জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী /উপপর্ব — ১৪/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৭৯
এগ্রিকালচারাল রেটুনিং
মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী

উপপর্ব — ১৪

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

'বুলা' 'বুলা' ...
যেন আপনজনের রূপকথার ডাক। প্রাণের অন্তস্থল থেকে উৎসারিত এক বিদায় সম্ভাষণ। এ‌ আহ্বানে সাড়া না দেয়, এমন উজবুক ভূভারতে অমিল। গাড়িতে চড়ে যে সকল আরোহী আপন গন্তব্যে ধাবমান, তাদের উদ্দেশ্যে পথচারীদের এ হেন প্রাণের ডাক পথেঘাটে হামেশাই শোনা যেত। 'বাই বাই' সম্বোধনে একে অপরকে অন্তরের ভালোবাসা জ্ঞাপন করাই রীতি এখানে। আসলে ফিজির মানুষজন খুব প্রাণখোলা। অনাবিল আনন্দে দিন কাটায় তারা। তাদের আতিথেয়তা দেখার মত। তাদের সহানুভুতির কাছে হার মানে যেকোনও দেশের সংষ্কৃতি। কোমলমতি লোকজনের হৃদ্যতার একগুচ্ছ বাস্তব দলিল প্রতিনিয়ত দেখা যায় হাটে বাজারে রাস্তাঘাটে ঘরে সর্বত্র। যানবাহনের জন্য অপেক্ষারত আগন্তুককে দেখে গাড়ি থামিয়ে গাড়িচালক মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞাসা করে—
'May I help you?' 

ফিজিতে অফিসে ঢোকার আগে থাকে রাজকীয় আপ্যায়নের ব্যবস্থা। ফিজির ন্যাশনাল ড্রিংকস ছিল আঙ্কোনা গাছের মূলের রস। আঙ্কোনা গাছের মূল থেঁতো করে নিংড়ে যে-রস বের করা হয়, সেটাই ওদেশের জাতীয় পানীয়। আঙ্কোনা গাছের মূল অনেকটা শাঁকালুর মূলের মতো দেখতে। এ হেন আঙ্কোনা গাছের মূলের রস পান করার অভিজ্ঞতা সবসময় সুখের হয়নি রামচন্দ্র বাবুর নিকট। অফিসের দোরগোড়ায় একজন লোক আঙ্কোনার মূল ছেঁচা রস ও নারকেলের খালি মালা নিয়ে বসে থাকে। অফিসে ঢোকার আগে সেই আঙ্কোনা রস একটি মালায় ভরে পরিবেশন করা হতো আগত অতিথিকে। দুহাতের চেটোর মধ্যে রস ভর্তি মালা  ধরে রেখে এক চুমুকে শেষ করতে হয় পানীয়। রামচন্দ্র বাবুও দু-একবার আঙ্কোনা রস পান করেছেন। কিন্তু অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। কারণ, আঙ্কোনা রস পান করার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে শিরা উপশিরায় একখানি শিরশিরানি ভাবের উদয় হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় পেশী শিথিলতা। শরীরে ক্যালসিয়াম ইনজেকশন নিলে যেমন অভিজ্ঞতা হয়, অনেকটা সেরকম অভিজ্ঞতা। কারণ কী? আঙ্কোনার রস কার্বোহাইড্রেট খাবারে পরিপূর্ণ। অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট যুক্ত কাঁচা রস শরীরে প্রবেশ করলে স্নায়ু শিথিলতা বা আড়ষ্টতা, স্থুলতা (Obesity)-র মতো রোগগুলো শরীরে বাসা বাঁধে। অধিকাংশ ফিজি অধিবাসীর শরীরে বাসা বেঁধেছে এ রোগ। তা চাক্ষুষ করে রামচন্দ্র বাবু আগাম সতর্ক। লোভ সংবরণ করলেন তিনি। সিঙ্কোনা রস দেখলেই এড়িয়ে চলতেন। সামান্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে পানীয় পরিবেশনকারীকে ভদ্রভাবে বলতেন — 'Just taken' অর্থাৎ এই মাত্র নিয়েছি। এ কথা শুনে কেউ আর জোরাজুরি করে না। যদিও অল্প দিনের মধ্যে তাঁর এ চালাকি ধরা পড়ে গেল। রামচন্দ্র বাবুর চিরায়ত অভ্যাসের ব্যাপারে সকলে অবগত হয়ে যায়। তিনি অ্যালকোহল পান করেন না।  কোনও নেশার বালাই নেই। এমনকি চা পর্যন্ত সেবন করতে তাঁর তীব্র অরুচি। বড় বড় পার্টিতে সবার সূরা পানে আসক্তি থাকলেও তাঁর জন্য বরাদ্দ থাকত সফট ড্রিংকস।

