জ্বলদর্চি

প্রয়াত কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার : শ্রদ্ধা ও স্মরণে কলম ধরেছেন বিশিষ্টজনেরা

প্রয়াত কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার : শ্রদ্ধা ও স্মরণে কলম ধরেছেন বিশিষ্টজনেরা


কথা দিয়ে কথা রেখেছিলেন
ঋত্বিক ত্রিপাঠী 
(সম্পাদক - জ্বলদর্চি) 

কথা দিয়ে ছিলেন। শারীরিক সমস্যা নিয়েও এসেছিলেন জ্বলদর্চি পঁচিশ উৎসবে। ১৫ অক্টোবর ২০১৭ সকাল ১০ টায় মেদিনীপুর শহরের বিদ্যাসাগর মেমোরিয়াল হলের সামনে তিনি নামলেন। সেই প্রথম তাঁর মুখোমুখি। তার আগে লেখার সূত্রে চিঠি ও ফোনে বহুবার যোগাযোগ। অনুষ্ঠানে  দীর্ঘ অভিভাষণের শেষ তিনটি লাইন ছিল: "ঋত্বিকের যা বয়স, ও এই কাগজের পঞ্চাশ বছর পার করাবে। তবে আমি সেদিন থাকব না পৃথিবীতে,  আমার যা বয়স, আমি সেদিন থাকব না। কিন্তু আমি প্রার্থনা করি সেদিন আরও সফলভাবে আজকের এই অনুষ্ঠান যেন হয়।"

হয়তো তিনি লিখছেন, ব্যস্ত, এই ভাবনায় ফোন করতে আমার সংকোচ হত। এস এম এস করতাম। এস এম এস পেয়েই তিনি ফোন করতেন। গত দশ বছরের প্রায় সব বিশেষ সংখ্যাতেই তিনি লেখা দিয়েছেন। এ বছরের শুরুতে জ্বলদর্চির তিরিশ বছর উপলক্ষ্যে তিনি শুভেচ্ছার অডিও রেকর্ড পাঠিয়েছিলেন। জ্বলদর্চির বিশেষ সংখ্যা 'প্রথম লেখা'(২০১৬ সাল)-য় 'উত্তরের দরজা' নামে একটি গল্প প্রকাশ পায়। লেখাটি ছিল অপ্রকাশিত। প্রথম জ্বলদর্চিতে তা প্রকাশ পায়। লেখার সঙ্গে চিঠি দিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন : 
ঋত্বিক 
কিছুদিন আগে পুরোন ফাইল পরিস্কার করতে গিয়ে এই লেখাটা দেখতে পেলাম। যখন লিখেছিলাম  তখন আমি সংবিত্তি নামের একটি মাসিক পত্রিকায় প্রুফ দেখার চাকরি করি। মাসে তিরিশ টাকা মাইনে পাই। থাকি সম্পাদকের অফিসে। তখন পাঁচ পয়সায় রুটি আর বারো পয়সায় তড়কা পাওয়া যেত। চারমিনার প্যাকেট ছিল আঠারো পয়সা। এই লেখাটা লিখেছিলাম 'সংবিত্তি'-র প্যাডের পাতায়। ১৯৬৫ সালে। অর্থাৎ প্রায় একান্ন বছর আগে। কোথাও ছাপতে দিইনি, যদি সম্পাদক ফেরৎ দেয়, এই ভয়ে। সাতষট্টিতে 'দেশ'-এ গল্প বের হয়েছিল। তার দুবছর আগে এই চেষ্টা।  এখন কেমন মায়া লাগে।
এখন গল্পের মর্যাদা পাবে কিনা জানি না। আদৌ কি গল্প হয়েছে ! কে জানে।
শুভেচ্ছাসহ
সমরেশ মজুমদার 
২০/১/২০১৬

দীর্ঘ ৫১ বছর তাঁর ওই লেখা যা ছিল অপ্রকাশিত, জ্বলদর্চিতে প্রকাশ করতে পেরেছিলাম, তার পিছনে ছিল তাঁর জ্বলদর্চির প্রতি ভালোবাসা। সে ভালোবাসায় আজও আমরা আবেগ আপ্লুত।

