জ্বলদর্চি

দেশান্তরী -১৮ /হিল্লোল রায়

দেশান্তরী -১৮ /হিল্লোল রায়


সমস্যার সমাধানভাবনার অবসানহাবড়ায় শেষ রজনী যাপন


মিঃ বর্ধনসীতাপতি দুজনের কাছেই গেলাম। উত্তর পেলাম টেলেক্স এর কোন জবাব ওরা পায় নি। চিন্তামগ্ন হয়ে আর কোন কাজ না থাকায় পাইকাপাড়ায় ফিরে এলাম সন্ধ্যা ৭-৩০ । তারপর গতানুগতিকভাবে রাতটা কেটে গেল পাইকপাড়াতেই।

বুধবার মার্চ ১৯১৯৭৫ সকালে উঠলাম ৬০৩০। প্রায় ৮-৩০ নাগাদ এয়ার ইন্ডিয়া অফিসে টেলিফোন করলাম টেলেক্স সমপর্কে। তখনও কোন খবর পায় নি। বেলা দশটা নাগাদ হঠাৎ একটা টেলিগ্রাম পেলাম পাইকপাড়ার বাড়িতেঃ

-Paid Fare, Start as planned, Confirm departure by Cable-Pradyot.

সব সমস্যার সমাধান। চিন্তা -ভাবনার অবসান। এয়ার ইন্ডিয়ার অফিসে ফোন করতেইঃ

-ইউইউ হ্যাভ রিসিভ দা রিপ্লাই অ টেলেক্স-মিঃ রে।

ছুটলাম এয়ার ইন্ডিয়ার অফিসে আমার কাগজপত্র নিয়েওখান থেকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কে গেলাম। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেটের জন্য। FTS অর্থাৎ Foreign Travel Scheme (চার মাস duration , tourist দের জন্য return Ticket) এর জন্য প্রয়োজনীয় ফর্ম পূরণ করলাম মিঃ বর্ধনের সংগে বসে। তারপর ফর্মটাতে চারখানা ফটো লাগিয়ে পাসপোর্ট সংগে নিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কে জমা দিলাম। একটা Token পেলাম হলুদ রঙের। আবার হেঁটে গিয়ে এয়ার ইন্ডিয়াটোকেনখানা মিঃ বর্ধনকে দিলাম।

রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ক্লীয়ারেন্সের জন্য টোকেনখানা প্রয়োজন। মিঃ বর্ধন বল্লেনউনিই জোগাড় করে দেবেনকোন চিন্তার কারণ নেই। আমিও নিশ্চিন্ত হলাম। আর কোনই কাজ বাকী নেই। গেলাম সি এম পি ও র গার্সটিন প্লেস অফিসে। সবার সংগে বিশেষ করে মিঃ অজিত ভ্যুঁইঞা রণেন ব্যানার্জ্জীমৃগেন ঘোষ, , দীপ্তিময় দেমানস চরিত প্রভৃতির সংগে গল্পগুজব করে চারটে নাগাদ বেরুলাম। ট্রাম চেপে এসপ্ল্যানেড এ সঞ্চয়ের অফিসে চলে এলাম বেলা সাড়ে চারটেয় গলপগুজবচা খেয়ে ওর অফিস ছুটীর পর দুজনেই বেরিয়ে পড়লাম। শ্যামবাজারগামী ট্রাম পেলাম এসপ্ল্যানেড থেকেই। ট্রামে চেপে দুজনেই আসছি। সঞ্চয় বেশ মনক্ষুণ্ণ হয়ে পড়েছে আমার বিদায় সময় এগিয়ে আসছে দেখে। ও কথাই বলতে পারছিল না। দুঃখ-বিরহজনিত। তাই কোন রকমেঅনেক কষ্টে বললোঃ

-চলিহিরে

শিয়ালদায় ও নেমে গেল। আমি বল্লামঃ

-মন খারাপ করিস না একটুওআবার দেখা হবে।

চল্লাম শ্যামবাজার। পাইকপাড়ায় পৌঁছাই রাত ৮টায়। বিশ্রামগতানুগতিক পদ্ধতি। রাতটা কোনরকমে কাটিয়ে দিলাম। বলতে ভুলে গেছি। মেজমামা একটা চিঠি দিয়েছেন আমাকেঃ