ফিজি দ্বীপপুঞ্জে ইউরোপীয়, অষ্ট্রেলিয়, নিউজিল্যান্ডজাত ব্রিটিশ আর ভারতীয় বংশোদ্ভুত ফিজিবাসীগণের সমাবেশ। এদের দ্বারা পরিচালিত স্থানীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। চাষাবাদের কাজে, বিশেষত আখচাষে পাঞ্জাবিদের দখল সন্দেহাতীত। ব্যবসা বাণিজ্যে গুজরাটিয়াদের একচেটিয়া রাজত্ব। অন্যান্য কাজে বিহারী ও উত্তরপ্রদেশের লোকেদের দারুণ নামডাক। ফিজিয়ানরা বেশ আরামপ্রিয়। সাদাসিধে। এবং ভোজনরসিক। গাঁয়ের মোড়লকে ঘিরে একসঙ্গে ভোজনে আগ্রহী। যারা জননেতা, তারা পর্যন্ত সাদাসিধে জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত। ভালোবাসেন সাধারণ ভাবে বাঁচতে। সাধারণের মাঝে বেঁচে থাকতে। একদিনের ঘটনা। ফিজির প্রধানমন্ত্রীর আসনে তখন রাতু কামিসেসি মারা। প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী। অথচ কোনো সিকিউরিটি গার্ড নেই। পাইলট-কার নেই। হুটার বাজানোর শূন্য আওয়াজ। শুধুমাত্র ড্রাইভার নিয়ে গাড়িতে দিব্বি ঘুরে বেড়ান একা একা। একদিন হঠাৎ দোকানের পাশে গাড়ি থামিয়ে তিনি একলা নেমে পড়লেন চারচাকা গাড়ি থেকে। নিজে কেনাকাটা সেরে গাড়ি চড়ে চলে গেলেন গন্তব্যে। সম্পূর্ণ নিরহংকার লাইফস্টাইল।
         
আর একদিনের ঘটনা। খাসির দোকানে মাংস কেনার লম্বা লাইন। রামচন্দ্র বাবু লাইনে দণ্ডায়মান। ফিজিতে ভেড়ার মাংস আসত নিউজিল্যান্ড থেকে।
'হ্যালো, মিঃ মণ্ডল।'
প্রত্যুত্তর দিতে গিয়ে ক্ষণিক কিংকর্তব্যবিমূঢ় রামচন্দ্র বাবু। মাটন কেনার লাইনে সামনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা যে-মানুষটি তাকে অভিবাদন জানাচ্ছেন, তিনি স্বয়ং ফিজির প্রিন্সিপল সেক্রেটারি। ভদ্রলোক অ্যাংলো ফিজিয়ান। তিনিও খাসির মাংস কেনার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন বাদবাকি জনসাধারণের মাঝে। ফিজির কৃষিমন্ত্রীও দারুণ জনপ্রিয়। মন্ত্রী-আমলা থেকে আমজনতা সবাই অনাড়ম্বর সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত।

ফিজির সরকারি কাজকর্ম রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। সপ্তাহের প্রথমে প্রতি সোমবার বসে কৃষিমন্ত্রকের রিভিউ মিটিং। মিটিং-এ মূল আলোচ্য বিষয় বিগত সপ্তাহে কাজের অগ্রগতি দেখে বর্তমান সপ্তাহে কাজের পর্যালোচনা ও নির্দেশ প্রদান। বিভিন্ন স্থানে বেতার সংযোগে সে-নির্দেশ পাঠিয়ে দিলে'পর শুরু হয় নির্দিষ্ট দিনের কাজ। রিমোট কন্ট্রোল সিডিউল টাইম (Remote Control Scheduled Time)-এর মধ্যে নির্দিষ্ট কাজ শেষ করতেই হবে। এটাই ফিজির অলিখিত নিয়ম। অন্যথায় কৈফিয়ত দিতে হয়। গাফিলতির ঠাঁই নেই। অজুহাতের বালাই নৈব নৈব চ। রামচন্দ্র বাবুও একবার রিসার্চ কাউন্সিলে আলোচনা না করে প্রোজেক্টের পরিবর্তন আনতে গিয়ে ফরেনার তথা বিদেশি ও সরকারি উভয় স্তরে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন। সে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। 

