জ্বলদর্চি

সরিৎ কুমার জানা (সঙ্গীতশিল্পী, তমলুক) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৫৬
সরিৎ কুমার জানা (সঙ্গীতশিল্পী, তমলুক) 

ভাস্করব্রত পতি

“এস আজ মোরা হাতে হাত ধরে / নতুন শপথ করি / আগামীদিনের পৃথিবীতে মোরা / নতুন শপথ গড়ি"— এ গান গেয়েছিলেন সেদিন, যেদিন তমলুকে প্রথম এসেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তিল ধারণের জায়গা ছিলনা সেদিন। লক্ষাধিক মানুষের ভিড়। নিজের ভাষায় নিজের সুরে সেদিন এই গান গেয়েছিলেন যিনি, তিনি সরিৎকুমার জানা। 

তাঁর গানের অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর দিদি। অশ্রুকণা গিরি। তিনি খুব ভালো গান করতেন। দিদির গান শুনেই তাঁর গানে হাতেখড়ি। শেখেন রবীন্দ্রসঙ্গীত। কলেজে প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান লাভ করেন গান গেয়ে। এরপর ১৯৬২-৬৩ তে শান্তিনিকেতনে ছয় মাসের জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রশিক্ষণ নেন।

আজ তিনি আকাশবাণীর গীতিকার। গান গেয়েই ভুলিয়ে দিতে চান মানুষের দুঃখ কষ্ট বেদনার জায়গাটুকু। গান গেয়েই মানুষের অন্তরে প্রবেশ করতে চান তিনি। সমাজের যাবতীয় হিংসা, দ্বেষ, কলহের অবসান ঘটাতে চান এই গানের মাধ্যমেই। 

১৯৭৪ এর ২২ জানুয়ারি তমলুকে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় রাজবাড়িতে। মুখ্য আয়োজক সংস্কৃতিবান রাজা বীরেন্দ্রনারায়ণ রায়। সেদিনও ঐ সম্মেলনের উদ্বোধনী সঙ্গীত গেয়েছিলেন সরিৎবাবু। এসেছিলেন বনফুল, জসীমউদ্দিন, আশাপূর্ণা দেবীরা। আগত অতিথি কবিদের উদ্দেশ্যে সেদিন দরাজ কণ্ঠে সুর তুলেছিলেন -- "এসেছো যাঁরা এই সম্মেলনে / জানাই মোদের অভিনন্দন / অতীতের বন্দরে আমাদের অন্তরে / তোমরা জাগালে আজ স্পন্দন"। সেই গান শুনে স্বয়ং বনফুল তথা বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, "অভিনন্দন, সঙ্গীতটি ভালো হয়েছে"। 

শুধু গান গাওয়া নয়, গান লেখাতেও পাকিয়ে ফেলেন হাত। ১৯৫৯-৬০ নাগাদ কলেজে ছাত্রাবস্থাতেই গান লেখা শুরু। ১৯৭৫ এ আকাশবাণীর স্বীকৃত গীতিকার হন। আর সুরকার হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ বাবার লেখা গানের মাধ্যমে। বাবা সত্যেন্দ্রনাথ জানা ছিলেন মেদিনীপুরের অন্যতম বিশিষ্ট কবি। সাগরিকা, বহ্নিপাথান, রূপরেখা, পনেরই আগস্ট, রবি তর্পণ, কবি দীপিকা তাঁর অন্যতম গ্রন্থ। এ হেন বাবার সান্নিধ্য পেয়ে সরিৎকুমার জানা হয়ে ওঠেন যথার্থ সঙ্গীত শিল্পী। মেদিনীপুরের মানুষ রতন। একসময় রাজ্য সরকারের কো অপারেটিভের ডাইরেক্টর ছিলেন। এখন অখণ্ড অবসর। কিন্তু গান হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের অন্যতম সোপান।
১৯৪০ এর ১১ মার্চ জন্ম। এ পর্যন্ত গান লিখেছেন ১৫০০ এর বেশি। সুর দিয়েছেন প্রায় পাঁচশোটিতে। কবিতা লিখেছেন পাঁচশোর কাছাকাছি। জেলা থেকে প্রকাশিত বহু পত্রপত্রিকাতে তাঁর কবিতা গান প্রকাশিত হয় নিয়মিত। প্রথম লেখা প্রকাশ হয় 'বেদুইন' ও 'প্রদীপ' পত্রিকায়। যে বছর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে, সেই সময় তিনি লিখেছিলেন 'জয় বাংলা' গীতি আলেখ্য। ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি সেদিন।

ভক্তিগীতি, দেশাত্মবোধক, আধুনিক সহ সব ধরনের গানে তিনি আজ সমানভাবে সচল। তমলুক শহরের এই বর্ষীয়ান মানুষটি এই বয়সেও গান ছাড়েননি। 'জয় বাংলা', 'প্রেম', 'প্রেমের পূর্ণিমা', 'ভালোবাসায় কৃষ্ণ মেলে' বইগুলি তাঁর গান চর্চার ফসল।

কোনো অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইতে হলেই ডাক পড়ে সরিৎ কুমার জানার। ১৯৯৯ এর ১০ জানুয়ারির জেলা কংগ্রেস কার্যালয়ে সতীশচন্দ্র সামন্ত, অজয় মুখোপাধ্যায়, রজনী প্রামাণিকের মূর্তি উন্মোচনের দিন তিনিই গেয়েছিলেন উদ্বোধনী গান। নিজের লেখা, নিজের সুরে। তমলুক রেড ক্রশ ভবনের উদ্বোধনে তিনিই গেয়েছিলেন 'রক্ত দাও প্রাণ বাঁচাও'। সেদিন উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং রাজ্যপাল সৈয়দ নুরুল হাসান।

তাঁর মতে গান আসলে মানুষের সবসময়ের বন্ধু। দুঃখ, কষ্ট, কিংবা সুখের দিন গানই পারে মানুষকে সতেজ, সরল এবং সবল রাখতে। যদিও ইদানিং যে গান চলছে, তা কতখানি 'গান', তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তাঁর মতে, পূর্ব মেদিনীপুরের গানের ঘরানায় পঁচেটগড় রাজবাড়ির গান চর্চাই অন্যতম। যা আজ হারিয়ে গেছে। মহিষাদল রাজ বাড়িতে এক সময় গান চর্চা হত। সুস্থ সবল সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে রুচিশীল গান এখন অতি প্রয়োজন। যা ক্রমশঃ হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সুস্থ সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে রুচিশীল গানই পারে বলীষ্ঠ ভূমিকা নিতে। আর সুশ্রাব্য গানের জন্য তাঁর কন্ঠ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে নীরবে নিভৃতে নিরালায়।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇




Post a Comment

0 Comments