জ্বলদর্চি

বনসৃজনে ও পরিবেশ রক্ষায় পথিকৃৎ রবীন্দ্রনাথ/প্রসূন কাঞ্জিলাল

বনসৃজনে ও পরিবেশ রক্ষায় পথিকৃৎ রবীন্দ্রনাথ
        
প্রসূন কাঞ্জিলাল


প্রকৃতিপ্রেমী কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ তার ‘টিনটার্ন অ্যাবে’ কবিতায় ওয়ে নদীর তীরে নদীর আওয়াজ নয়, শুনতে পেয়েছিলেন কান্নার শব্দ। নদী বুজে যাওয়ার সেই শব্দ জানান দিচ্ছিল সভ্যতা ধ্বংসের। ইংল্যাণ্ডে শিল্প বিপ্লবের পর যে বিষাক্ত পরিণাম পদার্থ ওয়ে নদী বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ওয়ার্ডসওয়ার্থ তা দেখে হতাশ হয়েছিলেন। তাঁর মন বিষাদে ভরে উঠেছিল। কিটস, শেলি, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, হুহটম্যান, রবার্ট ফ্রস্ট থেকে বাংলার রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ সবাই  প্রকৃতির নানাবিধ ক্ষতির বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন বারেবারে। এযুগের শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমি দেখি’ কবিতায় কবি একান্তভাবে প্রার্থনা জানিয়েছেন, ‘বাগানে গাছ বসাও আমি দেখি’। একাল সেকাল মিলিয়ে আজও আমাদের গুরুদেবের কথাই বলতে হয়- “দাও ফিরে সে অরণ্য , লও এ নগর। লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর।।”

কবিগুরু র কথায়---- “যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো। তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছো, তুমি কি বেসেছ ভালো?”- ‘প্রশ্ন’ কবিতায় কবি রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টিকর্তার কাছে যে প্রশ্ন রেখেছেন তা চিরন্তন, রবি ঠাকুরের সেই প্রশ্ন আজ আমাদেরও। নগরসভ্যতার বিকাশের জন্য পরিবেশের সঙ্গে যথেচ্ছাচার একদিন হয়ত আমাদের ধ্বংস করে ফেলবে। আমরা বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে পরিবেশ দিবস পালন করে সত্যিই পরিবেশকে রক্ষা করতে পারব তো ? প্রকৃতি প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষ আগেই তা বুঝতে পেরেছিলেন। আর আজও আমরা  বুঝেও অবুঝ। 
   কলকাতার জমিদার বংশের সন্তান রবি ঠাকুর একবার বলেছিলেন, “ কলকাতায় থাকলে প্রকৃতিকে ভুলে যেতে হয়।” সত্যিই তাই , জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে মানুষ হয়েও একদা বালক রবিকে বলতে শোনা গেছিল- "বিশ্ব প্রকৃতিকে আড়াল আবডাল হইতে দেখিতে হইত"। প্রকৃতির মাঝে মানবের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ছাড়াও  কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, নওগাঁর পতিসর বা সিরাজগঞ্জের সাহজাদপুরে যখন তিনি তাঁর জমিদারির কাজে গেছেন এবং থেকেছেন, তখন কবির দীর্ঘসময় কেটেছে নদীর সঙ্গে— পদ্মা, নাগর, করতোয়া, ইছামতী, বড়াল, আত্রেয়ী, যমুনা নদীতে ভেসে বেড়িয়েছেন।‘পদ্মা’ নামের বজরায় তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলার নদীপথ। 

