জ্বলদর্চি

বৃক্ষপূজা /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৭২
বৃক্ষপূজা

ভাস্করব্রত পতি

গাছকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করার রেওয়াজ পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম গ্রামাঞ্চলে দেখা যায়। এ এক ধরনের লৌকিক উৎসব। আসলে বৃক্ষ যখন ভক্তি আর শ্রদ্ধার মিশেলে সম্মানিত হয় তখন তা 'বৃক্ষপূজা' হিসেবে পরিগণিত হয়। বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গাছ বিভিন্ন উপচারে পূজিত হয়। যা আসলে এক বিচিত্র সংস্কৃতি, বিচিত্র উৎসব। ড. প্রদ্যোত কুমার মাইতি লিখেছেন, "বাংলাদেশে লৌকিক পূজাচারের মধ্যে বৃক্ষপূজা অন্যতম। অতি সুপ্রাচীন কাল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির মধ্যে বৃক্ষপূজা প্রচলিত। ভারতবর্ষে সিন্ধু সভ্যতার যুগেও বৃক্ষপূজা প্রচলিত ছিল, তা সুধিসমাজ কর্তৃক স্বীকৃত। বর্তমান কালে ভারতবর্ষের সর্বত্রই বৃক্ষপূজার প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশে বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে বৃক্ষপূজার বহুল প্রচলনের ফলে মনে হয়, এখানেও সুপ্রাচীন কাল থেকে বৃক্ষপূজা চলে আসছে। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান ও সাহিত্য থেকে জানা যায়, ভারতবর্ষে বৃক্ষপুজার শুরুতেই সব রকমের বৃক্ষ বা উদ্ভিদ পূজিত হত না। বিশেষ বিশেষ বৃক্ষাদি প্রথম পূজিত হত যেমন —অশ্বত্থ, নিম, বট, বেল, কাঁঠাল ইত্যাদি' । অবশ্য ভবিষ্য পুরাণে এক বিস্তৃত তালিকা পাওয়া যায় -- অশ্বত্থ, বট, অশোক, পদ্ম, দুর্বা, জাম, নিম, বকুল, বেল, তুলসী প্রভৃতি। এই সকল বৃক্ষাদির সঙ্গে কোনো না কোনো দেবদেবীর ঘনিষ্ঠতার কথা জানা যায়।" 

ধান গাছ হল দেবী লক্ষ্মী। মকর সংক্রান্তির সময় 'ক্ষেত বাড়ানো' উপচারে ধানগাছের পূজা করা হয়। লক্ষ্মী পূজার সময় ধানের শিষ লাগবেই। পৌষ পার্বণ আসলে ধানের পূজা বলা চলে। আবার ধানের সঙ্গে সম্পৃক্ত নল সংক্রান্তি। নলগাছকে নিয়ে পূজা করা হয় নল সংক্রান্তিতে। মূলতঃ ধানের সাধভক্ষনে বৃক্ষ পূজাতে দরকার নল সহ অন্যান্য গাছ। শিষযুক্ত নলগাছে প্রথমে 'বরোজ' বাঁধতে হয়। এই বরোজ বাঁধতে গেলে প্রয়োজন বড়সড় পাতা। একাজে ব্যবহার করা হয় বোড় পাতা বা বাজবরণ গাছের পাতা। সেই পাতায় একটা বিশেষ মিশ্রন মুড়ে নতুন পাট দিয়ে বাঁধতে হয় নলগাছে। প্রথমেই সংগ্রহ করতে হয় কালমেঘ, কাঁচা হলুদ, বনকেঁউ, ঘেঁটু পাতা, চিংড়ি মাছ এবং নলগাছ। কোথাও কোথাও নল বা সরকাঠির সাথে বোড় গাছের পাতায় মুড়ে শালুক ফুল, নিম, হলুদ, আদা, কেতকী পাতা, কালোমেঘ, বেলপাতা, সিঁদুর সহযোগে মিশ্রন করে বাঁধা হয়। এসব দিয়েই 'বরোজ' বাঁধতে হয়। এই 'বরোজ' বাঁধার জন্য বেছে নেওয়া হয় গ্রামের কোনো মোড়ল বা মক্কেল শ্রেনীর বাসগৃহ। মূলতঃ সন্ধ্যার পরই একাজে জড়ো হতেন গ্রামের মানুষ। প্রায় তিন চার ঘন্টা ধরে চলতো তা। সেইসাথে ঐ মোড়লের বাড়িতে চলতো খাওয়া দাওয়া। ঐ মোড়লই খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এ কাজের সময় ঘনঘন হরিধ্বনি দেওয়া বাধ্যতামূলক। এভাবেই কথাবার্তা, চিৎকার, খাওয়া দাওয়ার মাধ্যমে শেষ হত নলগাছে বরোজ বাঁধার কাজ। হরিধ্বনির সাথে শাঁখ বাজানোর রেওয়াজ রয়েছে।

