কালিম্পং ডায়েরি
পর্ব-৪
সুমিত্রা মাহাত
সিনিয়র হিসেবে ছেলেদের দায়িত্বে আছে পিনাকী ও মানস (কোচ)। মেয়েদের কোচ মোনালিসা ও কণিকা। পিনাকী মিষ্টি ছেলে , বক্সিং ছাড়াও সাহিত্যের প্রতি তার আগ্রহ । মানস অত্যন্ত সহজ ও স্বাভাবিক । মোনালিসা ও কণিকার কথা যদি বলতে হয় , ফেরার পথে মেয়ে কিছুটা অসুস্থ হলে তাদের ভূমিকা অবশ্যই বর্ণনা করব ।
ছেলে - মেয়েকে আপার বার্থে তুলে দিয়েছি । আমি , হাজব্যন্ড মিডল বার্থে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি লোয়ার বার্থ দুটিতে কে ওঠেন তা দেখার জন্য! ট্রেনের এই জার্নি যেন অল্প সময়ের কোকিলের সংসার , এর মধ্যেই ব্রাশ করা , খাওয়া-দাওয়া, নানান গন্তব্যের মানুষের সঙ্গে পরিচয়, ভাব-বিনিময় ইত্যাদি ইত্যাদি। বেশ কয়েকটি স্টেশন পেরোনোর পর লোয়ার বার্থের দাবী নিয়ে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক উঠলেন , সঙ্গে স্ত্রী। কিছুক্ষণ যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত। যদিও এটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না । হাজার হলেও আমরা মনুষ্য প্রজাতি , দলবদ্ধতা এক মহৎ গুণ আমাদের। বিশেষ করে আমার ছেলে-মেয়েকে দেখে উনি আর আবেগ সামলাতে পারলেন না । বোধহয় নিজের নাতি - নাতনিদের কথা মনে পড়ে গেল। পরিচয় দিলেন । উনি সুশোভন চ্যাটার্জি । বাড়ি বর্ধমানের কোন একটা জায়গায়, এখন আমার ঠিক মনে পড়ছে না ।
আগে সরকারি দফতরেই ছিলেন। হঠাৎ বাবা অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় দেখভালের কেউ না থাকায়, দূরে ট্রান্সফার দেওয়াতে উনি চাকরি ছেড়ে দেন। ভদ্রলোক সাহসী ও চ্যালেঞ্জিং তা বোঝা যায় । জীবন সম্পর্কে এমন সাহসী পদক্ষেপ আমরা কজন নিতে পারি ! কত সহজেই পরাজয় স্বীকার করে নিই । চার ভাই এখনও একই বাড়িতে থাকেন, রান্না যে যার আলাদা । ওনাদের বন্ধু-বান্ধব ,আত্মীয়-স্বজন মিলিয়ে বয়স্কদের একটা টিম আছে । তাঁরা সারাবছর নানান জায়গা বেড়াতে যান। এবারে ইউটিউব ঘেঁটে দার্জিলিঙের একটি অফবিট খুঁজে বের করেছেন যেখানে দু-চারদিন কাটাবেন। ভ্রমণের নেশা মূলত উনি বাবার কাছ থেকেই পেয়েছেন। তাঁর একমাত্র ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ব্যাঙ্গালোরে থাকে , ভালো কোম্পানিতে চাকুরীরত। বৌমা , নাতনিও রয়েছে। তাঁদের ভ্রমণপ্রিয়তা আমাকে মুগ্ধ করে । বয়স কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে তাঁরা যেভাবে জীবন কে নিজের মতো উপভোগ করছেন, কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েও সেই আনন্দ পাওয়া যায় না । আসলে গৃহবাস হল অনেকটা মাটির নীচের জল বা বাতাসের অক্সিজেন ব্যবহারের মতোই , একই জায়গায় চার দেওয়ালের মধ্যে থাকতে থাকতে বা বিনামূল্যে পেতে পেতে স্যুইট হোম বা জীবনদায়ী প্রকৃতির গুরুত্ব আমাদের জীবনে ফিকে হয়ে আসে । ভ্রমণ আমাদের কানে মোচড় দিয়ে সেই গুরুত্বের কথা মনে করিয়ে দেয় । তাই তো দু-চারদিন যেতে না যেতেই হোম বা হোমল্যান্ডের প্রতি তীব্র অভিকর্ষজ টান অনুভব করি , স্বর্গীয় সৌন্দর্য্য দেখে ফেরার পরেও গোপাল দার মুখে শুনি -' যাক বাবা ! ঝাড়গ্রামে নেমে মনটা শান্তি পেল '। যাইহোক আমার কাঙাল মন একেবারে গল্পে মজে গেল। পরদিন নামা পর্যন্ত ভদ্রলোক যে কতগুলো ভ্রমণ কাহিনী শোনালেন তা বলতে শুরু করলে আর কালিম্পং পৌঁছানোই যাবে না । ওনার স্ত্রী ও সমানতালে সাথ দেন । শরীর চর্চায় আগ্রহী এমন একদল ছেলে মেয়েকে দেখে উনি খুউব খুশী ।
