জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প—জাভা (এশিয়া)/ওল্টানো নৌকা /চিন্ময় দাশ

চিত্র-শুভম দাস

দূর দেশের লোকগল্প—জাভা (এশিয়া)
ওল্টানো নৌকা
চিন্ময় দাশ


[পশ্চিম জাভার লেমবেঙ শহরের একটা পাহাড়। মাঝেমধ্যে লাভা উদ্গীরণও হয় সেটা থেকে। সান্দানীজ ভাষায় পাহাড়টার নাম— ‘তাংকুবান পারাহু’। বাংলায় যার অর্থ হোল—ওল্টানো নৌকা। নামটা নেওয়া হয়েছে স্থানীয় একটি লোককথা থেকে। সমাজবিদেরা এই কাহিনীতে সোফক্লিশ-এর বিখ্যাত গ্রীক ট্রাজেডি “অদিপাস রেক্স”-এর ছায়া দেখতে পান। সেই কাহিনীটিই আমাদের আজকের গল্প।]
এই গল্পটা এক নির্বাসিত রাজকুমারীর। মেয়েটির নাম—দায়াঙ সুম্বি। নির্বাসিত কন্যা। সময় কাটে না তার। অনেক ভেবে চিন্তে, বুননের কাজ বেছে নিয়েছে সে। সেলাই ফোঁড়াই করে সময় কাটে তার। 
একদিন বসে সেলাই করছে কন্যা। হোল কী, হাতের সূঁচটি গেল মাটিতে পড়ে। কী করা যায় এখন? সূঁচ কুড়ানো মানে অনেক হ্যাপা! আসন ছেড়ে ওঠোরে। নীচে নামোরে। কোমর বেঁকিয়ে কুড়োওরে। হোলই বা নির্বাসিত! রাজার মেয়ে তো বটে!  নিজেই তো আর সূঁচ কুড়ানো যায় না! 
আসল কথা হোল, মেয়েটি স্বভাবে ভারি আলসে। সূঁচ নীচেই পড়ে রইল। নিজের আসনে গ্যাঁট হয়ে বসে রইলো রাজকন্যে। 
বিড়বিড় করে বলল—হে ঈশ্বর! এক্টুখানি দয়া করো আমাকে। কিছু একটা ব্যবস্থা করে দাও। হলফ করে বলছি, কেউ যদি এসে আমার সূঁচ কুড়িয়ে দেয়, তাকেই বিয়ে করবো আমি। কথা দিলাম তোমাকে। 
কী কপাল রাজকন্যের! সেসময়েই তুমাঙ নামের একটা কুকুর যাচ্ছিল বাড়িটার পাশ দিয়ে। তার কানে গেল কথাটা। সে টুক করে ঘরে ঢুকে পড়ল। সূঁচটা তো মেঝেতে পড়ে ছিল। কুড়িয়ে রাজকন্যের হাতে তুলে দিল।
খানিক সময় গেল সে মেয়ের, ব্যাপারটা বুঝে উঠতে। কিন্তু করবার কিছু নাই। নিজেরমুখে কথা দিয়েছে ঈশ্বরকে। মনে কোন দ্বিধা রাখল না। কুকুরকেই বিয়ে করে ফেলল।
আসলে কিন্তু কুকুরটা ছিল অভিশপ্ত এক দেবকুমার। তবে, সেকথা মেয়েটি জানলো না। 
কিছুদিন গেল। ফুটফুটে একটি ছেলে হোল তাদের। ছেলের নাম রাখা হোল সাঙকুরিয়াঙ।
আনন্দের বন্যা বয়ে গেল বাড়িতে। সারাদিন হইচই। আনন্দ হুল্লোড়। দেখতে দেখতে বড় হয়ে উঠছে ছেলে। রাজকন্যা তাকে অস্ত্র চালাতে শেখায়। তীর-ধনুক চালাতে শেখায়। একদিন বেশ ভালো শিকারী হয়ে উঠল ছেলেটি। 
সাঙকুরিয়াঙ শিকারে বের হলে, তুমাঙকে সাথে নিয়ে যায়। সে তো আর জানে না, এ কুকুরই নয়। অভিশপ্ত এক দেবতা। এমনকি, এই কুকুরই যে তার বাবা, সে কথাও জানে না ছেলেটি। অনেক কাজে লাগে কুকুরটি, তাই সাথে নিয়ে যায়।
একদিন হোল কী, কোন শিকারই পাওয়া গেল না। ঘোরাঘুরিই সার হোল সারা দিন। কী করা যায়? খালি হাতে তো আর ঘরে ফেরা যায় না। 