অশ্বত্থনারায়ণ ব্রতের মাধ্যমে পূজা করা হয় অশ্বত্থ গাছকে। এই পূজার মূল উপকরণ হল ৫ টি অশ্বত্থ পাতা। এর মধ্যে ১ টি পাকা পাতা, ১ টি কাঁচা পাতা, ১ টি কচি পাতা, ১ টি শুকনো পাতা এবং ১ টি ঝুরঝুরে ছেঁড়া পাতা রাখতে হয়। এরকম পাঁচ ধরনের অশ্বত্থ পাতা মাথায় নিয়ে ব্রতিনী প্রতিদিন সকালে পুকুরে গিয়ে পাঁচবার ডুব দেয়। এরপর পুকুর থেকে ভেজা গায়ে উঠে এসে অশ্বখ গাছের গোড়ায় এক ঘটি জল ঢেলে প্রনাম করে আর এই ছড়া আওড়ায় -- "পাকা পাতাটি মাথায় দিলে / পাকা চুলে সিন্দুর পরে। / কাঁচা পাতাটি মাথায় দিলে / কাঞ্চন মূর্তি হয়। / কচি পাতাটি মাথায় দিলে / নব কুমার কোলে হয়। / শুকনো পাতাটি মাথায় দিলে / সুখ-ঐশ্বর্য বৃদ্ধি হয়। / ঝুরঝুরে পাতাটি মাথায় দিলে / হীরে মুক্তোর ঝুরি পায়। / উজাইতে পারিলে ইন্দ্রের শচী হয়। / না পারিলে ভগবানের দাসী হয়। / সুখ হয়, সম্পদ হয়, স্বস্তি হয়। /  সাত ভাইএর বোন হয়"। 

সাধারণতঃ 'অরণ্যষষ্ঠী' পালিত হয় অশ্বত্থ গাছের গোড়ায়। জৈষ্ঠ্যর শুক্লা ষষ্ঠীতে পিটুলি দিয়ে কালো বেড়াল ও কঙ্কন তৈরি করে ৫ থেকে ৯ ধরনের ফল (বিজোড় সংখ্যায়) দিয়ে 'বাটা' সাজানো হবে প্রথমে। এর মধ্যে করমচা রাখতেই হয়। প্রত্যেকের হাতে থাকবে থালা। তাতে থাকবে ফল। ৭ টি পান, ৬ টি সুপারি, আমপাতা, বাঁশপাতা, হলুদে ছোপানো নেকড়ায় জড়িয়ে ৬ টি হলুদে ছোপানো সূতোয় বাঁধা হবে। একে বলে "ষাট সূতা"। চির সবুজ তথা চিরকাল সতেজতার লক্ষ্যে ১০৮ গাছা দূর্বা রাখার নিয়ম আছে কোথাও কোথাও। রাখা হয় তালপাতার পাখাও। সাধারণত আপদ বিপদ দূরে ঠেলে চারিদিকে শান্তির কামনায় তা দিয়ে বাতাস করে উচ্চারিত হয় ছড়া --- "জ্যৈষ্ঠ মাসে অরণ্য ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট / শ্রাবণ মাসে লোটন ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট / ভাদ্র মাসে মন্থন ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট / আশ্বিন মাসে দুর্গা ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট / অঘ্রাণ মাসে মূলা ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট / পৌষ মাসে পাটাই ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট / মাঘ মাসে শীতল ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট / চৈত্র মাসে অশোক ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট / বারো মাসে তেরো ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট"। এই তিনবার 'ষাট' বলা হয়, দীর্ঘায়ু কামনার জন্য।