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যেও প্রকৃতির উপস্থিতি অবাধ। তাঁর গান, গল্প, নাটক, উপন্যাস, কাব্য সর্বত্রই প্রকৃতিকে ঘিরে। রবীন্দ্রনাথ শুধু মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক নিয়ে বিস্তৃতভাবেই লেখেননি, তিনি শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করে তার বাস্তব রূপও দেখিয়েছিলেন। সবদিকে সবুজবেষ্টনী দ্বারা শান্তিনিকেতন ঘেরা, যে শান্তিকেতন একসময় ছিল রুক্ষশুষ্ক তাকেই তিনি এক নতুন রূপ দিলেন। শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছিলেন মুক্তচিন্তার মধ্য দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার পথ।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন পরিবেশবাদী। তাই কবি প্রকৃতির প্রতি সচেতন হয়ে ‘বৃক্ষরোপণ’ নামে গাছ লাগানোর একটি উৎসবেরও সূচনা করেছিলেন শান্তিনিকেতনে।

বড়ো বড়ো গাছ গুরুদেব খুব পছন্দ করতেন। বলতেন, "আমি ভালোবাসি অরণ্য - বড়ো বড়ো গাছ, বনস্পতি। তার ছায়া প্রাণ মাতিয়ে তোলে। অনেকে আবার তা সহ্য  করতে পারেন না; যখনই দেখেন গাছ বড়ো হল, অমনি কাট তাকে। ঐ একটু একটু গাছে একটু একটু রঙ নিয়েই তারা খুশি। আশ্চর্য, বড়ো গাছের মাথায় যখন মেঘ করে আসে, তার সৌন্দর্যের কি তুলনা হয় - যখন সেই মেঘের ছায়া এসে পড়ে ঐ একটু একটু গাছের উপরে - তার সঙ্গে?"

বর্ষার জল পেয়ে মাটির তলার কবেকার কোন্ শুকনো বীজ অঙ্কুরিত হয়ে এখানে-ওখানে মাথা তুলত; গুরুদেব খুব খুশি হয়ে উঠতেন, ঘুরে ঘুরে দেখে বেড়াতেন। সেই সেই গাছ সেখানেই বাড়তে দিতেন। বড়ো গাছ কেউ কাটলে তিনি প্রাণে ব্যথা পেতেন। আগে আশ্রমে আতা গাছ ছিল না। আতা যে সে মাটিতে হতে পারে তা জানা ছিল না কারো। একবার দু-তিনটে আতা গাছ হল উত্তরায়ণে, খুব ভালো আতা ফলল। গুরুদেব আতা খেয়ে বীজগুলি প্লেটে না রেখে হাতে নিয়ে দু দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতেন। বলতেন, "হোক গাছ - যেখানে যেখানেই ঠাঁই পাবে শিকড় মেলুক এরা; পথ-চলতি লোকেরাও তুলে নিয়ে খাবে একদিন এ ফল।"
সেই বীজ হতে পরে অনেক গাছ হয়েছিল উত্তরায়ণে। 'শ্যামলী' বাড়ির ধারে এক সময়ে আতা গাছের বেড়াই তৈরি হল গুরুদেবের ফেলা বীজ হতে। কত তাল, জাম, হিমুঝুরি, মহানিম হয়েছে এখানে-ওখানে আশ্রমে বর্ষার জলে আপনা হতে।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
 'কোনার্ক' বাড়ির সামনের বারান্দার ঠিক সামনে উঠল এক শিশু শিমুল এক বর্ষার শেষে। গুরুদেব দেখে খুব খুশি। দিনে দিনে তাকে লালন করেন, গোড়ায় জল নিয়মিত ঢালান। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভয় পান, শিমুলগাছ আকারে বেজায় বাড়ে, আর তেমনই তার পলকা দেহ। ঝড়ে হাওয়ায় ভেঙে যদি পড়ে কখনো, বারান্দার ছাদ যাবে ধসে। গাছটাকে ওখানে হতে না-দেওয়াই ভালো।
গুরুদেব দুঃখ পান শুনে। দিনে দিনে সে গাছ মাথা ছাপিয়ে ওঠে। আর এক বর্ষায় মালতীলতা দেখা দেয় তার তলায়, গুরুদেব মালতীর লিকলিকে কচি লতাটি তুলে জড়িয়ে দেন কিশোর শিমুলের গায়ে। লতা বেড়ে উঠুক আশ্রয় পেয়ে। সেই শিমুল শেষে একদিন মহীরুহতে পরিণত হল। মালতী তার সর্বাঙ্গে পাকে পাকে জড়িয়ে আছে আজও। এই শিমুলের ছায়ায় গুরুদেব কত সকালে কত বিকেলে বসে চা খেয়েছেন, গল্প করেছেন। মাথার উপরে ডালে ডালে কচি পল্লব দুলেছে, মাটিতে শিমুল ফুল লুটিয়ে পড়েছে, ফল ফেটে হাওয়ায় তুলোর ঝরনা ঝরেছে। বর্ষায় শুভ্র মালতী লাল কাঁকরের উপর সাদা গালিচা বিছিয়েছে। এই মালতীকে নিয়েই গুরুদেব গান গেয়েছেন, "তব ভবনদ্বারে রোপিলে যে মালতী সে মালতী আজি বিকশিতা"।

