ডারউইন ও বিশ্বযুদ্ধ
সৌমেন রায়
শিরোনাম পড়ে আবার ভাববেন না যে ডারউইন বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী। তবে ক্ষীণ হলেও যোগাযোগ তো একটা ছিলই। সবাই জানেন ডারউইন বিবর্তনবাদের জনক। বিবর্তন বলতে বোঝায় কিভাবে প্রাকৃতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে । ডারউইন যে প্রথম এমন একটি ধারণা টুক করে চয়ন করে এনেছিলেন তা নয়। ঈশ্বরীয় সৃষ্টি তত্ত্বের বিপরীতে যুক্তি নির্ভর ভাবনা অনেকদিন থেকেই চিন্তা নায়কদের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল। ভাবনাগুলি পূর্ণতা পায় ডারউইনের মাথায়।
অষ্টাদশ শতকে লিনিয়াস(1707-1778) উদ্ভিদ ও প্রাণীদের বর্গীকরণ করেন। তিনি ছিলেন দরিদ্র ও প্রায় স্বশিক্ষিত। হয়তো বা সে কারণেই পরিশ্রমী। তিনি প্রায় একা হাতে উদ্ভিদ ও প্রাণীদের বর্গীকরণের কাজ করেন। সে বর্গীকরণের কিছু পরিবর্তন হলেও মূল বিষয়টি এখনও অপরিবর্তিত। বর্গীকরণের ফলে জীব বিজ্ঞানীদের কাজে যেমন সুবিধা হল তেমনি জীব ও প্রকৃতির পারস্পরিক ক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা চলতে থাকলো। ডারউইনের দাদু ইরাসমাস ডারউইন বলেন যে একটিমাত্র পুং দণ্ড থেকে সমগ্র জীবজগৎ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ততদিনে খ্রিস্ট ধর্মীয় ব্রহ্মাণ্ড তত্ত্ব বাতিল হয়ে গেছে। তাই প্রান তত্ত্ব কে আঁকড়ে বেঁচে ছিল ধর্মবাদীরা। ঈশ্বর জীব সৃষ্টি করেছে এমনটা ভাবাই তখন স্বাভাবিক। তাই আদম ইভের উপাখ্যান বা নোয়ার নৌকাকে উপড়ে ফেলা সম্ভব হয়নি। বিবর্তনের ব্যাপারে ল্যামার্ক প্রথম একটি যুক্তি নির্ভর তত্ত্বের অবতারনা করেন(1709)। তিনি বলেন প্রাণীরা সর্বদা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ফলে তার মধ্যে বিভিন্ন পরিবর্তন হয়। সেই পরিবর্তন বংশানুক্রমে সঞ্চারিত হয়। যেমন উঁচু গাছের পাতা খাওয়ার চেষ্টা করার ফলে আস্তে আস্তে জিরাফের গলা লম্বা হয়। আর তা ক্রমাগত সঞ্চারিত হতে হতে সব জিরাফই লম্বা গলার জিরাফে পরিণত হয়। এ তত্ত্বের ত্রুটি থাকলেও এটাই প্রথম কোন মৌলিক ধারণা।
যে বছর ল্যামার্কের তত্ত্ব বেরোলো, সেই বছরই জন্ম নিলেন ডারউইন। আশ্চর্য সমাপতন। ঠিক এমনটি না হলেও এমন ধরনের সমাপতন আগেও ঘটেছে। যে বছর গ্যালিলিও মারা গেলেন সেই বছরই জন্ম হলো নিউটনের(1642)। এ যেন বিজ্ঞানের আলোকবর্তিকা পূর্ব পুরুষ তুলে দিয়ে গেলেন উত্তর পুরুষের হাতে। যাই হোক দাদু ডাক্তার, বাবা ডাক্তার কিন্তু ডারউইনের পড়ায় মন নেই। শৈশবে মা হারা ছেলে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়।পোকামাকড় ধরে, পাখি দেখলে খেলনা বন্দুক তাক করে। এখন পশ্চিমবঙ্গে জন্মালে ডারউইনের কপালে সকালে একটি, বিকাল একটি টিউশন জুটতো। যাতে করে কার্নিশ থেকে বিড়ালের লাফানো দেখারও সময় না হয়। ভাগ্যিস তখন অপচয় করার মত সময় পেয়েছিলেন তিনি। তাই দেখার চোখটি ঠিকমতো তৈরি হয়ে গিয়েছিল। প্রথমে ডাক্তার হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করা, তারপর কোনোক্রমে ধর্ম যাজকের ডিগ্রী। কাজ অবশ্য করেননি।বরং পাঁচ বছরের জন্য ভেসে পড়েছিলেন সমুদ্রে। না নিজের পয়সায় নয় অন্য একটি অভিযানে বিনা পয়সার প্রকৃতি পর্যবেক্ষক হিসাবে গালাপাগোস দ্বীপ সহ বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করে ফিরে এলেন। প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে তার মনে হল যে বিভিন্ন প্রজাতি সৃষ্টি হয়েছে প্রাকৃতিক ভাবে। সরল এককোষী জীব থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে সমগ্র জীব জগত। কিন্তু তখনই সেই কথা বললেন না। শুধুমাত্র ভ্রমণের দিনপঞ্জি প্রকাশ করলেন। সংগ্রহ করে চললেন আরো তথ্য। তারপর ১৯৪২ থেকে শুরু করলেন লিখতে।