ছেলেটা করল কী, কুকুরটাকেই মেরে ফেললো। ঘরে ফিরে এলো কুকুরের কলজেটা কেটে নিয়ে।
সব শুনে, আগুন জ্বলে উঠলো রাজকন্যার মাথায়। সোনার ফ্রেমে কাপড় সেঁটে, সেলাই করে সে। সেই ফ্রেমটাই সপাটে বসিয়ে দিল ছেলের মুখে—দূর হয়ে যাও আমার সামনে থেকে। কোন দিন যেন এই মুখ আমাকে দেখতে না হয়। বেরিয়ে যাও বাড়ি থেকে।
গাল বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কপালে হাত চেপে, ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সাঙকুরিয়াঙ। 
দিন যায়। বছর যায়। বছরের পর বছর এই দেশ সেই দেশ ঘুরে বেড়ায় সাঙকুরিয়াঙ। বীর যোদ্ধা হিসাবে ভারি নামডাক হয়েছে এখন তার। দেখতেও হয়েছে ভারি সুপুরুষটি।
একদিন তার নিজের দেশে এসে হাজির হয়েছে সাঙকুরিয়াঙ। যে দেশ থেকে একদিন মা তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। ঘুরতে ঘুরতে বেলা দূপুর। তেষ্টা মেটাতে, একটা ঝরণার কাছে গিয়ে হাজির হোল সে।
জলের কাছে গিয়ে থমকে গেল সসাঙকুরিয়াঙ। জলে হাত দেবে কী, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল সামনের দিকে। অপরূপ সুন্দরী এক মেয়ে সেখানে। ঝরণার জলে দুটি পা ডুবিয়ে বসে আছে। কী সুন্দর চিকন পা দু’খানি। কাঁচের মতো টলটলে জল। কোন মানুষের চরণ তো নয় এ। যেন শ্বেত শুভ্র দুটি মরাল খেলা করছে আপনমনে। 
যুবক বয়স তার। এমন সুন্দর মেয়ে! ভারি ভালো লেগে গেল সাঙকুরিয়াঙের। মেয়েটির দিকে এগিয়ে যেতে, জলে ছায়া পড়ল তার।
চমকে উঠল মেয়েটি। জলের ভিতর এ কার ছায়া! কী অপরূপ দেহখানি। ঘাড় ফিরিয়ে সাঙকুরিয়াঙকে চোখে পড়ল মেয়েটির। তারও ভারি ভালো লেগে গেল ছেলেটিকে। 
মন দেওয়া নেওয়া হোল দুজনের। দুজনেই রাজি দুজনকে বিয়ে করতে। 
মেয়েটি বলল—চলো আমার ঘরে। এখানে একাই থাকি আমি।
দুজনে ঘরের পথ ধরল। মেয়েটি চলেছে আগে আগে। পিছনে সাঙকুরিয়াঙ। 
মেয়েটি কিন্তু আর কেউ নয়। দায়াঙ সুম্বি, সেই নির্বাসিত রাজকন্যা। সাঙকুরিয়াঙের নিজের মা। বিধাতার এমনই খেলা, দুজনের কেউই কাউকে চিনতে পারেনি।
ঘরে ফিরে, মুখোমুখি হয়েছে দুজনে। অমনি আকাশের বাজ ভেঙে পড়ল দায়াঙ সুম্বির মাথায়। হায় ঈশ্বর, এর ডান কপালে যে জ্বলজ্বল করছে একটা কাটা দাগ! আমার নিজের পেটের ছেলে! পোড়া কপাল আমার। কী মহা পাপ করতে যাচ্ছিলাম আমি! 
মুখ ফুটে কিছু বলল না ছেলেকে, বলবেই বা কোন মুখে। মাথা খাটিয়ে একটা বুদ্ধি বার করল দায়াঙ সুম্বি। 
সাঙকুরিয়াঙকে বলল—আমার সারা জীবনের সাধ আছে একটা। পণও করে রেখেছি সারা জীবন। আজ এক রাত্তিরের মধ্যে বড় একটা হ্রদ আর বড় মাপের একটা নৌকা বানিয়ে দেবে যে, তাকেই বিয়ে করব আমি। হ্রদের জলে ভাসতে ভাসতে, নৌকাতেই বিয়ে হবে আমার।
সাঙকুরিয়াঙকে বলল—চেষ্টা করে দ্যাখো, পারো কি না।