বারান্দার একপাশে ছিল নীলমণি লতা, এধারে ওধারে মধুমালতী, ছিল কুরচি গোলঞ্চ হেনার মঞ্জরী। সবাইকে নিয়ে জড়িয়ে যেন থাকতেন তিনি। কার কবে কুঁড়ি এল, কে কবে ফুল ফোটাল, কখন তারা কোন্ সময়ে পাতা ঝরিয়ে দিল, দিনে দিনে চেয়ে দেখতেন। যেন কথা কইতেন তাদের সঙ্গে। যেন তারা ছিল তাঁর বড়ো আপন জন।

গুরুদেব ‘হলকর্ষণ’ নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। ১৯২৫ সালের ২৫ বৈশাখ কবির জন্মোৎসব পালিত হয় শান্তিনিকেতনে। ‘বৃক্ষরোপণ’ উপলক্ষে সেদিন কবির সদ্য রচিত গানও গাওয়া হয়।  রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। কনিষ্ঠা কন্যা মীরার বিয়ের পর জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে বিদেশ পাঠান কৃষিবিদ্যা শেখার জন্য। যে যুগে সন্তানদের আইসিএস বা ব্যারিস্টার বানানো ছিল উচ্চবিত্ত বাঙালি জমিদার পরিবারগুলির 'এলিট রীতি', সে সময় রবি ঠাকুর জমিদারের পুত্র হয়েও জামাতা আর বন্ধুপুত্রকে চাষাবাদ শিখতে বিদেশ পাঠানোর মত একটা বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িতও করছেন তিনি। কবিপুত্র এবং কবির বন্ধুপুত্র বিদেশ থেকে ফিরে কবির নির্দেশনায় শুরু করেন বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষ। সার, বীজ, সেচ ইত্যাদির ব্যবহার সম্বলিত কৃষিকাজ শুরু করলেন তাঁরা। 

এছাড়াও কুটির শিল্প স্থাপন করে রবীন্দ্রনাথকে গ্রামীণ মানুষকে কৃষিজ-শিল্পে উৎসাহিত করতে দেখা যায়।এটিও তার পরিবেশ সচেতনতার অংশ। একজন একনিষ্ঠ প্রকৃতি-কর্মী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। কৃষি ব্যাঙ্ক স্থাপন, ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ ও কৃষিকাজের নানাবিধ উন্নতি সাধন করেন তিনি। পরিবেশকে বিপর্যস্ত ও বিপন্ন হতে দেখে কবি বারেবারে বিচলিত হয়েছেন।১৯১৪ সালের ঘটনা, জাপান যাওয়ার পথে একটি জাহাজ থেকে তেল পড়তে দেখে তিনি অবাক হয়ে যান। আধুনিক মানুষের প্রকৃতির প্রতি এই উদাসীন মনোভাব কবিকে তীব্র ভাবে নাড়া দেয়। রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই উন্নয়নে বিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু পরিবেশকে বিপর্যস্ত করে একেবারেই নয়।

রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষ আগে পরিবেশের রুগ্ন দশা দেখে তা রক্ষার ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছিলেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। ‘শিল্পায়ন, নগরায়ণে'র নামে ফসলি জমির যে ক্ষতি হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ তা দেখে বিচলিত হন। লেখেন একের পর এক প্রবন্ধ - ‘পল্লী-প্রকৃতি’ ‘ভূমিলক্ষী’ ,‘দেশের কাজ’, ‘শ্রীনিকেতন’ ,‘পল্লী সেবা’ ও ‘উপেক্ষিতা পল্লী’। একটি শিমুল গাছের প্রতি প্রেম থেকে লেখেন ‘বলাই’ গল্পটি। একাধিক লেখায় রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়েছেন তিনি একজন প্রথম সারির পরিবেশ সচেতন দার্শনিক।রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে তাই প্রকৃতির উপস্থিতি অবাধ। তাঁর গান, গল্প, নাটক, উপন্যাস, কাব্য সর্বত্রই প্রকৃতিকে ঘিরে। ‘ছিন্নপত্র’ পাঠ করলে আমরা বুঝতে পারি কতখানি প্রকৃতি প্রেমিক মানুষ ছিলেন।
   বিশ্বমানবতার এই মহান কবি যদিও পরিবেশ বলতে বিশ্বমানবের পরিবেশই বুঝতেন, তবু তাঁর স্বদেশই ছিল এর কেন্দ্রে। তাঁর বাংলাদেশ ছিল, নগরবাংলা নয়, গ্রামবাংলা, সবুজ পত্রপল্লবে ঢাকা পাখিডাকা নদীমাতৃক বাংলাদেশ।
কবির মৃত্যুদিনকে তাঁর আশ্রমে বৃক্ষরোপণের দিন হিসেবে চিহ্নিতকরণের ভিত্তিটি শুধুই নবজীবনের উদ্বোধন নয়, আরো গভীর এবং ব্যাপক। সেটি অনুধাবন করতে হলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বৃক্ষের সম্পর্কটা সম্যক জানতে হবে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, তিনি প্রথম জন্মেছিলেন বৃক্ষ হয়েই। ছিন্নপত্রের ৬৪ তথা ছিন্নপত্রাবলীর ৭০-সংখ্যক পত্রটি কবির আত্মপরিচয় উন্মোচনের পরম্পরায় পাঠককে যেন প্রকৃতি থেকে মনুষ্যের বিবর্তনের একেবারে আঁতুড়ঘরেই নিয়ে যায়। ছিন্নপত্রের ৬৭ তথা ছিন্নপত্রাবলির ৭৪-সংখ্যক পত্রটি যেন প্যান্থিজমের ডেক্লারেশন, অর্থাৎ সর্বেশ্বরবাদের নির্বাচন। বৃক্ষময় পল্লীপ্রকৃতির সঙ্গে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে একেবারে একাকার হয়ে আছেন কবি।
রবীন্দ্রনাথ ‘এই পৃথিবীর নূতন মাটিতে কোথা থেকে এক প্রথম জীবনোচ্ছ্বাসে গাছ হয়ে পল্লবিত হয়ে উঠেছিলেন’ এবং ‘তার পরেও নব নব যুগে এই পৃথিবীর মাটিতে’ জন্মেছিলেন বলেই তাঁর মৃত্যুদিনটিকে বৃক্ষরোপণের দিন অর্থাৎ নব নব জীবন উদ্বোধনের দিন হিসেবে ধার্য করা হয়। ১৯২৫ সালের পঁচিশে বৈশাখ কবির জন্মোৎসব পালিত হয় শান্তিনিকেতনে।
     উত্তরায়ণের উত্তর দিকে ‘পঞ্চবটী’ (অর্থাৎ অশত্থ, বিল্ব, বট, আমলকী ও অশোক) প্রতিষ্ঠা করা হয় জন্মোৎসবের অঙ্গ হিসেবে উত্তরায়ণের উত্তর-পশ্চিম সীমানায়। বৃক্ষরোপণ উপলক্ষে সেদিন কবির সদ্য রচিত গান ‘মরুবিজয়ের কেতন উড়াও’ গীত হয়।