পরদিন সকাল থেকেই প্রেক্ষাপটের বদল ঘটতে থাকে। সুবিস্তৃত তরাই ভূমি জানান দেয় আমরা বাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। এদিক-সেদিক ছত্রাকারে চা বাগান। হিমালয় থেকে ঝরে আসা নুড়ি, পাথর,পলি সযত্নে গচ্ছিত আকারে সঞ্চিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে এই স্যাঁতস্যাঁতে সমতল । স্টেশনের নামগুলোতেও এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। আমরা ডাহি , ডিহা, পুর ইত্যাদি যোগে জায়গার নামে অভ্যস্ত । এখানে গঞ্জ্ আর বাড়ির ছড়াছড়ি । যাত্রীরা খুব ই উত্তেজিত। আমার তো মনে হয় এরা খেলার চেয়ে বেশি ঘুরতেই এসেছে । আমার আবার খুব আনন্দ ঘন মুহূর্তে কেবলই শেকড়ে টান পড়তে থাকে । দুঃখিত মনে ভাবি আমার আত্মীয়-স্বজন চারপাশে যেখানে যা আছে , বিশেষ করে পৈতৃক সূত্রে দু-একজন বাদে আমিই প্রথম এমন বৈচিত্র্যময় পটভূমি স্পর্শ করছি । এতে লজ্জা নেই আবার গৌরব ও নেই। ঝাড়গ্রামের চেনা গন্ডীর বাইরে বেরোনোর দুঃসাহস তারা দেখাতে পারেনি । আমার আগের জেনারেশন হয় সম্পূর্ণ নিরক্ষর নয় মাধ্যমিকের গন্ডীও টপকাতে পারেনি। হায় বিধাতা ! জীবনের কত রস থেকে তারা বঞ্চিত থেকে গেল ! তাদের কাছ থেকেই আমি প্রকৃতিকে মায়ের মতো ভালোবাসতে ও জলের মতো চিনতে শিখেছি। অন্ধ ব্যক্তির যেমন অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলি অনেক বেশি সজাগ হয়ে ওঠে তেমনি পড়াশোনা না জানা মানুষ গুলো বাঁচার তাগিদে ও জীবন - জীবিকার তাগিদে প্রাণ পণে প্রকৃতিকে আঁকড়ে ধরে, সেই প্রেমময় বন্ধন অটুট থাকুক চিরকাল !
সকাল আটটা পঞ্চাশ নাগাদ ট্রেন এনজেপি তে পৌঁছে গেল । মহা আনন্দে আমরা স্টেশনে নেমে গেলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠে সবাই স্টেশনের বাইরে জড়ো হলাম। স্যার ছোট ম্যাজিক ভ্যান পাঁচ-ছটা ঠিক করলেন । তাতে করে সকলে পৌঁছে যাই শিলিগুড়ি বাসস্ট্যান্ড । শিলিগুড়ি খুব ই ব্যস্ত শহর, চারিদিকে ভীড় , মানুষজন , গাড়ি-ঘোড়া, কলকাতার সঙ্গে তার কিছুটা তুলনা করা চলে । সব জায়গাতেই নামানো - ওঠানোর সময় , জামার ভেতর থাকা লাল পিঁপড়ের মতো জ্বালাতে থাকে বড়ো ট্রলি ব্যাগ টি । যখন তখন মনে করায় 'এটাকে কেন যে এনেছি ' ।
বাসস্ট্যান্ড থেকে সবাই কে আঁটানোর জন্য দুটি বাস ভাড়া করা হয় । রসালো শশা আর টুস্ টুসে পেয়ারাতে কামড় দিয়ে আমরা মূল যাত্রার জন্য তৈরি হয়ে নিই । শুভাকাঙ্খী কয়েকজন এই যাত্রা পথের খুব বদনাম করেছে । একটু অসাবধান হলেই নাকি মৃত্যু এসে পা জড়িয়ে ধরে জীবন ভিক্ষা চায় ! শোনা কথা মাথার মধ্যে যতটুকু জমে আছে তা এবার চাক্ষুষ মিলিয়ে নেবার পালা । চারপাশে শিশু , বয়স্ক, নারী ,পুরুষ পাহাড়ী মুখ গুলো চোখে পড়ছে। তারা নিজেদের মধ্যে যে ভাষায় কথা বলছে তার বিন্দু বিসর্গ ও আমি বুঝতে পারছি না । গাড়ির ড্রাইভার বেশ সাহসী ও বলিষ্ঠ। সম্ভবত তাদের কেরামতিতেই সমতলের মানুষ উত্তরবঙ্গে এসে তাঁদের স্বপ্ন পূরণ করেন । কুর্নিশ জানাই তাদের। দুর্গম প্রকৃতিই হয়ত এমন সাহসী করে তুলেছে তাদের। গাড়ি স্টার্ট দেয় । অজানাকে জানার গভীর আকাঙ্খা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। আঁকাবাঁকা পাহাড়ী রাস্তায় গন্তব্য কালিম্পং । প্রায় তিন ঘন্টার জার্নি। একটা সীটে আমি-মেয়ে অন্য সীটে বাবা-ছেলে। কৌতূহলের সীমা নেই কারো । বাসস্ট্যান্ড থেকে বেরিয়ে, চওড়া পীচ রাস্তা ছাড়িয়ে বাস ধীরে ধীরে হিমালয়ের চরণ স্পর্শ করে !
2 Comments
পড়লাম। ভালো।
ReplyDeleteপরের পর্বের অপেক্ষায়।
Amazing, so so so so wonderful
ReplyDelete