জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৭৬/ প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৭৬

 শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
 
 প্রীতম সেনগুপ্ত
 
 অ্যাটর্নি হিসেবে নরেন্দ্রনাথের পিতা বিশ্বনাথ দত্ত প্রভূত খ্যাতিলাভ করেছিলেন। তাঁর কর্মক্ষেত্র উত্তরভারতের প্রায় সর্বত্রই বিস্তার লাভ করে। কর্ম উপলক্ষে তাঁকে লখ্নৌ, লাহোর, দিল্লি, রাজপুতানা, বিলাসপুর, রায়পুর প্রভৃতি অঞ্চলে যেতে হয়েছিল। অ্যাটর্নির কাজে তাঁর আয় ছিল প্রচুর, সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ও করতেন বহুল পরিমাণে। প্রচুর দাসদাসী পরিবৃত হয়ে থাকতেন বিশ্বনাথ। পছন্দ করতেন আহারের পারিপাট্য। তাঁর মত ছিল, ছোট ছেলেদের ভালো খাওয়াতে হয়, অন্যথা মগজের পুষ্টি হয় না। তাদের লেখাপড়া শেখালে ও জীবনের উচ্চমানের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দিলে তারা যথাসময়ে নিজেরাই নিজেদের বন্দোবস্ত করে নিতে পারবে।
 বিশ্বনাথ দত্ত মুক্তহস্ত দাতা ছিলেন। এই কারণে পাড়ার লোক দাতা বিশ্বনাথ বলে ডাকত তাঁকে। পরবর্তী সময়ে তাঁর পুত্র মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, “গরীব-দুঃখীকে দান করা তাঁহার যেন একটা ব্যামোর মত ছিল।” তাঁর নির্বিচার দানের স্বভাব জ্যেষ্ঠপুত্র নরেন্দ্রনাথ কর্তৃক একবার সমালোচিত হলে তিনি পুত্রকে বলেছিলেন, “জীবনটা যে কত দুঃখের তুই এখন কি বুঝবি? যখন বুঝতে পারবি, তখন দুঃখের হাত থেকে ক্ষণিক নিস্তার লাভের জন্য যারা নেশাভাঙ্গ করে, তাদের পর্যন্ত দয়ার চক্ষে দেখবি।” খুব সম্ভবত পিতার অমিতব্যয়িতার অভ্যাসটিকে লক্ষ্য করে নরেন্দ্রনাথ একবার পিতাকে বলেছিলেন --“আপনি আর আমার জন্য কী করেছেন?”অত্যন্ত ধীরতা সহায়ে বিশ্বনাথ উত্তর দেন --“যা আরসিতে নিজের চেহারাটা একবার দেখ গে, তাহলেই বুঝবি।” ( যুগনায়ক বিবেকানন্দ, প্রথম ভাগ, স্বামী গম্ভীরানন্দ প্রণীত )
 নরেন্দ্রনাথ দত্ত যিনি উত্তরকালে স্বামী বিবেকানন্দ নামে জগৎপ্রসিদ্ধ হয়েছিলেন, তাঁর বংশপরিচয় বিষয়ে প্রমথনাথ বসু লিখেছেন --“যিনি উত্তরকালে স্বামী বিবেকানন্দ নামে জগৎপ্রসিদ্ধ হইয়াছিলেন তাঁহার পূর্ব্বনাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত। কলিকাতার অন্তর্গত সিমুলিয়া নামক স্থানে দত্ত বংশে ইহার জন্ম হয়। ইঁহার পিতার নাম ৺বিশ্বনাথ দত্ত ও পিতামহের নাম ৺দুর্গাচরণ দত্ত। নরেন্দ্রনাথের বাল্যজীবনের ইতিহাস বর্ণনা করিবার পূর্ব্বে সংক্ষেপে তাঁহার পিতা ও পিতামহের কিঞ্চিৎ পরিচয় দিলে পাঠক বুঝিতে পারিবেন যে, সন্ন্যাস জীবনের প্রতি অনুরাগ একপ্রকার তাঁহাদের বংশগত ধারা।
 দুর্গাচরণ সংস্কৃত ও পারস্য ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপন্ন ছিলেন এবং সঙ্গীতবিদ্যায়ও তাঁহার সম্যক পারদর্শিতা ছিল। তাঁহার পিতা রামমোহন দত্ত সুপ্রীম কোর্টের একজন খ্যাতনামা আইন ব্যাবসায়ী ছিলেন এবং তদুপার্জ্জিত অর্থে দত্তবংশের যথেষ্ট বিষয় সম্পত্তি ও পসার প্রতিপত্তি হইয়াছিল। দুর্গাচরণও আইন ব্যবসায়ে প্রবেশ করিয়াছিলেন এবং শীঘ্রই ধনে মানে পিতার সমকক্ষ হইয়াছিলেন। কিন্তু তিনি স্বভাবতঃই ধর্মপ্রাণ ছিলেন এবং সর্বদা সাধুসঙ্গ ও সাধুসেবা করিতেন। ধন মান যশঃ তাঁহাকে অধিকদিন সংসারে আবদ্ধ রাখিতে পারিল না। পঁচিশ বৎসর বয়সে তিনি স্ত্রী ও একমাত্র পুত্রের রক্ষণাবেক্ষণ ভার আত্মীয়স্বজনের হস্তে সমর্পণপূর্ব্বক গৃহত্যাগ করিলেন এবং পাঁচ ছয় বৎসর ভারতবর্ষের নানা স্থানে ভ্রমণ করিয়া অবশেষে ৺কাশীধামে উপনীত হইলেন। সে সময়ে ৺কাশীধামে যাইতে হইলে পদব্রজে বা নৌকাপথে যাইতে হইত, কারণ তখন এদেশে রেলগাড়ীর প্রচলন হয় নাই। দুর্গাচরণের সংসারত্যাগের পাঁচ ছয় বৎসর পরে তাঁহার স্ত্রী অষ্টমবর্ষীয় শিশুপুত্র বিশ্বনাথকে সঙ্গে লইয়া নৌকাযোগে বারাণসীধামে যাইতেছিলেন। দেড়মাস পরে তাঁরা বারাণসী পৌঁছিলেন। পথে নৌকার উপর খেলা করিতে করিতে বিশ্বনাথ জলমগ্ন হইয়াছিলেন এবং পুত্রবৎসলা জননী পুত্রের জীবনরক্ষার জন্য অতিমাত্র ব্যস্ত হইয়া আপন প্রাণের মমতা পরিত্যাগপূর্ব্বক মজ্জমান পুত্রের উদ্ধারকল্পে ভাগীরথীসলিলে ঝম্ফ প্রদান করিয়াছিলেন। সেদিন মাতা পুত্র উভয়েরই প্রাণনাশ হইত, কিন্তু বিধিকৃপায় নৌকার মাঝিমাল্লার যত্নে উভয়েই রক্ষা পান। যখন উহারা মাতা পুত্র উভয়কে জল হইতে তুলিল, তখন দেখা গেল, স্নেহময়ী জননী পুত্রের একখানি হাত দৃঢ়ভাবে ধরিয়া আছেন! বহুকাল বিশ্বনাথের হস্তে ঐ দাগ ছিল। 