শান্তিনিকেতনে আনুষ্ঠানিক বৃক্ষরোপণ শুরু হয় আরো তিন বছর পরে ১৯২৮ সালের ১৪ জুলাই। তার দশদিন পর প্রতিমা দেবীকে লেখা এক চিঠিতে কবি জানালেন, "এখানে ও শ্রীনিকেতনে যে দুটো উৎসব হয়ে গেছে তার সমস্ত বিবরণ তোমরা পেয়েছ। এখানে হোলো বৃক্ষরোপণ, শ্রীনিকেতনে হোলো হলচালন। শাস্ত্রীমশায় সংস্কৃত শ্লোক আওড়ালেন, আমি একে একে ছটা কবিতা পড়লুম।" যে ছটা কবিতা কবি পাঠ করেছিলেন, সেগুলি পঞ্চভূতের উদ্দেশ্যে রচিত, ক্ষিতি কিংবা পৃথিবী, অপ্ অথবা জল, তেজ কিংবা আলোক, মরুৎ অথবা বায়ু, ও ব্যোম কিংবা আকাশ। ষষ্ঠ কবিতাটি মাঙ্গলিক।
নন্দলাল বসু ও সুরেন্দ্রনাথ করের তত্ত্বাবধানে সুসজ্জিত হন পঞ্চভূত। এঁরা ছিলেন : ক্ষিতি- সত্যেন্দ্রনাথ বিশি, অপ-সুধীর খাস্তগীর, তেজ-প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, মরুৎ- মনোমোহন ঘোষ, ব্যোম- অনাথনাথ বসু। বৃক্ষ বহন করে এনেছিলেন আরিয়াম ও বিনায়ক মাসোজি। বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠান হয়েছিল গৌড়প্রাঙ্গণে। এই উপলক্ষে কবি তাঁর সদ্যরচিত ‘বলাই’ গল্পটি পাঠ করেছিলেন।
     এর আগেও কবি বৃক্ষরোপণ করেছেন বেশ কয়েকবার, তবে বিদেশের মাটিতে। ১৯২৬ সালে চিকিৎসকদের পরামর্শে হাঙ্গেরির বালাতন হ্রদের তীরে এক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিশ্রামের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে তিনি ‘Lindentree’এর চারা রোপণ করেন ৮ নভেম্বরে। সেই বৃক্ষরোপণ উপলক্ষে কবি লেখেন :
"হে তরু, এ ধরাতলে রহিব না যবে
সেদিন বসন্তে নব পল্লবে পল্লবে
তোমার মর্মরধ্বনি পথিকেরে কবে
‘ভালোবেসেছিল কবি বেঁচেছিল যবে’।।"
   আবার রবীন্দ্রনাথ ১৯২৬ সালে ভিয়েনায় বসে লিখছেন বনবাণী কাব্যগ্রন্থের ভূমিকাংশটি। বৃক্ষের গুরুত্ব অনুধাবন করে তিনি এরপর লিখে চললেন এক একটি কবিতা। গাছের মধ্যে তিনি বিশ্বসংগীতের ধারা অনুভব করতেন। বিশ্বভারতীতে রোপিত গাছগুলোকে তার মনে হতো বিশ্ববাউলের একতারা। এদের পাতায় পাতায় ছন্দের নাচন।
   শুধু কবিতায় নয় রবীন্দ্রনাথ প্রায়োগিকভাবে বৃক্ষাদিরোপণ ও সবুজায়নের কাজটি করেছেন। শুধু প্রকৃতিতাত্ত্বিক হয়ে রবীন্দ্রনাথ সন্তুষ্ট হননি, বরং কর্মের মধ্যদিয়ে তিনি প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন করেছেন। নামহীন বৃক্ষ লতার নাম দিয়ে মানুষের মাঝে পরিচিত করেছেন নতুন নতুন প্রজাতিকে। শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে রবীন্দ্রনাথের বাসগৃহের সামনে বন্ধু পিয়ার্সনের দেওয়া বিদেশি চারা রোপণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। একসময় এই গাছ নীল ফুলে ভরে ওঠে। নামহীন অসম্ভব সুন্দর এই ফুলটির নাম রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন ‘নীলমণিলতা’। একইভাবে ‘মধুমঞ্জরি’র বাংলা কোনো নাম সেকালে ছিল না। ফুলের রূপে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ নাম দিলেন ‘মধুমঞ্জরি’। 
