জ্বলদর্চি

মেদিনীপুর গ্যালোপিন লোকাল /সুব্রত মাইতি


মেদিনীপুর গ্যালোপিন লোকাল

সুব্রত মাইতি

   সকালের সাতটা দশ মিনিটের মেদিনীপুর হাওড়া গ্যালোপিন লোকাল ট্রেন ধরে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আসলে সকালের এই ট্রেনগুলোতে অফিস কিংবা কারখানার কাজের জন্য বহু মানুষ যাতায়াত করে থাকে। তার ব্যাতিক্রম ছিল না বুধবারের সকাল। ট্রেনে উঠে আমি লক্ষ্য করলাম, কয়েকজন ট্রেনে উঠেই কত নম্বর কামরায় আছে ফোন করে জানাচ্ছে। প্রতিদিন ওরা একসাথে কাজে যায় ও ফিরে আসে। কেউ কাউকে কোনোভাবে ছেড়ে যাতায়াত করে না। 
     স্বভাবতই প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কতটা প্রিয়জন চোখে না দেখলে অনুভব করা সম্ভব নয়। মোটামুটি সামনের দিকের একটি কামরা হবে। পরের স্টেশনে প্রায় দশ জনকে একসঙ্গে উঠতে দেখাগেল। তাদের মধ্যে কয়েকজন পঞ্চাশের বেশি বয়স হবে। সবাই উঠে একজন যুবকের হাত দিয়ে বাঙ্কারে সবার ব্যাগগুলো তুলে দিল। তারপর ওদের  এক-একজনকে জড়িয়ে চুমু খাচ্ছিল আর আগাধ আদর।সবার মধ্যে প্রাণোচ্ছল হাসি। প্রতিদিনের যাতায়াত করা মানুষগুলো একে অপরকে কিভাবে আপন করে নিয়েছে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। এটা এদের একটা পরিবার, পরিবারের মতো ভালো-মন্দ ভাগ করে নেওয়া। পরে স্টেশনে আরো কয়েকজন, একজন বেশ সিনিয়র মানুষ ছিলেন। 
🍂

       তিনি উঠে জিজ্ঞাসা করলেন কিরে আজ স্বপনকে দেখছি না? ও কোথায় গেল।পাশের বন্ধুটি বলল ওর ছেলের খুব শরীর খারাপ তাই আসেনি। উনি বললেন ছেলেটাকে নিয়ে খুব ভুগছে। মাঝে মাঝেই ওর ছেলের শরীর খারাপ হয়ে যায়। ঈশ্বর সবার মঙ্গল করুক। 
     ওদেরই চারজন পকেট থেকে তাসের প্যাকেটটা বের করে খেলা শুরু করে দিল। আরেকজন শুকনো তামাকের কৌটো পকেট থেকে  বের করে বেশ ধোলাই মালাই করে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল। তারপর জমিয়ে গল্প, মাঝে মাঝে কাঁচা পাকা কথার রসদ। কিভাবে খুশিতে ওরা এভাবে প্রতিদিন যাতায়াত করে, তার অনুভূতিটা ওরাই জানে। 
ভোর থেকে বেরিয়ে নিজের নিজের কাজে সারাদিন প্রত্যেকে। বাড়ির আপনজনদের থেকে  অনেক দূর। প্রতিদিনের আলোকিত সময় ঘরের বাইরে কাটে। স্বভাবতই নিজেদের যাতায়াতের পথে খুনসুটি গুলো বেঁচে থাকার রসদ অক্সিজেন। কাজের কথা কিংবা নিজেদের বাড়ির কথা ছাড়া এই সভ্যতার নোংরা রাজনীতি কিংবা কাদা মাখা নোংরা কথা নিয়ে কোন তর্জমা নেই। ওরা কেউ ধুলাগড়, কেউ সাঁতরাগাছি,কেউ কলকাতা যাবে। ওরা কাজ করে ওটাই ওদের বেঁচে থাকার রসদ।
   দিন যায় রাত যায় এভাবে, মানুষগুলোর এই হাসিঠাট্টার মাঝে ও কপাল জুড়ে বিষন্নতার ছাপ। পরিবারের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ এই নোংরা সভ্যতায় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।একজন সাধারণ শ্রমিক হিসেবে অনুভব করছে মালিক আর শ্রমিকের ব্যবধান।দিনের পর দিন কাজে ছাটাই এ যন্ত্রণা সারাক্ষণ বুকের ভেতর। কাজে বিন্দু মাত্র সময়ের ঘাটতি হলে বেতন কাটবে মালিক এ ভয় তাড়া করে বেড়ায়। জীবনের বিলাসিতা বলতে এই যাতায়াতের ফাঁকে ঠাট্টা আর বন্ধুত্ব।

Post a Comment

2 Comments

  1. AnonymousJune 13, 2023

    অসাধারণ

    ReplyDelete
  2. AnonymousJune 13, 2023

    খুব ভালো গ্যালোপিং ট্রেনে নিত্যকার যাতায়াত নিয়ে লেখাটি। সহজ সরল ভাষায় লেখাটি তৈরি করেছে সুন্দর এক চিত্রপট।

    ReplyDelete