জ্বলদর্চি

রমেশ চক্রবর্তী (পালাগায়ক, কাঁউরচণ্ডী, কোলাঘাট) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৫২
রমেশ চক্রবর্তী (পালাগায়ক, কাঁউরচণ্ডী, কোলাঘাট) 

ভাস্করব্রত পতি

আজও তাঁর গলায় ঝরে পড়ে সুরের মূর্ছনা। একদিকে আর্থিক অনটন, সংসারের অস্বচ্ছলতা, অন্যদিকে প্রায় হারাতে বসা সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার অদম্য বাসনা। এই দুয়ের দ্বন্দ্বযুদ্ধে তিনি জয়ী হতে বদ্ধপরিকর। 

তিনি মঙ্গলকাব্যকে কীর্তন আকারে এবং পাঁচালি আকারে পরিবেশন করার বাসনায় বিভোর হয়ে থাকেন। নিজের কল্পনার সাথে মিশিয়েছেন সেই সব পালাগুলিকে। কোলাঘাটের কাঁউরচণ্ডী গ্রামের নিতান্ত অভাবী ব্রাহ্মণ সন্তান রমেশ চক্রবর্তীর গলায় এখনও আত্মপ্রত্যয়ের সুর। আজকের চলমান সংস্কৃতিতে কিছুটা পিছিয়ে পড়া মঙ্গলকাব্যের সংস্কৃতিকে তিনি বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছেন প্রাণপণে। একদিকে পেটের ভাত জোগাড় আর অন্যদিকে বাংলার সংস্কৃতিকে রক্ষার নিরলস প্রচেষ্টা। 

শীতলামঙ্গল, কপিলামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল, শিবায়ন, সত্যপীরের পালা, ওলাবিবির পালা, হাতল বিবির পালা, দেওয়ান পীরের পালা, ইষ্টকমঙ্গল, পঞ্চানন্দের গীত, শিবায়নে শঙ্খ পরিধান, গৌরাঙ্গের পালা, জগন্নাথ পালা, রায়মঙ্গল ইত্যাদি পালাগানের তিনি গায়ক এবং নায়ক। গানও করেন। আবার অভিনয়ও করেন।

দশ বছর বয়স থেকে ‘শয়াল' গানের সাথে যুক্ত। শয়ালের প্রতি প্রেম মাটির কাছাকাছি থেকেই। আজ পঞ্চাশের কোঠায় আসা রমেশ সেই শয়াল গানের সাথে সংযুক্তকরণ করেছেন নিজের জীবনকে। ভালোবাসার সিলেবাসে মিশিয়েছেন মঙ্গলকাব্যের পালাগানকে।

প্রথমে বাবা জলধর চক্রবর্তীর কাছে 'গানে খড়ি'! এরপর মূলতঃ বিমলচন্দ্র দাস, কালীপদ মণ্ডল এবং হিমাংশুশেখর রায়ের কাছে তালিমের পর তালিম। এঁরাই রমেশের আদর্শ শিক্ষাগুরু। একসময় তাঁর সাথে আলাপ হয়েছিল 'সহজিয়া'র মধুসূদন মুখোপাধ্যায় এবং বিশিষ্ট লোক গবেষক ড. শ্যামল বেরার সাথে। নিজেকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন এই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে আরও বেশি জড়িয়ে থাকার জন্য। কোলাঘাটের অদূরে রূপনারায়ণ নদের পাড়ে 'কাউরচণ্ডী চণ্ডীমাতা শয়াল সংস্থা'তে যুক্ত রয়েছেন তিনি। আজ সেই দলে তিনিই আছেন মধ্যমণি। আপাতত এতে যুক্ত ৭ জন। কিন্তু রঙিন পোশাক পরে যখন অভিনয়ের ডাক পড়ে, তখন প্রায় ২৫ জন থাকে সাথে। 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
নিজেই লিখেছেন 'ইষ্টকমঙ্গল' পালা। ইষ্টকমঙ্গলকে বলা হয় ইঁটের গান। পল পোড়ানোর গান। কোনো বস্তু বারবার ভেঙে গেলে তখন তার দোষ কাটানোর জন্য 'ইষ্টকমঙ্গল' পালা অভিনীত হয়। ইঁট, টালি তৈরিতে খামতি হলে এই পালার গায়কদের ডাক পড়ে। পাকা বাড়ি তৈরির সময় ক্ষতি হলেও গাওয়ানো হয় 'ইষ্টকমঙ্গল'। সেই পালাগান লিখেছেন রমেশ। অন্তত তিন ঘন্টা ধরে গাওয়া যাবে আসরে।

শিবায়নের 'কৃষিমঙ্গল' লিখেছেন পালা আকারে। এছাড়াও লিখেছেন মালিনী মনসা, মালিনী শীতলা, মালিনী চণ্ডী, মালিনী কৃষ্ণ পালা। খাতায় লেখার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এক সময়ে মঙ্গলকাব্যের গান গাইতেন কেবল। এখন তার সাথে কীর্তনের রূপ মিশিয়েছেন অত্যন্ত সচেতনভাবে। আর তাতেই তিনি শ্রোতৃ সমাজে প্রতিষ্ঠিত গায়ক। সেইসাথে অন্য সময়ে পূজার্চনার দিকেও নিমগ্ন হয়েছেন তিনি। 

ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়াশুনা। তাতে কি? এই সামান্য বিদ্যাতেই হাত দেবেন ‘শনিমঙ্গল' লেখার কাজে। পোশাক ছাড়া যে কোনো পালাগান তিনি তিন ঘন্টা ধরে করেন। আর পোশাক পরে হলে সাড়ে চার ঘন্টার পালাগান তিনি করতে পারেন দলবল নিয়ে। করোনার সময়ে খুব বিপদের মধ্যে পড়েছিলেন। থাইরয়েড থেকে গলায় সমস্যা তৈরি হয়েছিল। আপাতত কিছুটা সুস্থ। মেদিনীপুরের বুকে মেদিনীপুরের লুপ্তপ্রায় সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার মরিয়া প্রচেষ্টা করে চলছেন নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। একদমই নীরব ভাবে। স্বাভাবিকভাবেই এহেন মানুষটি হয়ে উঠেছেন 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন'। 

কোলাঘাটের শয়াল গায়ক রমেশ নিজেকে স্বতন্ত্র রেখে বাঁচতে চান। যে সুর তিনি গলার স্বর বেয়ে দাপিয়ে ছাড়েন, সেই সুর তিনি শুনতে চান নিজের আগামীদিনের সংস্কৃতিবান মানুষের স্বরনালীতেও। হারাতে বসা সংস্কৃতিকে ভালোবেসে রমেশের এই লড়াই কি মান্যতা পাবে না?
🍁
বাড়িতে বসেই রেজি.ডাক মাধ্যমে জ্বলদর্চির বিশেষ সংখ্যাগুলো সংগ্রহ করতে পারেন। যোগাযোগ  হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৭৩২৫৩৪৪৮৪

Post a Comment

0 Comments