জ্বলদর্চি

আমেরিকার আদিম মানুষের খোঁজে-১০/মলয় সরকার

আমেরিকার আদিম মানুষের খোঁজে 

মলয় সরকার

পর্ব- ১০(দশম বা শেষ পর্ব)

এখানে এসে আমার, আজকের সভ্য আমেরিকা এবং তার ইতিহাস ও মাঝের সংযোগকারীদের নিজের চোখে দেখে এক নতুন দৃষ্টি বা বোধ উন্মুক্তভাবে জেগে উঠল।বইটি পড়ে এই সমস্ত নিরীহ মানুষদের উপর অত্যাচার, এদের সঙ্গে ছলনা, নৃশংসতার বর্ণনা পড়ে চমকে উঠেছিলাম। তাই ইচ্ছা ছিল ,বর্তমানে এই সমস্ত মানুষেরা কেমন আছেন তাঁদের স্বচক্ষে দেখে আসতে। আমরা তো সভ্য আমেরিকার বা স্পেনীয়দের গল্প শুনে তাঁদের পৃথিবীর সেরা হিসাবেই আমাদের মনে ছবি এঁকে রেখেছি।তাই বাস্তবটা দেখতে গিয়েছিলাম।
 আর একটা কথা, মনে হল।আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথ বা বিবেকানন্দ যখন জন্মাচ্ছেন, তখনও এই সমস্ত মানুষেরা অন্ধকার জগতে।এর থেকে বোঝা যায়, সেই দেশে সভ্যতার আলো প্রবেশ করেছে কত পরে। আজ যে ইতিহাসকে আমেরিকা বিদেশীদের কাছে নিজেদের ইতিহাস বলে তুলে ধরে সেটি কোন ক্রমেই দেড়শ বছরের বেশি নয়, এবং এ ছাড়া এ ইতিহাস তাদের নিজস্ব নয়, ইতিহাস যদি কিছু থাকে, তা সবই সেই আদিম আদিবাসীদের এটাই আমি বুঝতে পারলাম। এর আগে অবশ্য আমি আমেরিকার আর এক জায়গায় এই সমস্ত মানুষদের ঐতিহাসিক স্মৃতি দেখে এসেছি, তা হল মোডোক উপজাতিদের নেতা কিয়েন্তপুষ বা ক্যাপ্টেন জ্যাক এর বিচরণভূমি, যা ক্যালিফোর্ণিয়া ও ওরেগন সীমানায় ক্ল্যামাথ ক্ষেত্রর আশেপাশে। সেখানেও একই রকম অত্যাচার, হত্যার, ও নিষ্ঠুরতার, বর্বরতার সাক্ষী হয়ে পড়ে রয়েছে বিশাল লাভাক্ষেত্র আর তার চারিদিকে আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই সমস্ত অসহার আত্মার কান্নার প্রতিধ্বনি। (পরে সময় হলে এদের কথাও লেখার ইচ্ছা রয়েছে।তারা সেই কঠিন লাভাক্ষেত্রে কি কষ্ট করে থাকত, এবং কি ভাবে তাদের হত্যা করে নির্মূল করা হয়েছে, সেটিও আমার মনে দাগ কেটে দিয়েছে)
যাত্রা আমাদের শেষের পথে। এখান থেকে ফিরলাম এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে। পরবর্তী যাত্রা এখানকার ঐতিহাসিক এবংবিখ্যাত নদী রিও ডি গ্রাণ্ডের গা ছুঁয়ে সোজা আলবুকার্কের দিকে , যেখানে অনেক ঐতিহাসিক সম্পদ নিয়ে অপেক্ষা করছে এক প্রত্নতাত্বিক ভূমি।
যাওয়ার পথে পড়ল ধূ ধূ পথের মাঝে এক আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য বা প্রকৃতির উপর মানুষের কারিকুরির ঊজ্বল দৃষ্টান্ত।তা হল রিও গ্রাণ্ডে নদী, যার কথা এর আগে আমার লেখায় এসেছে। এসে দেখলাম, এই তাহলে সেই রিও গ্রাণ্ডে যার আশে পাশে বিস্তৃত হয়ে রয়েছে সেই সমস্ত আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের বিচরণ ক্ষেত্র।আমরা যে জায়গাটা দিয়ে পেরোচ্ছি সেটা হল একটি ‘গর্জ’ বা ঘাটি (কিংবা ঘাট) যা আসলে দুটি খাড়াই উঁচু পাহাড়ের মাঝে অনেক নীচে দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি নদী। ভৌগোলিকরা বলেন, এটি তৈরী হয় সুদীর্ঘকাল ধরে বয়ে চলা একটী জলধারার ক্রমাগত পাথরের সাথে ঘর্ষণের ফলে। প্রায় ৫০ মাইল দীর্ঘ এই ঘাটি।যাই হোক, এখানেও নদী বয়ে চলেছে অনেক নীচ দিয়ে।