জ্বলদর্চি

কালিম্পং ডায়েরি /পর্ব-৬/সুমিত্রা মাহাত

কালিম্পং ডায়েরি
পর্ব-৬

সুমিত্রা মাহাত
 
একটা আশ্চর্য জিনিস লক্ষ্য করছি। যতই উপরে উঠছি ঘরবাড়ি,জনবসতি ক্রমশ বাড়ছে। জীবন - জীবিকার তাগিদে , প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে , নাকি দুর্গমতার নেশায় মানুষ এত উপরে বাসা বেঁধেছে বুঝতে পারি না । খাড়া রাস্তায় গাড়ি নির্দ্বিধায় সোজা উপরে উঠছে , দেখে আমার মাথা ঘুরে যায় , এও কি সম্ভব! রাস্তার দুদিকে রং রূপের বাহার জানান দেয় কালিম্পং আসন্ন। মনে তখন একরাশ প্রফুল্লতা। অবশেষে দুপুর দু টা নাগাদ আমাদের বাস কালিম্পং পৌঁছায়। মেইন রাস্তার পাশেই মেলা গ্রাউন্ড। এটাই প্রতিযোগিতাস্থল। মেলা গ্রাউন্ড এর বড় লোহার গেটের বাইরে সারি সারি গাড়ি দাঁড়ানো।  বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিযোগীরা এসেছে। এছাড়া মেইন রাস্তা তে ও গাড়ির লাইন পড়ে গেছে। নানান সাইজের,নানান কোম্পানির নানান রং এর গাড়ি। এগুলোতে রয়েছে ভ্রমণবিলাসী মানুষজন । লোকাল বাসগুলোতে বেশিরভাগ যাতায়াত করে  লোকাল লোক ও কর্মসূত্রে আসা লোকজন। 
এখনও আমরা ফুল এনার্জি নিয়েই রয়েছি। মেলা গ্রাউন্ড এর পাশে মেইন রাস্তায় বাস দাঁড়ায়। একে একে সকলেই নেমে পড়ি। ট্রাফিক পুলিশের তাড়নায় বাস দ্রুত খালি হয়। ঘর আগে থেকেই বুকিং করা আছে সবার জন্য। বেশি দূরে নয় পাঁচ মিনিট হাঁটতে হবে। আশ্চর্যের ব্যাপার পাশাপাশি দুটো রাস্তা , তবু একটা থেকে আরেকটায় যেতে গেলে মাঝে কুড়ি টা সিঁড়ির ধাপ উঠে তবে যেতে হবে। জটিল যোগাযোগ ব্যবস্থা ! স্থানীয় মানুষ হাল্কা হাওয়ায় ভেসে চলার মতো নির্দ্বিধায় পা ফেলে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। লাগেজ নিয়ে আমাদের অবস্থা বলার মতো নয় । মেইন রোড থেকে কুড়ি টা সিঁড়ি উপরে উঠে আরেকটা পিচ রাস্তা , সেখান থেকে পনেরো- কুড়িটা সিঁড়ি নীচে নেমে আমাদের থাকার জায়গা। এটা ঠিক লজ নয় , শান্ত পরিবেশে যেন সাক্ষাৎ মহাদেবের অধিষ্ঠান। ঢালু রাস্তা শেষ হলে গেট। ছেলে , মেয়ে লাগেজ , বাগেজ টানা হ্যাঁচড়া করে কোন রকমে নিয়ে আসি। পরিবেশ পরিস্থিতি একেবারে নতুন তাই বুঝে নিতে সময় লাগছে,তা না হলে আমিও হাল্কা হাওয়ায় ভেসে চলার চেষ্টা করতাম। পাহাড়ে ওঠা নামার অভ্যাস নেই ঠিকই, রোদে-জলে পোড়ার অভ্যাস তো আছে। 
গেটে ঢুকেই বামদিকে বড়ো বেদীর উপর সিমেন্টের বিশাল ষাঁড় বসানো। তার ডান দিকে বড়ো শিবলিঙ্গ। পাশেই দোতলা বাড়ির ওপর ও নীচতলা মিলিয়ে আমাদের থাকার জায়গা । ওপরে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট ঘর ও টানা বাথরুম। নীচে একটি টানা হলঘর ,কোন বাথরুম নেই। ষাঁড় এর ধবধবে সাদা রং ও ঘন কালো চোখ দেখেই যাত্রা পথের সমস্ত ক্লান্তি , শ্রান্তি দূর হয়ে যায় । সবাই রুমের মধ্যে জিনিসপত্র রেখে ফ্রেশ হয়ে নেয়। জলের অবস্থা সঙ্কটজনক। কল দিয়ে সরু সুতোর মতো জল পড়ছে , যা ধরতে ধরতেই শেষ হয়ে যায়। সত্যিই তো এতো উঁচুতে জলের ব্যবস্থা করা মুখের কথা নয়। সমতল থেকে গাড়িতে করে , নয় তিস্তার জল পাইপলাইন এর সাহায্যে তোলা হয়। দুই ই খরচ সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য। মানুষজন বৃষ্টির জল ধরে রেখেও ব্যবহার করে। আমরা কারণে অকারণে কত জল অপচয় করি অথচ এখানে সামান্য জলের জন্য হাহাকার। যারা প্রাণ থাকতে জলের মর্ম বোঝেনা তাদের ঘাড় ধরে একবার পাহাড়ে নিয়ে আসা উচিত। খুব প্রয়োজন ছাড়া এখানে জামাকাপড় ধোওয়া যাবে না। প্রথমত জলের সমস্যা দ্বিতীয়ত সূর্য দেবের কৃপা লাভ এত সহজে হয় না , এত সহজে তার দর্শন মেলে না। 
🍂

