জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৭০/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ৭০

সেবার আন্তর্জাতিক নারীদিবসে বীরভূম জেলার হেতেমপুরের কৃষ্ণচন্দ্র কলেজে স্পিকার হিসেবে গেছলাম। অনেকখানি পথ, ওনাদের গাড়ি পাঠানো সম্ভব হবে না বলে এখান থেকেই গাড়ি নিতে বলেছিলেন। যেহেতু দাদার বাড়ি গড়বেতায়, আগের দিন ওখানে গিয়ে খান সাহেবকে বৌদির জিম্মায় রেখে ৮মার্চ ভোরে দাদাকে সঙ্গে  নিয়ে রওনা হলাম। কলেজটি হেতেমপুর রাজ বাড়ির একটি মহলে প্রতিষ্ঠিত। আমরা দুবরাজপুরের মামা ভাগ্না পাহাড় দেখার আগ্রহ প্রকাশ করাতে, ওনারা বললেন, হেতেম্পুরের পাশেই দুবরাজপুর। চাইলে এখনি দেখে আসতে পারেন।  আমাদের এখন পদযাত্রা হবে, তারপর মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে। কলেজের অধ্যাপিকা সুবর্ণাদি আমাদের সঙ্গে গেলেন। আসলে এসব দেখার শখ আমার দাদার। আমি  এইসব অনুষ্ঠানে গেলে মনটা ওখানেই থাকে, ঠিকভাবে গুছিয়ে বলতে পারব তো? কারণ আমি কাগজ দেখে বক্তব্য রাখতে পারিনা।
    যাই হোক, অনুষ্ঠান শুরু হল। আমি আর অধ্যক্ষ মঞ্চে ছিলাম এবং নারী দিবস সম্পর্কে বক্তব্য রাখলাম। অনুষ্ঠান শেষে অধ্যাপক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হল। লাঞ্চে এলাহি ব্যবস্থা ছিল। লাঞ্চের পর সুবর্ণাদি কলেজের পাশের মহলগুলির ওপর নীচ ঘুরিয়ে দেখালেন। একটি মহলে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল হয়েছে। আর একটিতে পুলিশ ফাঁড়ি দেখলাম। কলেজটি শ্বশুর মহাশয়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহারানী পদ্মাসুন্দরী দেবী। মহলের ভিররে তাঁর মূর্তিটিও দেখলাম। গড়বেতা ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেছল। পরদিন বিকেলে বাড়ি ফিরলাম।

     সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম অনলাইন আনন্দবাজারে মাস্কুরাকে নিয়ে লেখাটির প্রচুর মানুষ প্রশংসা করেছেন। এর মধ্যে এক দুপুরে ল্যান্ডফোন বেজে ওঠে,  রিসিভ করতে অপর প্রান্ত থেকে পুরুষ কণ্ঠ জিজ্ঞেস করলেন, রোশেনারা খান বলছেন? হ্যাঁ, বলার পর ভদ্রলোক জানালেন, তিনি অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী  ক্যানবেরা থেকে বলছেন, আনন্দবাজারে মাসকুরা খাতুনকে নিয়ে আমার লেখাটি তাঁর হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। তিনি মাস্কুরার মেডিক্যাল পড়ার সমস্ত দায়িত্ব বহন করবেন। ৪ মার্চ লেখাটি পড়ার পর থেকে  তিনি সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজের  প্রিন্সিপ্যালের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছেন। মাস্কুরার পক্স হওয়ার কারণে ও গ্রামে চলে গিয়েছিল, আজই ফিরেছে। প্রিন্সিপাল ওকে ডেকে ওর ফোন নাম্বার  নিয়ে ওই ভদ্রলোককে মেল করেন।তখন ভদ্রলোক মাস্কুরাকে ফোন করে আমার নাম্বার নিয়ে আমাকে ফোন করেছেন। অনেক কথা হল। বললেন আপনি খেয়াল রাখবেন, ও যেন মন দিয়ে পড়াশোনা করে, ফাস্ট বেঞ্চে বসে, ভাল পোশাক কেনে, একটা ঘড়ি কেনে এবং দুধ,ফল ইত্যাদি নিয়মিত খায়।

