রেশমের একাল - সেকাল
পর্ব - ১
কুহেলী বন্দ্যোপাধ্যায়
বাগানে বসে চা খাচ্ছিলেন চিনের এক জনৈকা রানি। গরম চায়ের পেয়ালায় টুপ্ করে এসে পড়ল ছোট্ট একটি গুটি। চায়ের ওমে সেই গুটি থেকে বেরিয়ে এলো এক সূক্ষ্ম সোনালি রঙা সুতো। জনশ্রুতি আছে, এভাবেই চিনদেশে আত্মপ্রকাশ ঘটে রেশমের। ঠিক যেন নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কারের, গাছ থেকে আপেল পড়ার মতো। চায়ের কাপ থেকে রেশমের বিস্তৃতি ঘটে সমগ্র বিশ্বে।
রেশমের সাথে মানব সভ্যতার যে টানাপোড়েনের ইতিহাস, এর যোগাযোগ সুদুর অতীতের রেশম পথ ধরে। আঁকাবাঁকা, দুর্গম রেশম পথের মতোই রেশমের বিবর্তনের ধারাও অমসৃণ। জিশুখ্রিস্টের জন্মের পূর্বে আবিষ্কৃত এই রেশম একসময় চিন থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচুর রপ্তানি হওয়ায় সেই পথের নাম হয় রেশম পথ বা সিল্করুট। চিন থেকে ভুমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এই পথের দৈর্ঘ্য ছিল ৪০০০ মাইল। বানিজ্য ছাড়াও, সেকালে এই পথেই দেশবিদেশের মধ্যে বিনিময় হতো জ্ঞানবিজ্ঞান, সংস্কৃতির এবং ভাবনাচিন্তার। সুদুর প্রাচীনকালে বৌদ্ধধর্ম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল এই পথ ধরেই। এরপর সিল্কের প্রসার ঘটে ধীরে ধীরে ভারত, জাপান এবং পারস্য (বর্তমান ইরান) পর্যন্ত। তুঁত রেশম তিব্বত হয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল বলে জানা যায়।
রেশমের ইতিহাস হাতড়ে দেখা যায়, বাংলার যে এই শিল্প তা নেহাত আজকের নয়। স্কুল পাঠ্যে বইয়ের পাতায় পড়া ইংরেজ শাসনকালে ভারত তথা বাংলার বস্ত্রশিল্পের যে নিদারুন অবক্ষয় হয়েছিল …. এ তার চেয়েও প্রাচীন। ঋকবেদ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং খ্রিস্টপূর্ব দেড় হাজার বছর আগে রচিত উপনিষদে গাঙ্গেয় সমভুমিতে পোশাক ব্যবহারের প্রমান পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকরা ভারতীয় গাঙ্গেয় সভ্যতাগুলিতে খননকার্য চালিয়ে সুতো কাটার বস্ত্রবয়নের ছোট ছোট কল এবং কাপড় রঙ করার চৌবাচ্চার সন্ধান পেয়েছেন। মহাকবি কালিদাসের রচনাতেও একপ্রকার সূক্ষ্ম কাপড়ের বিশেষ বর্ণনা রয়েছে যাতে জানা যায় সে সময় গাঙ্গেয় উপত্যকায় উৎপন্ন মসলিন ফু দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যেত।
🍂
তবে চিনকে রেশমের আঁতুড়ঘর বলে মনে করা হলেও খ্রিষ্টের জন্মের বহু আগে থেকেই বাংলাতেও একপ্রকার রেশমের চাষ হতো। যা অতুঁত রেশম নামে পরিচিত। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে মোঘল সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলায় (অবিভক্ত) তথা মুর্শিদাবাদে রেশম শিল্পের প্রসার ঘটেছিল। সে সময় বিভিন্ন দেশে বাংলার মসলিনের চাহিদা ছিলো আকাশ ছোঁয়া। এমনকি এই সিল্কের টানেই দেশের বিভিন্ন প্রদেশের রাজারা তাঁদের তাঁতিদের পাঠাতেন রেশম চাষের পদ্ধতি শেখার জন্য। ততদিনে অবশ্য নিজস্ব রেশম ও চিন থেকে আসা তুঁত বা মালবেরি রেশম দুটিতেই বাংলা খ্যাতি অর্জন করেছে । বাংলা থেকেই পরে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে রেশম চাষ বিস্তার লাভ করে। এই শিল্পের টানেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল শাসনকালে বাংলায় বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে। যার ফল স্বরূপ বাংলার শিল্পের চূড়ান্ত ক্ষতি হয়েছিল।
সেকালে বাংলায় অতুঁত রেশমের চাষ হতো তা ছিল তিন প্রকারের- তসর, মুগা এবং এরি। তবে এই মালবেরি তুঁতের চাষ ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল তার সঠিক তথ্য অজানা। বাংলায় রেশম উৎপাদনের দীর্ঘ ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, গ্রামের গৃহস্থেরা তিনটি পর্যায়ে রেশম উৎপাদন করতো ১.মালবেরি বা তুঁত চাষ ২.রেশমগুটি লালনপালন এবং ৩. কাপড় তৈরির জন্য রেশমগুটির সুতো পৃথক করা। শিল্পটি কৃষিভিত্তিক হলেও এর উৎপাদন পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল। সেরিসিন নামক এক প্রকার প্রোটিন হল রেশমের মূল গাঠনিক পদার্থ। বোমবিকস মোরি বর্গভুক্ত রেশম পোকার গুটি থেকে তৈরি সুতো দিয়ে বোনা একপ্রকার সূক্ষ্ম ও কোমল তন্তু হল রেশম। শব্দটি মূলত ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে।
মালবেরি তুঁতের মথ বা পলু পোকা কে সহজেই ঘরে পালন করা যায়। কিন্তু তসর, মুগা রেশমের পলু বন্য। এরা অর্জুন, আসান, শাল, সেগুন ইত্যাদি গাছের পাতা খেয়ে থাকে। পাতার রঙ অনুযায়ী তাই রেশমের রঙ ও হয় ভিন্ন। রেশমগুটি আসলে রেশমমথের শুঁয়োপোকা। রেশমমথ > ডিম > শূককীট > মুককীট > পূর্ণাঙ্গ পোকা এই পর্যায়ক্রমে এর জন্মচক্র চলে। মুককীট মুখ থেকে একপ্রকার লালা বের করে নিজেকে আবৃত করে। আবরণ সহ মু্ককীটকে কোকুন বলে। পরিপূর্ণ কোকুনকে কয়েক মিনিট সেদ্ধ করার পর ডিসেকটিং নিড্ল দিয়ে সুতো বের করা হয়। আবহাওয়া অনুযায়ী রেশম অথবা তসর উভয় প্রকার গুটি থেকে নির্দিষ্ট সময় পর মথ বের হয়। তবে মথ বেরিয়ে গেলে গুটির গুণ কমে যায়। তা থেকে উৎকৃষ্ট মানের কাপড় তৈরি হয় না।
( ক্রমশ )
1 Comments
Excellent documentation..waiting for the next.
ReplyDelete