আশ্চর্যের কথা জীব বিজ্ঞানের এই তত্ত্বের পিছনে ভূতত্ত্ববিদ্যার অপরিসীম অবদান ছিল। খনিজ উত্তোলন করতে গিয়ে ভূতত্ত্বের দিকে মানুষের নজর আসে। প্রাথমিকভাবে সবাই মনে করত পাহাড়, নদী পার্থিব সবই ঈশ্বরের সৃষ্টি।হাউটন প্রথম বলেন কাণ্ডজ্ঞান নির্ভর ভূতত্ত্বের কথা। বলেন পাহাড় নদী পর্বত সব প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি। যেমন নদী সৃষ্টি হয়েছে প্রাকৃতিক ঢাল বরাবর জলের প্রবাহ থেকে। নদীর পলি জমে হয়েছে পাললিক শিলা, অগ্নুৎপাত থেকে আগ্নেয় শিলা। ইংল্যান্ডের খাল খনক স্মিথ খাল খনন করতে এবং রাস্তা তৈরি করতে গিয়ে দেখলেন মাটির মধ্যে বিবিধ স্তর। লায়ল তার জিওলজি অফ আর্থ বইতে বললেন এক একটি স্তর এক একটি যুগের অবক্ষেপ। প্রাচীন সময় থেকে মানুষ জীবাশ্মর সঙ্গে পরিচিত ছিল। এই সময় থেকে শুরু হলো গবেষণা। দেখা গেল একেকটি স্তরে জীবাশ্মের ধরন এক একরকম। দ্বিতীয় স্তরের আগে পাওয়া গেল না কোন সরীসৃপের জীবাশ্ম ,তৃতীয় স্তরের আগে পাওয়া গেলনা স্তন্যপায়ীর জীবাশ্ম। অর্থাৎ এক এক রকম যুগে সৃষ্টি হয়েছে একেক রকমের প্রাণী। এই ধারণা ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল ডারউইনকে। আর ছিল মালথাসের তত্ত্ব। ম্যালথাসের মূল কথা ছিল মানুষের জীবন এক সংগ্রাম। প্রকৃতি যোগ্য ব্যাক্তিকে বরণ করে নেয়। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রিত হয় যুদ্ধ, রোগের দ্বারা। এই তত্ত্ব নাড়া দিয়েছিল ডারউইনকে।
যাই হোক ডারউইন 1844 নাগাদ একটা খসড়া খাড়া করলেন। কিন্তু স্ত্রীর নিষেধে ছাপতে দিলেন না।যদি চার্চের রোষানলে পড়েন! পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে তো! কাজ কিন্তু থেমে থাকল না। ব্যাপারটা অনেকটা নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব ফেলে রাখার মত। অনেকদিন পর হঠাৎ ওয়ালেস এর কাছ থেকে পেলেন একটা প্যাকেট। ভেতরে একটা পান্ডুলিপি, সঙ্গে একটা চিঠি। পান্ডুলিপি খুলে ডারউইন তো হতবাক। তার গবেষণার সঙ্গে হুবহু মিল গবেষণাপত্রটির। চিঠিতে ওয়ালেস অনুরোধ জানিয়েছেন গবেষণাটি পছন্দ হলে কোন বিজ্ঞান পত্রিকায় যেন ছাপিয়ে দেন। পান্ডুলিপিটি চেপে দিয়ে নিজেরটা অনায়াসে ছাপিয়ে দিতে পারতেন ডারউইন। কিন্তু করলেন না, বদলে লায়ল এবং বন্ধু হুকারকে কে জানালেন সবকিছু। বললেন নিজের পান্ডুলিপিটা পুড়িয়ে ছাপিয়ে দেবেন ওয়ালেস এর টা।লয়ালের মধ্যস্থতায় ডাকা হল দুজনকেই। বিবর্তনবাদের স্বপক্ষে নিজের নিজের পান্ডুলিপি পড়ে শোনালেন। স্বীকৃতি পেল দুজনেরই কাজ। কিন্তু বই ছাপানো হলো ডারউইনের।ওয়ালেস আপত্তি করেননি,এমনকি তিনিই নাম দিলেন ডারউইনবাদ। কি অসামান্য সৌজন্য। সারা জীবনের মেধা সম্পদ পরস্পর পরস্পরকে দান করে দিতে উদ্যত। মনে পড়ে যাবে আমাদের রাজনৈতিক সমাজের কথা, সাজুসের জন্য নয় বৈপরীত্যের জন্য!!