২০১০ সালের আগে আমার সঙ্গে তাঁর কোনও যোগাযোগ ছিল না। প্রতিদিন রোববার (সম্পাদক - ঋতুপর্ণ ঘোষ। ২০১০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর) পত্রিকায় সমরেশ মজুমদার আমার 'মনখারাপের কবিতা' বই নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা লিখলেন। পাশাপাশি তিনি নিজেই ফোনে তাঁর অভিমত জানালেন। সেই থেকে সম্পর্ক। ২০১২ সাল থেকে জ্বলদর্চিতে নিয়মিত লিখেছেন। জ্বলদর্চিতে শেষ লিখেছেন(উৎসব ১৪২৯-এ) 'নিজের ছবি' নামে এক স্মৃতিগদ্য(লেখাটি নিচে সংযোজিত হল)।

তিনি ছিলেন জ্বলদর্চির শুভাকাঙ্ক্ষী। বড় উপন্যাস লেখার মাঝে সময় বার করে জ্বলদর্চির জন্য লেখা পাঠিয়েছেন। অনেকবারই তাঁর বাড়িতে ডেকেছেন। আমি যেতে পারিনি। তিনি বলেছিলেন, "তুমি আসতে পারছো না। আমি যাবো তোমার কাছে।" জ্বলদর্চি পঁচিশ উৎসবে এসে কথা রেখেছিলেন। 

সশরীরে তিনি নেই। থাকলো তাঁর লেখা, তাঁকে ঘিরে অজস্র স্মৃতি আর তাঁর হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি।



নিজের ছবি
সমরেশ মজুমদার
(কথাসাহিত্যিক)

এরকম কথা ছিল না। জল ওপর থেকে ঝরলে তা নিচে নেমে যাবে, সেটাই তো নিয়ম। জন্মালেই প্রতিটি দিন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে হবে, এর অন্যথা তো হয় না, তেমনি, এই আমি, আমার পাঁচ বছর বয়সে যে পৃথিবীকে চিনতাম সেটাই তো আমার নিজস্ব ছিল। পরপর গোটা আটেক টিনের চালওয়ালা বাড়ি, সামনে বিশাল খেলার মাঠ, মাঠের মাঝখানে একটা বিশাল লম্বা গাছ, যাতে কখনই ফুল ফুটতো না কিন্তু প্রচুর ছায়া দিত। মাঠের ওপাশে তারের বেড়া ডিঙোলেই সরু পিচের রাস্তা। সেই রাস্তায় গোটা দিনে বড় জোর গোটা পনের গাড়ি ছোটাছুটি করত। বাসের সংখ্যা চারের বেশি নয়। আর সেই পিচের রাস্তার দুপাশে প্রায় হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকত শাল, সেগুন অথবা ইউক্যালিপটাস গাছগুলো। সকাল সন্ধেতে গাছগুলোয় রাজ্যের পাখিরা এসে দখল নেওয়ার চেষ্টা করত। রাতের জায়গা দখল নেওয়ার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়ে যেত ।

আমাদের সেই টিনের চালওয়ালা বাড়িগুলোয় আটটি পরিবার থাকতাম। এবং কি আশ্চর্য, আটটি পরিবারেই আটজন প্রায় সমবয়সের বন্ধু থাকতাম। আমরা আটজন রোজ সকালে অর্ধমাইল পথ হেঁটে হাট পেরিয়ে পাঠশালায় যেতাম। দুপুরে খাওয়ার আগে ফিরে আসতাম খিদে পেত বলে। তারপর বিকেল অবধি মায়ের শাসনে ঘুম। ঘুম ভাঙলেই বাতাবি লেবু নিয়ে ফুটবল খেলা। আমাদের সেই খেলার মাঠ যা পাখিদের দখলে চলে যেত ভোরে ও সন্ধ্যায়। কতরকমের পাখি এবং তাদের বিচিত্র ডাক এত প্রবল হয়ে যেত যে কান ঝালাপালা হয়ে যেত।

বাড়ির পিছনে খানিকটা জঙ্গল মত জায়গা পার হলেই ছিল এক স্বপ্নের নদী। চওড়ায় খুব বেশি হলে চল্লিশ কি পঁয়তাল্লিশ ফুট। সবচেয়ে বেশি গভীরতা সাড়ে তিনফুটের বেশি নয়। স্রোত এত তীব্র যে সাড়ে তিনফুট জল পার হয়ে যেতে হিমসিম খেতে হয়। দূরের চা-বাগানের মাটি ফুঁড়ে যে জল উঠে আসছে তা অন্য ঝরণাদের সঙ্গে মিশে এই জলের ধারা তৈরি করেছে। এই জল দুপাশের চায়ের কারখানায় মেশিনে বিদ্যুৎ তৈরি করে আলোকিত করছে ওই চত্বর।

