জ্বলদর্চি

আমেরিকার আদিম মানুষের খোঁজে-৬/ মলয় সরকার

আমেরিকার আদিম মানুষের খোঁজে 
মলয় সরকার

পর্ব-৬ (ষষ্ঠ পর্ব)

এসেছি Los Alamos নামে একটি জায়গায়। জায়গাটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা। সকালে যাওয়ার কথা একটি দারুণ জায়গায়। 

সকালে এলাম Bandelier National Monumentএ।ভোরের নরম আলো তখন সবে চারিদিক তুলির মত বুলিয়ে দিচ্ছে তার নরম ছোঁওয়ার প্রলেপ। বাতাসেও হাল্কা শীতের ছোঁওয়া। এই জায়গাটি এক ঐতিহাসিক জায়গা। এখানে মানুষ বাস করত প্রায় ১১০০০ বছর আগেও। তবে আমরা যাদের রয়ে যাওয়া চিহ্ন দেখতে এসেছি, তারা যদিও আমেরিকার ইতিহাস অনুযায়ী অনেক প্রাচীন যুগের, আমাদের দেশের তুলনায় তা কিন্তু একেবারেই বিশাল ঐতিহাসিক বা প্রাগৈতিহাসিক নয় , বরং নিতান্তই অর্বাচীন।

 এখানকার ইতিহাস মোটামুটি ১১৫০-১৬০০ খ্রীষ্টাব্দের। তখন আমাদের বাংলায় সেন বংশের রাজত্ব শেষের মুখে। এর পরের দিকে তো চৈতন্য দেব এসে গেলেন অর্থাৎ বাংলার মানুষ তখন যথেষ্ট সভ্য তো বটেই শিক্ষাদীক্ষাতেও অনেক উঁচুতে। আর সেই সমসাময়িক কালে আমেরিকার আদিবাসীরা প্রস্তর যুগে ঘোরাফেরা করছে।কাজেই সহজেই বোঝা যায়, যে, সেখানে সভ্যতা এসেছে অনেক পরে এবং অনেক ধীরে ধীরে।
প্রায় ১৩০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে Jamez পর্বতের Pajaritoউপত্যকা অঞ্চলে রিও গ্র্যাণ্ডে নদীর কাছাকাছি অঞ্চলে ৫০০০ থেকে ১০০০০ ফুট উচ্চতায় ছিল এই আদিবাসীদের বিচরণক্ষেত্র। এই অঞ্চলটি Adolph Francis Bandelier নামে এক সুইস পুরাতত্ববিদের নামে নামাঙ্কিত হয় ,যিনি ১৮৮০ সালে এখানে এসে উপস্থিত হন।তিনি একাই এর অনুসন্ধান করছিলেন।তিনি Santa Feর কাছে যখন Cochiti Puebloর ব্যাপারে অনুসন্ধান করছিলেন, তখন স্থানীয় মানুষেরা তাদের পূর্ব পুরুষদের বাসস্থান দেখাতে আগ্রহী হয়। এর ফলেই আবিষ্কার হয় আমেরিকার আদিবাসীদের সম্বন্ধে এক অজানা অধ্যায়ের।এখানে প্রায় প্রতি বছর দু’ লক্ষ পর্যটক আসেন দেখতে।

জায়গাটি বেশ পাথুরে ও আগ্নেয়পাথরের পাহাড়ের মধ্যে।প্রায় ১৫০ লক্ষ বছর আগেকার এক আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্ট এই নরম পাথরই ছিল তাদের বাসভূমি। যখন তারা ঘর তৈরী করতেই শেখে নি তখন তারা এখানেই ডেরা বেঁধে ছিল।

এরই কাছাকাছি ছিল সেই ম্যানহাট্টান প্রোজেক্ট যা বিখ্যাত বা কুখ্যাত এটম বোমা বানানোর জন্মস্থান বলে সারা ইতিহাসে চিহ্নিত।

এই জায়গাটি দর্শকদের জন্য ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দের ১১ই ফেব্রুয়ারী উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

