দূরদেশের লোকগল্প—মায়ানমার (এশিয়া)
কলার পাতায় সোনার মোহর
চিন্ময় দাশ
ইরাবতী নদীর ধারে, নিজের মেয়েকে নিয়ে বাস করে এক বুড়ো। হোল কী, একদিন একটা ছেলেকে বেশ মনে ধরে গেল সে মেয়ের। খবর জেনে, মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিল বুড়ো। স্বামীর ঘরে এসে, মেয়েও বেশ খুশি।
কিন্তু আগুপিছু না ভেবে কাজ করলে, যা হয়! মাসখানিক না যেতেই, খুশি উবে যেতে লাগল মেয়ের। কোন কাজে মন নাই ছেলেটার। নিজেকে একজন রসায়নবিদ ভাবে সে ছেলে। একটাই স্বপ্ন তার মনে। একদিন ধুলো থেকে সোনা বানাবে সে। সেই কাজেই ডুবে থাকে সব সময়। মনই নাই তার সংসারে।
কিছু বলতে গেলে, একটাই কথা তার—আমি একজন রসায়নবিদ। শান্তিতে আর নির্ঝঞ্ঝাটে কাজ করে যেতে দাও আমাকে।
কী আর করা যায়? অগত্যা এক চাষির ঘরে কাজ নিতে হোল মেয়েকে। হাটে নিয়ে যাওয়ার জন্য, খেত থেকে ফসল তুলে দেয় চাষিকে। অতি সামান্য মজুরি আসে তা থেকে।
ছেলেটার একটাই কথা। কাজ সারা হয়ে এসেছে আমার। কটা দিন সবুর করো আর।মুঠো ভর্তি ধুলোকে সোনা বানিয়ে ফেলব। এ তল্লাটে আমরাই হয়ে যাবো সবচেয়ে বড়লোক। কোন কষ্টই থাকবে না আর আমাদের।
সেই ‘কটা দিন’ আর ফুরোয় না। মুঠো ভর্তি তো অনেক দূরের কথা। ধুলোর একটা কণাও সোনা হয় না। এদিকে সংসার চালানো দায় হয়ে উঠেছে একা মেয়ের পক্ষে। হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও, ভাল করে অন্ন জোটে না দুটো পেটের।
ছোট থেকেই নিজের বাবার বুদ্ধি আর জ্ঞানের উপ ভারি ভরসা মেয়েটির। বাধ্য হয়ে, একদিন বাবার কাছে গিয়ে হাজির হোল সে। বাবা নিশ্চয় কিছু একটা উপায় বার করে দেবে।
বাবা সব শুনল। একটু মুচকি হাসি বাবার মুখে। বলল—সব মানুষেরই কিছু না কিছু স্বপ্ন থাকে রে, মা। আমার জামাইয়েরও আছে। তুই কিছু ভাবিস না। জামাইকে গিয়ে বলবি, আমি একবার ডেকেছি।
শ্বশুর ডেকেছে শুনে, একটু ভাবনা হোল ছেলের। নিশ্চয় এইসব নিয়ে মেতে থাকবার জন্য বকাবকি করবে। ভাবতে ভাবতে পরদিনই শ্বশুরের কাছে গিয়ে হাজির হোল।
ব্যাপার হোল একেবারে উল্টো। বকাবকি নয়, বরং প্রশংসাই করল মানুষটা—তোমার জানা নাই। আমিও ছিলাম একজন রসায়নবিদ। কাজ করতে করতে, সাফল্যের প্রায় দোরগোড়াতেই পৌঁছে গিয়েছিলাম। তুমিও এই চেষ্টা করছ শুনে, ভারি খুশি হয়েছি আমি।
ছেলের তো উৎসাহের শেষ নাই। গড়গড় করে নিজের কাজের বিবরণ দিয়ে যেতে লাগল। শুনে তো বুড়ো একেবারে লাফিয়ে উঠল—তাই বুঝি? তার মানে, তুমি একেবারে শেষ পর্বে চলে এসেছ দেখছি। কিন্তু বাবা, এখন একটা জিনিষেরই ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে তোমার। যা আমার বেলাতেও ঘটেছিল। অতি সাধারণ জিনিষ। কেউ অনুমান করতেই পারে না। আমি যেদিন বুঝলাম, তখন আর বয়স নাই আমার।
ছেলেটার আর ধৈর্য ধরছে না এ কথা শুনে। বলল—আমার এখন যুবক বয়স। গায়ে শক্তিও কম নাই। আমাকে বলুন আপনি, কী সে জিনিষ।
--শুধু জিনিষটাই নয়। তার সাথে মেহনতও করতে হবে অনেক।
--বলুন আমাকে। কিছুতেই পিছপা হব না আমি।
--বলছি তা হলে। বুড়ো বলল—তবে, একটা কথা। পুরো গোপন রাখতে হবে কথাটা। মুখে একেবারে কুলুপ এঁটে থাকবে। একটি শব্দও যেন দু’কান না হয়।
ছেলে বলল—সেটাও পারব আমি। কান দিয়ে যা ঢুকবে, মুখ দিয়ে বেরোবে না আমার। কথা দিচ্ছি। সোনা গড়বার জন্য, সব কিছুতেই রাজি আমি।
তাহলে বলি তোমাকে। বুড়ো বলল—সোনা বানাবার জন্য লাগবে রূপালী গুঁড়ো। আর সেটা পাওয়া যাবে কলাগাছের পাতায়। গাছের যত বয়স হবে, ততই গুঁড়ো জমতে শুরু করবে পাতার উপর। মেহনত আর ধৈর্য লাগবে তার জন্য।
ছেলেটার তো উৎসাহের শেষ নাই—কতটা গুঁড়ো লাগবে সোনা বানাবার জন্য?
বুড়ো বলল—পাউণ্ড দুয়েক। মানে হোল, সের খানেক তো বটেই।
ছেলেটার কপালে হাত। থমকে গেল খানিক। বলল-- সে তো অনেক গুঁড়ো। মানে, অনেক গাছের দরকার।
বুড়ো হেসে বলল—তাহলে আর বলছি কী? তার মানে, অনেক বড়ো মাপের বাগান। সে নিয়ে চিন্তা কোর না তুমি। আমার তো যাবার সময় হয়ে এলো। টাকাকড়ি আর কী কাজে লাগবে? আমার যা আছে, তা দিয়ে জমি কেনো তুমি।
জমি কেনা হোল। বাগান তৈরি হোল কলার চারা পুঁতে। উৎসাহ ধরে না ছেলের। আগাছা পরিষ্কার, সেচের ব্যবস্থা করা, বেড়া দিয়ে গরু-ছাগল আটকানো—ব্যস্ততার শেষ নাই তার। আনন্দ যেন ধরে না বুড়োরও।
বুড়োমাঝে মাঝে এসে সব দেখভাল করে যায়। একদিন বলল—এক্কেবারে ঠিকঠাক এগোচ্ছ তুমি। সফল হবেই। কেবল সেই কথাটা মনে রেখো। ভুলেও মুখ খুলবে না। কথাটা যেন ফাঁস না হয়, খেয়াল রাখবে। এমনকি আমার মেয়ের কাছেও বলবে না কিছু। জানোই তো, মেয়েদের পেটে কথা থাকে না।
দেখতে দেখতে গাছ বড় হোল। মোচা এলো গাছে গাছে। কালচে লাল রঙের মোচা মুখ বের করছে। ভারি অপরূপ দৃশ্য বাগান জুড়ে। কিন্তু ছেলেটার চোখ সে দিকে নাই। তার চোখ গাছের পাতায় পাতায়।
কাঁদি পাকতে লাগল যখন, কলার পাতার সবুজ রঙ তখন কালচে হতে শুরু করেছে। আর, কী আনন্দের কথা, সেই পাতার উপর রুপালি ধুলোর মত কিছু ফুটে ফুটে উঠতে শুরু করেছে। তা দেখে, আনন্দে বুক ফেটে যাওয়ার জোগাড় ছেলেটার।
এবার পাক ধতে শুরু করেছে কাঁদিতে। হলুদ রঙ লেগেছে কলার কাঁদিতে। পাকা কলার কাঁদিতে সামান্য আগ্রহও নাই তার। কেটে কেটে বউকে দিয়ে দেয় সব। নিজে লেগে পড়ে পাতার উপর থেকে রূপালী গুঁড়ো জোগাড়ের কাজে।
এই ভাবে চলতে লাগল। পুরানো গাছের জায়গায় নতুন গাছ লাগানো। বউয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে, একটু একটু করে বড়ও করছে বাগানটাকে। যেভাবে হোক, সেরখানিক গুঁড়ো জোগাড় করতেই হবে। বাগান বড় না হলে, এতটা গুঁড়ো জোগাড় তো আর চাট্টিখানি কথা নয়।
আনন্দ ধরে না বুড়ো মানুষটারও। বলল—হয়ে গেছে বুঝি? চলো, নিজের চোখে দেখি।
দুজনে ছেলের বাড়ি এসে হাজির। কাঁচের বড়সড় দুটো জারে ধুলো জমিয়েছে ছেলেটা। সেটা বের করে এনে শ্বশুরের সামনে রাখল—এই দেখুন রূপালি গুঁড়ো। এবার বলুন, কী করতে হবে? ধুলো থেকে কীভাবে সোনা বানাবো?
মুখ ভরা হাসি বুড়োর। চোখ দুটো আলোয় উজ্বল হয়ে উঠেছে। বলল—সোনা তুমি বানিয়ে ফেলেছ, বাবা। নতুন করে বানাতে হবে না তোমাকে। আগে আমার মেয়েকে ডাকো। নিশ্চয় সব পরিষ্কার হয়ে হয়ে যাবে, সে এলে।
বাবা এসেছে শুনে, মেয়ে বেরিয়ে এলো। বুড়ো বলল—কলার পাতা থেকে গুঁড়ো জোগাড় করেছে এই ছেলেটা। তুই তখন কী করছিলি, মা? কলাগুলো নিয়ে কী করলি?
--কেন? বেচে দিয়েছে হাটে গিয়ে? অনেক টাকা পেয়েছি তা থেকে। নইলে খাওয়া দাওয়া চলত কী করে আমাদের?
--সব টাকা খেয়ে ফেলেছিস? বুড়ো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
একথায় মেয়ে অবাক—কী যে বলো না তুমি? অত টাকা খাওয়া যায় না কি? সব আমি জমিয়ে রেখেছি।
বুড়ো বলল—কই দেখি তো, কতো জমিয়েছিস কলার বাগান থেকে।
মেয়েটা ভেতর থেকে দুটো থলে এনে হাজির করল—এই দেখো। এতেই সব জমা করেছি। একটি পাই-পয়সাও নষ্ট করিনি আমি।
বুড়ো তো এটাই চেয়েছিল। বলল—কই ঢেলে ফেল তো দেখি, কতটা জমেছে।
থলে দুটো ঢেলে ফেলা হোল মেঝেতে। টুং-টাং ঠুং-ঠাং করে এক গাদা মোহর গড়িয়ে পড়ল থলে দুটো থেকে। সবই সোনার মহর। ছোটখাটো একটা স্তুপই হয়ে গেল তা থেকে।
ছেলেটার তো কথা সরছে না মুখ থেকে। এত মোহর তার ঘরে! সবই এসেছে তার বাগানের কলা বেচে!
বুড়োকে আর কিছু বলতে হোল না। বুঝতে বাকি নাই কিছু ছেলেটার। ধুলো থেকে কী করে সোনার সঞ্চয় গড়তে হয়, এই মানুষটা জানে। এই মানুষটাই দুনিয়ার সেরা রসায়নবিদ।
ধুলো, সোনা এসব ভাবনা নিয়ে আর মাতলামি নাই ছেলের। এখন বউকে সাথে নিয়ে, কলার বাগান পরিচর্যা করেই দিন কাটে তার।
0 Comments