সেই বইতে ডারউইন দেখালেন প্রকৃতির সঙ্গে সংঘর্ষে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য অর্জিত হয়। ভেদ ঘটে প্রজাতির মধ্যে। সেই ভেদ সঞ্চারিত হয় পরবর্তী প্রজন্মে। এইভাবে ক্রমাগত ভেদ সৃষ্টি এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হস্তান্তরের মাধ্যমে এক প্রজাতি থেকে সৃষ্টি হয় অন্য প্রজাতি। যে মানিয়ে নিতে পারেনা সে বিদায় নেয় পৃথিবী থেকে,অবলুপ্ত হওয়া তার ভাগ্যলিপি। প্রকৃতি বিজয়ীকে জয়মাল্য পরিয়ে দেয়। অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ কিভাবে হয় সেটা অবশ্য ডারউইন বলেননি। সে কথা কিছুটা বলেছিলেন মেন্ডেল(1856)। তিনিও ছিলেন একজন ধর্মযাজক। কোপার্নিকাস ,ডারউইন ,মেন্ডেল এসব ধর্ম যাজকরা যে ধর্মের এমন সর্বনাশ করবে কে জানতো!! জীবনকালে মেন্ডেল অবশ্য কোন স্বীকৃতি পাননি, পেয়েছেন শুধু উপহাস।দা ভ্রিস প্রমুখের প্রচেষ্টায় তার স্বীকৃতি মিলে অনেক পরে।তবে মেন্ডেল বলেছিলেন বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরন।বৈশিষ্ট্য অর্জিত হয় জিনের পরিবর্তনে,জানা গেছে অনেক পরে।
ডারউইন এর পরও অনেকগুলি বই লিখেছেন। তার মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত হলো 'ডিসেন্ট অফ ম্যান'। এখানে তিনি দেখালেন আমরা আসলে বাঁদরের উত্তর পুরুষ। বিশ্বাস না হলে হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির যেকোনো একজনের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে আমরা কেমন এ ডাল থেকে ও ডাল লাফালাফি করছি,ভেংচি কাটছি,মাঝে মাঝে চুলকে নিচ্ছি,পরস্পরের উকুন দেখছি, দোল খাচ্ছি। এ বিষয়ে একটি প্রশ্ন ছাত্র মনে প্রায়শই জাগরিত হয় যে বাঁদর থেকেই যদি মানুষ হয় তাহলে এখনো বাঁদর আছে কেন? আসলে বাঁদর থেকে মানুষ হওয়া কথাটা সরলীকৃত ভাষ্য। শিল্পাঞ্জি, বেবুন, ,গরিলা ,ওরাং ওটাং এরা সকলেই বানর গোত্রীয় জীব। এই সমস্ত এক গোত্রীয় জীবের মধ্যে একটি শাখা বিবর্তিত হয়ে মানুষ পরিণত হয়েছে । অন্যদের বিবর্তন হয়তো হয়েছে কিন্তু মানুষের মতো এতোখানি পরিবর্তন ঘটেনি। তাই তারা এখনো প্রায় একই রকম ভাবে বেঁচে আছে।সেই একটি প্রজাতির বিপুল পরিবর্তনের পিছনে জিনগত হঠাৎ পরিবর্তন বা মিউটেশন ও হতে পারে ।
0 Comments