কেন এই বৃক্ষরোপণ উৎসব সে বিষয়ে কবি তাঁর মনোভাব স্পষ্ট করে জানিয়েছেন ১৯৩৯ সালে। তিনি বলেন :
"পৃথিবীর দান গ্রহণ করবার সময় মানুষের লোভ বেড়ে উঠল। অরণ্যের হাত থেকে কৃষিক্ষেত্রকে সে জয় করে নিলে, অবশেষে কৃষিক্ষেত্রের একাধিপত্য অরণ্যকে হটিয়ে দিতে লাগল। নানা প্রয়োজনে গাছ কেটে কেটে পৃথিবীর ছায়াবস্ত্র হরণ করে তাকে নগ্ন করে দিতে লাগল। তার বাতাস হল উত্তপ্ত, মাটির উর্বরতার ভার নিঃস্ব হল। এই কথা মনে রেখে কিছুদিন পূর্বে আমরা যে অনুষ্ঠান করেছিলুম সে হচ্ছে বৃক্ষরোপণ, অপব্যয়ী সন্তান কর্তৃক মাতৃভার পূরণ করবার কল্যাণ-উৎসব।"
১৯২৮ সালের বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানটির মন্ত্রপাঠে এ কথাই বলা হল যে বৃক্ষদের জন্ম শ্রেষ্ঠ। সকল জীব এদের অবলম্বন করে জীবিত থাকে। যাচকেরা এর নিকট থেকে নিরাশ হয়ে ফিরে যায় না। পত্র, পুষ্প, ফল, ছায়া, ফুল, বল্কল, কাষ্ঠ, গন্ধ, রস, ক্ষার, সার, অঙ্কুর- এই সকলের দ্বারা এরা লোকের কাম্যবস্তু দান করে। সংসারে সকল সম্পদের হেতু, ভূমিলক্ষ্মীর কেতুস্বরূপ ও জীবগণের জীবনৌষধীস্বরূপ এই তরুগণ অক্ষত হয়ে বেঁচে থাকুক।
১৯৩২ সালে অনুষ্ঠানে নতুনত্ব এল। উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভুবনডাঙা গ্রামে। বিশ্বভারতীর উদ্যোগে গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় জলাশয় পরিষ্কার করে তার তীরেই উৎসব  হয়েছিল। কবি রোপণ করেছিলেন কৃষ্ণচূড়া। ১৯৩৩ সালে শান্তিনিকেতনের পার্শ্ববর্তী সাঁওতাল গ্রামে বিশ্বভারতীর ‘হলকর্ষণ ও বৃক্ষরোপণ’ উৎসব সম্পন্ন হয়েছিল। অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করেন আশ্রমগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁকে সাহায্য করেন ক্ষিতিমোহন সেন। কবি আসন গ্রহণ করলে সাঁওতালরা তাঁকে হাতে বোনা কাপড় উপহার দেয়। পরে ক্রমান্বয়ে হলকর্ষণ ও বৃক্ষরোপণ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
এর পরের বছর বর্ষামঙ্গল, হলকর্ষণ ও বৃক্ষরোপণ উৎসব শ্রীনিকেতনে অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসবে কবি তাঁর ভাষণে বলেন, "মানুষ গৃধ্নুভাবে প্রকৃতির দানকে গ্রহণ করেছে, প্রকৃতির সহজ দানে কুলোয় নি, তাই সে নির্মমভাবে বনকে নির্মূল করেছে। তার ফলে আবার মরুভূমিকে ফিরিয়ে আনবার উদ্যোগ হয়েছে।…এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হলে আবার আমাদের আহ্বান করতে হবে সেই বরদাত্রী বনলক্ষ্মীকে আবার তিনি রক্ষা করুন এই ভূমিকে, দিন তাঁর ফল, দিন তাঁর ছায়া।"
