জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৭০/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৭০

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 লণ্ডনে অভেদানন্দজীর জীবনধারা কোন খাতে বইতে শুরু করল সেই বিষয়ে পুনরায় গম্ভীরানন্দজীর ‘শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্তমালিকা’র শরণাপন্ন হতে হয়। তিনি লিখছেন --“স্বামীজীর লণ্ডন ত্যাগের পর স্বামী অভেদানন্দ স্টার্ডি মহোদয়ের আবাসে উঠিয়া আসিলেন। স্টার্ডি নিজে নিরামিষাশী ও কঠোরী ছিলেন, অভেদানন্দও উক্ত ভবনে তদনুরূপ জীবনই অবলম্বন করিলেন। তিনি হর্ম্যোপরি একটা উত্তাপহীন ও গবাক্ষশূন্য ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে উপাধানবিহীন কঠিন শয্যায় শয়ন করিতেন ও নীচের এক কক্ষে অধ্যয়নাদি করিতেন। এই আবাসস্থানকে ভিত্তি করিয়াই ১৮৯৭ ইং-র ১২ই জানুয়ারি হইতে রীতিমত বেদান্তের বক্তৃতা ও ক্লাস আরম্ভ হইল। পরন্তু লণ্ডনের কার্য দীর্ঘকালস্থায়ী হইল না। ঐ বৎসরের মধ্যভাগে তাঁহার আমেরিকা গমনের আহ্বান আসিল। স্বামীজী তখন ভারতে -- এই প্রস্তাবে তাঁহারও সমর্থন ছিল। অতএব লণ্ডনের কার্যপরিচালনার্থে স্বামীজী যে অর্থ রাখিয়া দিয়াছিলেন, উহার দ্বারা টিকেট কিনিয়া স্বামী অভেদানন্দ ৩১শে জুলাই আমেরিকাগামী জাহাজে আরোহণ করিলেন।”
 নিউ ইয়র্কে তিনি পৌঁছলেন ৯ অগাস্ট। নিউ ইয়র্ক বেদান্ত সোসাইটির সেক্রেটারি মিস মেরি ফিলিপসের অতিথি হিসেবে সেখানে থাকতে শুরু করলেন। এই সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৪ সালে। সোসাইটির পক্ষ থেকে অভেদানন্দজীকে সম্বর্ধনা দেওয়া হল ২৫ অগাস্ট। অভেদানন্দজী শুধুমাত্র নিউ ইয়র্কে নিজেকে আবদ্ধ রাখলেন না। পূর্ব উপকূল বরাবর বিভিন্ন স্থান -- ফিলাডেলফিয়া, ওয়াশিংটন, ভার্জিনিয়া এবং নিউ ইয়র্ক স্টেটের নিউ পালজে বক্তৃতা প্রদান করলেন। ১৯ সেপ্টেম্বর ফিরলেন নিউ ইয়র্ক শহরে। সেই সময় সারদানন্দজী বস্টন ও কেম্ব্রিজ অঞ্চলে বক্তৃতা প্রদানে ব্যস্ত ছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ভারতে প্রত্যাবর্তনের। ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি নিউ ইয়র্কে এসে অভেদানন্দজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। দুই ভ্রাতা পরস্পরের মিলনে যারপরনাই আনন্দিত হলেন এবং পাশ্চাত্যে বেদান্ত প্রচারকার্যে তাঁদের অর্জিত অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করলেন। তাঁদের পুনরায় সাক্ষাৎ হল নিউ জার্সির মন্টক্লেয়ারে মিসেস হুইলারের বাসায়। একদিন অভেদানন্দজী প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক টমাস এডিসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। তাঁরা বেদান্ত ও ভারত বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন এবং বিজ্ঞানীপ্রবর অভেদানন্দজীকে তাঁর ল্যাবরেটরি দেখিয়েছিলেন।
 অভেদানন্দজী নিউ ইয়র্কের মট মেমোরিয়াল হলে সিরিজ বক্তৃতা প্রদান শুরু করলেন। এই হলটি ভাড়া নিয়েছিল বেদান্ত সোসাইটি। ১৮৯৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তিনি প্রথম বক্তৃতাটি দিলেন। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘বেদান্ত কী?’ (What is Vedanta?) এই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন রালফ ওয়ালডো এমার্সনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এডওয়ার্ড এমার্সন। এই বক্তৃতা বিষয়ে পাশ্চাত্য সন্ন্যাসী স্বামী অতুলানন্দ ‘With the Swamis in America’ গ্রন্থে লিখছেন --“Punctually at three o'clock a swami entered the hall. He was dressed in robe and turban of an orange colour. He went straight to the platform and without a moments delay began to deliver his lecture...The discourse was lucid, convincing and impressive. There was not much flourish, not much eloquence, hardly any gesticulation. It was a straight-forward, well-reasoned out exposition of Vedanta philosophy, delivered in a calm, dignified manner... Young, tall, straight, good-looking swami had his appearance in his favour...I was told that the Swami I had listened to was Swami Abhedananda, another disciple of Sri Ramakrishna.” (God lived with them, Swami Chetananada, Advaita Ashrama)
 ১৮৯৭ সালের ২ অক্টোবর থেকে বিবেকানন্দের রাজযোগ বিষয়ে সপ্তাহে দুইদিন -- বুধবার ও শনিবার ক্লাস নিতে শুরু করলেন অভেদানন্দজী। উপনিষদের শান্তি স্তোত্র পাঠান্তে তিনি কিছুক্ষণের জন্য ধ্যান করতেন এবং শিক্ষার্থীরাও এতে যোগদান করত। প্রায় এক ঘন্টা ধরে এই ক্লাস চলত, তারপর হত প্রশ্নোত্তর পর্ব। তাঁকে প্রশ্ন করা হত, তিনি উত্তর দিতেন। সোমবার মন্ট ক্লেয়ার, নিউ জার্সিতে ক্লাস নিতেন। সিস্টার এলেন ওয়াল্ডোর ( রালফ ওয়াল্ডো এমার্সনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া) ব্রুকলিনের বাড়িতে থাকতেন তিনি। ১৮৯৮ সালে অভেদানন্দজী ‘The Ideal Of Vedanta and How to attain It’ শীর্ষক বক্তৃতায় বেদান্তের নির্যাস তুলে ধরে বলেন -- The ideal of Vedanta is to solve the problem of life, to point out the aim of existence, to make our ways of living better and more harmonious with the universal Will...Its ideal is to show us how we can live in this world without being overcome by sorrows and misery, without being afflicted by sufferings and misfortunes that are sure to fall on every human being in some way or other; how to conquer death in this life, how we can embrace death without being frightened in the least. And above all, the chief object of Vedanta is to make us live the life of unselfishness, purity, and attain to perfection in this life...The mission of Vedanta is to establish that oneness and to bring harmony, peace, toleration amongst the different religions, sects, creeds, and denominations that exist in this world.



জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



 ১৮৯৯ সালের ২৮ অগাস্ট বিবেকানন্দ দ্বিতীয়বারের জন্য আমেরিকায় গেলেন। সঙ্গে ছিলেন তুরীয়ানন্দ। অভেদানন্দ তখন গ্রিন একর কনফারেন্সে ব্যস্ত। বিবেকানন্দ ও তুরীয়ানন্দ মি. লেগেটের গ্রামের বাড়ি রিজলি ম্যানরে এসে উপস্থিত হলেন। নিউ ইয়র্কের স্টোন রিজে অবস্থিত এটি। ৭ সেপ্টেম্বর অভেদানন্দজীর কাছে একটি তার এল বিবেকানন্দের কাছ থেকে। স্বামীজী তাঁকে রিজলিতে চলে আসতে বলেছেন। পরদিন বস্টন থেকে রিজলির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন তিনি। স্বামীজী ও তুরীয়ানন্দজীর সঙ্গে মিলিত হয়ে প্রবল আনন্দ অনুভব করলেন। পাশ্চাত্যে তাঁর যাবতীয় কার্যধারা বিষয়ে তাঁদেরকে অবহিত করলেন। তিন গুরুভ্রাতা একত্রে সেখানে দশদিন থাকেন। এরপর অভেদানন্দজী ফিরে এলেন নিউ ইয়র্ক। ৭ নভেম্বর বেদান্ত সোসাইটির পক্ষ থেকে স্বামীজীকে সম্বর্ধনা জানানো হল। ১৮৯৮ সালের ২৮ অক্টোবর নিউ ইয়র্কের বেদান্ত সোসাইটির রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়। মি. ফ্রান্সিস লেগেট এর প্রেসিডেন্ট হন। 
 মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেদান্ত আন্দোলন দ্রুত বিস্তারলাভ করার কারণে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের পক্ষ থেকে স্বামী অভেদানন্দকে সহায়তার জন্য স্বামী নির্মলানন্দকে পাঠানো হয়। ১৯০৩ সালের ১২ নভেম্বর তিনি নিউ ইয়র্কে পৌঁছান এবং ডিসেম্বর মাস থেকে ক্লাস নিতে আরম্ভ করেন।
 ১৯০৫ সালটি ছিল বেদান্ত সোসাইটির পক্ষে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই বছর ৩০ জানুয়ারি ব্রুকলিনে আরেকটি বেদান্ত কেন্দ্রের উদ্বোধন হয়। নির্মলানন্দ এই কেন্দ্রের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯০৬ সালের ২৭ জানুয়ারি নির্মলানন্দ ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। অভেদানন্দজীকে সহায়তার জন্য মঠের পক্ষ থেকে পাঠানো হয় স্বামী বোধানন্দকে। পাশ্চাত্যে একটানা দশ বছর বেদান্ত প্রচারের কাজে নিযুক্ত থাকার পর ভারতে ফেরার তাগিদ অনুভব করেন অভেদানন্দজী। ১৯০৬ সালের ১৬ মে নিউ ইয়র্ক ত্যাগ করেন এবং লণ্ডনে জাহাজ পরিবর্তন করার পর শ্রীলঙ্কার কলম্বো পৌঁছান ১৬ জুন। রামকৃষ্ণানন্দ, প্রেমানন্দ, ব্যারিস্টার ত্যাগরাজ এবং অনাগরিক ধর্মপাল ( চিকাগো ধর্মমহাসভায় যিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন ) তাঁকে নিতে উপস্থিত ছিলন কলম্বো বন্দরে।

Post a Comment

0 Comments