অশ্বত্থ গাছের মতো বট গাছকেও দেবতা রূপে পূজা করা হয়। সাধারণ মানুষ পুণ্য লাভের জন্য অশ্বত্থ গাছের পাশাপাশি বট গাছও লাগিয়ে থাকেন। বট গাছের সঙ্গে কৃষ্ণের ঘনিষ্ঠতা মেলে। বট গাছের সঙ্গে নাকি ষষ্ঠীদেবী, লক্ষ্মী, ব্রম্ভা, কুবেরের যোগ রয়েছে। ষষ্ঠীদেবী নাকি একসময় বট গাছের গোড়ায় পূজিতা হতেন। চণ্ডীমঙ্গলে আছে, "বটতরু রাখিল ষষ্ঠীর ধাম/ মহাতরু রাখিল জন বিশাম / মূল বান্ধিবারে আসিল থৈকর"। বটের ডাল এবং ফল পিটুলি দিয়ে এঁকে সূতিকা ষষ্ঠীর পূজায় ষষ্ঠীজ্ঞানে পূজা করা হয়। জৈষ্ঠ্য মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে সাবিত্রী ব্রততে বট গাছকে পূজা করা হয়। রামায়ণ এবং উত্তর রামচরিতে বটকে বলা হয় 'অক্ষয় বট'। প্রতি শনিবার বিহার, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ এবং গুজরাটের মহিলারা বটকে সাবিত্রী জ্ঞানে পূজা করেন। 