যেটিকে নিউ মেক্সিকোর সাথে বাকী আমেরিকার সীমারেখাও বলা যায়।উপর দিয়ে রয়েছে একটি সুদৃশ্য ব্রীজ। এতই সুন্দর লাগছিল, যে এখানে গাড়ি না থামিয়ে পারা গেল না। ব্রীজের উপর থেকে নীচে জলের দিকে তাকালে দেখা যায় শীর্ণ জলধারা বয়ে চলেছে নিঃসঙ্গ পথে আপনমনে।আর এই নদীটি নামেও ‘গ্রাণ্ডে’ বা অদ্বিতীয় ,সৌন্দর্য্যেও তাই। এটি আমেরিকার দক্ষিণ-মধ্য কলোরাডো অঞ্চলের পর্বত থেকে বেরিয়ে প্রায় ৩০৩৪ কিমি পথ অতিক্রম করে মেক্সিকো উপসাগরে পড়েছে। এটি আমেরিকার চতুর্থ দীর্ঘতম নদী। এরকম ‘গর্জ’ বা ঘাটি অবশ্য আগেও অনেক দেখেছি।তবু, প্রকৃতির আজব সুন্দর সৃষ্টিও যেমন দেখি বিস্মিত হয়ে, মানুষের কৃতিত্বও কম আশ্চর্য করে না।ধনুকের আকৃতির এই ইস্পাত-সেতুটি সত্যিই দৃষ্টি নন্দন।
এর উপর থেকে নীচে প্রবহমান জলধারাকে দেখে মনে হল শীর্ণ শান্ত এক জলরেখা মাত্র। প্রকৃতপক্ষে এই উচ্চতার জন্যই এমনটি মনে হচ্ছে, আসলে তা মোটেই নয়।
এই ব্রীজটির সম্বন্ধে বলি। এটি নদীর ৬৫০ ফুট উপরে, আমেরিকার হাইওয়েতে যে সমস্ত ব্রীজ আছে তাদের মধ্যে দ্বিতীয় উচ্চতম স্থানে রয়েছে এবং সমস্ত রকম ব্রীজের মধ্যে পঞ্চম(?) উচ্চতম ব্রীজ। ১৯৬৫ তে নির্মিত এই সেতুটিকে ইস্পাতনির্মিত সেতুগুলির মধ্যে সুন্দরতম বলা হয়,।মোটর রাস্তার দুপাশে পায়ে হাঁটার পথও রয়েছে।এই ব্রীজটির অন্য এক কৌলিন্যও আছে। এই ব্রীজটি ইতঃপূর্বে হলিউডের বহু চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়েছে, তার মধ্যে Paul, Terminator Salvation, Wild Hogs, White Sands ইত্যাদি অন্যতম। তবে এটির বদনাম হচ্ছে, যে, জায়গাটিকে নাকি অনেকে আত্মহত্যার জন্য নির্ভরযোগ্য স্থান বলে বেছে নেন। ফলে অনেকের অন্তিম দৃশ্যের সাক্ষী এই সেতু। সরকার তাই এটিকে জাল দিয়ে চারপাশ ঘিরে দিয়ে চেষ্টা করেছেন সেই জীবনবিতৃষ্ণ মানুষদের এই অপপ্রচেষ্টাকে বন্ধ করতে।
এরই কিছুদূরে রয়েছে পেট্রোগ্লিফ ন্যাশনাল মনুমেন্ট (Petroglyph National Monument) . এখানে আমাদের পৌঁছাতে একটু দেরী হয়ে যাওয়ার জন্য আর ভিতরে ঢুকলাম না।এর সামনে থেকেই চলে যেতে হল। অবশ্য এর জন্য আক্ষেপ ছিল না খুব। যা দেখে এসেছি, তাই বা কম কি!
 এখানে সুবিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সেই স্প্যানিশ আমল এবং তার কিছু আগে থেকেও ছড়িয়ে রয়েছে বিশাল এলাকা জুড়ে পাথরের গায়ে নানা রকম , আদিম মানুষের আঁকিবুঁকি, চিত্রশিল্প।এটি উত্তর আমেরিকার একটি অন্যতম ঐতিহাসিক সম্পদ যা প্রায় ৪০০-৭০০ বছরের পুরানো।প্রায় ২৭ কি মি জুড়ে আগ্নেয়শিলার ( ব্যাসাল্ট পাথর) উপরে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য( প্রায় ২৪০০০) শিল্পকীর্তিতে ভর্তি। অনেকে বলেন, এই চিত্রগুলো নাকি প্রায় ৩০০০ বছরের পুরানো।তবে বেশিরভাগই বোধ হয় ১৩০০-১৭০০ খ্রীষ্টাব্দের।আমাদের দেশে মধ্যপ্রদেশে ভীমবেটকাতেও রয়েছে এমন শিলাচিত্র যেগুলোর বয়স নাকি পণ্ডিতেরা বলেন লক্ষাধিক বছরের।এ ছড়াও এরকম শিলাচিত্র দেখেছি হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের লাভা স্তুপের উপরে, এবং বহু জায়গায়।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
পরদিন দুপুরের দিকে আমাদের ট্রেন, যাব বার্কলে।নামব Emeryvilleতে। যে ট্রেনে যাব, সেটি এক অদ্ভুত সুন্দর ট্রেন, নাম Southwest chief. এটি চলে শিকাগো থেকে লস এঞ্জেলস।এই ট্রেনে চাপাও আমার এবারের ভ্রমণের একটি বিশেষ অঙ্গ। এটি রাস্তার মধ্যে ছুঁয়ে যায় আটটি প্রদেশ। আলবুকার্ক থেকেই আমাদের চড়ার কথা। ট্রেনটি আমেরিকার খুব লাক্সারী ভ্রমণ ট্রেনগুলির মধ্যে অন্যতম। চলে ধীর গতিতে, গ্রাণ্ড ক্যানিয়নের পাশ দিয়ে, সেডোনার মত লাল পাহাড়ের গা ঘেঁসে নানা পাহাড় পর্বত মরুভূমি নদী সমুদ্রের দৃশ্য দেখাতে দেখাতে , সৌন্দর্য্যবিলাসীদের আমেরিকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের আস্বাদ দিতে দিতে। এর মধ্যে সুন্দর একটি ডাইনিং কার আছে যার ছাদ সহ সমস্ত দেওয়াল স্বচ্ছ কাঁচের, ফলে এর চেয়ারে বসে আরামে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। কাউবয়দের পশু চারণ ক্ষেত্রের পাশে পার্বত্য মরুভূমি কেড়ে নেয় যাত্রীর মনপ্রাণ।Amtrak পরিচালিত এই ট্রেনটিতে ২ বেড ও ৪ বেডের ছোট ছোট রুম আছে, যাতে বিছানা ছাড়াও প্রয়োজনীয় প্রায় সমস্ত কিছু আছে। এমনকি অনেক ঘরের মধ্যেই বাথরুমও আছে।আমরা দুজনে ছিলাম এরকম এক দু’ বেডের ঘরের যাত্রী।
এর যাঁরা কণ্ডাক্টর,তাঁদের ব্যবহারও খুব ভাল। সময় মত ঘুম থেকে তুলে দেওয়া, খাবার সময় ডেকে দেওয়া,স্টেশন এলে নামিয়ে দেওয়া ছাড়াও, যা প্রয়োজন সমস্ত সেবায় সবাই একপায়ে খাড়া।
আমরা স্টেশনে এসে দেখি, সুন্দর ছিমছাম স্টেশন।তার বুকিং কাউন্টারে দুটি ভদ্রমহিলা বসে। টিকিট আগে থেকেই কাটা ছিল।্সেগুলি দেখাতে বলল, ট্রেন তো আসতে একটু দেরী হবে, খুব দুঃখিত। আপনি এই সময় ইচ্ছা করলে কোথাও ঘুরে আসতে পারেন। আমরা বললাম, যাব তো, কিন্তু এই সমস্ত মালপত্র কি করব? সঙ্গে সঙ্গে হেসে বলল, এই কথা! আমাকে দিন,আমি রেখে দিচ্ছি। ট্রেন আসার আগে আমার কাছে নিয়ে নেবেন। 
আমরা তো হাতে স্বর্গ পেলাম। বিদেশ বিভুঁই জায়গায় এটুকু আন্তরিকতাই যেন আমাদের স্বর্গের ছোঁয়া এনে দেয়। মুগ্ধ হয়ে যাই। 
আমরা ঘুরতে বের হলাম স্টেশন ছাড়িয়ে এধার ওধার, বাজার হাট রাস্তা ঘাট খাবার দোকান।
জায়গাটা বেশ পরিষ্কার।এই সেই আলবুকার্ক যেখানে অক্টোবর মাসে টানা ন'দিন ধরে চলে International Balloon Fiesta, সারা পৃথিবীর বহু মানুষ জড়ো হন এই রঙ বেরঙের বেলুনের মেলা দেখতে।তবে এ বেলুন, সাধারণ বেলুন নয়, রঙ চঙে মানুষভর্তি বেলুন, যাতে চেপে সবাই আকাশ থেকে পৃথিবীকে উপভোগ করতে থাকেন।
স্প্যানিশদের ১৭০৬ সালে তৈরী এই শহরটি তৈরীর আগে রিও গ্রাণ্ডের ধারে ধারে একসময় বহু প্রাচীন মানুষের বাস ছিল। Tanoan ও Keresan উপজাতিদের প্রায় ২০ টি পুয়েব্লো বা গ্রাম ছিল এই বিশাল অঞ্চলে।
আজও এখানে ওখানে, বিশেষ করে বর্তমান শহর এলাকার বাইরে ছড়িয়ে রয়েছে এঁদের বংশধরেরা।
নাভাহো, এপাচে, কোমাঞ্চো উপজাতিরাও এখানে একসময় ডেরা বেঁধে ছিল।এখানে ওখানে এখনও তাদের মুখের ছাপ সহ মানুষের দেখা মেলে।অনেকটা আমাদের পার্বত্য উপজাতিদের সঙ্গে এদের মুখের মিল আছে।
ঘুরে ফিরে সন্ধ্যার মুখে যখন ফিরলাম, বুকিং কাউণ্টারের মেয়েটি ফিক করে হেসে বলল, ট্রেন তো এখনও একটু দেরী আছে।

Post a Comment

0 Comments