(২)
১৯৭৫ সাল। একাকি তাঁর দেশে ফেরা। স্ত্রী শেফালী দেবী আর কন্যা শম্পারেখা ত্রিবেন্দ্রামে রয়েছে। দুজনের পাসপোর্ট তৈরি ছিল। অথচ, তারা কেউ ফিজি রওনা হয়নি। কারণ কন্যার পড়াশুনা। ইতিমধ্যে স্থানীয় স্কুলে ভর্তি হয়ে গেছে কন্যা। ফিজি ঘুরতে গেলে মেয়ের পড়াশুনার ব্যাঘাত ঘটবে, এই ভেবে শেফালী দেবীর‌ এ হেন কঠিন সিদ্ধান্ত।

ফিজি থেকে ফিরে CTCRI জয়েন করলেন রামচন্দ্র বাবু। ফেরা অব্দি তাঁর নিস্তার নেই। ফিরে আসার ক'দিন পর নতুন প্রোজেক্টের কাজ শুরু হল। লক্ষ্য গোয়াতে ICAR Research Complex গড়ে তোলা। এটি একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রকল্প। এ হেন প্রকল্পের বিষয় আপাতত তিনটি। প্রথম, কৃষি বিজ্ঞানে (Crops Sciences) মাঠের ফসল (Field Crops), আবাদী শস্য (Plantation Crops) এবং ভেজিটেবলসের ওপর পরিকল্পনা মাফিক রিসার্চ। দ্বিতীয়, অ্যানিম্যাল সায়েন্সে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি ও শূকর চাষে উন্নত গবেষণা। সর্বশেষ, মৎস্য বিজ্ঞানে রিসার্চ। বিশাল এক কর্মকাণ্ডের রক্ষনাবেক্ষণের গুরু দায়িত্ব বর্তায় রামচন্দ্র বাবুর কাঁধে। ভারতবর্ষের কৃষি ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে ও সমৃদ্ধ করতে দেশের বিভিন্ন কৃষি গবেষণা কেন্দ্র ও কৃষি কলেজের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে ভিন্ন ভিন্ন জাতের উন্নত মানের বীজ সরবরাহ করা ছিল তাঁর কাজ। তাছাড়া, ICAR - এর গবেষণাগার থেকে কৃষি জমি পর্যন্ত কার্যকর উদ্ভাবিত পদ্ধতিগুলো কীভাবে সুষ্ঠুভাবে রাজ্যে রাজ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে, উন্নয়ন মূলক সেই সব কৃষি ব্যবস্থা বিশদভাবে জানার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর। বিরল এ অভিজ্ঞতা অনুসন্ধিৎসু মনের খোরাক জুগিয়ে তাঁর জ্ঞানের সম্প্রসারণ ঘটিয়েছিল হাজার গুণ। গোয়ার প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং কৃষিমন্ত্রী, বিশেষত মুখ্যমন্ত্রীর সরাসরি সান্নিধ্যে রাজ্যের কৃষি ও প্রাণিসম্পদের উন্নয়নের পথ প্রশস্ত হয়েছিল। গোয়ার কৃষি ও প্রাণীজ সম্পদ সম্পর্কে প্রভূত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন তিনি। 

