জ্বলদর্চি

হিউয়েন সাং ও জঙ্গলমহল/সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব- ৬৯
হিউয়েন সাং ও জঙ্গলমহল

সূর্যকান্ত মাহাতো


'চীন' দেশের নামটা নাকি ভারতীয়দেরই দেওয়া। না, না, এটা কোন ভারতীয়রা দাবী করেননি। বরং চীনা পুরাতত্ত্ববিদরাই এটা সুনিশ্চিত করেছেন। মহান পন্ডিত বললেও যার সম্পর্কে কম বলা হয় সেই প্রাচ্যবিদ্যার্ণব  'নগেন্দ্রনাথ বসু' তাঁর 'বিশ্বকোষ'(ষষ্ঠ খণ্ড) গ্রন্থের ৩৬২ পৃষ্ঠায় একথা উল্লেখ করেছেন। 

শুধু তাই নয়। চীনা সংস্কৃতির উপরও ভারতীয় সংস্কৃতি দারুণ প্রভাব ফেলেছে। চীনা বর্ণমালা থেকে শুরু করে অঙ্ক, জ্যোতিষ শাস্ত্র, সাহিত্য সংস্কৃতি সবেতেই তার উদাহরণ আছে। না, একথাগুলো কোন মনগড়া নয়। চীনা ইতিহাস গ্রন্থ "Outlines of Chinese History"/ Li Ung Bing -তেই সেকথা লেখা আছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের মধ্য দিয়েই। চৈনিক পরিব্রাজকেরা আমাদের দেশে এসেছিলেন বৌদ্ধ তীর্থস্থানগুলোতে ভ্ৰমণ এবং প্রাচীন বৌদ্ধ শাস্ত্রগুলোর গভীর অনুসন্ধান করতে। সেরকমই এক চীনা পরিব্রাজক নাম হিউয়েন সাং শুধু এদেশেই নয় বাংলা এমনকি জঙ্গলমহলেও(?) এসেছিলেন।

রাঁচি কলেজের অধ্যাপক ও গবেষক বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত তার "ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য" গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন 'ছোটনাগপুর এবং সন্নিহিত পশ্চিমবাংলা' নামে এই অঞ্চলে একদা চীনা পরিব্রাজক 'হিউয়েন সাং' নাকি পা রেখেছিলেন। তার মানে এই জঙ্গলমহলে 'শ্রীচৈতন্যদেব' ও শেষ জৈন তীর্থঙ্কর 'মহাবীরের' মতো হিউয়েন সাংও একদিন জঙ্গলমহল তথা ছোটনাগপুরে এসেছিলেন! কিন্তু কিছুতেই হিউয়েন সাঙের এখানে আগমনের কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না। আবার অন্য মতটিও ফেলে দিতে পারছি না। তার কারণ কথাটা তো বঙ্কিমবাবু আর এমনি এমনি বলেননি! নিশ্চয়ই বড় কিছু প্রমাণ তিনি পেয়েছেন। কিন্তু কি সেই প্রমাণ? উনি প্রমাণ হিসাবে "Manbhum District Gazetteer" এর কথা উল্লেখ করেছেন। সেখানে হিউয়েন সাঙের বর্ণনা অনুযায়ী ওই গেজিটিয়ারের ৪৬ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে,
"These (Huen Tsang's Accounts) as interpreted by Cunningham, show that between Orissa on the south, Magadh or Bihar (Buddhist manasteries are called Biharas) on the north, Champa (query Bhagalpur and Burdwan) on the east and Maheswara (i.e. Central India) on the west lay the kingdom of kie-lo-na-su-fa-lana or the kingdom of karnasuvarna, ordinarily identifiedwith the Suvarna Rekha river. This General Cunnigham writes, must have comprised all the petty hill states lying between Midnapore and Surguja on the east and west and between the sources of Damodar and Vaitaram on the north and south."