আমরা আটজন পাঁচ বয়সী সবে বালক হওয়া ছেলে ওই নদীর খুব ভাল বন্ধু ছিলাম। নদীর গায়ে কাপড় কাচার জন্য যে পাথরের চাঁই ছিল সেটা কোনোমতে সরালেই কাঁকড়া আর চিংড়িদের দেখা পেতাম। আচমকা মাথার ওপর থেকে আড়াল সরে গেলে তারা হকচকিয়ে যেত। আমরা খপ করে তাদের জল থেকে তুলে নিয়ে এসে চটের ঝোলায় ভরতাম। স্রোতে সাঁতার কাটা মাছগুলোকে ধরা আমাদের সাধ্যের বাইরে ছিল।

কিন্তু বছরে একটা দিন আসত যেদিন আমরা জেনে যেতাম আজ বিকালে ওই নদী বন্ধ করা হবে। আগামী সকাল পর্যন্ত নদী থাকবে শুকনো। তারপর আবার জল ছাড়া হলে কিছুক্ষণ পরে নদী জলে টলমল করবে।

বিকেল হতেই আমরা চলে যেতাম নদীর পাড়ে। চোখের সামনে ধীরে ধীরে আলো নেভার মত নদীর জল কমে আসত, নীচের বালি দেখা যেত। আমরা নেমে পড়তাম, শুধু আমরা নয়, ওপাশের শ্রমিক বাড়ির থেকে ছেলে-মেয়ে, নারী-পুরুষ জল চলে যাওয়া নদীর বুকে লাফানো মাছ, যে যেমন পারে ধরতে নেমে পড়তাম। সন্ধে নামলেই নদীর বুকে শত শত লণ্ঠন, মোমবাতি জ্বলে উঠত। নুড়ি পাথরের ওপরে লাফানো মাছেদের ধরা হয়ে গেলে পাথর বালির নিচে লুকিয়ে থাকা জলের প্রাণীদের খোঁজা শুরু হয়ে যেত।

বাড়ি থেকে ডাক আসতো আমাদের। খুব মন খারাপ হয়ে যেত। তখন আমরা নদী থেকে উঠে আসতে বাধ্য হতাম। যে যার বাড়ি ফিরে গিয়ে দেখতাম আমাদের এক একজন কাজের লোক বালতি নিয়ে শুকনো নদীর দিকে যাচ্ছে বালির নীচ থেকে মাছ ধরে আনতে। তখন আমাদের যাওয়ার অনুমতি থাকতো না। পরের দিন সকালে আমরা জমা হতাম জল-হীন নদীর পাড়ে। যতটা দেখা যায়, তাতে বুঝতে অসুবিধা হোত না যে গতরাতে লোকজন বালি-নুড়ি তছনছ করে মাছ কাঁকড়া খুঁজেছে। যে নদীর বুককে সারা বছর জলের আড়ালে দেখে আসতে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম, তার এমন বিশ্রী চেহারা আমাদের মোটেই ভাল লাগত না। আমরা ফিরে এসেছিলাম বাড়ির সামনের মাঠে। আমাদের প্রত্যেকেরই মনখারাপ হয়ে গিয়েছে। যেভাবে নদীর সব চিংড়ি, কাঁকড়া, পুঁটিমাছ তুলে নেওয়া হল, তাতে আর নতুন করে ওদের নদীর জলে দেখা যাবে তো? খোকন সান্ত্বনার সুরে বলল, বাবা মাকে বলছিল, 'সারা বছর নদীতে যত আবর্জনা জমেছিল তা জল বন্ধ করে পরিষ্কার করা হয়। পরিষ্কার জলে ফ্যাক্টরির বিদ্যুৎ উৎপাদনে সুবিধা হবে।'