-বি ই কলেজ থেকে একটা অফিসিয়াল ট্রান্সক্রিপ্ট জোগাড় করে নিয়ে এসো।

বৃহস্পতি্বারমার্চ ২০১৯৭৫ পাইকপাড়া থেকে বি ই কলেজে ফোন করলাম ট্রানসক্রিপ্টের ব্যাপারে। পরে নিজেই ১১টায় বেরিয়ে পড়লাম বি ই কলেজের উদ্দেশ্যে।

বি ই কলেজে পৌঁছাতে বেলা ১-৩০ হয়ে গেল। এগজামিনেশান সেন্টারে গিয়ে খোঁজখবর নিলাম অফিসিয়াল ট্রানসক্রিপ্টের ব্যাপারে। এ জন্য এ কটা ফর্ম পুরণ করতে হয়। আমার মার্কসীটরেজিষ্ট্রেশন নাম্বার ইত্যাদি সহ একখানা এ্যাপলিকেশন লিখে জমা দিলাম এগজামিনেশন সেণ্টারে। ওখান থেকে ২টোর সময় বেরিয়ে গেলাম সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিং ডিপার্টমেণ্টে। পাশ করে যাবার পর আবার ডিপার্টমেণ্টে গিয়েছি। পুরানো স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভাসছে। সেই ক্লাসঃ রুমসেই চেয়ারগুলোসেই প্রফেসররা...

বেশ ভালই লাগছে। আমার প্রফেসরদের দেখা পেলাম। সবারই এক প্রশ্নঃ

-কি করছকোথায় আছো?

আমেরিকা চলে আসছি শুনে সবাই কেমন যেন একটু থমকে গেলেন।

-তাই নাকিকবে যাচ্ছ?

-পরশুদিন অর্থাৎ মার্চ ২২১৯৭৫।

সবার কাছ থেকেই উৎসাহ-উদ্দীপনা পেলাম। পাইকপাড়া থেকেই এ্যাপয়েন্টমেণ্ট করে রেখেছিলাম ডঃ সন্তোষ কুমার মুখার্জ্জীর সংগে। ডঃ মুখার্জ্জী হচ্ছেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের হেড অব দি ডিপার্টমেণ্ট ।

-তোমার কি ধরনের সার্টিফিকেট চাই বলোতুমি তো Editor ছিলে নাডঃ মুখার্জী বল্লেন।

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
ওঁনার একটা রেকমেনডেশন লেটার আমার কাছে আগে থেকেই ছিল। ওটা নিয়েছিলাম জুন ২০১৯৭৪। নতুন রেকমেণ্ডেশন লেটার কেমন হবে ডঃ মুখার্জ্জী জানতে চাইলেন।

আগের রেকমেন্ডেশন লেটার দেখাতেই বল্লেনঃ

-এটা খুব ভালই আছে। এটাতে কাজ হবে তোমার?

-হ্যাঁচলবে।

সংগে সংগে স্টেনোগ্রাফার অমরনাথ ব্যানার্জি কে ডেকে পাঠালেন। পুরনো লেটার খানারই হুবহু দু কপি (অরিজিনালটাইপ করে দিলেন মিঃ ব্যানার্জ্জী। ডঃ মুখার্জী সোৎসাহে সই করে দিলেন।

হঠাৎ ডঃ মুখার্জ্জীর ঘরে ঢুকলেন সয়েল মেকানিক্স এর অধ্যাপক ডঃ সুরেশপ্রসাদ ব্রহ্ম। আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বল্লেনঃ

-কেমন আছোহিল্লোল?