কেরালার কাসারগড়ে রয়েছে সেন্ট্রাল প্ল্যান্টেশন ক্রপস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (Central Plantation Crops Research Institute)। এ হেন প্রতিষ্ঠানে যোগ দিলেন রামচন্দ্র বাবু। শুরু হল কোকোনাট প্রোডাকশন তথা নারকেল উৎপাদনের উপর নানারকম এগ্রোনমিক রিসার্চ। এগ্রোনমি বিভাগের প্রধান ছিলেন মিঃ ই. ভি. নেলিয়ট। ধূমপানে তীব্র আসক্ত। চেইন স্মোকার। ধূমপানের কালো ধোঁয়ায় তাঁর কণ্ঠনালির ঝিল্লিগুলি যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত ধূমপানের নিমিত্ত হঠাৎ একদিন মারা গেলেন মিঃ নেলিয়ট। তিনি মারা যেতে না যেতেই একঝাঁক দায়িত্ব এসে পড়ল রামচন্দ্র বাবুর ওপর। এগ্রোনমি বিভাগের প্রধানের পদ অলংকৃত করার দায়িত্ব ন্যস্ত হল তাঁর উপর। বিভিন্ন শাখা কেন্দ্রগুলির তত্ত্বাবধায়নের ভারও পড়ল। প্রতিষ্ঠানে ডিরেক্টরের কড়াকড়ি ছিল দেখার মত। তাঁর নির্দেশে সায়েন্টিফিক স্টাফদের হাজিরা রেজিস্ট্রার বাধ্যতামূলক ছিল। সময়ানুবর্তিতা মেনে চলে সবাই। ডিরেক্টরের অনুপস্থিতে ইনস্টিটিউটের সমূহ দায়িত্ব রামচন্দ্র বাবুর ওপর বর্তায়। সুতরাং গবেষণার পাশাপাশি প্রশাসনিক কাজকর্ম একা কড়া হাতে সামলান রামচন্দ্র বাবু।
       চিত্র -২
ইতিমধ্যে কেটে গেছে বেশ কয়েক বছর। নারকেল চাষ সম্পর্কে আলাদা আলাদা বিভাগের তথ্যের পাহাড় জমেছে তাঁর টেবিলে। সমস্ত তথ্য এককাট্টা করে তিনি লিখলেন একখানি পুস্তক। কোকোনাট প্রোডাকশন অব প্রোটেকশন টেকনোলজি (Coconut Production of Protection Technology)। সুরক্ষা প্রযুক্তির সাহায্যে নারকেল উৎপাদন কৌশল। পাশাপাশি বাংলায় লিখেছেন নারকেল চাষ সম্বন্ধে একটি আর্টিকেল। বাংলায় লেখা প্রবন্ধটি অবশ্য আজও অপ্রকাশিত। এ হেন রিসার্চ কাউন্সিলের মুখ্য ভূমিকায় রামচন্দ্র বাবু। তাঁর অন্তর্ভুক্তি একজন মুখ্য পরীক্ষক হিসেবে। বিভিন্ন বিভাগের রিসার্চ পেপার নিঁখুতভাবে রিভিউ করার পর অনুমতি প্রদানের দায়িত্ব ছিল রিসার্চ কাউন্সিলের উপর। এ হেন কাউন্সিলের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে রাতদিন খেটে নিঁখুতভাবে তথ্যাদির যৌক্তিকতা বিচার করতেন রামচন্দ্র বাবু। আজীবন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। রীতিমতো নেশায় পেয়ে বসেছিল তথ্য যাচাইয়ের কাজ। অজানাকে জানার অপরিসীম আগ্রহ তাঁর। ফলে যারা সায়েন্টিস্ট, রিসার্চ পেপার জমা করতে গিয়ে তারা পর্যন্ত অত্যন্ত সজাগ ও সন্ত্রস্ত থাকে। কখন কী হয় কিংবা পেপার ফেরত না চলে আসে এই ভয়ে সারাক্ষণ আড়ষ্ট থাকে সবাই। কিন্তু রামচন্দ্র বাবুর কাছ থেকে একবার 'ওকে' পেয়ে গেলে আর নো চিন্তা। সবাই একবাক্যে স্বীকার করবে সংশ্লিষ্ট থিসিসটি উচ্চ মানের পেপার। বিজ্ঞানী মহলে রামচন্দ্র বাবুর এতটাই ক্রেজ! আধিপত্য। কৃষিবিদ্যায় তাঁর জ্ঞানের সুবিশাল পরিধি। রীতিমতো সম্ভ্রম আদায় করার মতো ঘটনা।