    আমি কিছুক্ষণের জন্য ভাষা হারিয়ে ফেললাম, আমার সামান্য একটা লেখা একটি মেয়ের রূপকথার মত ভাগ্য বদলে দিল! আল আমিন মিশন তাদের ছাত্রী  মাস্কুরার এই কাহিনী চারিদিকে প্রচার করতে থাকে। ও রাতারাতি কলেজে  সেলিব্রিটি হয়ে ওঠে। যারা ওর সস্তার পোশাক ও হিজাব দেখে অবজ্ঞা ভরে তাকাত, তারা নিজেরাই এসে বলে, কিছু দরকার হলে আমাদের বোলো। প্রসঙ্গত জানাই আমার এই লেখাটি বাংলা দেশের ৯/১০ জায়গায় পুনঃ প্রচারিত হয়েছিল। এটা আমি পরে গুগুল সার্চ করে জেনেছিলাম।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
ভদ্রলোকের পরিচয়টাও দেওয়া হয়নি। ওনার নাম আলি কাজি।উনি প্রবাসী বাঙ্গালি। ক্যানবেরার একটি ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেন। মাস্কুরাকেই শুধু নয়, জাতিধর্ম নির্বিশেষে উনি মেধাবী দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের আর্থিক সাহায্য করে থাকেন। মাস্কুরার কাছে জেনেছি আমেরিকা থেকে এক ভদ্রলোক ওর জন্য কলেজে ১৫০,০০০/= (দেড় লাখ) টাকা পাঠিয়ে ছিলেন। মাস্কুরার ইচ্ছায় প্রিন্সিপাল সেই  টাকা কলেজের দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। মাস কয়েক পরে আমার মেসেঞ্জারে একটি মেসেজ দেখতে পাই, ইংল্যান্ডের সুইনডন থেকে পায়েল সরকার নামে একটি মেয়ে লিখেছেন, আমি যদি খুব ভুল না করি, মাস্কুরার  কাহিনীটি আপনি লিখেছেন। ভুল করলে ক্ষমা করবেন। মেসেজটি পুরনো হলেও  আমিই যে মাস্কুরার কাহিনী লিখেছি, ওকে জানাই এবং সেইসঙ্গে এটাও জানাই, মাস্কুরার সমস্ত দায়িত্ব ক্যানবেরার এক প্রবাসী বাঙালি অধ্যাপক নিয়েছেন। তারপরেও পায়েল লেখেন, আমি সবটা পারতাম না, কিছুটা নিতাম।

    মাস্কুরা ২০২১ সালে এম বি বি এস পাশকরে আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করে নেয়। আমি ওকে বকাবকি করলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। দুবছর পর এই ২০২৩ শে ১৪ মার্চ হঠাৎই মাস্কুরার ফোন পেলাম। আমি এবং আলি কাজি দুজনেই এখন ওকে বিয়ে করতে না করেছিলাম, ওর উচ্চ শিক্ষায় ব্যঘাত ঘটতে পারে এই ভেবে। তাই ও প্রতিজ্ঞা করেছিল ভাল রেজাল্ট করে  আমাদের দেখাবে। ও এবার নেট পিজি দিয়ে ছিল। আজই রেজাল্ট আউট হয়েছে।আড়াই লাখের ওপর স্টুডেন্টদের মধ্যে ও ৪,৩০০ র‍্যাঙ্ক করেছে। সেটা জানাতেই ও আজ আমাকে ফোন করেছে। মনোযোগ নষ্ট হবে বলে ও গত ছ’মাস বাড়ির সঙ্গেও যোগাযোগ  রাখেনি। মাস্কুরা মেডিসিন নিয়ে পড়তে চায়। এটাই  আমার কাজের বড় সাফল্য। আমি মেয়েদের মধ্যে এই জিদ, এই ইচ্ছাশক্তি দেখতে চাই। আনন্দে চোখে জল এসে গেল। এভাবেই আমাদের সমাজের পিছিয়ে থাকা পরিবারের অবহেলিত কন্যা সন্তানেরা একদিন সম্পূর্ণ আকাশ আলোয় ভরিয়ে তুলবে।