-খুব ভাল।

আমি তখন মনে মনে ভাবছিডঃ ব্রহ্ম কেমন সুন্দর আমার নাম মনে রেখেছেন। দেখলামম্যাগাজিন সম্পাদনার সূত্রে আমার নামপাশ করে যাওয়ার পরেও প্রফেসরদের মনে রয়েছে। খুব ভাল লাগছিল।

সবার কাছ থেকেই উৎসাহ পাচ্ছি।

বি ই কলেজে সবার সংগে দেখা সাক্ষাৎ সেরে ৩-৩০ বেরিয়ে পড়লাম। শিয়ালদা থেকে ৫-১০ এর ট্রেণ দেরী করে ছাড়লো সন্ধ্যা ৬-১৫। হাবড়ায় পৌঁছালাম রাত ৮টায়। লোড শেডিং । বদ্ধ ঘরে চুপচাপ সময় কাটাতে বাধ্য হলাম।


বিশ্রামখাওয়া-দাওয়া সেরে শুতে রাত ১০-৩০। ভীষণ ক্লান্ত। ভারতবর্ষে থাকতে আর্গোসিতে আজই শেষ রাত কাটাচ্ছি। মায়ের পাশে শুয়েছি। চিন্তা ভাবনায় মায়ের চোখে ঘুম নেই। আমার ও চোখে ঘুম নেই একটুও। সারারাত ছটফট করছি ভবিষ্যৎ ভেবে। রাতটা কেটে গেলমায়ের হাতদুটো বুকের কাছে রেখে। আমার চোখের জল যখন মায়ের হাতে পড়েছেতখন আর মা নিজেকে সামলে রাখতে পারে নিআমাকে ধরে অঝোরধারায় কেঁদে নিজেকে হাল্কা করলেন। আমি তখনও মায়ের দুই হাতের স্পর্শ রেখেছি আমার মাথায়।

-মাতোমার স্বপ্ন আজ সার্থকআমিও সার্থক তোমার মতন মা পেয়েছি বলে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তোমাকে আমি নিয়ে রাখব আমার কাছে। থাকবে তো মা তোমার মিন্টুর কাছে?

-মা তখন চোখের জল মুছে রাজি হলেন

-মিন্টুতোর দু ভাই যাতে মানুষের মতন মানুষ হয় ঠিক তোর মত তার ব্যবস্থা করিস। ভুলিস না ওদের এই বলে মা আমাকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করলেন

পরদিন অর্থাৎ মার্চ ২১১৯৭৫ সকাল ৬টায় উঠলাম।


হিরে” আমারপ্রিয় আমারপরম ধন ধন রে


আর্গোসি ত্যাগ

জন্মস্থান থেকে যাত্রার প্রস্তাবনা


আজ মার্চ ২১১৯৭৫ হাবড়ায় ঘুম থেকে উঠেছি সকাল ৬টা নাগাদ। আমেরিকা যাওয়ার পথে নানারকম চিন্তাভাবনা জট পাকাচ্ছিল। তাই গত কয়েকদিন যাবৎ রাত্রে ঘুম আসতই না। গত রাতে একটুও ঘুমাতে পারি নি।

দাদু-দিদিমা-মা সবার চোখেই জল কারণ আজ “যাত্রা” করে কলকাতায় পাইকপাড়ায় বড়মামার বাড়ীতে থাকব। আমিও নিজে চোখের জল ফেলতে ফেলতে হাবড়া থেকে সকাল ৭-৩০ মিনিটে সঞ্চয়ের সংগে রওনা হই। তারপর ৮-২০ নাগাদ দমদম জংশন ও সেখান থেকে রিক্সা নিয়ে সোজা পাইকপাড়ার বাসা। সেখানে চান খাওয়া সেরে বড়মামার সংগে গাড়ীতে গিয়ে এয়ার ইন্ডিয়ার অফিস থেকে টিকিট নিলাম। সমস্ত ঝামেলা বারোটার মধ্যে মি্টে গেল ।

ওখান থেকে হেঁটে এসপ্ল্যানেডে সঞ্চয়ের অফিসচা খাওয়া। সমস্ত স্টাফদের সংগে আলাপ আলোচনা করে বেলা একটা নাগাদ বিদায় নিলাম।

তারপর বাস ধরে পাইকপাড়ার বাড়িতে পৌঁছানো। সমস্ত দুপুরটা ঘুমিয়ে বিশ্রাম নেবার চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই ঘুম এল না। খুব ক্লান্ত ভাব লাগছিল।