(৩)
গোয়ায় প্রথম কাজু বাদামের আমদানি পর্তুগিজদের হাত ধরে ষোড়শ শতকে। তারপর সেখান থেকে ধীরে ধীরে অন্যান্য রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে কাজু বাদামের চাষ। বিংশ শতকের পঞ্চাশের দশকে প্রায় ৪,৫০,০০০ হেক্টর জমিতে ১,৫০,০০০ টন কাঁচা কাজু বাদাম উৎপন্ন হত। বর্তমানে ভারতের প্রায় ৭,০০,০০০ হেক্টর জমিতে ৮,০০,০০০ টন কাঁচা কাজু বাদাম উৎপন্ন হয়। কাজু বাদামের উৎপাদনে ভারতের ব্যাপক আর্থিক উন্নতি ঘটেছে। অথচ দেশে কাজু বাদাম নিয়ে গবেষণার সূত্রপাত সেই ১৯৫১ সালে। কেরল, কর্ণাটক আর মহারাষ্ট্র – তিনটি রাজ্যে প্রথম কাজুবাদাম গবেষণার সূচনা। ধীরে ধীরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে লাভজনক কাজুর চাষ। ১৯৭১ সাল। অল ইন্ডিয়া কোঅর্ডিনেটেড প্রোজেক্ট অন ক্যাসিউ (All India Coordinated Project on Cashew)-এর প্রোজেক্ট কোঅর্ডিনেটর  হলেন রামচন্দ্র বাবু। এই কাজের সূত্রে ১৯৮২ সালে যুক্ত হয় মাল্টি স্টেট ক্যাসিউ প্রোজেক্ট (Multi State Cashew Project, সংক্ষেপে MSCP)-এর দায়িত্ব। ১৯৮৬ সালে তিনি যোগ দিলেন ম্যাঙ্গালোর-এর সন্নিকটে ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার ফর ক্যাসিউ শান্তিগোদু (National Research Centre for Cashew Shantigodu)-এ। এখান থেকেই অবসর গ্রহণ করেছিলেন। 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
সেটা ১৯৮৯ সাল। মার্চ মাসের শেষ দিন। কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণের সময় উপস্থিত। অবসর গ্রহণের দিনও তাঁর হাজারো ব্যস্ততা। অসমাপ্ত কাজের তালিকা বেশ লম্বা। অপূর্ণ রয়েছে গবেষণার কাজ। সে সকল কাজের দায়িত্ব বুঝিয়ে তবেই নিস্তার। হোক না আজ শেষ দিন। আর হয়তো কিছু ক্ষণ। নস্টালজিক কয়েকটি মূহুর্ত। তারপর তিনি প্রাক্তন। কর্মজীবন কখন যে অবসরের খাদের কিনারায় পৌঁছে গেছে, সে খেয়াল হয়নি। আজ যখন কৃষি বিভাগ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় এল, তখন মনে পড়ে এই তো সেদিন চাকুরী জীবনে তাঁর প্রবেশ! খেয়াল হয়নি, সময় বয়ে চলে দ্রুত; কারও অপেক্ষা না করে। 

কিছু কিছু মানুষ থাকেন যাদের প্রয়োজন কখনও ফুরায় না। সোনার চেয়ে দামী অমূল্য রতন তাঁরা। ড. রামচন্দ্র মণ্ডল সেরকম একজন মানুষ। অবসরের পরে শুরু হল তাঁর আসল কাজ। সমাজ গড়ার ভাবনা। সুস্থ সমাজ গড়ার লক্ষ্যে তাঁর অনন্ত পথচলা। অফুরন্ত কর্মোদ্যমের ভাণ্ডার তিনি। ক্লান্তিহীন। ১৯৮৯ সাল। সদ্য অবসর নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর অবসর নেই। এপ্রিল মাসের ঘটনা। তিনি রওনা হলেন এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম এনভায়রনমেন্টাল লার্নিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে— এশিয়া প্লেটো সেন্টার অব এনভায়রনমেন্টাল লার্নিং (Asia Plateau Centre of Environmental Learning বা APCEL)। ১৯৬১ সালে স্থাপিত কেন্দ্রটি। ফ্রেন্ডস অব মরাল রি-আর্মামেন্ট ইন্ডিয়া (Friends of Moral Re-armament (MRA) India)-র পাবলিক ট্রাস্টের রেজিস্ট্রিকৃত একটি সংস্থা হল APCEL প্রতিষ্ঠান। ১৯৬৩ সালে মহাত্মা গান্ধীর পৌত্র রাজমোহন গান্ধী 'পরিস্কার, মজবুত ও ঐক্যবদ্ধ ভারত' গড়ার উদ্দেশ্যে বেছে নিয়েছিলেন পঞ্চগনি জায়গাটি। পশ্চিম মহারাষ্ট্রের পার্বত্য অঞ্চলে ঘেরা মহাবলেশ্বরের নিকট একটি নির্জন স্থান হল পঞ্চগনি। পুনা থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে, সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১৩০০ মিটার উচ্চতায় প্রকৃতির কোলে অবস্থিত মনোরম স্থান। অপূর্ব বনাঞ্চল ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশ। 
        