কথাগুলো যতই সত্য হোক, আমাদের ভাল লাগল না।

বিকেল হতে না হতেই খোকনের চিৎকার কানে এল, ‘তাড়াতাড়ি আয়, নদীতে জল আসছে।' চোঁ চোঁ দৌড়ে আমরা আটজন পৌঁছে গেলাম নদীর পাড়ে। অবাক হয়ে দেখলাম, ওপাশ থেকে শুকনো নুড়ি-বালির ওপর দিয়ে গড়াতে গড়াতে জলের ঢেউ যখন নিচের দিকে চলে গেল তখন নদীর এপাড় ওপাড় জলে টলমল করছে। খানিক বাদে জলের রঙ বদলাতে শুরু করল। ধীরে ধীরে জলের ঢেউ বাড়তে লাগল। ঘোলাভাবটা কাটতে লাগল ।

আমাদের আটজনের একজন বন্ধু ছিল হ্যাফপ্যান্ট আর ছেঁড়া গেঞ্জি পরে সে লাঠি হাতে দূরের কুলি লাইন থেকে বেরিয়ে রাস্তার একটা ধার দিয়ে হেঁটে আমাদের খেলার মাঠ ছাড়িয়ে বাজারের দিকে চলে যেত। ওর নাম ছিল মাংরা। দুটো চোখেই কোনো দৃষ্টিশক্তি ছিল না। অথচ হাঁটতে হাঁটতে খেলার মাঠের পাশের রাস্তায় পৌঁছেই সে দাঁড়িয়ে যেত। মুখ ঘুরিয়ে শব্দ শোনার চেষ্টা করত। আমাদের কেউ ওকে দেখে এগিয়ে গেলে হলদে দাঁত বের করে হাসতো। আমরা ওকে ঘিরে ধরতাম, কথা বলতাম আমরাই, প্রশ্নের পর প্রশ্ন, সে হাসতো, কথা বলতো না। অথবা জানি ও যাচ্ছে বাজারের মিষ্টির দোকানে। সেখানে আধঘণ্টা বসে অপেক্ষা পর দোকানদার যদি একটা মিষ্টি খেতে দেয়, তাই খেয়ে লাঠি দিয়ে পথ মেপে ফিরে আসতো। ওকে আমরা লজেন্স দিতাম। কোনো কোনোদিন ও পকেট থেকে পেয়ারা বের করে আমাদের সামনে তুলে ধরত। যেহেতু দৃষ্টিহীন, রোজগার করার কোনো ক্ষমতা থাকার কথা নয়, ভাইদের দয়ায় সে বেঁচে আছে কিন্তু হাসিতে আমরা তার কোনো প্রভাব দেখতাম না। মিনিট খানেক আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে ও লাঠি আর পা দিয়ে রাস্তা মাপতে মাপতে চলে যেত বাজারের দিকে। খোকন একবার বলেছিল, 'মাংরার মনে খুব জোর। এতটা রাস্তা হেঁটে রোজ মিষ্টি খেতে যায়। আমি অন্ধ হলে বাড়ির বাইরে যেতে সাহসই পেতাম না।’ আশ্চর্য ব্যাপার, আমাদের আটজনের কথা মাংরা জানতো। প্রত্যেকের কন্ঠস্বর ওর চেনা ছিল। কোনোদিন আমাদের কেউ না এলে কথা শুনতে শুনতে ওর কপালে ভাঁজ পড়ত, ঠোঁট ছুঁচালো হোত। এবং শেষ পর্যন্ত যার গলা শুনতে পাচ্ছে না তার নাম ধরে বলতো, ‘বিশু, বিশু আজ আসেনি? কি হয়েছে বিশুর ?"

শুনে আমাদের খুব ভাল লাগতো। কিন্তু একটা ব্যাপার আমাদের খুব অবাক করত। আমাদের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও সে হাইওয়ের পাশ থেকে নেমে খেলার মাঠ তো দূরের কথা বাড়ির বারান্দায় আসতে চাইতো না।

এলো পনেরই আগষ্ট। পাঠশালার মাঠে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে জমায়েত হবে সকাল আটটায়। কদিন ধরে মাস্টারমশাই আমাদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে দুটো গান গাইতে শিখিয়েছেন। যার প্রথমটা খুব বড় হলেও আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। 'ধনধান্যপুষ্পভরা', দ্বিতীয়টি, 'জনগণমন অধিনায়ক'। ওই ছোট্ট জনপদে তখন কি উত্তেজনা। ভারতবর্ষ স্বাধীন হচ্ছে, ইংরেজরা ভারত ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে, আমরা এখন স্বাধীন।

