জ্বলদর্চি

রবীন্দ্র-নৃত্যে লিঙ্গ বৈষম্য/ মিলি ঘোষ

 রবীন্দ্র-নৃত্যে লিঙ্গ বৈষম্য

মিলি ঘোষ


রবীন্দ্রসঙ্গীতে বা যে কোনও গানে কি লিঙ্গ বৈষম্য আছে? আমি তো শুনিনি। 
কেউ যদি গায়, "আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, শুধাইল না কেহ।"
সে ক্ষেত্রে মনের আকুতি নারী পুরুষ ভেদে পৃথক হতে পারে কি ?
   অথবা, "মধুর, তোমার শেষ যে না পাই প্রহর হলো শেষ, ভুবন জুড়ে রইল লেগে আনন্দ আবেশ।"
এ অনুভূতি তো আমার আপনার যে কোনও কারোর। গাইবার সময় একজন পুরুষ শিল্পী আর একজন মহিলা শিল্পীর গায়কী বা প্রকাশ ভঙ্গিমায় পার্থক্য তো থাকে না। 
অথচ নৃত্যে এই ফারাকটা ছিল। আছেও। ছেলেদেরকে এমন ভাবেই নাচতে হবে যাতে বোঝা যায় সে একজন পুরুষ। তার চলন, তার তাকানো, এমন কি নৃত্য ভঙ্গিমাতেও বিস্তর ফারাক রাখা হয় একজন মহিলা শিল্পীর সঙ্গে। এটা হয়ে আসছে বহুদিন ধরে এবং আমাদের চোখ, মন তাতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। 

বেশিরভাগ নাচের স্কুলগুলোতে ছাত্রীদের সংখ্যাধিক্য। ছাত্রের সংখ্যা একজন বা দু'জন। কোথাও কোথাও সেটা শূন্য। এর ফলে কোনও অনুষ্ঠানে পুরুষ চরিত্রের অভাব পূরণ করতে হয় উচ্চতায় বেশি মেয়েদেরকে দিয়ে। আর যদি একজন  দু'জন ছাত্র ভুলক্রমে থেকেও থাকে, যাবতীয় পুরুষ চরিত্রের দায়ভার তাদের ওপরেই বর্তায়। এদের প্রত্যেকেরই পড়াশুনা থাকে। সে'সব সামলে বাড়তি রিহার্সাল এই ছেলেদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। তার সঙ্গে থাকে অনুষ্ঠান চলাকালীন বারবার দ্রুততার সঙ্গে পোশাক বদল। 

আজকাল অভিভাবকরা যথেষ্ট সচেতন। পড়াশুনার সঙ্গে সঙ্গে সন্তানকে গান বা আঁকা শেখানোর দিকে তাঁরা গুরুত্ব সহকারেই নজর রাখেন। মেয়েদের জন্য নাচটাও থাকে। এগুলো সবই এক একটা অপশন। কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে নাচটা ভুলেও নয়। কল্পনাতেও আসে না। এমনিতেই ঘাড়ের কাছে একশোটা পাঠ্য বিষয়ের নিঃশ্বাস। তার মধ্যে এমন উদ্ভট চিন্তাকে প্রশ্রয় দেবার কথা তাঁরা স্বপ্নেও আনেন না। শেখার জিনিসের কি অভাব আছে ? তাই বলে নাচ ? পুত্র সন্তানকে ? ছেলেরা তবলা বাজাক, অসুবিধা নেই। নাচ বিষয়টি ইঁদুর প্রতিযোগিতার বাইরেই রাখা হয়। 

আসলে আমাদের চোখ জন্ম থেকে যা দেখে অভ্যস্ত। তার বাইরে একটা স্টেপ ফেলতেও আমরা রাজি নোই। সমাজের দাগিয়ে দেওয়া নিয়ম। লোকে কী বলবের ভয়। এ'সব নিয়েই মানুষকে বাঁচতে হয়। তার সঙ্গে কিছু বাঁধা গৎ। যা আমাদের মাথায় ফুটো করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সেগুলোই আমরা ইনজেক্ট করি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। এর ফলে ছেলে মেয়ে উভয়েরই মনের ইচ্ছা বা প্রতিভার মূল্যায়ন হয় না। 

ভেতরে ভেতরে কিছু চাহিদাও আমরা তৈরি করে ফেলি। যেমন, মহিলা ডাক্তার হলে যাবার আগে দু'বার ভাবি। সার্জারিটা কোনও ডাক্তারবাবুর হাতেই হওয়া ভালো। আবার পিঠে, পায়েস মা'র মতো কেউ পারে না কি ? সেরকমই মেয়েকে যার কাছে নাচ শিখতে দেব, তিনি যেন শিক্ষক মহাশয় হন। 
নাচ যদি ছেলেরা না'ই শিখল, শিক্ষক পাব কোথায় আমরা ? 

এক ঝাঁক তরুণকে অবশ্য নাচতে দেখা যায় কিছু কিছু জায়গায়। দিব্য নাচছে। চুটিয়ে নাচছে। নাচের জন্য বিদেশ ভ্রমণ করছে। সে সব নামিদামি প্রতিষ্ঠান। এই মুহূর্তে আপনারা যে সব প্রতিষ্ঠানের কথা ভাবছেন, আমিও তাদের কথাই বলছি। 
কিন্তু ওই সমস্ত প্রতিষ্ঠানে নাচ শেখাবার সাধ্য ক'জনের আছে ? দূরত্বটাও একটা সমস্যা বিশেষ।  বাড়ির কাছাকাছি এই ধরনের সুযোগ পাওয়া যায় না বললেই চলে। 
নিতান্তই ব্যক্তিগত মত, একটা শাস্ত্রীয় নৃত্য শেখাটা জরুরী। তারপর যেমন খুশি করতেই পারে। ক্রিয়েটিভ ডান্সারদের মধ্যে বহু আছে, যারা যে কোনও একটা শাস্ত্রীয় নৃত্য শিখেই আসে। 