দুর্গাপূজায় বিল্বতলে দেবীর বোধন সহ পূজা করা হয় ‘নবপত্রিকা'র। এই নবপত্রিকা আসলে নয়টি গাছের মিশ্রিত রূপ। কেটে নেওয়া বেল গাছের ডাল এবং নবপত্রিকা সহ পূজাস্থানে প্রবেশ করতে হয়। তখন শ্বেত অপরাজিতা লতিকা এবং হলুদ রঙের বন্ধনী দিয়ে বেঁধে পীঠাসনে স্থাপন করতে হয়। এই যে 'নবপত্রিকা'— একে আমরা বলে থাকি 'কলাবউ'। এই কলাবউ হল মূলতঃ সমৃদ্ধির প্রতীক। একটি ছোট কলাচারাকে নতুন শাড়ি পরিয়ে ঘোমটা পরা বউয়ের মত করা হয়। দাঁড় করিয়ে রাখা হয় গণেশের পাশে। আমরা এঁকে 'গণেশের বউ' বলে ভুল করি। এঁর প্রকৃত নাম ‘নবপত্রিকা’। কিন্তু গণেশের বউয়ের নাম হল 'পুষ্টি'। এই কলাবউ বা নবপত্রিকা হল দেবী দুর্গার অন্য একটি রূপ। রঘুনন্দন তাঁর দুর্গোৎসব তত্ত্বতে এই নবপত্রিকা সম্পর্কে লিখেছেন— “কদলী দাড়িমী ধান্যঃ হরিদ্রা, মানকংকচুঃ / বিশ্বাশোকৌ জান্তী চ বিজ্ঞেয়া নবপত্রিকাঃনবপত্রিকাঃ"। 
অর্থাৎ, এই নবপত্রিকাতে রয়েছে কদলী (কলা), হরিদ্রা (হলুদ), মান, দাড়িম্ব (ডালিম), কচু, অশোক, বিল্ব (বেল), ধান্য (ধান) এবং জয়ন্তী গাছের পাতা, কাণ্ড, ফল ইত্যাদি। সাথে থাকে শ্বেত অপরাজিতা লতার বন্ধন। এই নয়টি বৃক্ষের সম্মিলিত অবস্থানই আমাদের আলোচিত 'নবপত্রিকা'। এই নবপত্রিকার আরাধনা আসলে শস্যদেবীর আরাধনা। পণ্ডিতদের মতে শষ্যদেবী দুর্গার অন্য নামই তো শাকম্ভরী। এই নয়টি গাছের সমষ্টি 'নবপত্রিকা' আসলে মা দুর্গারই প্রতিনিধি বা অন্য রূপ। এই নয়টি চারার (বৃক্ষ) প্রত্যেকটির অধিষ্ঠাত্রী এক একজন দেবী। তাঁরা হলেন— কদলী—ব্রহ্মাণী / হরিদ্রা—দুর্গা / জয়ন্তী—কাৰ্ত্তিকী / মান—চামুণ্ডা / অশোক— শোকরহিতা / কচু -- কালিকা / দাড়িম্ব—রক্তদন্তিকা / বিশ্ব – শিবা / ধান—লক্ষ্মী। অনেকের মতে, নবপত্রিকা আসলে ‘কুলবৃক্ষ', দেবীর নানা শক্তির প্রতীক। যোগিনীরা সবসময় নাকি কুলবৃক্ষতে বসবাস করেন। তাই দেবী এখানে নবপত্রিকাবাসিনী। 

ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশী তথা পার্শ্ব একাদশীর দিন সীমান্তবর্তী এলাকায় করম গাছের ডাল প্রতীকে করম রাজার পূজার প্রচলন রয়েছে। মূলতঃ মাহাতো, কুড়মি, ভূমিজ, কোল, দেশওয়ালী, ওঁরাও, ভুক্তা, লোধা, বীর, মাহালী, মাঝি, কোড়া, হড়, খেড়িয়া, ভুঞ্যা, মুণ্ডাদের কাছে এই উৎসব দারুন জনপ্রিয়। তেমনি ডোম, কুমার, বাগাল, গোয়ালা, ঘোড়ই, হাড়ি, বাউরী, কামার, মুচি, তাঁতিদের মধ্যেও প্রচলিত আছে। মূলতঃ শষ্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং নানা অপদেবতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই করম পূজা করা হয়। তাই এটি সম্পূর্ণ কৃষি উৎসব হিসেবেই পরিচিত। 

করম পূজার ৭ থেকে ১১ দিন আগে কুমারী মেয়েরা নদী বা খাল থেকে বালি মাটি সংগ্রহ করে আনে। সেই বালিমাটির ওপর ছড়িয়ে দেওয়া হয় পঞ্চশষ্য। পুঁতে দেওয়া হয় হলুদ ও ধানের চারা। কোথাও কোথাও গ্রামের ছোট ছোট মেয়েরা নতুন ঝুড়ি (টুপা) বা ডালাতে ১১ রকমের শস্যবীজ রেখে দেয়। এগুলোর অঙ্কুরোদগম হয়ে যাওয়াকে বলে 'জাওয়া' স্থাপন। 'জাওয়া' শব্দের অর্থ হল Germination। এবার জঙ্গল থেকে ধামসা মাদল বাজিয়ে মহা সমারোহে নিয়ে আসা হয় করম ডাল। 