প্রতিষ্ঠানের গোটা চারেক লক্ষ্য। সততা (Honesty)। পবিত্রতা (Purity)। নিঃস্বার্থপরতা (Unselfishness) । এবং প্রেম (Love)। প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ট্রাস্টি ছিলেন লুইস গোমস। গোয়ার একজন সৎ নিষ্ঠাবান বাসিন্দা। ত্রিবেন্দ্রামে CTCRI-তে কর্মরত থাকাকালে মিঃ গোমসের সঙ্গে রামচন্দ্র বাবুর একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তাঁর কাছে সেসময় মিঃ গোমস সহযোগিতা চেয়েছিলেন পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে। তখন থেকে দুজনের আলাপ পরিচয়। কর্মজীবনে অবসরের পরেও অব্যাহত সেই হৃদ্যতা। ষাটোর্ধ্ব রামচন্দ্র বাবুর ডাক আসে APCEL-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থায়। এগ্রিকালচার, অ্যানিম্যাল বিজ্ঞান, প্রাকৃতিক বনায়ন, প্রাকৃতিক দৃশ্য নির্মাণ হেতু বিষয়গুলোর উপদেষ্টা হিসেবে তাঁকে ডেকে পাঠালেন লুইস গোমস। পরিবেশগত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পৌঁছে তিনি শুরু করে দিলেন তাঁর স্টাডি কোর্স। বেশ কয়েক দফা কার্যকর প্ল্যান তাঁর তৈরি। প্ল্যান জমা পড়ল ট্রাস্টি বোর্ডের টেবিলে। যদিও অর্থের অভাবে বন্ধ ছিল অ্যাকশন প্ল্যানের নীল নকশা। অকার্যকর হয়ে ফাইল বন্দি রইল দীর্ঘদিন। এদিকে, সাত দিনের মাথায় পঞ্চগনি ছেড়ে ফিরে এলেন রামচন্দ্র বাবু। তবে লুইস গোমস-এর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ অটুট থাকল।

অল্প দিনের জন্য হলেও বেশ মায়া পড়ে গেছিল পঞ্চগনির উপর। এখানে রাস্তার ধারে প্রচুর আগাছা জন্মায়। রামচন্দ্র বাবুর দৃষ্টি এড়ায়নি বিষয়টা। ইনস্টিটিউটে আগাছা প্রতিকারের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। আগাছা দমনের জন্য তিনি একধরনের তলোয়ার তৈরি করেছিলেন। অস্ত্রের শেষভাগ এমনভাবে বাঁকানো থাকত যে একজন লোক সোজা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সুইং করালে দুদিকের থোক থোক ঘাস গোড়া থেকে কাটা হয়ে যায়। এমন ধারালো অস্ত্র পেয়ে শ্রমিকরাও দারুণ খুশি। তারা সহজে ও কম পরিশ্রমে ঘাস আগাছা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তলোয়ারটির একটা যুতসই নাম দেয় তারা। 'মণ্ডল' তলোয়ার। কারণ, সংস্থায় দেশী বিদেশী সবার কাছে 'মণ্ডল' নামে খ্যাত ছিলেন ড. রামচন্দ্র মণ্ডল। (ক্রমশ...)

তথ্য সূত্র :
• প্রণম্য বৈজ্ঞানিক ড. রামচন্দ্র মণ্ডল মহাশয়
• শ্রী সুদর্শন সেন বিশিষ্ট শিক্ষক ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক
• 'মনীষী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল' – সম্পাদনা শ্রী জয়দেব মাইতি ও শ্রী সুব্রতকুমার মাঝি


Post a Comment

0 Comments