এমন সঙ্কটে পড়তে হবে, জানতো না সাঙকুরিয়াঙ। কিন্তু পিছপা হোল না এক্টুও। ভালো লেগে গেছে মেয়েটিকে। মনে মনে পূর্বপুরুষদের প্রণাম জানিয়ে, কাজে লেগে পড়ল সন্ধ্যা না নামতেই।
সাঙকুরিয়াঙ তার বাবাকে দেখেই কোনদিন। বাবার পরিচয়টুকুও জানতো না সে। কিন্তু দেবতার শক্তি বলে কথা। সাত তাড়াতাড়ি কাজ হতে লাগল। বিশাল এক হ্রদ খোঁড়া হয়ে গেল মাঝরাত নাগাদ। 
এবার শুরু হোল নৌকা গড়বার কাজ। নৌকা গড়াও শেষ হতে চলল যখন, রাত শেষ হতে বড় একটা বাকি নাই। বুক ফেটে যাওয়ার জোগাড় হোল দায়াঙ সুম্বির। নরকেও ঠাঁই হবে না আমার! এখন কী করি আমি? হাহাকার করতে লাগলো অসহায় মেয়েটি।
এবার সুজ্জিঠাকুরকে ডাকতে লাগল প্রাণপণে—একদিন রাত থাকতেই উঠে এসো আকাশে। বাঁচাও আমাকে এই অভিশাপ থেকে। 
কিন্তু তা কি আর হয় কখনো? হঠাৎ মনে পড়ে গেল, একখানা যাদু ওড়না আছে তার। মেলে ধরলে সূর্যের আলো ঝলসায় তাতে। অমনি চোখমুখ ঝলমল করে উঠল মেয়েটির। 
ঝটপট বাক্স খুলে ওড়না বের করে, দৌড় লাগালো হ্রদের দিকে। নৌকা তৈরি শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। একটা পাথরের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল দায়াঙ সুম্বি। দু’হাতে মেলে ধরল ওড়নাটাকে।
অমনি কী আশ্চর্য! রাত না ফুরোতেই, ঝলমলে আলোয় ভরে উঠল চার দিক। সে আলোর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল সাঙকুরিয়াঙ। সকাল হয়ে গিয়েছে! পরাজয়ের গ্লানি তার  সারা মুখে। 
কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। মনের দুঃখে এক ধাক্কায় উলটে ফেলে দিল নৌকাটাকে। কী করে মুখ দেখাবে মেয়েকে। উলটো মুখে আবার হাঁটতে শুরু করে দিল সাঙকুরিয়াঙ। 
 তখন কোথায় নৌকা? রাতারাতি মাটি ফুঁড়ে একেবারে একটা পাহাড় গজিয়ে উঠলো সেখানে। সেদিন থেকে হ্রদের তীরে দেখা যায় পাহাড়টাকে। মাঝে মাঝে আগ্নেয়গিরির মতো লাভা বেরিয়ে আসে পাহাড়টার মাথাথেকে। লোকে বলে, আগুন নয়, সাঙকুরিয়াঙ-এর দীর্ঘশ্বাস ওসব। 
[পশ্চিম জাভার অধিবাসী মানুষেরা বিশ্বাস করে, সেখানে হ্রদের তীরে যে তাঙ্কুবান পেরাহু নামে পাহাড়, সেটার জন্ম হয়েছে এভাবেই। শুধু তাই নয়, সাঙকুরিয়াঙ-এর মর্মন্তুদ এই কাহিনী খোদাই করে লিখেও রাখা হয়েছে তাঙ্কুবান পেরাহু নামে পাহাড়টার গায়ে।]
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇

Post a Comment

0 Comments