এখনও দৃশ্যটা উত্তেজনা তৈরি করে। আমরা আটজন বালক যার যার কোয়াটার্সে সারারাত উত্তেজনায় ভালো ভাবে ঘুমাতে পারিনি। আলো ফোটার আগেই সাদা শার্ট আর সাদা প্যান্ট পরে যে যার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। গতকাল স্কুল থেকে যে জাতীয় পতাকা আমাদের দেওয়া হয়েছিল তা মাথার উপর তুলে ধরে দৌড়াতে লাগলাম। মুখে 'বন্দেমাতরম' ধ্বনি। রাস্তার দুপাশের গাছে গাছে সবে ঘুম থেকে ওঠা পাখিরা চেঁচামেচি শুরু করে দিল সেই ধ্বনি শুনে। আমরা নির্জন পিচের রাস্তা ধরে ছুটে যাচ্ছি স্লোগান দিতে দিতে। পাঠশালার মাঠে আজ অনেক ভিড়। শুধু ছাত্রছাত্রী নয়, অভিভাবকরাও চলে এসেছেন। জাতীয় পতাকা একটা লম্বা খুঁটিতে বেঁধে দড়িতে ঝুলিয়ে নামিয়ে রাখা আছে। কেউ একজন গান ধরল, 'ধনধান্যপুষ্পভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা' সঙ্গে সঙ্গে গলায় গলায় ছড়িয়ে গেল সেই গান। তখন সবে সূর্য উঠবে উঠবে করছে।

মনের গায়ে গেঁথে থাকা ওই দৃশ্যগুলো চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই। আমার সেই সাত বন্ধু আজ কে কোথায় জানি না, আছে কিনা তাও জানি না; কিন্তু ভাবলেই ওরা চলে আসে। চলে আসে মাংরা, চলে আসে সাড়ে তিনফুট গভীর সেই জলের ধারা।

আমার বেঁচে থাকার সম্পদ।
(জ্বলদর্চি উৎসব ১৪২৯)

আমার আর বাবলু বলে ডাকবার কেউ রইল না 
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় 
(কথাসাহিত্যিক)

সমরেশের প্রয়াণ বজ্রাঘাতের মতো। আমার ছোটো ভাইয়ের মতো ছিল। যখন লেখালেখি শুরু করেনি তখন থেকেই আলাপ। নাটকের দল ছিল সমরেশশের। তার কয়েক বছর পর লেখালেখি শুরু। পাশাপাশি টিভিতে সিরিয়ালও তৈরি  করেছে। তাছাড়া ইনকাম ট্যাক্সে ভাল চাকরি করত। পরে সিরিয়াল তৈরি করতে গিয়ে চাকরি ছেড়ে দেয়। পরে শুধু লেখালেখি নিয়েই ছিল। আমার সঙ্গে বরাবরই সম্পর্ক ছিল। ইদানীং দেখা হত না, ফোনে কথা হত। আমি ওকে বাবলু বলে ডাকতাম। বলত , তুমি ছাড়া আমাকে বাবলু বলে ডাকার আর লোক নেই। এখন আমার আর বাবলু বলে ডাকবার কেউ রইল না। 


সমরেশ মজুমদার চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন আমাদের মাঝে
চন্দন সেন
(নাট্যকার) 

দুঃসংবাদটি পেলাম আজ সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার মুখেই। আমার বিশিষ্ট বন্ধু ও সাতের দশকের থেকে বাংলাভাষার অন্যতম নামজাদা সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার সিওপিটি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক রোগ-ব্যাধিতে ভুগে প্রয়াত হয়েছেন। আমরা দুজনেই সমবয়সী, আমারও বয়স ঐ ৭৯। সমরেশ আমার অনেকগুলি নাটক দেখতে এসেছেন, নাটক নিয়ে তাঁর সাথে একান্তে দীর্ঘ কথাবার্তা হত। তিনি তাঁর পছন্দ আর অপছন্দের কথা অকপটে জানাতেন। সত্তরের উপান্তে তিনি তাঁর উপন্যাসের মধ্যে বাঙলার যৌবনকে প্রথম অনিমেষ আর মাধুরীলতার প্রেমের সাথে বিপ্লবের পাঠ  দিয়েছিলেন উত্তরবঙ্গের চা-বাগানের পটভূমিকায়।