তবে, কিছু ছেলে আজকাল সাহস দেখাচ্ছে। তারা একক নৃত্যে বা মেয়েদের সঙ্গে দলগত নৃত্যে নিজেকে পুরুষ প্রমাণ করার কোনও রকম চেষ্টা করছে না। কী অসম্ভব শিক্ষার ছাপ তাদের নাচে। প্রতিটি মুদ্রা থেকে অভিব্যক্তি মাধুর্য্যে ভরপুর। গানের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়ে নাচে তারা। কোথাও কোনও ফাঁক নেই। আর আছে নাচের প্রতি তাদের অদম্য ভালোবাসা। তা নাচ দেখলেই বোঝা যায়। 
তারপরেও তাদের শুনতে হয়। এই সোশ্যাল মিডিয়াতেই। ব্যক্তি জীবনে যে কীসের মুখোমুখি হতে হয় তাদের, সে তারাই জানে। এই সোশ্যাল মিডিয়াতেই কয়েকটি নাচের গ্ৰুপ আছে। সেগুলি পরিচালনা করেন দক্ষ নৃত্য শিল্পীরাই। দিনে তিন চারটে ভিডিও পোস্ট হয়। বয়সের কোনও সীমাবদ্ধতা নেই। ছোট ছোট বাচ্চারাও অংশ গ্রহণ করে এবং কী নিখুঁত নৃত্য পরিবেশনা, দেখে অবাক হতে হয়। তারা যে ঠিকঠাক শিখছে তা তাদের উপস্থাপনাই বলে দেয়। এই সব গ্ৰুপে প্রতিযোগিতা হয়, ভিউয়ার্স চয়েজের ওপর। বলাই বাহুল্য যে পুরুষ শিল্পীরা একক নৃত্য পরিবেশন করে তাদের স্থান তলানিতেই থাকে। বিশেষ করে রাবীন্দ্রিক নৃত্যের ক্ষেত্রে। তবে দর্শক হিসেবে আমাদের চোখের আরাম হয়। যে যেমন আরাম পেতে চায়।  

দাগিয়ে দেওয়া সমাজ ব্যবস্থার প্রতিফলন ছাড়া এগুলো আর কিছুই নয়। ছোটো থেকেই আমরা বুঝে যাই, কোন কাজটা ছেলেদের আর কোনটা মেয়েদের। কোনটাতে হাসব ( উপহাস ) কোনটাতে বাহবা দেব। পরিবার, পরিপার্শ্বই ভাবতে শেখায়।  এগুলো তকমা ছাড়া আর কী! নাচ শুধুমাত্র মেয়েরা করবে, তবলাও শুধু ছেলেরাই বাজাবে। আর নাচ মেয়েরা করলেও তা একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত। তারপর আবার নাচ কীসের ? আজকাল যদিও মানসিকতার সামান্য পরিবর্তন চোখে পড়ছে। 
কিছু বাদ্যযন্ত্র তবু আভিজাত্য পায়। গাম্ভীর্যের আড়ালে একটা কুলীন কুলীন ভাব আছে। নাচ, গান, তবলার সে কৌলিন্য কোথায় ? 
'ছোটোবেলায় সবাই যেমন নাচ গান একটু আধটু করে' -- এই ধরনের মন্তব্য অনেক জ্ঞানীগুণীজনও করে থাকেন। ওই একটু আধটু নাচ গানটা যেন খুব সহজ জিনিস। যেন তার জন্য সময় দিতে হয় না। পরিশ্রম করতে হয় না। প্রতিভার প্রয়োজন হয় না। কেউ প্রতিদিন অনুশীলন করলেও বলবে, 'ঘষেমেজে উঠছে'। হ্যাঁ, ঘষতে হয়, মাজতে হয়। নাহলে মরচে ধরে। কোনও কিছুই চর্চা ছাড়া এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। নিজের অজান্তেই একটু একটু করে পিছিয়ে যায়। তবে, গুরু নিতে হয় চিনে। ভুলভাল পদ্ধতিতে বেশি ঘষামাজা করলে ছাল বাকল উঠে যাবার সম্ভবনা থাকে। 

তবে সুখের কথা কিছু আছে। বর্তমানে রাবীন্দ্রিক নাচের প্রসার ও পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। তার অন্যতম কারণ করিওগ্রাফিতে চিন্তার প্রসার ও তার প্রয়োগ। করিওগ্রাফাররা এত ভালো কাজ করছেন, দেখে বিস্মিত হতে হয়। ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে এই কাজ চলছে। কখনও কখনও মিলিত প্রচেষ্টাতেও। যদিও কিছু প্রশ্ন এখনও আছে। আশাকরি সেগুলো অদূর ভবিষ্যতেই কাটিয়ে উঠবেন তাঁরা। এবার শুধু দরকার একটু মনের প্রসার। কোনও কাজকেই নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বেঁধে না রেখে খোলা মনে এগিয়ে আসা। এ'জন্য অভিভাবক থেকে ছাত্রছাত্রী সকলের সহযোগিতা কাম্য।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের বিশাল আবেগের জায়গা। তিনি সেই যুগে নৃত্য পরিচালনা করেছেন। এমনকী নিজে নৃত্যে অংশ গ্রহণ করেছেন। শুধু পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণে 'লহ প্রণাম' না বলে তাঁর আধুনিক মনস্কতার এক শতাংশও যদি আমরা নিতে পারি তবেই তাঁর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠা সম্ভব।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇



Post a Comment

0 Comments