    এখন রোজই সংবাদ মাধ্যমে ‘তিন তালাক’ এর খবর থাকছে। আগেই বলেছি, সবই হচ্ছে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য। আমার একটা বিষয় খুব  খারাপ লাগছে, বামেরাও তালাক আইনের সংস্কার চাইছে না। ১১ মে সুপ্রিমকোর্টে এই মামলার শুনানি শুরু হবে। তাই বিভিন্ন সংগঠন একত্রিত হয়ে ৩০ এপ্রিল প্রেসক্লাবে একটি প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করে। এখনে প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গাঙ্গুলি, তনভির, ওসমান, কাজি মাসুম আখতার ও আমি উপস্থিত ছিলাম। সবার বক্তব্যে একটা দাবিই উঠে আসে, তাৎক্ষণিক তিন তালাক বন্ধ  করতে হবে, কোরানে এই রকম তিন তালাকেকের কোনো উল্লেখ নেই। এই সময় তিন তালাক নিয়ে সংবাদপত্রে আমিও আমার যুক্তিগুলি আর্টিকেলের মাধ্যমে তুলে ধরতে থাকি। ২০১৭ র ১০ মে  আনন্দবাজার অনলাইনে ‘শাপমুক্তির অপেক্ষায় শীর্ষ আদালতের দিকে তাকিয়ে দেশের মুসলিম মেয়েরা’ শিরোনামে একটি আর্টিকল প্রকাশিত হল। আমাদের রাজ্যে তাৎক্ষণিক তালাক বন্ধের দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন যে আন্দোলন করছিল, তাদের নিজেদের মধ্যে সবার সদ্ভাব ছিল না। তাই আমার এই আর্টিকেলটি পড়ে অধ্যাপিকা আফরোজা আমাকে লিখেছিল, দিদি আপনি খুব ব্যালেন্স করে লিখেছেন। ৭ জুন আজকাল এ লিখলাম ‘তাৎক্ষনিক তিন তালাক বন্ধ করা আদালতের মাধ্যমেই সম্ভব’। ২৬ জুন ইদ নিয়ে লিখলাম, ‘খাবার নয়, ইদির দিকেই বেশি নজর থাকে  ছোটদের’। এইভাবে একের পর এক আর্টিকেল লিখতে থাকলাম বিভিন্ন সংবাদপত্রে ও ছোট বড় পত্রিকায়। এই বছরই(২০১৭)  মুসলিমদের নিজস্ব সংবাদপত্র হিসেবে ‘দিন দর্পণ’ আত্মপ্রকাশ করে এবং আমাকে লেখার জন্য অনুরোধ  করা হয়। আমি কয়েকমাস লিখে ওদের ব্যবহার ভাল না লাগায় লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।

     খান সাহেবকে নিয়মিত কলকাতা চেকআপে নিয়ে যেতে হয়। সেদিনও সকালে ওনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে  সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা পোস্ট দিলাম,  আমি আজ কলকাতা যাচ্ছি। রওনা হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই তনভির মেসেজ করল, দিদি দেখা হবে। আমি কিছু বুঝলাম না। কোলাঘাটে চা খেতে নেমে ওকে ফোন করে জানলাম, ও এখন কলকাতার পথে। আজ সুপ্রিমকোর্ট ইসরত জাহানদের মামলার রায় দেবে। রায় যদি আমাদের পক্ষে যায়, তাহলে সন্ধ্যাবেলা একটি টিভি চ্যানেলের টক-শোতে অংশগ্রহন করবে, রাতের ফ্লাইটে  ভিয়েতনাম রওনা হবে। আজকের রায়ের বিষয়টি আমার মাথা থেকে একেবারে বেরিয়ে গেছল। খান সাহেবকে কলকাতা নিয়ে আসার বিষয়টি আমার কাছে এতটায় গুরুত্বপূর্ণ যে অন্যকিছু নিয়ে ভাবার অবকাশ ছিল না। ওনাকে নিয়ে আসার জন্য প্রথম কাজ ওনাকে রাজি করানো, কে সঙ্গে যেতে পারবে? সেটা ঠিক করা, তারপর ড্রাইভার ঠিক করা। এর পরের চিন্তা রিপোর্ট কী বলবে?