উত্তরবঙ্গের মানুষ হিসেবে উত্তরবঙ্গ ছিল তাঁর বিশেষ দুর্বলতার জায়গা। বিশেষত নকশালবাড়ি বা নকশাল আন্দোলন নিয়ে তাঁর একটি সম্পর্ক ছিল। আর এই কারণে যখন জানতে পেরেছিলেন, আমি নকশালবাড়ি নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে একটি নাটক লিখছি, তারপর বারবার জানতে চাইতেন-" চন্দনবাবু নকশালবাড়ির আন্দোলন নিয়ে আপনার লেখা নাটকটি লেখা শেষ হল?" সমরেশের এই উদগ্রীবতার জন্য আমার মনে আফসোস থেকেই গেল। 

তিনি পারতপক্ষে কোনও রাজনৈতিক দলের অনুগামী ছিলেন না। তবে অন্যায়ের প্রতিবাদের জন্য যখন ডেকেছি তাঁকে, কখনও এসেছেন। বলতেন-" আমি আমার লেখাতেই অন্যায়ের কথা, জয়-পরাজয়ের কথা, প্রতিবাদের কথা, আনন্দের কথা বলব, তার বাইরে আমাকে দেখা যাবেনা।" আমরা তাঁর এই মনোভাবকে শ্রদ্ধা করি। পরে আমিও ভেবে দেখেছি লেখার মাহাত্ম্যে যে কথা বলা যায়, তাই হাজারটা রাজনৈতিক স্লোগানেও উচ্চারিত হয়না। 

বুঝতে পারছিলাম সমরেশের  স্মৃতি বিস্মৃতি ঘটাচ্ছিল। ভাবছিলাম খুব বেশিদিন আর লিখে যেতে পারবেন না। বাঙলা সাহিত্যে তাঁর অবদান ছড়িয়ে আছে গল্পে উপন্যাসে কিশোর সাহিত্যে আখ্যানে ভ্রমণ কাহিনী প্রবন্ধ ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের লেখায়। আমরা কেউ তার সাহিত্যে তাঁর এই অবদানকে ভুলব না। সমরেশ মজুমদার চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন আমাদের মাঝে। আর পরিশেষে বলি, আমার মতে বাংলা সাহিত্যের আপাতত শেষতম পর্ব পুরুষ সমরেশ মজুমদার। হ্যাঁ, আপাতত বলছি আমার যেটুকু পড়াশোনা এইসময়ের বাংলা সাহিত্য নিয়ে, তাতে তাই মনে  হচ্ছে।

আমি জ্বলদর্চির জন্য সমরেশ মজুমদারের প্রয়াণে এই কথাগুলো বললাম।

সময়ের কথা লিখেছেন
অচিন্ত বিশ্বাস 
(প্রাবন্ধিক)

সমরেশ মজুমদার আমাদের সময়ের কথা লিখেছেন। নকশালবাদ স্থায়ী হয়নি, কিন্তু তার তরঙ্গ বাঙালি সমাজে স্থায়ী দাগ রেখে গেছে। সমরেশ সেই স্বপ্নদর্শী তরুণ তরুণীদের প্রজন্ম- কথা ( Saga -র ঢঙে) লিখেছেন। 
দেশ ভাগ উদ্বাস্তু জীবন, নগরায়ণ তাঁর বিষয়, তবে তাঁর বাংলা টালা থেকে টালিগঞ্জে সীমিত নেই। কাঞ্চনজঙ্ঘা ঘেঁষা ডুয়ার্স তরাই তাঁর কথা সাহিত্যে নতুন প্রাণ এনেছে। 
বঙ্গ ভাষা সাহিত্য পড়া সাহিত্যিক এখন হাতে গোনা। প্রমথনাথ বিশী নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের যোগ্য উত্তরাধিকারী সমরেশ মজুমদার। তিনি বাংলা ভাষা জানা বাঙালী সাহিত্যিক। শ্রদ্ধা নিরবধি।
সমরেশ মজুমদার 
ঈশিতা ভাদুড়ী
(কবি, প্রাবন্ধিক)