যাই হোক , আমরা তো সকালের দিকেই গেলাম সেই ঐতিহাসিক স্থান দেখতে। গিয়ে দেখি চারিদিকে শুধু শুকনো পাহাড় , বেশি উঁচু নয় তবে শুকনো অর্থাৎ ঘাসে ঢাকা বা শ্যমল মোটেই নয়। সমস্ত পাহাড়টাই নরম অর্থাৎ সহজে কাটা যায়। ফলে প্রাকৃতিক কারণেও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে গোটা পাহাড়সারি জুড়ে উঁচু নীচু চূড়া, খোঁচা, গর্ত, খাঁজে ভর্তি। 

আমরা গিয়ে হাজির হলাম আগে ভিজিটর সেন্টারে। এখানে সমস্ত দর্শনীয় জায়গায়ই ভিজিটর সেন্টার আছে। তাতে যে কোন জায়গা দেখার জন্য অনেক সুবিধা হয়।জায়গাটির সম্বন্ধে প্রাথমিক পরিচয়টা এখানেই হয়ে যায়। এ ছাড়া অল্প চা জল খাওয়া কি রেস্টরুমের ব্যবস্থাও থাকে এখানে। এখানেও একটি মিনিট পনেরোর তথ্যচিত্র ছিল দেখার মত।আমরা সেটি দেখে, এগোলাম দর্শনীয়র পথে। 

এখান থেকে হাঁটা পথে অনেক দূর যাওয়া যায়। তার জন্য হাঁটা পথের রাস্তা, দিকনির্দেশ সব রয়েছে।তবে অনেক জায়গাই পাহাড়ী এবং সিঁড়ি ভাঙ্গারও ব্যাপার আছে। আসলে এই বিশাল ক্ষেত্রটির আয়তন তো ৩৩০০০ একর।তার অনেকটা যাওয়া যায় না, আবার বেশ কিছুটা যাওয়া যায়।তবে আমরা এত বেশি হাঁটতে পারব না তাই কাছাকাছি যতটুকু ঘোরা যায় আমাদের সাধ্যের মধ্যে তাই দেখে নিতে চাইছিলাম।পাহাড়ের রংটা হল ঠিক হাল্কা গেরুয়া বেলেপাথরের মত।

তবে ভাবতেই একটা এমন শিহরণ লাগছে যে, এখানেই একসময় ঘুরে বেড়াত সেই আদিম অধিবাসীরা। এখানেই ছিল তাদের বিচিত্র সংসার ,সুখ -দুঃখ, জন্ম মৃত্যু, হাসি-কান্না মাত্র ৬-৭০০ বছর আগেই।আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি সেই সমস্ত মানুষদের ঘর গেরস্থালির মধ্যে।আকাশে তখন চকচকে রোদ এবং সেই সঙ্গে ভালই ঠাণ্ডাও। কাজেই খুব অসুবিধা হচ্ছে এমন নয়।কেবল তাদের সেই জীবনযাত্রাটা অনুভব করার চেষ্টা করছি মন দিয়ে। 

আমরা দেখতে পেলাম, নরম পাথরের মধ্যে ,হয়ত কোন জায়গায়,একজন মানুষ শোওয়ার মত কাটা আছে।যেন ঠিক একটি পাথরের বাঙ্ক।তার উপরটা হয়ত একটু অল্প ছাদ মত আছে।  কোন জায়গায় একজন বসার মত বা কয়েকজন বসার মত জায়গা। কোন জায়গায় ওঠার মত পাহাড়ের গায়ে খাঁজ বা সিঁড়ি রয়েছে। সেটা কোথাও প্রাকৃতিক, কোথাও মনুষ্যকৃত।এ ছাড়া গোটা পাহাড় জুড়ে শুধু গর্ত, সারি সারি বা বিক্ষিপ্তভাবে। কি তার উদ্দেশ্য, সব সময় বোঝা মুস্কিল। হয়ত এগুলোতে পা রেখে উঠত বা এর ভিতর কাঠের টুকরো ঢুকিয়ে সিঁড়ি বা ঘরের ছাদ বানাত, সব কিছুই হতে পারে।হয়ত পাথরের অস্ত্র দিয়েই সব করত।