আজকের আবহাওয়া বেশ পরিষ্কার। আমাদের এখনও কিছু খাওয়া হয়নি। স্টেডিয়াম ঘুরে দেখতে হবে সঙ্গে খাবার দাবার যদি কিছু পাওয়া যায়। সকলে বেরিয়ে পড়ি। আবার কুড়িটা সিঁড়ি উপরে উঠে পিচ রাস্তা পেরিয়ে কুড়িটা সিঁড়ি নীচে নেমে মেইন রাস্তা। চলতে ফিরতে যদি এরকম ওপর-নীচ হতে হয় তাহলে শরীরের মধ্যপ্রদেশ অবশ্যই সমতল থাকবে। স্টেডিয়ামের ভেতরে ঢুকে গ্যালারির সিঁড়িতে পা ঝুলিয়ে বসি। কাল যে যুদ্ধ হতে চলেছে তার কিছুটা আঁচ পাওয়ার চেষ্টা করি। ছেলেমেয়েরা স্যার এর সঙ্গে রেজিস্ট্রেশন করতে চলে যায়। স্টেজ, বক্সিং এর জন্য রিং বানানো ও পতাকা দিয়ে সাজানো চলছে। পাহাড়ের কোলে অনেকটা জায়গা গোল করে কেটে সমতল বানিয়ে মেলা গ্রাউন্ড টি বানানো হয়েছে।মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে কী ই না করতে পারে ! নানা স্থান থেকে নানান ভাষা-ভাষীর মানুষ মাঠে ভিড় করেছে। প্রতিযোগীরা সকলেই রেজিস্ট্রেশন করে নিচ্ছে। আজ রাত থেকে পর পর দু - দিনের , ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ , ডিনারের এর বন্দোবস্ত এখানেই রয়েছে তাই কর্তৃপক্ষের খাতায় নাম তোলা জরুরি। ছেলেমেয়েরা ফিরে এলে সকলে স্টেডিয়াম লাগোয়া ছোট্ট বাজারে খাবারের খোঁজে যেতে উদ্যত হয়। মাঝে রাস্তা,দুদিকে বাজার, বড় বড় হোটেল। আশা করা যায় কপালে কিছু জুটবে। আমার যেতে মন চায় না । গ্যালারির সিঁড়ির ধাপে বসে মানুষের অদৃশ্য আবেগ বোঝার চেষ্টা করি। একজন মানুষ হিসেবে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে নিজের জীবনযাপন মেলানোর চেষ্টা করি । স্টেডিয়ামের বাইরে নানারকম দোকান - মোমো,চা-কফি,ফুচকা,ঘুঘনি। কেউ ছোট টেবিলের উপর দোকান সাজিয়ে রেখেছে,পাশে ফুটন্ত গরম জলের ওপর সেদ্ধ হচ্ছে মোমো তো কেউ চা , কফি নিয়ে শুধু টুলের উপর বসে। একটা ঠেলাতে বিক্রি হচ্ছে ফুচকা , আরেকটা তে সবরকম-ঘুঘনি,মিক্সচার , কাঁচা ভুট্টা থেঁতলে ভাজা করা,আরও কীসব ! সারাবছর ই এদের কমবেশি রোজগার হয় তবে সিজ্ন এ বেশি। পাশেই একটি চারতলা বাড়ির ছাদ থেকে দুটি লোমশ ছোট্ট কুকুর সমস্ত শক্তি দিয়ে আওয়াজ বের করে হয় আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে চাইছে নয় আমরা অনধিকার প্রবেশ করেছি এটাই বোঝাতে চাইছে । একটি সাদা ও একটি কালো রং এর। তাদের আগ্রহ দেখে আমি না হেসে পারি না। পৃথিবীর প্রত্যেকেটা জীব ই নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে চায় । বিশেষ করে তার নিজের পরিবেশের বদল ঘটলে। ছেলে - মেয়ে , হাজব্যন্ড ফিরে আসে। হাজব্যন্ড ভাত,ডাল, সব্জি, আচার , পাঁপড় দিয়ে নিরামিষ থালি খায়। ছেলে-মেয়ে খায় রুটি ও মাংস । আমার জন্য নিয়ে এসেছে রুটি ও ডিমের কারি । ডিম কারিতে দুটো ডিম রয়েছে , রুটি গুলো নরম তুলতুলে। যথেষ্ট শক্তি দিয়ে ডলে শুকনো আটাকে এই পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে । অভুক্ত অবস্থায় আমার কাছে তা অমৃত সমান। 