গত কয়েক দশক ধরে খুব কম লেখক-কবি আছেন, যাঁদের সঙ্গে আমার দেখা বা কথা হয়নি কখনও। সমরেশ মজুমদার এমন একজন লেখক, তাঁকে আমি দু-একবার দেখে থাকলেও তাঁর সঙ্গে আমার কখনও আলাপ হয়নি, কথা হয়নি। তবে যদি লিখি সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না, তাহলে ভুল বলা হবে, কেননা তিনি তো আমার পুরো অস্তিত্ব জুড়ে। আমাদের কৈশোর, আমাদের যৌবন ধরা আছে তাঁর লেখায় লেখায়। লেখা তো আসলে একটা মাধ্যম, যে মাধ্যমের সাহায্যে পাঠকের হৃদয়ের অন্তস্তলে পৌঁছাতে চান লেখক। 
উত্তরবঙ্গকে সাহিত্যের পৃষ্ঠায় তুলে ধরেছেন বারবার। বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে জলপাইগুড়িতে বড়ো হওয়া, চা-বাগান ইত্যাদি এসেছে। তাঁর ত্রয়ী উপন্যাস উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ থেকে তো আজও বাঙালি পাঠক বার হতে পারেনি। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র অনিমেষ, মাধবীলতা আমাদের পাঠকমনে আজও বিরাজমান, বাঙালি পাঠক আবেগে আক্রান্ত আজও। নকশাল পিরিয়ডের সেই জীবন্ত চরিত্রে পাঠক এমন আটকে গেছেন, সেখান থেকে আজও বার হতে পারেনি। এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মের কাছে এই বইটা চলে গেছে, সেই সময়ের আন্দোলন সম্পর্কে একটা ধারণা নিয়ে। তাঁর অর্জুন চরিত্রকে পাঠক ভুলবেন কোনোদিন?
সাহিত্যে তাঁর অনন্য অবদানের জন্য তিনি বিভিন্ন সময়ে আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কার ইত্যাদি নানা পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু তাঁর লেখা যাবতীয় পুরস্কারের ঊর্ধ্বে। 
আজ তাঁর ‘দৌড়’ শেষ হল, এক অধ্যায়ের সমাপ্তি। আজ তাঁর প্রয়াণে আরেকবার সাহিত্যজগতে শোক নেমে এল। তিনি তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যকর্মের মাধ্যমেই মানুষের মধ্যে রয়ে যাবেন।
স্মরণে: সমরেশ 
গৌতম বাড়ই 
(কবি, লেখক)

কৃষ্ণপক্ষের হয়ত আঁধার ছেয়ে আছে। কৃষ্ণপক্ষের তৃতীয়ার চাঁদের হয়ত আজ ম্লান বিষাদ আলোমাখা উত্তরের এই চা-বাগিচার প্রায় অন্ধকার ছাউনি গাছের দলে। স্বর্গছেঁড়ার আংড়াভাসা তির-তির করে এখনও বয়ে চলছে। আকাশে কালো মেঘের জটলা কী! আর তো দাঁড়াবে না এসে ডুয়ার্সের এই স্মৃতির প্রাঙ্গণে সেই ক্ষুদে সমরেশ। তবে সাহিত্যের আঙিনায় এই স্বর্গছেঁড়া চা-বাগান  চিরস্থায়ী স্থান করে নিয়েছে সমরেশ মজুমদারের অমূল্য লেখনীতে। স্বর্গছেঁড়া জানে বোঝে সব। সেই কিং সাহেবের ঘাট, সেই বার্ণেশ তারাও জানে সব। 

আজ ২৪-শে বৈশাখ, ১৪৩০ আর ইংরেজি ক্যালেন্ডারে জানান দিচ্ছে ৮ই মে, ২০২৩। তিনি সেই মফফ্সল জেলা শহরের ইশকুল থেকে মহানগরের কলেজে পড়তে আসা নয়, তিনি আজ পাড়ি দিয়েছেন মহানগর থেকে সাহিত্যের নক্ষত্রলোকের মহাকাশে। দৌড় দিয়েই শুরু, তারপর একে- একে উত্তরাধিকার, কালবেলা আর কালপুরুষের মতন ট্রিলজিতে বাংলা সাহিত্যে আর এক ধ্রুপদী সাহিত্যিক অন্য এক সমরেশের সাথে পাল্লা জুড়ে দিয়েছেন। আমরা নামী পত্রিকার শারদীয়ায় চোখ বুলিয়ে নিতাম দুই সমরেশ আছেন কিনা! আমার মনে হয় 'কালবেলা' তাকে অসম্ভব সেই জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল। 