কোন জায়গায় দেখলাম, বেশ উঁচু কোন পাহাড়ের গায়ে দরজার মত কাটা রয়েছে। অত উঁচুতে কি ভাবে তারা উঠত জানি না। এখন তো কাঠের সিঁড়ি রয়েছে। তখনও তারা এমনই সিঁড়ি বানাত কি জানি না, বা পাহাড় বেয়েই বানরের মত উঠত কি না। এরকম পাহাড় কাটা ঘর আমি দেখেছি তুরস্কের কাপাদোসিয়া অঞ্চলে। তারা পাহাড় কাটা ঘরেই থাকত বহুদিন। এমনকি পাহাড় কাটা ঘরে এখনও অনেক মানুষ থাকেন। তারা সম্ভবতঃ পাহাড়ের গায়ে গর্ত করে তাতে পা দিয়ে উঠত।একটা বড় পাহাড়কে কেটে তাকে তো গ্রাম বানিয়ে ফেলেছে গ্রীকরা, যারা মাত্র কয়েকদিন আগে সেটি ছেড়ে গেছে।সেখানে তারা বাস করত এই সভ্য যুগেও।এদের কথা আমি আগে লিখেছি আমার ‘তুর্কী নাচন’ ভ্রমণ কাহিনীতে।সেখানেও দেখেছি এখানকার মত পাহাড়।

এখানেও রয়েছে ওখানের মত “মাশরুম ‘’পাহাড়,(Mushroom Rock)বা ছাতা পাহাড়( Tent Rock)  যার গোটা শরীরটা একটা নিটোল কোণের মত এবং মাথায় পাথরের একটা বড় টুকরো ছাতার মত রয়েছে।
আমরা ঐ উঁচুতে উঠলাম সিঁড়ি দিয়ে। উঠে দেখি সেই কাটা দরজার ভিতরে অনেক জায়গা, একটা ঘরের মত। এখানে যে মানুষ বাস করত একসময়, তার চিহ্ন সুস্পষ্ট।

তবে ঐতিহাসিকরা বলছেন, এরা যে একেবারে কিছুই জানত না তা ঠিক নয়।এরা যে দু তিনতলা ঘর বানাতে পারত পাহাড়ের গায়ে, সে কথাও বুঝতে পারা যায় ঠিক। এক তলার ছাদটা হয়ত পাহাড়ের গায়ে কাঠ পুঁতে হল। এরকম ভাবেই দু তিন তলা হত।পাহাড়ের গায়ে এরকম কাঠ পোঁতার বহু চিহ্ন আছে।


একটা জায়গায় রয়েছে এরকম একটি ঘর , আমাদের পক্ষে আর গিয়ে দেখা সম্ভব হয় নি, মাটি থেকে ১৪০ ফুট উঁচুতে, যেটা , আজকের হিসাবে চারটে উঁচু কাঠের সিঁড়ি ছাড়াও বেশ কিছু পাথরের সিঁড়ি ভেঙ্গে তবে ওঠা যাবে, এরকম এক জায়গায় বেশ একটা গুহার মধ্যে অনেক খানি ছাদ ঢাকা ফাঁকা গুহার মত জায়গায় একটা বড় পাথরের বেদী মত বানানো, কিছু কুলুঙ্গী মত গর্ত রয়েছে। এখানে অন্ততঃ একসঙ্গে ২০ -২৫ জন মানুষ জমায়েত হতে পারত। একে বলা হচ্ছে Alcove House।এরকম একটা জিনিস না দেখার দুঃখটা যদিও রইল, তবুও শারীরিক বাধা বড় বালাই, মানতেই হয় তার কথা।তবু একটা কথা না ভেবে পারলাম না, তারা অত উঁচুতে উঠে সবাই মিলে ওই রকম একটা জায়গায় কি করত!কোন বিশেষ সামাজিক অনুষ্ঠান কি!
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
এ ছাড়া এক জায়গায় দেখা গেল , প্রায় চারশ’ পাশাপাশি, গায়ে গায়ে লাগালাগি ছোট ঘরের ভিতের মত। সেখানে অন্ততঃ দু তিন তলা ঘর যে ছিল সে ব্যাপারে পণ্ডিতরা নিঃসন্দেহ।এই ঘরগুলো পাশাপাশি এবং তিন  সারিতে একটার সঙ্গে একটা  লাগোয়া ভাবে রয়েছে। এই ঘর গুলো একত্রে একটা অর্ধবৃত্তাকার বা ডিমের আকৃতিতে সাজানো। এগুলো সম্ভবতঃ শস্য রাখার ঘর ছিল। এর জন্য ব্যবহার হয়েছিল আগ্নেয়গিরির পাথরের ইঁট ও সঙ্গে মাটি বালি দিয়ে প্লাস্টার করা।একে বলা হয় Tyuonyi (Qu-weh-nee)। এগুলো সম্ভবতঃ ১৩৫০সাল থেকে ১৫৫০ সালের মধ্যে তৈরী হয়েছিল।