তবুও আমার মনে সন্দেহ ও প্রশ্ন দুটোই জাগছে। হিউয়েন সাং কি আদৌ এসেছিলেন? নাকি তার সঙ্গে যোগসূত্রটা জোরপূর্বক জুড়ে দেওয়া হয়েছে! আবার যদি নাই এসে থাকেন তাহলে বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতর মতো মানুষ কিংবা মানভূমের গেজেটিয়ারে সে কথা বলা হয়েছেই বা কেন? আবার যদি এসেও থাকেন তাহলে ঠিক কোথায় এসেছিলেন? উনি বাংলায় যে এসেছিলেন একথা সর্বৈব সত্য। কিন্তু তার সঙ্গে এই জঙ্গলমহলের যোগসূত্রটা ঠিক কোথায়? তবে কি প্রাচীনকালে এই জঙ্গলমহলের বিস্তার আরো বেশি ছিল?
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
আসল সত্যটা জানতেই এক বন্ধুর সঙ্গে শুরু করলাম পড়াশোনা। সেই অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেশ কয়েকটা গ্রন্থের নাম পেলাম। বিপুল সাহা রচিত 'হিউয়েন সাঙের ভারত ভ্রমন', প্রেমময় দাশগুপ্তের 'হিউয়েন সাং এর দেখা ভারত', সত্যেন্দ্রকুমার বসুর 'হিউ এন চাঙ',  অসীম কুমার রায়ের 'বঙ্গ বৃত্তান্ত', যোগীন্দ্রনাথ সমাদ্দারের 'বৌদ্ধ যুগের ভারত' এবং খুররম হোসেনের 'হিউয়েন সাঙ ভ্রমণ কাহিনী' । দেখলাম সবকটা গ্রন্থই একটি মূল গ্রন্থ বা বইকে অনুসরণ করে লেখা হয়েছে। আর সেই মূল গ্রন্থটি হল- স্যামুয়েল বিল রচিত  'Si-Yu-Ki: Buddhist Records of the Western World'/ Samuel Beal বা  'Records of Western countries'.  বিল সাহেবের এই গ্রন্থ হিউয়েন সাঙের চীনা ভাষায় লেখা 'সি-ইউ-কি' গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ। এবং সেই গ্রন্থটিই পরবর্তীকালে বাংলা ভাষায় অনেকেই অনুবাদ করেছেন।

"হিউয়েন সাং কোন সময় ভারতে এসেছিলেন?"

"শ্রী যোগীন্দ্রনাথ সমাদ্দার তার "সমসাময়িক ভারত" দ্বিতীয় কল্প 'চৈনিক পরিব্রাজক',( প্রথম খন্ড) গ্রন্থে জানাচ্ছেন, 'হিউয়েন সাং' ভারতে এসেছিলেন ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে। এবং ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মোট ১৭ বছর তিনি ভারতে ছিলেন।"

"আর বাংলায় এসেছিলেন ঠিক কোন সময়?"

"অসীম কুমার রায়ের মতে তিনি বাংলায় আসেন ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে। অসীম কুমার রায় তার 'বঙ্গ বৃত্তান্ত' গ্রন্থে জানাচ্ছেন 'পুন্ড্রবর্ধনে' হিউয়েন সাং যখন আসেন তখন সময়কাল ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই জানুয়ারি। এরপর 'কর্ণসুবর্ণ' যখন পৌঁছান তখন সময়কালটা ছিল ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২০শে এপ্রিল। তখন গ্রীষ্মকাল। রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যও  তার 'চীন থেকে ভারত' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, গ্রীষ্মকালটা হিউয়েন সাং বাংলায় কাটিয়েছিলেন।(চীন থেকে ভারত , পৃষ্ঠা ১৩১) তবে সালটা উনি এক বছর আগে অর্থাৎ ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ বলে উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন অনুবাদকদের লেখায় কিছু কিছু তথ্যের এরকম হেরফের ঘটেছে। সুতরাং যে মূল গ্রন্থটি অবলম্বন করে তারা অনুবাদের কাজটি করেছেন, আমরা বরং সেই গ্রন্থটিতে কী বলা আছে তা নিয়েই বর্ণনা করব। যেমন Samuel Beal এর Si-Yu-Ki: Bbuuddhist Records of the. Western World গ্রন্থের Voll-ii এর Book-X(Records of Western countries) এর ১৯৩ থেকে ২০৪ পাতা জুড়ে বাংলার ভ্রমণ স্থানগুলো নিয়ে আলোচনা আছে। যেমন কজঙ্গল, পুন্ড্রবর্ধন, সমতট, তাম্রলিপ্ত ও কর্ণসুবর্ণ। এরপর  হিউয়েন সাং উড্রো বা উড়িষ্যায় চলে যান।"

"তুমি যে কয়েকটা জায়গার নাম বললে, যেগুলোতে হিউয়েন সাং  তার বর্ণনা দিয়েছেন, সেখানে ছোটনাগপুর বা জঙ্গলমহলের যোগসূত্র আছে এমন কথা তো কোথাও পেলাম না। এখন এই সব স্থানগুলোর মধ্যে ঠিক কোনগুলোর সঙ্গে জঙ্গলমহলের যোগসূত্র আছে? সেটা কীভাবে প্রমাণিত হবে?"