প্রথমেই গভীর জঙ্গলে গিয়ে করম শাখা নির্বাচনের পর শাখা দুটিকে বরণ করতে হবে গানের সুরে। কচিকাঁচা কিশোরীদের কন্ঠে অনুরণিত হয় জাওয়া করমের সুরেলা গান। সেই গান করতে করতে কিশোরীরা করম ডালের গায়ে হলুদ অথবা লাল সূতা বাঁধবে। সিঁদুরও মাখিয়ে দিতে হয়। এখন করমের ডাল দুটি কাটতে হবে। একজন কিশোর তা কাটে। এগুলির নিচের অংশে লাল গামছা জড়িয়ে ফেলা হয়। তারপর সবাই মিলে সেগুলিকে নিয়ে আসবে গ্রামের থানে -- যেখানে করম পূজার আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে ইতিমধ্যেই গ্রামের প্রধান ‘মাহাতো' এবং ‘পাহানরা' করম পূজার যাবতীয় ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রেখেছে। পাহানের যিনি সহকারী থাকেন, তিনি এই ‘পূজার’ করম শাখা দুটি প্রাঙ্গণের নির্দিষ্ট বেদীতে পুঁতে দেওয়ার কাজটি সম্পন্ন করেন। এরপর চলে নির্দিষ্ট উপচারে পূজা পদ্ধতি। প্রথমে পাহান একটি ফুল দিয়ে আরাধনা করে গ্রাম দেবীকে। আসলে তাঁকে সন্তুষ্ট না করলে চলেনা। তারপর আবারো কিছু ফুল ও তুলসীতে সিঁদুর মাখিয়ে করম শাখা দুটির নিচের অংশে দিয়ে করমের আরাধনা করা হয়। গোল হয়ে থাকা ভক্তদের সকলের হাতে একটি করে ফুল দিলে তাঁরা তা প্রনাম করে বেদীর দিকে ছুঁড়ে দেয়। পূজোর শেষে শুরু হয় ব্রতকথা। ধরম ও করম এই দুই ভাইয়ের কাহিনী নিয়েই ব্রতকথা এগিয়ে চলে।

বৈশাখের প্রথম দিন থেকে সারা মাস জুড়ে বাড়ির তুলসীতলায় দেওয়া হয় 'বসনঝারা'। নতুন কেনা মাটির ভাঁড়ে ফুটো করে সেটা ঝোলানো থাকে বেল, অশ্বত্থ, মনসা, বট, তুলসী গাছের ওপরে। এই ভাঁড়ের ফুটোতে দূর্বাঘাস গোঁজা থাকে। ভাঁড়ে জল ঢাললে সারাদিন ফোঁটা ফোঁটা করে জল পড়ে গাছে। একে বলে 'বসুন্ধরা'। গ্রীষ্মকালীন পরিবেশে এইসব বৃক্ষকে বাঁচিয়ে রাখতে এভাবেই জলদান করে পূজা করার রেওয়াজ লক্ষ্য করা যায়। নারায়ণ তথা বিষ্ণুর প্রিয় এই তুলসী। তাই একে বলা হয় বিষ্ণুপ্রিয়া। বৈষ্ণবদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র বৃক্ষ।  শ্রীকৃষ্ণের অন্যতম গোপিনী ছিলেন তুলসী। প্রতিটি হিন্দু পরিবারে রয়েছে তুলসীতলা তথা হরি মন্দির। সেখানে সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বেলে ধূপ দেওয়া হয়। পুণ্যিপুকুর ব্রততে এই তুলসী গাছে জল ঢেলে বলা হয়, "তুলসী তুলসী নারায়ণ / তুমি তুলসী বৃন্দাবন / তোমার মাথায় ঢালি জল / অন্তিমকালে দিও স্থল"। 

