জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব- ৭৫
ঝাড়গ্রামের তামাজুড়ি ও বামাল গ্রামে মিলেছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগের অস্ত্র
সূর্যকান্ত মাহাতো
অধুনা 'ঝাড়গ্রাম' জেলার বিনপুর-২ ব্লকের বেলপাহাড়ী থানার অন্তর্গত একটি গ্রাম। নাম 'তামাজুড়ি' গ্রাম। গ্রামের চারপাশে বেশ মনোরম পাহাড় আর ঘন ও সবুজ শালের জঙ্গল। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে এই গ্রামেরই সামনের পাহাড় থেকে একটি 'তামার কুঠার' আবিষ্কৃত হয়। প্রমাণিত হয় যে সেটি 'তাম্র প্রস্তর' যুগের। সে কারণেই বর্তমানে সেই 'তামার কুঠারটিকে' কোলকাতা 'জাদুঘরে'(মিউজিয়াম) সংরক্ষিত করা হয়েছে।
"Catalogue and handbook of the archaeological collection in the Indian museum" এর part- 2 এর ৪৮৫ পৃষ্ঠায় তার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া আছে।
সেখানে লেখা আছে Mr F.A. perroux এর কথায়, "it was found at the foot of the hill system of Manbhum beyond Sildah in the Paragana of Jhatibani, in the Midnapore district a village called Tamajuri is not far from the site where the copper axe was found. It was discovered by some villagers who were digging a pit for some domestic purpose."
কুঠারটি সম্পর্কে বলা আছে, "This axe measures 7".10 long and 6".40 in breadth with a maximum thickness of 0".63. It weight 4 lbs. 12.5 oz." (page- 485)
যোগেশচন্দ্র বসু লিখেছেন ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে বিনপুর থানার অন্তর্গত ঝাটিবানি বা শিলদা পরগনার তামজুড়ি গ্রামের কাছেই এক পাহাড়ের পাদদেশ থেকে কুঠারটি পাওয়া গিয়েছিল। সেই কুঠার ৭.১০ ইঞ্চি দীর্ঘ, ৬.৪০ ইঞ্চি প্রস্থ এবং ০.৬৩ ইঞ্চি পুরু। ওজন প্রায় দুই সের। (মেদিনীপুরের ইতিহাস/ যোগেশচন্দ্র বসু, পৃষ্ঠা- ৫৬) যোগেশ বাবু ওজন হিসাবে যে 'সের' কথাটি ব্যবহার করেছেন তা মূলত কেজি হিসাবেই। অর্থাৎ কুঠারটি ভারি প্রায় দু কেজির মতো। কারণ 4 lbs (pound) 12.5 oz (ounces) এই দুটো যোগ করলে (পাউন্ড+আউন্স) ২ কেজি ১৬৮ গ্রাম পাওয়া যাচ্ছে।
এদিকে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন,"১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমাংশে ঝাটিবনি পরগণায় তামাজুড়ি গ্রামে একখানি কুঠার ফলক আবিষ্কৃত হয়েছিল।"(বাংলার ইতিহাস, প্রথম পর্ব, পৃষ্ঠা-৯) তবে তিনি কুঠারটি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে কিছু বলেননি। অন্যদিকে তারাপদ সাঁতরা এই কুঠারকে আবার 'স্কন্দযুক্ত কুঠার' বলে উল্লেখ করেছেন। (মেদিনীপুর: সংস্কৃতি ও মানব সমাজ, পৃষ্ঠা- ৯)
আসলে ইতিহাসের একটা ধারাবাহিকতা আছে। সেটা বাংলার অন্য কোথাও না থাকলেও মেদিনীপুরে যে বিশেষভাবে ছিল সে কথা বিনয় ঘোষও জোর দিয়ে বলেছেন। (পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি পৃষ্ঠা- ৩৩৩) কারণ হিসাবে তিনি উল্লেখ করেছেন মেদিনীপুরের ভৌগলিক অবস্থানকে। পাহাড়ের পাথুরে মাটি, গভীর বন জঙ্গল, সেই সঙ্গে নদীর পলি মাটি। যা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই সভ্যতা বিস্তারে সহায়ক ছিল। প্রস্তর যুগ থেকে ধাতু যুগ এই ধারাবাহিকতার কথা তারাপদ সাঁতরাও বলেছেন।(মেদিনীপুর: সংস্কৃতি ও মানবসমাজ, পৃষ্ঠা- ১০)
ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা বলতে?
'ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা' বলতে ইতিহাসের কাল পর্ব তথা গতিশীলতাকে বোঝানো হয়েছে। যেমন ইতিহাসেরও আগে একটা প্রাক পর্যায় ছিল। ঐ সময়কালটা ছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগ। সেই সময়টা ছিল প্রস্তর যুগ। এই প্রস্তর যুগ আবার প্রাচীন-মধ্য-নব্য এই তিনভাগে বিভক্ত ছিল। এরপর 'তাম্রযুগ' হয়ে পরে 'লৌহযুগ' এসেছিল। যদিও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরাতত্ত্ববিদ হিসাবে পরিচিত 'জন লবক'(John Lubbock) এই প্রস্তর যুগকে দুভাগে ভাগ করেছেন। একটি হল 'প্রত্নপ্রস্তর যুগ'(palaeothical age) আর অন্যটি হল 'নব্য প্রস্তর যুগ'(neothical age)।(বাংলার ইতিহাস/ রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা- ৪) এই দুই যুগে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলোর মধ্যে প্রত্ন প্রস্তর যুগে ছিল পাথরের অস্ত্র। আর নব্য প্রস্তর যুগে ছিল বিভিন্ন রকমের বর্শাফলক, শরফলক, কুঠারফলক এবং ছুরির মতো অস্ত্র। ঝাড়গ্রামের অন্তর্গত লালগড়ের কাছে 'বামাল' গ্রাম থেকে প্রত্ন প্রস্তর যুগের পাথরের অস্ত্র পাওয়া গেছে। অন্য দিকে তামজুড়ি গ্রামে আবিষ্কৃত কুঠারটি লবকের কথামতো নব্য প্রস্তর যুগের বলা যায়। সুতরাং এই দুই গ্রাম থেকে পাওয়া অস্ত্রগুলো থেকে সহজেই মনে করা যায় যে, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এখানে সভ্যতার সূচনা ঘটেছিল। 'ঝাড়গ্রাম'(জেলা) হল এমনই এক ভৌগলিক স্থান যেখানে একেবারে প্রত্নপ্রস্তর যুগ থেকেই এখানে আদি অস্ট্রালয়েডদের সভ্যতার বিকাশ গড়ে উঠেছিল। এবং তার নানান ঐতিহাসিক নিদর্শনও মিলেছে বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া ঐতিহাসিক উপাদানের ভিত্তিতে। যেমন প্রাচীন যুগের নানান অস্ত্র ও ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া গেছে ঝাড়গ্রামের বিনপুর, শিলদা, বেলপাহাড়ী থেকে শুরু করে লালগড়, রামগড়, নয়াগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে। প্রাচীন ইতিহাসের ওইসব একাধিক পাথুরে প্রমাণের কথা বিনয় ঘোষও স্বীকার করেছেন। (পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি/ বিনয় ঘোষ, অখন্ড সংস্করণ, পৃষ্ঠা- ৩৩৬)
লালগড়! লালগড়ের 'বামাল' গ্রামে যে এমন কিছু মিলেছে তা তো কোন ইতিহাস বইয়ে পড়েছি বলে মনে হয় না?
আসলে 'Science and Culture' Vol- 14 বইটি কতজন আর পড়েছে। অথচ তার ২৫ পৃষ্ঠাতে পরিষ্কার লেখা আছে, "A NOTE ON SOME CELTS AND CHISELS FROM WEST BENGAL" এই শিরোনামে সেখানে লেখা আছে "The site where the above artfacts have been found is situated on what appears to be a mound near the village Bamal about three miles south of Lalgarh in the Jhargram Sub-division of the Midnapore district in West Bengal." (Science and culture/ Dharani Sen, vol-14, (1948), p- 252, 253)
যাইহোক, প্রাচীন প্রস্তর যুগের পর পরবর্তী তাম্রযুগেরও নিদর্শন মিলেছে ঝাড়গ্রামের 'তামাজুড়ি' গ্রামে। গ্রামের নামটিও বিশেষ তাৎপর্যময়। 'তামা' থেকেই তো তামাজুড়ি নামটার উৎপত্তি। তামার কাজ যে এখানে একসময় হত, তার নিদর্শন এখনো রয়েছে বলে বিনয় ঘোষ উল্লেখ করেছেন তার বইয়ে।(পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, অখন্ড সংস্করণ, পৃষ্ঠা- ৩৩৮)
তামাজুড়িতে প্রাপ্ত কুঠারটির প্রাচীনতা সম্পর্কে তরুণদেব ভট্টাচার্য বলেছেন, 'আর্য প্রভাব বিস্তারের আগেই তার তারিখ পড়ে।' (মেদিনীপুর/ তরুনদেব ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা- ১)
ঝাড়গ্রাম মহকুমায় তামার কুঠার আবিষ্কারের একটি সংবাদ ১৯৭৭ সালের ১২ জুলাই ইংরেজি দৈনিক 'স্টেটসম্যান' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। (মেদিনীপুর/ তরুণদেব ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা- ১। সেখানে বলা হয়েছিল পশ্চিমবাংলার শেষ সীমা ঝাড়গ্রাম মহকুমার একটি গ্রামে দুদিক ধার বিশিষ্ট একটি তামার কুঠার আবিষ্কৃত হয়। বয়স প্রায় তিন হাজার বছরের পুরানো। (The statesman, 12 july, 1977)
0 Comments