"চলো বাংলা ভ্রমণের যে বর্ণনা হিউয়েন সাং লিখে গেছেন সেখানে এই স্থানগুলো সম্পর্কে তিনি কী বলেছেন, সেগুলো একটু দেখে নিই। তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে। একটু ভালো করে সেই বর্ণনায় নজর দিলে দেখা যায় যে, ওই স্থানগুলোর অবস্থান, ভূপ্রকৃতি, আবহাওয়া ও জলবায়ু, লোকজনের প্রকৃতি এবং ধর্মীয় বিশ্বাস এগুলোকেই তিনি বিশেষভাবে বর্ণনা করে গেছেন। সুতরাং হিউয়েন সাঙের বাংলা ভ্রমণের এই দিকগুলোকে ব্যাখ্যা করলেই ছোটনাগপুর তথা জঙ্গলমহলের সঙ্গে তার পদার্পণের যোগসূত্রটা নির্ণয় করা বা ধারণা করা যেতে পারে। এখন বাংলার ঠিক কোন কোন স্থানগুলোতে তিনি পরিভ্রমণ করেছিলেন আগে সেই স্থানগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে একটু জেনে নেওয়া যাক।

"কাজুঘিরা বা কাজিংহারা। হিউয়েন সাং একে কিএ-চু-হো-খি-লো বলেছেন। নীহাররঞ্জন রায় একে কয়ঙ্গল-কজঙ্গল-কজাঙ্গল-ক-চু-ওয়েন-কি-লো বলে উল্লেখ করেছেন। (বাঙ্গালীর আদি ইতিহাস, পৃষ্ঠা- ১৬১) রাজ্যটি ২০০০ লি. জুড়ে অবস্থিত। এখানকার মাটি সমতল ও দোঁয়াশ। নিয়মিত চাষবাস ও প্রচুর ফসল উৎপাদিত হয়। আবহাওয়া ও জলবায়ু সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন তাপমাত্রা উষ্ণ। এখানকার লোকেরা বেশ সহজ-সরল। গুণীজনেদের যেমন সম্মান করেন তেমনি তারা খুবই উচ্চ প্রতিভা সম্পন্ন। এর দক্ষিণভাগের বনে বন্য হাতির কথারও উল্লেখ রয়েছে।

"পুন্ড্রবর্ধন। হিউয়েন সাং একে 'পুন-না-ফা-তান-না' বলে উল্লেখ করেছেন। রাজ্যটি ৪০০০ লি. জুড়ে অবস্থিত। রাজধানীর পরিধি ৩০ লি। ভূ প্রকৃতি সমতল ও দোঁয়াশ। সব ধরনের শস্য উৎপাদিত হয়। বিশেষ করে 'পান-না-সো' বা  কুমড়ার মতো 'পানসা' ফলের কথা উল্লেখ করেছেন। এখানকার আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। জনবহুল এলাকা। এখানকার লোকেরা বেশ বিদ্যানুরাগী। জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিও উৎসাহী।

"সমতট। হিউয়েন সাং একে 'সান-মো-ত-চ' বলে উল্লেখ করেছেন। রাজ্যটি ৩ হাজার লি. জুড়ে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় অবস্থিত। এর রাজধানীর পরিধি ২০ লি। কানিংহাম 'যশোরকে' এর রাজধানী বলে মনে করেছেন। জমি নিচু ও উর্বর। আবহাওয়া বেশ নাতিশীতোষ্ণ। এখানকার লোকেরা ভদ্র ও পরিশ্রমী, বিদ্যানুরাগী ও বিদ্যা লাভে পরিশ্রমী। লম্বায় বেঁটে এবং গায়ের রঙ কালো। এখানে ৩০টি সাংঘারাম  ২০০০ সাধু এবং শ খানেক দেব মন্দির  আছে। যেখানে বেশির ভাগ সন্ন্যাসীই নির্গ্রন্থ।