শিবের সঙ্গে বেল গাছের গভীর সম্পর্ক। কথিত আছে শিবের বরে লক্ষ্মীর অঙ্গ থেকে এর সৃষ্টি। মানুষের বিশ্বাস বেল গাছকে পূজা করলেই শিবপূজা সম্ভব। যেসব গৃহস্থের উঠোনে বেলগাছ আছে সেখানে ভক্তিভরে জল ঢালা হয় প্রতি দিন। চণ্ডীমঙ্গলে আছে, "শঙ্কর পূজিত রাখিল বিল্ববন"। মনসা গাছ তথা সিজ গাছ পূজা করা হয় দেবী মনসা জ্ঞানে। আষাঢ় মাসের পঞ্চমী তিথিতে এই স্নুহী বৃক্ষ পূজা করা হয়। আবার ঘেঁটু গাছকে পূজা করা হয় মনসার স্বামী ঘন্টাকর্ণ হিসেবে। কথায় বলে সেওড়া গাছে নাকি ভূত বসবাস করে। তবে বনদুর্গার পূজায় সেওড়া গাছের তলায় পূজার আয়োজন করা হয়। ভাদ্র মাসের শুক্লা দ্বাদশীতে ইঁদ পূজায় শালগাছকে পূজা করা হয় বহু জায়গায়। এটি আসলে ইন্দ্রধ্বজ পূজা। 

শিব এবং বিষ্ণুর পূজায় প্রয়োজন হয় আমলকি পাতা। কথিত আছে পার্বতী এবং লক্ষ্মীর চোখের জল থেকেই নাকি আমলকি গাছের সৃষ্টি। শিবরাত্রির দিন এই গাছে লাল ও হলুদ সূতো দিয়ে জড়িয়ে পূজা করা হয়। চৈত্র মাসের নীল পূজায় নিম গাছের পূজা করা হয়। কোথাও কোথাও এই নিম গাছকে দেবী শীতলার অধীষ্ঠান ক্ষেত্র বলে কল্পনা করা হয়। তেমনি ঢেলাই চণ্ডীর অধীষ্ঠান ক্ষেত্র ভাবা হয় খেজুর গাছকে। কোনও একসময় খেজুর গাছকে মাটির ঢেলা নৈবেদ্য দিয়ে পূজা করা হতো। পরবর্তীতে তা চণ্ডী দেবীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কুলকুলতি ব্রত পালনে কুলগাছকেই মহিলারা কুলদেবতা হিসেবে পূজা করে। প্রতি দিন সন্ধ্যায় এই গাছের তলায় প্রদীপ জ্বালানো হয়। আবার ক্ষেত্র ঠাকুর এই কুল গাছে অবস্থান করে বলে বিশ্বাস। এক্ষেত্রেও কুলগাছ পূজিত হয়। গাছের তলায় দিয়ে আসা হয় পায়েস এবং ছাতু। 
দূর্বা একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গাছ। কথিত আছে সমুদ্র মন্থনের সময় বিষ্ণুর লোম থেকে সৃষ্টি হয়েছিল দূর্বার। প্রতিটি পূজায় দূর্বা অতি প্রয়োজনীয়। ভাদ্র মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে মহিলারা পালন করেন দূর্বাষ্টমী ব্রত। দূর্বা যেমন শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে নিজেকে বিস্তার করে, তেমনি অক্ষয় অমর তথা সৌভাগ্য পেতে দূর্বার পূজা করা হয়। পৌষ সংক্রান্তির দিন বাঁশ পূজা করা হয়। নতুন বাড়ি তৈরির সময় একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাঁচা বাঁশ কেটে বাড়ির সামনে পোঁতা হয়। এটি আসলে বাস্তু দেবতার পূজার উপচার। মালদায় গম্ভীরা পূজায় বাঁশ পূজা পায়। 'মানকুমার' নামক লৌকিক দেবতার পূজা করা হয় দুখণ্ড বাঁশকে দেবতার প্রতীক হিসেবে। 