সকালে হাবড়া ত্যাগ করার মুহূর্ত্তের দৃশ্যগুলো মনে এলেই কান্না আসছিল। একদিকে সবাইকে ছেড়ে বেশ কয়েকবছর আমেরিকায় থাকতে হবে এই দুঃখ আর অন্যদিকে প্লেনে চড়বার আগে যে ভয় থাকেসেটাই বেশী মনে হচ্ছিল।

সন্ধ্যা বেলা ছোটমামাকুমারদের সংগে গল্প করে কেটে গেল। রাত্রে প্রায় ১টা পর্যন্ত আমিছোটমামাবড়মামা পাইকপাড়ার বাড়ীতে বসে জিনিষপত্র ব্যাগে গুছিয়ে রাখি। শুতে রাত ১-৩০টা বাজে। ঘুম নেই চোখে আগামীকালের যাত্রার কথা চিন্তা করে।

আমেরিকার পথে আজ মার্চ ২২১৯৭৫ আমার যাত্রা হল শুরু। গতকাল রাত থেকেই জিনিষপত্র নেবার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। আজ পাইকপাড়ার বাড়ী থেকে বিকাল ৬-৩৫ মিনিটে যাত্রা শুরু করি। সঞ্চয় দমদম এয়ারপোর্টে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। এই ডাইরীখানা ওর কাছে পেয়েছি।

বিদায় জানাতে বড়মামাছোটমামামেজভাই কমলমামাতো বোন পিংকুবন্ধু কুমারসেজমাসি ও মেসোমশায় এবং ওর ননদ ও ভাগনে এসেছিল। আমার ট্রাভেল এজেন্ট মিঃ সিনহা ও এয়ারপোর্টে। এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে ৭-১৫ মিনিট। সন্ধ্যা হয়েছিল। খুব তাড়াহুড়ো করে এখানেই 'সাপারসেরে নিলাম। বাড়ী থেকে বেরিয়ে নতুন পরিবেশে খেতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল। যাই হোকখাওয়ার সময় বড়মামাও ছিলেন।


এয়ার ইন্ডিয়া বিমানে কলকাতা ত্যাগ। প্লেনের মধ্যে বসে যাত্রাপথের বর্ণনা।

সন্ধ্যা ৭-৪৫ মিঃ এর মধ্যেই খাওয়া শেষ করে শেষবারের মত সবাইকে বিদায় জানালাম। কাস্টমস চেকিং বিশেষ কিছুই হয় নি। আমার প্লেন ছাড়ার কথা রাত ৮-৪৫ মিঃ কিন্তু দেরী করে রাত ৯-১৫ মিঃ দমদম বিমানবন্দর ত্যাগ করে। মানসিক অস্বস্তি এখন কিছুই নেই যদিও গতকাল সকালে ৭-১২ এর ট্রেণে হাবড়া ছেড়ে আসতে খুব কান্না পাচ্ছিল। দমদমের ইন্টারন্যাশনাল লাউঞ্জে বসে এই ডাইরী লেখা শুরু। আমার প্লেন যখন ছাড়ল তখন রাত ৯-৫৫। এখন প্লেনে চেপেছি মনে হচ্ছে না। খুবই স্বাভাবিক লাগছে। অন্যান্য প্যাসেঞ্জার সবাই নির্বিঘ্নে ঘুমাচ্ছে। এখন মুম্বাই এর পথে উড়ে চলেছি। কান দুটো মাঝে মাঝে ভোঁ ভোঁ করছে।

শারীরিক বা মানসিক অস্বস্তি কিংবা দৌর্বল্য একদম নেই। বেশ ভালই লাগছে এত দূরের যাত্রী হিসেবে সংগীহীণ হলেও। আমার এখনকার flight হচ্ছে AI 315 (CCU/BOM) সীট-A14.

ক্রমশঃ

http://www.jaladarchi.com/2023/05/late-fiction-writer-samaresh-majumder.html


Post a Comment

0 Comments