তাহলে দেখা যায় যে আজকের পরিবেশ আন্দোলনের পথিকৃতের ভূমিকাও রবীন্দ্রনাথেরই, যা তিনি শান্তিনিকেতনে শুরু করেন ১৯২৫ সালে পঞ্চবটী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এবং জোরদার করেন ১৯২৮ সালে বর্ষাঋতু-উৎসব উদযাপনের চল করার মধ্য দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান-লেখিকা র‌্যাচেল কারসন-এর একটি পুস্তকের সূত্রে সেখানে আকস্মিকভাবে পরিবেশচর্চার সূচনা ও প্রসার ঘটে, বঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ-উন্নয়ন কর্মকাণ্ড জোরদার করার প্রায় চার দশক পরে।
বিদেশে পরিবেশ চেতনা ও চর্চার কিছু তথ্য এখানে উল্লেখ্য, শুধু এ সত্যটুকুর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে যে, বিষয়টির মর্মবস্তু রবীন্দ্রনাথ কত আগে এবং কত গভীরভাবে বলে গেছেন এবং কর্মেও পরিণত করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত সেই বৃক্ষরোপণ প্রথার উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষাশ্রম শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন এলাকার অনুসরণে বৃক্ষরোপণ-উৎসব যেন দেশময় প্রচলিত হয় এবং তাঁর প্রিয় স্বদেশের পরিবেশ যেন কখনো কলুষিত না হয়।
'বৃক্ষবন্দনা' কবিতায় কবি লিখছেন-
  " মৃত্তিকার হে বীর সন্তান,
সংগ্রাম ঘোষিলে তুমি মৃত্তিকারে দিতে মুক্তিদান
মরুর দারুণ দুর্গ হতে;যুদ্ধ চলে ফিরে ফিরে;
সন্তরি সমুদ্র-ঊর্মি দুর্গম দ্বীপের শূন্য তীরে
শ্যামলের সিংহাসন প্রতিষ্ঠিলে অদম্য নিষ্ঠায়,
দুস্তর শৈলের বক্ষে প্রস্তরের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়
বিজয়-আখ্যানলিপি লিখি দিলে পল্লব-অক্ষরে
ধূলিরে করিয়া মু্‌গ্ধ, চিহ্নহীন প্রান্তরে প্রান্তরে
ব্যাপিলে আপন পন্থা।"
  বর্তমানে সারা বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতার তাগিদে সাড়ম্বরে প্রতি বছর ৫ই জুন পালিত হয় ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’। ১৯৭২ সালের ৫ থেকে ১৬ জুন অবধি জাতিসংঘের মানবিক পরিবেশ কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। আর সেখানেই ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। 'বিশ্ব পরিবেশ দিবস' প্রথম পালিত হয় ১৯৭৩ সালে। প্রতিবছরই এই দিনটি আলাদা আলাদা শহরে, আলাদা আলাদা বিষয় ও উক্তি নিয়ে পালিত হয়। উত্তর গোলার্ধে দিবসটি বসন্তে আর দক্ষিণ গোলার্ধে দিবসটি শরতে পালিত হয়।