"তাম্রলিপ্ত। হিউয়েন সাং একে 'তান-মো-লি-তি' বলে উল্লেখ করেছেন। রাজ্যটি ১৪০০ থেকে ১৫০০ লি জুড়ে অবস্থিত। রাজধানী ১০ লি। একেবারে সমুদ্র তীরে অবস্থিত। জমি নিচু ও উর্বর। চাষবাস হয়। আর প্রচুর ফল ও ফুল জন্মায়। আবহাওয়া বেশ উষ্ণ বা গরম। এখানকার লোকেরা বিশেষ করে পুরুষেরা বেশ কর্মঠ ও সাহসী। যেমন চটপটে তেমনি আবার রূঢ়। এখানে দশটি সংঘারাম এবং এক হাজার সাধু দেখেছিলেন। বৌদ্ধ- অবৌদ্ধ দুই ধরনেরই মানুষ এখানে দেখেছিলেন হিউয়েন সাং।

"কর্ণসুবর্ণ। হিউয়েন সাং একে 'কিয়ে-লো-না-সু-ফা-লা-না' বলে উল্লেখ করেছেন। রাজ্যটি ১৪০০ থেকে ১৫০০ লি। এবং রাজধানীর পরিধি ২০ লি। জমি নিচু ও দো-আঁশ। মূল্যবান ফসল ফলে। প্রচুর ফুল উৎপন্ন হয়। আবহাওয়া বেশ নাতিশীতোষ্ণ। এখানকার লোকেরা সৎ, ভদ্র এবং বিদ্যা ও লেখাপড়ায় বেশ আগ্রহী। নগরটি জনবহুল এবং লোকেরা বেশ ধনী। শশাঙ্কের রাজধানী। এখানে 'লো-টো-ওয়েই-চিহ' বা 'রক্তমৃত্তিকা' নামে একটি সাংঘারামের কথা উল্লেখ করেছেন। ১০টি বিহার ও ৩০০ ভিক্ষু ছিল।"

"কিন্তু এই পাঁচ জায়গার বর্ণনার সঙ্গে এই জঙ্গলমহলের যোগসূত্র তো এখনও নির্ণীত হল না?" 

"এখানে দুটো জায়গাকে উল্লেখ করা যেতে পারে। 'কর্ণসুবর্ণ' এবং 'পুন্ড্রবর্ধন'।"

"'পুন্ড্রবর্ধনকে' মনে করা হল কেন? এর ভৌগোলিক অবস্থান তো উত্তরবঙ্গে?"

বললাম, "কারণ প্রফেসর H.H. Wilson প্রাচীন 'পুন্ড্র' বলতে রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, নদীয়া, বীরভূম, বর্ধমান, মেদিনীপুর, জঙ্গলমহল, রামগড়, পাচিত, পালামান এবং চুনারের কিছু অংশকে উল্লেখ করেছেন। (Quart. Orient. Mag. volume 2 page- 188 and Vishnu Purana, volume- 2, page 134, 170) এখানে উইলসন সাহেব দেখো 'জঙ্গলমহল' কথাটা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছেন।"

"কিন্তু মিস্টার ওয়েস্টম্যাকট পুন্ড্রকে তো পাঞ্জারা জেলার 'পরগনা' রূপেই বর্ণনা করেছেন। এবং বলেছেন দিনাজপুরের বর্ধনকুঠি যা রংপুর থেকে ৩৫ মাইল দূরে উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। শুধু তাই নয়, ফার্গুসন এই জায়গাটাকে রংপুরের কাছেই বলে উল্লেখ করেছেন। তাহলে? উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্রভূমি যার একটা দীর্ঘ অংশ সেই 'পুন্ড্রবর্ধন' কীভাবে দক্ষিণের জঙ্গলমহলের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে? উইলসন মশাইয়ের ওই যুক্তি তাই মানতে পারছি না।"

"কিন্তু আমি যদি বলি, ওই একই কথা নীহারঞ্জন রায়ও বলেছেন তাহলে কি বিশ্বাস হবে?"

"নীহারঞ্জন রায় এ কথা বলেছেন নাকি?"