খাওয়া দাওয়া ঘোরাঘুরি সেরে আমরা সবাই ফিরে আসি । কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিই। পরের দিনের প্রতিযোগিতার আলোচনা চলে । রাত্রি আটটা নাগাদ পুনরায় খেলা কমিটি নিবেদিত ডিনার সারতে যাই। উফঃ আবার সেই সিঁড়ির পর সিঁড়ি , ধন্য এ মানব জীবন ! স্টেডিয়ামের পেছনে একটা প্রাচীর ঘেরা জায়গাতে ডিনারের আয়োজন। জায়গাটা চোখের সামনেই কিন্তু সেখানে নামা এতটা সোজা নয় । খাড়া ঢাল বেয়ে হেঁটে হেঁটে নামতে হবে , গড়িয়ে গেলে একদম নীচে , ডিনারের টেবিলেই পৌঁছে যাবো । সকলেই আমাকে টপকে চলে যায়। ধরে নামতে গেলেও বিপদ তাতে দুজনেরই পড়ার সম্ভাবনা। একবার ভাবি বসে হামাগুড়ি দিয়ে নামলে কেমন হয়,চক্ষু লজ্জার ভয়ে তা পারি না। ডানদিক দিয়ে আবার স্পীডে গাড়ি চলাচল করছে। যাইহোক কপালের জোরে ডিনার টেবিলে পৌঁছাই। খাওয়া দাওয়ার সুন্দর বন্দোবস্ত। একজন খেলোয়াড়ের যা যা খাওয়া উচিত তাই আছে মেনুতে । সুন্দর ভাত, ডাল, সব্জি, স্যালাড, আচার, পাঁপড়। হাতে কাগজের থালা নিয়ে সবাই লাইন দিয়ে গিয়ে খাবার নিচ্ছে । পাহাড়ি যুবকেরা মিষ্টি হাসি ও মধুর আতিথেয়তার সঙ্গে খাবার পরিবেশন করছে । মন পরিতৃপ্ত হয়। এত মানুষ খাচ্ছে অথচ কোন গোলমাল নেই, বিশৃঙ্খলা নেই। আমার পাপী চোখ আবার অন্য কিছুর সন্ধানে মত্ত। একপাশে আমার নজরে পড়েছে সারবদ্ধ লিলি ফুলের ঝাড় , সেখানে অসংখ্য নলাকার স্টিকের উপর টুকটুকে লাল রং এর থোকা থোকা ফুল। আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। মেয়ের ধমকানিতে সম্বিত ফেরে। সদলবলে ফিরে আসি। ফেরার সময় খাড়া পথ ধরে উপরে উঠতে হয়,হাঁপিয়ে যাই। আবার গন্ডা গন্ডা সিঁড়ি ভেঙ্গে তবে রুমে পৌঁছাই। মনে ভাবি এখানকার মানুষ তো অন্যের নিন্দা চর্চা করার কোন সময়ই পাবে না , ওঠা নামা করতেই সময় কেটে যাবে।
সকলেই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন ছেলে মেয়েদের সাড়ে পাঁচটা র মধ্যে মাঠে পৌঁছাতে হবে।   ভোর তিনটে থেকে বাথরুম এ লাইন না দিলে সুতোর মতো জলে কার্যোদ্ধার অসম্ভব। প্রথমে প্রতিযোগী তার পর সহযোগী সুযোগ পাবে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে হঠাৎ মনে পড়ল ছাদ থেকে দেখা দৃশ্যের কথা । ঘন অন্ধকারে সমস্ত পাহাড় জুড়ে , সকলের মঙ্গল কামনায় , কোন রমনীয় নারী যেন আলোর প্রদীপ জ্বালিয়েছে !

Post a Comment

0 Comments