     আজ বিশ্ব পরিবেশ  এক বিরাট প্রশ্ন চিহ্নের সম্মুখীন ফলে আগামী প্রজন্মকে সুরক্ষিত রাখতে  বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠিত হচ্ছে নানান দিবস ও তৈরী হয়েছে নানা নিয়মাবলী। ১৯৭০ সালে ‘আর্থ ডে’, ১৯৭২ সালে স্টকহোমে মানব-পরিবেশ শীর্ষক কনফারেন্স, ১৯৮০-র দশকে লন্ডন, ব্রাজিল ও ভিয়েনা কনভেনশন, ১৯৯২ সালে রিয়ো-তে বসুন্ধরা সম্মেলন, কিয়োটোতে পরিবেশ মহাসম্মেলন। তারই জের হিসেবে বিভিন্ন দেশের দি ওয়াইল্ড লাইফ অ্যাক্ট, দি ওয়াটার অ্যাক্ট, দি এয়ার অ্যাক্ট, দি ফরেস্ট কনজারভেশন অ্যাক্ট ইত্যাদি পদক্ষেপ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার অবিলম্ব প্রয়োজন সম্পর্কে সমগ্র বিশ্বকেই সচেতন করতে চেয়েছে।
অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরিবেশ-সংকটকে এমনি প্রকট করে তুলবার বহুপূর্বেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই রবীন্দ্রনাথ বোঝাতে চেয়েছিলেন যে প্রাণের প্রাচুর্য এবং প্রকৃতির মাধুর্য নিয়ে আমাদের পৃথিবীটি যেন একটি বড়ো সমাজ যার পরিবেশকে সুন্দর এবং স্বাস্থ্যকর রাখতে হবে। প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এই ভূমিশ্রীকে মর্যাদা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে এই জগতের বাস্তুব্যবস্থার একটা প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা আছে, সীমা আছে। দূষণভার সহনক্ষমতার প্রায় শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছে আমাদের এই ধরাধাম। পৃথিবীর মাটির নিচের ‘ফসিল-ফুয়েল’ সীমাবদ্ধ। তাই মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে তার মাটির উপরের ‘রিনিউয়েবল ফুয়েল’ তথা পুনরুৎপাদনশীল জলজ ও স্থলজ, স্থাবর ও জঙ্গম প্রাণসম্পদের ওপর।
পুনরুৎপাদনধর্মী ইন্ধন হিসেবে বৃক্ষ মানুষের অশেষ শক্তির জোগানদার এবং অফুরান অক্সিজেন-চেম্বার হিসেবে মানুষের স্বাস্থ্যের অতন্দ্র প্রহরী। তাই বৃক্ষরোপণ-উৎসব ও বর্ষাঋতু-উৎসবের ধারাটি রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তন করেছিলেন দেশের মানুষের ভবিষ্যৎ ক্ষয়ক্ষতিজনিত ক্ষতিপূরণের সংস্থানস্বরূপ।
প্রতীচ্যের পরিবেশ সচেতনতার এত আগে প্রাচ্যের মনীষী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দূষণমুক্ত পরিবেশ সংরক্ষণের চিন্তা ও কার্যকর ব্যবস্থা তাঁর নিরন্তর স্বদেশভাবনারই মহত্তম প্রকাশ যা আদর্শ হতে পারে সকল মানুষের স্বদেশভাবনার।

তথ্যঋণ :----
১. রবীন্দ্রজীবনী- প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়
২. রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ ভাবনা- আবদুশ শাকুর
৩. প্রকৃতি ও পরিবেশ: রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ও ভাবনায়---- জয়ন্ত কুমার বিশ্বাস
৪.রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ
৫. ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্য তথ্য



Post a Comment

1 Comments