তিনি যে মাটির, যে জলবায়ুর, হাওয়া- বাতাস মেখে বড় হয়ে উঠেছেন। আমরাও বড় হয়ে উঠেছি সেই উত্তরের জল হাওয়া মাটি বৃষ্টি মেখে। তাই অনিমেষ, তাই মাধুরীলতাকে, অর্ককে এখনও খুঁজে ফিরি সেই মাটিতে। জ্বলদর্চির সঙ্গে ছিল আত্মিকযোগ। তিনি হাজির হয়েছিলেন জ্বলদর্চির ২৫- শের অনুষ্ঠানে। জ্বলদর্চির প্রথমলেখা সংকলন গ্রন্থে এই সময়ের পর্বে তাঁর 'উত্তরের দরজা' নামে একটি অপূর্ব গল্প আছে। জ্বলদর্চিতে এই অপ্রকাশিত লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এতটাই ভালোবাসা ছিল জ্বলদর্চির প্রতি , পুরানো ফাইল ঘাঁটতে গিয়ে এ লেখাটি পেয়েই জ্বলদর্চির সম্পাদকের হাতে ' প্রথম লেখা' সংকলন গ্রন্থের জন্য দিয়েছিলেন। 

আজ কথাশিল্পীর এই যাত্রাপথে তাঁর বাণী একটু পাল্টে স্মরণ করি তাঁকে --" প্রতিটি ছোট্ট পদক্ষেপে আমাদের সেই অমৃতলোকের যাত্রাপথে টেনে নিয়ে যায়।" তিনি রেখে গেলেন তাঁর কথার অমূল্য শব্দ-সম্পদ। সেই নক্ষত্রলোকে বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রটি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ তাঁর শুভদিন ২৫-শের প্রাকমুহূর্তে হয়ত বুক পেতে বসে আছেন সমরেশ-কে বুকে তুলে নেবেন বলে। 

আঙরাভাসার কোলে হয়ত বৃষ্টি নেমেছে। হয়ত এই রাত্তিরে কেঁদে ভাসাবে ডুয়ার্স- তরাই। সমরেশ মজুমদার ঠিক টের পায়ে যাবেন স্বর্গছেঁড়ার ওপর থেকে। তোমার উত্তরাধিকার তোমার কালবেলা তোমার এই দৌড়ে দূর থেকে শুধু চেয়ে বসে থাকবে। বিদায় বলব না, সেলাম তোমায় মজুমদার সমরেশ। অমর রহে এই বঙ্গ- সাহিত্য আকাশে।

স্মৃতি 
নির্মল বর্মন 
(প্রাবন্ধিক) 

জ্বলদর্চি'র পঁচিশ অনুষ্ঠানে কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার উপস্থিত ছিলেন। কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠী আমাকে ডেকে নিয়ে সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে আলাপ করে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন --"আপনার উপন্যাসের উপর ইনি জ্বলদর্চিতে প্রবন্ধ লিখেছেন।" কিংবদন্তি সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার এক ঝলক প্রবন্ধটি দেখে একটাই মন্তব্য করেছিলেন "খুব সুন্দর"। তখনকার দিনে ছবি তোলার তেমন হিড়িক ছিল না। সেদিনের সেই আনন্দ আজও মনের মনিকোঠায় সুন্দরভাবে গুছিয়ে রেখেছি। আজ প্রথিতযশা সাহিত্যিক নেই অথচ আছেন। তিনশো পঁয়ষট্টি দিনই ছাত্র পড়ানোর সুবাদে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ ,অমিয় চক্রবর্তী, নজরুল ইসলাম  ও সমরেশ মজুমদার আমাদের আলোচনা করতে , পড়াতে ও পড়তে  হয়। সুতরাং সাহিত্যিকদের মৃত্যু হয় না, সেই অর্থে সমরেশ মজুমদার আজও আমাদের ও জ্বলদর্চি পত্রিকা পরিবারের হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন।

জ্বলদর্চি ৩০ নিয়ে সমরেশ মজুমদারের শুভেচ্ছা।
------------------------------------------------
কৃতজ্ঞতা -রাজর্ষি রায়, গৌতম বাড়ই। 

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇

Post a Comment

2 Comments

  1. প্রয়াত লেখককে স্মরণ করেছেন শ্রদ্ধার সঙ্গে।

    ReplyDelete
  2. শ্রদ্ধা ও প্রণাম

    ReplyDelete