""বাঙ্গালীর ইতিহাস"(আদি পর্ব) গ্রন্থে তো তিনি স্পষ্টই বলেছেন, পুন্ড্রবরেন্দ্রভূমির সঙ্গে রাঢ়ভূমির বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ- বীরভূম- বর্ধমানের এক সময় ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল।( বাঙ্গালীর ইতিহাস, পৃষ্ঠা- ১৬৪) সুতরাং জঙ্গলমহল যে পুন্ড্রবর্ধন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল না এমন কথা অস্বীকার করি কী করে। উইলসন যে 'জঙ্গলমহলের' উল্লেখ করেছেন তা অস্বীকার করা উচিত নয়। আবার 'কর্ণসুবর্ণ' বলতে পশ্চিম বাংলার বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ও উত্তর বর্ধমানের কথা উল্লেখ করেছেন বিপুল সাহা।(হিউয়েন সাঙের ভারত ভ্রমণ, পৃষ্ঠা- ১১৫) আবার নীহাররঞ্জন রায়ও মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও বর্ধমানের কিছু অংশকে উল্লেখ করেছেন।(বাঙ্গালীর ইতিহাস, পৃষ্ঠা- ১৯০) সুতরাং বীরভূম যে অতীত থেকেই জঙ্গলমহলের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ সেটা তো সকলেই জানি। তাই এই দুই স্থানে বীরভূমের যোগসূত্রতা থেকেও তো একে জঙ্গলমহলের অংশ বলেই বিবেচনা করা যেতে পারে।"

"তাহলে তাম্রলিপ্তের মেদিনীপুরকে কেন ধরব না?"

"ব্রিটিশ পর্বে অবিভক্ত মেদিনীপুর তো 'জঙ্গলমহল জেলা' রূপেই ছিল। সেই যুক্তিতে তাম্রলিপ্তকে ধরা যেতেই পারে। তবে
অন্যান্য স্থানগুলোর সঙ্গে সে সম্ভাবনা কেন ক্ষীণ সেটা নীহাররঞ্জন রাযের ব্যাখ্যা থেকেই বোঝা যাবে। কারণ 'কজঙ্গল' সম্পর্কে হিউয়েন সাং যে বর্ণনা করেছেন, নীহাররঞ্জন রায় তার একটি সুন্দর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। হিউয়েন সাং কজঙ্গলের ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ু সম্পর্কে বলতে গিয়ে এখানকার দুটি ভাগের কথা উল্লেখ করেছেন। একটি 'উত্তরভাগ' ও অন্যটি 'দক্ষিণভাগ'। নীহারঞ্জন রায় দেখিয়েছেন 'উত্তরভাগ' বলতে হিউয়েন সাং দামোদর অজয় ও ভাগীরথীর উপত্যকা ভূমির কথা বলেছেন। কিন্তু সেটা বৈদ্যনাথ- বক্রেশ্বর- বীরভূমের দিক নয়। আবার দক্ষিণে বনপ্রদেশ বলতে বনবিষ্ণুপুরের দিকটি উল্লেখ করেছেন। (বাঙ্গালীর ইতিহাস, পৃষ্ঠা- ১৬১) এমনকি এখানে বুনো হাতির উপস্থিতিও উল্লেখ করেছেন। আবার 'তাম্রলিপ্ত' বলতে মেদিনীপুরের পূর্ব ও  দক্ষিণ -পূর্ব ভাগের কথা বলেছেন। তিনি পশ্চিমভাগের কথা অর্থাৎ যেদিকে জঙ্গল আছে সেদিকের কথা উনি বলেননি। (বাঙ্গালীর ইতিহাস, পৃষ্ঠা- ১৬১) এবার তোমার উত্তরটা নিশ্চয়ই পেয়ে গেলে। আবার 'সমতট' বলতে তখনকার যশোর, ফরিদপুর, ঢাকা অঞ্চলকেই উল্লেখ করেছিলেন।(বাঙ্গালীর ইতিহাস, পৃষ্ঠা- ১৬৬) সুতরাং এই স্থানগুলো কোনভাবেই যুক্ত নয়।"

এই সেই হিউয়েন সাং যার কারণেই ভারতীয় প্রত্নতত্ব বিভাগের যাত্রাপথের সূচনা ঘটেছিল।  হিউয়েন সাঙের উল্লিখিত স্থানগুলোর নাম ও তাদের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করার জন্যই ভারতীয় প্রত্নতত্ব বিভাগ গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে সেই বিবরণ অনুযায়ী কিছু নগরীর ভগ্নাবশেষও উদ্ধার হয়েছে।(হিউ এন চাঙ, সত্যেন্দ্র কুমার বসু, পৃষ্ঠা- ২, ভূমিকা অংশ) এইসব জেনে আমি তখন বেশ অবাক হয়ে পড়েছি।

তথ্যসূত্র: লেখার মধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে।

Post a Comment

0 Comments