাবে,অন্য অনেকের বাড়িতেও। আঁশপান্নার ভিতরেও বিষাদ। আরো একবছর চড়কের জন্য অপেক্ষা!
গ্রামঘরে বছরের শুরুটা আহামরি আনন্দের নয় বটে তবে গোবৎসল বাঙালির মানে আমাদের ভেবিয়াতে গোয়াল বা গরুর ঘরের পুজোটাও বৈশাখের ১ তারিখেই হয়ে যায়। অন্য সব বাড়িতে চৈত্রের শেষে তুলসীতলায় ঝরা বাঁধার রীতি থাকলেও জ্যাঠামশাই এর চলে যাওয়ার পর থেকে বছরের প্রথম দিনেই আমাদের বাড়িতে ঝরা বাঁধা হত। একটা বাঁশের মাঝখানে ফুটো ঘট বেঁধে দেওয়া হত। ঘটের ছিদ্রে দেওয়া হত পাটের সুত্তুলি। টিপ টিপ করে সারা মাস জল পড়বে তুলসীর গোঁড়ায়। প্রথমদিন ঘটের সামনে সিঁদূরে পুতুল বা লজ্জাগৌরীর চিহ্ন আঁকা হত,ঘটের উপরে লেপ্টে দেওয়া হত চাল-কলা-বাতাসার মাখা। থালায় থেকে যাওয়া বাকি চালমাখাটা আমাদের প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হয় হতো।
অতিনিম্নবিত্ত ম্যাড়মেড়ে আটপৌরে জীবনে নতুন বছরে অনাদির চায়ের দোকানে গণেশ-লক্ষ্মীর মূর্তির বদল ছাড়া আর কোনো বদল তো আজও চোখে পড়েনা! মানুষের মুখের ফ্যাকাশে রঙগুলো-কে তো তারিখের সংখ্যাগুলো পাল্টাতে পারেনা। খালি খালি ক্ষেত্তোর পালের দোকানের বাইরে টাঙানো আমপাতারা শুকিয়ে যায়। কুলিগুলো সেই ঘামে সিক্ত, কালিঝুলি মাখা লুঙ্গি আর স্যাণ্ডো গেঞ্জি পরেই বস্তা মাথায় নিয়ে দৌড়োয়। দুপুরে পায়রাগুলো জড়ো হয় চাল খুঁটে খেতে। বিকেলে সেই জেনারেটরের আওয়াজ—মফস্বলী আচ্ছন্নতার আড় ভেঙে ভাঙা টিন বাজাতে বাজাতে সারা পাড়া মাথায় করে মুচি পাড়ার বেচু—১লা বোশেখের জন্য আজ বিকেলেও মন্টু খাসি কাটবেএএএএ...
মিষ্টির দোকান ফাঁকা হয়। আমাদের ঠাকুরের আসনের জন্য বরাদ্দ বাতাসার সঙ্গে যোগ হয় একটু ফল,বিশেষত তরমুজ। সংসার আলাদা হওয়ার পরও সন্ধ্যের পর এ অন্যের ঘরে হালখাতা করে আনা মিহিদানা,সীতাভোগ বিলি করে। হাওয়া দেয়। খুব হাওয়া। বাউলের মৃদু আওয়াজ ভেসে আসে গান** পাড়া থেকে। হাওয়ায় মিলিয়ে যায় বছরের শুরুয়াৎ। হাওয়া থেকে যেমন আসে। কালবৈশাখীর প্রতীক্ষা করি।
বছর শুরু হয়ে গেছে তাই না?
*খুঁপড়ি—মাটির ছোট ঘট বিশেষ
**গান—গাইন
আরও পড়ুন
আত্মহত্যার সপক্ষে / ঋত্বিক ত্রিপাঠী
2 Comments
ভালো লাগলো। তথ্যমূলক। জীবনের সত্য অভিজ্ঞতা। শুভেচ্ছা রইলো।
ReplyDeleteধন্যবাদ
ReplyDelete