      যাইহোক সবরকম চিন্তা মাথায় নিয়ে আবার রওনা দিলাম। পার্কস্ট্রিটে ডাঃ সুচন্দ দাসের ক্লিনিকে পৌঁছে প্রথমেই ডাক্তার দেখিয়ে ওনার ব্লাড দেওয়া হয় টেস্টের জন্য। তারপর সারাদিন অপেক্ষা করা। রিপোর্ট তৈরি হলে, বিকেলে ডাক্তার সেই রিপোর্ট দেখে এবং আমাদের সঙ্গে কথা বলে প্রেসক্রি্পশন লেখেন। উনি বিরক্ত হয়ে  যান, কিন্তু উপায় তো নেই। সেদিনও ব্লাড দিয়ে অপেক্ষা করছি আর ভাবছি, কী হবে? এমন সময় আমাদের সহযোদ্ধা ওসমান মল্লিকের ফোন পেলাম, দিদি রায় আমাদের পক্ষে গেছে, তাই বিকেল চারটের সময় প্রেসক্লাবে প্রেস কনফারেন্স রেখেছি। আপনি তো কলাতায় আছেন, এই কনফারেন্সে আপনাকে যোগ দিতাই হবে। কিন্তু চারটে থেকে পাঁচটা, এই সময়ের মধ্যেই তো ডাক্তার ওনার রিপোর্ট ও ওনাকে দেখবেন।  আমার পক্ষে কেন যাওয়া সম্ভব নয়, ওকে বুঝিয়ে বললাম। কলকাতায় থেকেও কনফারেন্সে যোগ দিতে পারলাম না বলে একটু খারাপ লাগছিল।

     আরও কিছু সময় পরে, দুপুরের দিকে সুপ্রিমকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গাঙ্গুলির ফোন এল। বললেন, আপনাকে আসতেই হবে, দেখুন না চেষ্টা করে। ডাঃ দাসের সঙ্গে ধিরে ধিরে সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মেয়ে ইংল্যান্ড  থেকে ফোন করলে উনি যদি কোনও কারণে রিসিভ করতে না পারেন,প রে রিং ব্যাক করেন এবং সবসময় ভরসা দেন, চিন্তা করবেন না, আমি তো আছি। আজ আমি কনফারেন্সে যাওয়ার শেষ চেষ্টা করার জন্য ওনার চেম্বারে ঢুকে সবকথা বললাম। শুনে উনি বললেন, আপনি যান, আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব।
যেতে আর কোনও অসুবিধা থাকল না। ছোটভাইকে ওনার কাছে রেখে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। কনফারেন্স ভালই হল। প্রেসক্লাব থেকে যখন ডঃ দাসের ক্লিনিকে ফিরছি, অনলাইন আনন্দবাজারের সম্পাদক অঞ্জন ব্যানারজির ফোন এল, দিদি, সুপ্রিমকোর্টের রায়ের ওপর আজ একটা লেখা দিতে হবে। বললাম, আমি তো এখন কলকাতায়!- আপনাকে টিভির খবরে দেখেই তো বলছি।–আমার ফিরতে রাত হবে।– সে যাইহোক, আপনার লেখা চাই।

     খান সাহেবকে ডাক্তার দেখিয়ে রাত সাড়ে আটটায় বাড়ি ফিরে যাবতীয় কাজ গুছিয়ে, রান্না করে, ওনাকে খাইয়ে, নিজে খেয়ে ডেক্সটপ খুলে বসেছি। রাত দুটোতে ‘শীর্ষ আদালতের রায়ে উৎফুল্ল মুসলিম মহিলারা’ লেখাটি শেষ করে অঞ্জনকে মেল করে বিশ্রামে যাই। পরদিন সকাল ১০ টাতে আনন্দবাজার অনলাইনে প্রকাশিত হয়। আজকাল, একদিন ইত্যাদি সংবাদপত্রেও এই বিষয়ে লিখতে থাকি।  (ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments