জ্বলদর্চি

মেদিনীপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস হত্যা /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব -৭৩

মেদিনীপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস হত্যা

সূর্যকান্ত মাহাতো


যে বছর মেদিনীপুরের জেলাশাসক পেডিকে হত্যা করা হয়, সেই বছর অর্থাৎ ১৯৩১ সালে পরপর দুটো ঘটনা ঘটেছিল। যা পরবর্তী জেলাশাসক 'ডগলাস' হত্যার কারণ হয়ে উঠেছিল।

কোন দুটো ঘটনা?

একটি হল, ১৯৩১ সালের ৭ই জুলাই 'দীনেশের ফাঁসি' এবং অন্যটি হল হিজলি জেলে নিরস্ত্র বন্দীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালানো। এ দুটো ঘটনা বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স এর মেদিনীপুর শাখাকে দারুণ রকমের প্রভাবিত করেছিল। কারণ বিপ্লবী ফনীন্দ্রকুমার দাস যিনি 'ফনি দাস' নামেই বেশি পরিচিত, তার উপরই ডগলাস হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল,(বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স/ মধুমন্তী সেনগুপ্ত, পৃষ্ঠা - ১৯২) তিনি জানাচ্ছেন, দীনেশের ফাঁসির পর অর্থাৎ ১৯৩১ সালের ৭ই জুলাইযের পর 'বেনু' পত্রিকা 'দীনেশ সংখ্যা' বলে একটি সংখ্যা প্রকাশ করেছিল। সেখানে দীনেশের কিছু চিঠিপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। সেইসব চিঠিপত্র পড়ে মেদিনীপুরের ছেলেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, 'তাঁদের প্রিয়তম বন্ধু ও নেতার রক্তের বদলে দেবেন আরো রক্ত, লোপাট করবেন সাম্রাজ্যবাদী শ্বেত শাসকের দম্ভ কলঙ্কিত সিংহাসন।' (ফণীন্দ্রকুমার দাস, সূত্র: রক্তের অক্ষরে/ শৈলেশ দে, পৃষ্ঠা- ১৮২)। আর দ্বিতীয় কারণটাতে ফনি দাসের বক্তব্যটা দেখো, ফনি দাস প্রভাংশু পালকে বলছে যে, হিজলি জেলে বন্ধুদেরকে কুকুর বিড়ালের মতো মেরেছে। এবং তারপর তদন্ত রিপোর্টকে কুৎসিত মিথ্যায় সাজিয়েছিল এই ডগলাস। তাই চলো এর একটা উত্তর দিতে হবে।(রক্তের অক্ষরে/শৈলেশ দে, পৃষ্ঠা- ১৮৫) এর থেকেই তো পরিষ্কার ডগলাস কেন টার্গেট হয়েছিলেন।(রক্তের অক্ষরে/শৈলেশ দে, পৃষ্ঠা ১৮৫)। দীনেশের ফাঁসি ও হিজলীর ঘটনা মেদিনীপুরের বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার শাখাকেই যে শুধু প্রভাবিত করেছিল এমনটা নয়, কলকাতা কেন্দ্রীয় কমিটিও এই দুই ঘটনায় দারুণ রকমের আঘাত পেয়েছিলেন। তাই তো ডগলাসকে হত্যা করার নির্দেশ এবং সবুজ সংকেত কলকাতা থেকেই এসেছিল।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
আপনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে সেই নির্দেশ কলকাতা থেকেই এসেছিল?

বিপ্লবী ফনি দাস নিজেই সে কথা বলেছেন, ডগলাসকে হত্যা করার নির্দেশ কলকাতা থেকেই এসেছিল। সেই নির্দেশ আসার পরেই তারা ডগলাসকে হত্যার পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন। সেইমতো ডগলাসের গতিবিধির উপর তারা খোঁজ খবর সংগ্রহ করতে শুরু করেছিলেন। একদিন খবর পাওয়া গেল যে, ডগলাস ফেরিঘাট থেকে বোটে চেপে কংসাবতী নদী পার হয়ে কাঁথি যাবেন। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সাহেব গাড়ি থেকে নেমেই যে মুহূর্তে বোটে উঠতে যাবেন ঠিক সেই মোক্ষম মুহূর্তটাকেই টার্গেট করা হবে। ফনি দাস এই কাজের জন্য যে দুজন বিপ্লবীকে নির্বাচন করেছিলেন তাদের একজন হলেন প্রভাংশু পাল এবং অন্যজন হলেন প্রমথ মুখার্জি।(পৃষ্ঠা- ১৮৪, রক্তের অক্ষরে/শৈলেশ দে) কিন্তু এই পরিকল্পনা তাদের ব্যর্থ হয়েছিল।

ডগলাস হত্যার প্রথম পরিকল্পনা ব্যর্থ হল ঠিকই। তবে এই অভিযানে প্রমথ মুখার্জির অস্বাভাবিকতা ফনি দাসের খুব একটা ভালো লাগেনি। তাই পরবর্তী পরিকল্পনার জন্য প্রমথ মুখার্জির পরিবর্তে অন্য একজনকে খুঁজতে লাগলেন। এমন সময় তার প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্যের কথা মাথায় এসেছিল। হিন্দু কলেজের এই কৃতি ছাত্রকে উৎসাহিত করার জন্য ফনি দাস বলেছিলেন, হিজলী জেলে বন্দিদের যেভাবে কুকুর বিড়ালের মতো মেরেছে। এবং তারপর তদন্ত রিপোর্টকে যেভাবে কুৎসিত মিথ্যায় সাজিয়েছে এই ডগলাস, তাকে একটা উত্তর দেয়ার সময় এসে গেছে।

৩১ শে মার্চ জেলা বোর্ডের সভাকে টার্গেট হিসাবে বেছে নেয়া হয়েছিল। প্রফুল্ল দত্ত একটি সাড়ে চারশ বোরের রিভলবার এবং ছোট সাত চেম্বারের পিস্তল এনেছিলেন। রিভলবারটি প্রদ্যোৎকে এবং পিস্তলটি প্রভাংশুকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়ে পড়েছিল।

বারবার টার্গেট মিস হওয়ায় বিপ্লবী ফনি দাস বেশ একটা অনিশ্চয়তা এবং টেনশনে ভুগছিলেন। তাই কারবালা মসজিদের কাছে পীর বাবার স্থানে তিনি মানতও করেছিলেন এই বলে যে, এবার ডগলাস কে মারতে পারলে পাঁচ সিকা পয়সা প্রণামী দেবেন। (পৃষ্ঠা ১৯০, রক্তের অক্ষরে/ শৈলেশ দে)। পীর বাবার আশীর্বাদেই হোক আর যাই হোক এবার তারা সফল হয়েছিলেন। এবং ফনি দাস একটা 'আনি' ও একটি পয়সা ভক্তিভরে ছুঁড়েও দিয়েছিলেন। কারণ ১৯৩২ এর ৩০ শে এপ্রিল শনিবার প্রদ্যোৎ ও প্রভাংশু ডগলাসের উপর গুলি চালিয়েছিলেন। ১/৫/৩২ এর আনন্দবাজার পত্রিকায় "মেদিনীপুরের জেলা-ম্যাজিস্ট্রেট মি. ডগলাস নিহত" এই শিরোনামে সেই খবর প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে লেখা হয়েছিল, '৩০শে এপ্রিল অদ্য সন্ধ্যায় মেদিনীপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস যখন জেলা বোর্ডের সভায় সভাপতিত্ব করিতেছিলেন, তখন প্রায় তিনবার তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া গুলি নিক্ষিপ্ত হয়।...ডগলাস সাহেব রাত্রি ৯টা মারা গিয়েছেন।'(আনন্দবাজার পত্রিকা, ১/৫/৩২)

প্রদ্যোৎ পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন। কিন্তু প্রভাংশপালকে তখনও ধরতে পারেননি। প্রদ্যোতের ধরা পড়ার একটা কারণ ছিল, তার বন্দুকটি কোনভাবেই ফায়ার হচ্ছিল না। প্রভাংশুর গুলিতেই ডগলাস মারা গিয়েছিলেন। প্রদ্যোতের বন্দুকটি কাজ করলে ঘটনা যে অন্যরকম কিছু ঘটতো সেকথা তিনি নিজের মুখেই বলেছেন ইন্সপেক্টর ভুপেন বাবুকে, 'Irony of fate Bhupen babu! Had my revolver spoken out I would not have been here in this condition, the story would have been otherwise.'(রক্তের অক্ষরে/শৈলেশ দে, পৃষ্ঠা- ২১৭)

যখন জানতোই এটা একটা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, তখন ওই অচল বন্দুক নিয়ে কীভাবে গিয়েছিলেন?

আসলে ভুলটা ছিল ফনির। আগের রিভলবারটা ঠিকঠাক কাজ না হওয়ায় আরো একটি বন্ধুক আনা হয়েছিল। কিন্তু আগেরটা ফেরত পাঠানো হয়নি। পরে প্রদ্যোৎ ভুল করে আগেরটাই তুলে নিয়ে গিয়েছিল। ডগলাসের মৃত্যুর পর অনেককেই তুলে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। ফনিকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তার উপর তো পুলিশ এমন অত্যাচার শুরু করেছিল যে তার শরীর ঠান্ডা হয়ে পড়েছিল। পুলিশ ভেবেই নিয়েছিল সে মারা গেছে। অচল বন্দুক এর বিষয়টা নিয়ে পরবর্তীকালে ফনি দাস আফসোসও করেছিলেন।

মৃত্যুর আগেই ডগলাস বোধহয় বুঝে গিয়েছিলেন যে মেদিনীপুরই হবে তার কবরস্থান।

তাই নাকি! একজন জেলা শাসক হয়ে তাঁর এরকমটা মনে হয়েছিল কেন?

 উনি নিজেই তার ভাইকে একটি চিঠিতে একথা লিখে জানিয়েছিলেন, 'মেদিনীপুর হবে তার কবরস্থান।' (জিলা মেদিনীপুর: স্বাধীনতার সংগ্রাম, পৃষ্ঠা- ৫৭) আসলে পেডি হত্যার পর তিনি প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলেন। নাহলে মেদিনীপুর শহরে গোয়েন্দা দপ্তরকে ঢেলে সাজাতে গেলেন কেন? কেনই বা বেশ কয়েকটি বাড়ির উপর বাড়তি নজরদারি শুরু করেছিলেন? মেদিনীপুরবাসীর উপর কেনই বা ইউনিটি ট্যাক্স বসিয়েছিলেন?

কেন?

কারন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় জরুরী সৈন্য মোতায়েন করার জন্য।( পৃষ্ঠা- ৫৭, জিলা মেদিনীপুর: স্বাধীনতার সংগ্রাম) বাংলোর বাইরেও সচরাচর বেরোতেন না। বেশিরভাগ সময়টা গৃহবন্দী অবস্থাতেই থাকতেন। এতটাই ভয়ে ভয়ে থাকতেন যে কালেক্টারেও যেতেন না। কিন্তু তারপরেও সেই প্রবাদটাই ফলে গেল, 'যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়।'

ধরা পড়ার পর প্রদ্যোতের পকেট থেকে কী কী উদ্ধার হয়েছিল?

খামে ভরা দুটি কাগজ ছিল। একটিতে লাল কালিতে লেখা, 'হিজলি অত্যাচারের ক্ষীন প্রতিবাদ। ইহাদের মরনেতে ব্রিটেন জানুক আমাদের আহুতিতে ভারত জাগুক। বন্দেমাতরম।' (বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স, পৃষ্ঠা- ২১৯) অন্য কাগজটিতে হেডলাইন ছিল, 'আমাদের প্রাথমিক পাটিগণত' ( ঐ গ্রন্থেরই পৃষ্ঠা- ২১১।

বিপ্লবী প্রদ্যোতের রিভলবারটা কেন কাজ করল না?

এই নিয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্ন রকমের কথা বলেছেন। তবে বেশিরভাগ গ্রন্থাকার উল্লেখ করেছেন, অস্ত্রটির যান্ত্রিক গলযোগের কথা। আবার 'মেদিনীপুর' গ্রন্থে তরুণদেব ভট্টাচার্য যেমন উল্লেখ করেছেন প্রদ্যোতের রিভলবারের গুলি ছিল ভিজে।( মেদিনীপুর/ তরুণ দেব ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা- ৪১)

ডগাস হত্যার পর বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার এর সদস্যদের গ্রেফতার ও শারীরিক নির্যাতন ছিল আরো একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা।

শুনেছি প্রদ্যোতের মা নাকি ব্রিটিশ সরকারের কাছে ছেলের জন্য প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলেন? সেটা কি ঠিক!প্রদ্যোতের মামলার রায় কী হয়েছিল?
সেটাও একটা করুণ ইতিহাস। বিচারের জন্য স্পেশাল ট্রাইবুনাল গঠিত হয়েছিল। চব্বিশ পরগনা জেলার সেশন জজ মি. কে সি নাগ ছিলেন তার সভাপতি। অন্য দুই সদস্য  ছিলেন বর্ধমানের জেলা ও সেশন জজ জ্ঞানাঙ্কুর দে এবং মেদিনীপুরের জেলা ও সেশন এডিশনাল জজ ভুজগেন্দ্র মুস্তাফি।(State Archives of West Bengal, confident File, number 450/32) এই সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনের ৩০২/১২০ বি আই পি সি, ৩০২/৩৪, ৩০২/১১৪ আই পি সি ও ভারতীয় অস্ত্র আইন ১৯/এফ ধারা মতে প্রদ্যোৎকে অভিযুক্ত করা হয়।(বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স পৃষ্ঠা ৮৬) বাদি বিবাদী পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তি ও প্রতিযুক্তি দীর্ঘ মাত্রা পেয়েছিল। তারপরেও প্রদ্যোতের আইনজীবীরা যখন দেখলেন যে প্রদ্যোৎকে কোন ভাবেই বাঁচানো যাবে না তখন তারা শেষ অস্ত্র হিসাবে প্রদ্যোৎ এর অপরিণত বয়সকে হাতিয়ার করেছিল। কারণ ব্রিটেনে ২১ বছরের কম হলে মৃত্যদণ্ড দেওয়া যায় না।(Durba Ghosh, Gentlemanly Terrorists, Political Violence and the Colonial State in India, 1919-1947, Cambridge University Press, 2017, p -152)। বিচারে ৩০২/১২০ ধারা এবং ভারতীয় অস্ত্র আইনের ৩০২/৩৪৩ (১৯ এফ) ধারা মতে প্রদ্যোৎকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। 'জ্ঞানাঙ্কুর দে' যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা দ্বীপান্তরের পক্ষে বললেও কে সি নাগ ও ভুজগেন্দ্র মুস্তাফি ফাঁসিই উপযুক্ত শাস্তি বলে উল্লেখ করেছিলেন। ৩০ শে জুন ফাঁসির রায় হল। এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল হল। কিন্তু হাইকোর্টও সেই রায় বহাল রাখল। অবশেষে প্রদ্যোতের মা পঙ্কজিনী দেবী ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে রাজা পঞ্চম জর্জের কাছে আবেদন রেখেছিলেন। ১৮ই নভেম্বর সেই আপিল খারিজ করলে  তিনি পুনরায় বাংলার গভর্নর জন এন্ডারসনের কাছে আপিল করেন। এতেও কোন কাজ হলনা। কাজ যখন হল না তখন সরাসরি ইংল্যান্ডের পঞ্চম জর্জের কাছে টেলিগ্রামও করেছিলেন। এই আবেদন বিধিসম্মত না হওয়ায় সেটাও খারিজ হয়েছিল। অবশেষে ১৯৩৩ সালের ১২ জানুয়ারি মেদিনীপুর জেলে ফাঁসি হয়েছিল।(বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স/ মধুমন্তী সেনগুপ্ত, পৃষ্ঠা-২২৪,২২৫,২২৬)

তার মা কে লেখা চিঠিটি ছিল বিপ্লবের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য দর্শন।

কী লিখেছিলেন সেই চিঠিতে?

চলবে...

Post a Comment

1 Comments

  1. AnonymousMay 31, 2023

    পরের অংশটার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম।

    ReplyDelete