অর্থাৎ বুঝতে পারা যাচ্ছে, পরবর্তী সময়ে তারা পাথর গুলোকে গেঁথে ঘর তৈরী করতেও শিখেছিল।

এখানে নানা জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে অনেক Kivas যেগুলো আনুষ্ঠানিক সময় গুলোতে ব্যবহারের জন্য তৈরী হয়েছিল, বা অনেক Rock paintings, petroglyphs ইত্যাদি।এর মধ্যে Frijoles Canyon অঞ্চলে বেশ কিছু আধুনিক ও উন্নত জীবনযাত্রার নিদর্শন পাওয়া গেছে।এগুলো সম্ভবতঃ ১৫০০ সালের কাছাকাছি তৈরী।
এখানে যে মানুষরা বাস করত তারা প্রধানতঃ দুই শ্রেণির ছিল। এরা হল তেওয়া  (The Tewa) ও কেরেস (The Keres)। এরা উভয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষায় কথা বলত। বর্তমানে তেওয়া রা এখান থেকে উত্তরে থাকে এবং কেরেসরা থাকে দক্ষিণে।

এখানে নানা পাওয়া চিহ্ন এবং জিনিসপত্র থেকে বোঝা যায় যে, তারা স্থানীয় ,কিছুদূর পর্যন্ত আদিবাসীদের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেনও চালাত।
এরা প্রথম দিকে কেবলমাত্র শিকারের উপর ভরসা করেই দিন কাটাত। পরে তারা কৃষিকাজ শিখেছিল ভুট্টা চাষের মধ্যে দিয়ে।তাদের অস্ত্র শস্ত্র বেশিরভাগই তৈরী হত পাথর দিয়ে, বিশেষ করে আগ্নেয় নরম পাথর, যেগুলো তারা সহজে ইচ্ছা মত রূপ দিতে পারত।চাষের শস্যের মধ্যে তারা ভুট্টা, বীন,স্কোয়াশ ও কিছু বাদাম জাতীয় শস্যবীজ ফলাত।
আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল এদের প্রাত্যহিক জীবনচর্যা। আমি যেন মানসচক্ষে দেখতে পেলাম, এদের দৈনন্দিন জীবনের প্রেম ভালবাসা, হাসি কান্না, রান্না খাওয়া, চাষ বাস শিশুপালনের চলমান প্রতিচ্ছবি।এই ভাবেই এরা একটা প্রবহমান জীবনধারাকে বয়ে নিয়ে গেছে, নিত্য নৈমিত্তিক ধারায় তাদের নিজেদের মত করে,বহির্জগতের সঙ্গে সম্পর্কশূন্য হয়ে।পৃথিবীর কোন প্রান্তে কি হচ্ছে, কোথায় কোন রাজনৈতিক, ধর্মীয় সামাজিক বা ব্যবসায়িক কি পরিবর্তন হয়ে চলেছে, এই সমস্ত মানুষগুলোর, তার সাথে কোন সম্পর্কই ছিল না।নিজেদের মধ্যেই , নিজেদের সুখদুঃখ, অভাব, প্রাচুর্য নিয়ে নিজেরাই ছিল স্বচ্ছতোয়া প্রবহমান ঝরণার জলের মতই গতিমান স্বাধীন, নিষ্কলঙ্ক।

আমি অন্তর দিয়ে অনুভব করছিলাম, তাদের সেই গতিময় জীবনধারা।আমি যেন হয়ে গিয়েছিলাম, তাদের সেই আদিম জীবনের এক প্রত্যক্ষ সঙ্গী, তাদের জীবনযাত্রার এক সহমর্মী সহচর।এখানে অনেকটা সময় কাটিয়ে আমরা এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে এলাম বর্তমানের রূঢ় বাস্তবতায়।

এর পর যাব, এদের বর্তমানকে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে।

সঙ্গে থাকুন যাব পরের দৃশ্যে–

ক্রমশঃ-

Post a Comment

0 Comments