মাঘমণ্ডল ব্রততে কলাগাছকে সূর্যের প্রতীক হিসেবে কল্পনা করে পূজা করা হয়। পুকুরের ধারে কলাগাছকে পুঁতে সিঁদুর লাগিয়ে ফলমূল নৈবেদ্য দেয়। গন্ধেশ্বরী পূজায় লক্ষ্মীজ্ঞানে কাজে লাগে কলাগাছ। দুর্গা পূজায় কলাবউ তথা নবপত্রিকা পূজিত হয় দুর্গার প্রতীক হিসেবে। দুর্গাপূজায় বিল্বতলে দেবীর বোধন সহ পূজা করা হয় ‘নবপত্রিকা'-র। এই নবপত্রিকা আসলে নয়টি গাছের মিশ্রিত রূপ। কেটে নেওয়া বেল গাছের ডাল এবং নবপত্রিকা সহ পূজাস্থানে প্রবেশ করতে হয়। তখন শ্বেত অপরাজিতা লতিকা এবং হলুদ রঙের বন্ধনী দিয়ে বেঁধে পীঠাসনে স্থাপন করতে হয়। এই যে 'নবপত্রিকা'— একে আমরা বলে থাকি 'কলাবউ'। এই কলাবউ হল মূলতঃ সমৃদ্ধির প্রতীক। একটি ছোট কলাচারাকে নতুন শাড়ি পরিয়ে ঘোমটা পরা বউয়ের মত করা হয়। দাঁড় করিয়ে রাখা হয় গণেশের পাশে। আমরা এঁকে 'গণেশের বউ' বলে ভুল করি। এঁর প্রকৃত নাম ‘নবপত্রিকা’। কিন্তু গণেশের বউয়ের নাম হল 'পুষ্টি'। এই কলাবউ বা নবপত্রিকা হল দেবী দুর্গার অন্য একটি রূপ। রঘুনন্দন তাঁর দুর্গোৎসব তত্ত্বতে এই নবপত্রিকা সম্পর্কে লিখেছেন— “কদলী দাড়িমী ধান্যঃ হরিদ্রা, মানকংকচুঃ / বিশ্বাশোকৌ জান্তী চ বিজ্ঞেয়া নবপত্রিকাঃনবপত্রিকাঃ"। অর্থাৎ, এই নবপত্রিকাতে রয়েছে কদলী (কলা), হরিদ্রা (হলুদ), মান, দাড়িম্ব (ডালিম), কচু, অশোক, বিল্ব (বেল), ধান্য (ধান) এবং জয়ন্তী গাছের পাতা, কাণ্ড, ফল ইত্যাদি। সাথে থাকে শ্বেত অপরাজিতা লতার বন্ধন। এই নয়টি বৃক্ষের সম্মিলিত অবস্থানই আমাদের আলোচিত 'নবপত্রিকা'। এই নবপত্রিকার আরাধনা আসলে শস্যদেবীর আরাধনা। পণ্ডিতদের মতে শষ্যদেবী দুর্গার অন্য নামই তো শাকম্ভরী। এই নয়টি গাছের সমষ্টি 'নবপত্রিকা' আসলে মা দুর্গারই প্রতিনিধি বা অন্য রূপ। এই নয়টি চারার (বৃক্ষ) প্রত্যেকটির অধিষ্ঠাত্রী এক একজন দেবী। তাঁরা হলেন— কদলী—ব্রহ্মাণী / হরিদ্রা—দুর্গা / জয়ন্তী—কাৰ্ত্তিকী / মান—চামুণ্ডা / অশোক— শোকরহিতা / কচু -- কালিকা / দাড়িম্ব—রক্তদন্তিকা / বিশ্ব – শিবা / ধান—লক্ষ্মী। অনেকের মতে নবপত্রিকা আসলে ‘কুলবৃক্ষ', দেবীর নানা শক্তির প্রতীক। যোগিনীরা সবসময় নাকি কুলবৃক্ষতে বসবাস করেন। তাই দেবী এখানে নবপত্রিকাবাসিনী।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇



Post a Comment

0 Comments