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
তারপর কাশীধামে পৌঁছিয়া দুর্গাচরণপত্নী বহু দেবদেবী দর্শন করিয়া কথঞ্চিৎ শান্তিলাভ করিলেন। দৈবক্রমে একদিন বৃষ্টি হওয়াতে তিনি ৺বিশ্বেশ্বরের মন্দিরের সম্মুখে পড়িয়া যান। জনৈক সাধু তাহা লক্ষ্য করিয়া “মায়ি গির্ গিয়া” বলিয়া দৌড়াইয়া আসিলেন ও তাঁহার হাত ধরিয়া উঠাইলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য্য! -- কে এ সন্ন্যাসী? সন্ন্যাসী যখন মূর্চ্ছিতপ্রায় দুর্গাচরণ-পত্নীকে সযত্নে বহন করিয়া মন্দিরের সোপানে স্থাপিত করিলেন তখন পলকের জন্য চারি চক্ষুর মিলন হইল। উভয়েই উভয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া শিহরিয়া উঠিলেন। হা বিধিচক্র সন্ন্যাসী আর কেহ নহেন -- স্বয়ং দুর্গাচরণ।
 স্ত্রীকে চিনিতে পারিয়াই তিনি অস্ফুটস্বরে “মায়া হ্যায় মায়া হ্যায়!” এই কথা বলিতে বলিতে দ্রুতপদে সে স্থান হইতে অন্তর্হিত হইলেন। ত্যাগী পুরুষ! রমণীও ত্যাগশীলা। বহুদিনের পর অকস্মাৎ স্বামীর পবিত্র মুখদর্শনে দুর্গাচরণ-পত্নী আন্তরিক তৃপ্তিলাভ করিলেন বটে, কিন্তু আর তাঁহাকে সংসারবন্ধনে আবদ্ধ করিবার কল্পনা তাঁহার মনে উদিত হইল না। তিনি মন্দিরে প্রদক্ষিণ করিয়া বিশ্বনাথ দর্শন করিলেন এবং নতজানু হইয়া তাঁহার চরণে হৃদয়ের ভক্তিপুষ্পাঞ্জলি নিবেদন করিলেন।” (স্বামী বিবেকানন্দ, প্রমথনাথ বসু প্রণীত, উদ্বোধন কার্যালয়) 
 দত্ত পরিবারের আদি বাসভূমি বিষয়ে বিবেকানন্দ অনুজ ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত যা লিখেছেন তা বেশ প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখছেন -- “Narendranath Dutta, later on known as the famous Swami Vivekananda was born on Monday January 12, 1863 A.D. ( B.S. Paus Krishna-Saptami, Makar-Sankranti, Brahmo-Muhurta, i, e. 6.31.33 A.M. ). The Dattas according to family tradition originally hailed from Datta-Dariatona ( colloquially called Dereton ), a village situated in the Kalna sub division of the district of Burdwan. ... On inspection of the place by the writer himself, he culled out the follwing facts: The present day zamindar of the place said that they know nothing about the Dattas. All they know is, that they have bought three villages which originally belong to the Datta. On the entrance to the village is a meadow with a depressed surface, which is called ‘Naupukur’ ( Nine ponds ), a tank dedicated in the name of nine sons of the original founder of the family.
 ...Further, the late litterateur Purnachandra Dey Udvatsagar, who took special interest in old family geneologies and who was a son-in-law of local land-lord family, informed the present writer, that there is a big pond in the village which was donated by the Subedar of Bengal, Nawab Murshidkuli Khan to a milkman (Goala ). In the title-deed of the gift, the Dattas are mentioned as residing in the village. Thus, we can safely trace the Dattas of Dariatona from late Mughal period.” ( Vivekananda: Patriot Saint, Bhupendranath Dutta, Nababharat Publishers )

Post a Comment

0 Comments