আমার জীবনের ঘটনা-১৭ : পিসতুতো দাদার বিয়ে
মলয় রায়চৌধুরী
একদিন কোনও সাবিত্রীরানি বা জ্ঞানদাবালার বাড়ি যাবার জন্য পিসেমশায় তিনকড়ি হালদার সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলেন, তিনি দেখলেন তাঁর বড়ো ছেলে অজয় দ্রুত তাঁর পাশ দিয়ে নেমে রাস্তায় বেরিয়ে গেল। আহিরিটোলায় সোনাগাছিকে বলা হতো কামরেখা পাড়া। তিনকড়ি চাননি তাঁর ছেলেদের কেউ তাঁর মতন হোক। তাঁর ইচ্ছে আংশিক পুরো হয়েছিল। কেবল অজয় হয়েছিল বাপের মতন, দিশি মদ আর মহুয়ার মদ খে্য়ে অজয়ের দাঁতে কালো ছোপ ধরেছিল, কখনও তো দাঁত মাজতো না। তিনকড়ি হালদার দাঁত মাজা, গন্ধ সাবান মাখা, টাক পড়ে গিয়ে থাকলেও জবাকুসুম তেল মাখা শেষ দিন পর্যন্ত বজায় রেখেছিলেন।
.
সেই দিন অজয় হালদার সোজা বাড়ি ফিরে, টিনের সুটকেসে জামাকাপড় ঠেশে, বাবা বাড়ি ফেরার আগেই, যা কিছু সঞ্চয় ছিল কুড়িয়ে-বাড়িয়ে রওনা দিলো পাটনা, মামার বাড়ি।দাদা সমীরের আস্তানা চাইবাসা আর মামার বাড়ি পাটনাকে কেন্দ্রকরে ব্যবসা করতে লাগল। কলকাতা থেকে মাল কিনে মামার বাড়ি বা মামাতো ভাইয়ের বাড়িতে স্টক করত।কলকাতায় গিয়েও আহিরিটোলায় নিজের বাড়ি যেতো না, উত্তরপাড়ায় দিদিমার ভাঙা খণ্ডহরে আশ্রয় নিতো। কলকাতা থেকে কিনে পাটনায় পোর্টেবল আয়না আর ছবি আঁকার তুলি নিয়ে যেতো। আয়নায় যেখানে বাবল বা ঢেউ খেলে গেছে সেখানে ‘বেলজিয়ান গ্লাস’ বা ‘এক্সপোর্ট কোয়ালিটি’ স্টিকার লাগাতো, যেগুলো বাগড়ি মার্কেটে পাওয়া যেতো। তুলিগুলো যে লোমেরই হোক, বেশির ভাগ বেঁজি বা শুয়োরের, রাজাবাজার থেকে কিনে, তাতে ‘মেড অফ স্কুইরল হেয়ার, এমবস করিয়ে আনতো। মামাতো ভাইবোনদের বোঝাতো, ‘সব বাঞ্চোৎদের বিদিশি মাল চাই, বুঝলিনে !’
.
অজয় হালদার বেশিদিন বাংলা মদ, যাকে পিসেমশায় বলতেন ধান্যেশ্বরী, তাতে অনুগত থাকতে পারেনি। রামেশ্বরী, ভোদকাশ্বরী, ব্র্যাণ্ডিশ্বরী, হুইস্কিশ্বরী, তাড়িশ্বরী — আয় অনুযায়ী আনুগত্য পালটেছে। পাটনায় ধান্যেশ্বরী পেতো না। যে দিশি মদ পেতো তার নাম ঠররা, যা অত্যধিক খাবার ফলে নিচের পাটির কয়েকটা দাঁত তুলে ফেলে নকল দাঁত বসাতে হয়েছিল, যেটা ঘুমোবার সময়ে নেশায় বুঁদ থাকার দরুন, প্রায়ই খুলে রাখতে ভুলে যেতো। হাঁ করে ঘুমোবার অভ্যাসের দরুন হাঁ-মুখ থেকে দাঁতের ঘুমন্ত সেট ছিটকে বেরিয়ে যেতো, আর মাঝরাতে পেচ্ছাপ করতে উঠে মাড়িয়ে ভেঙে ফেলতো। নতুন পাটি না হওয়া পর্যন্ত মুখে হাত চাপা দিয়ে কথা কইতো।
.
অজয় হালদার পাটনায় মামার বাড়ি ফিরে চেষ্টা চালাতে লাগলো যাতে কোনো বাড়িতে ঘরজামাই হওয়া যায়। দাদা সমীর চাইবাসা থেকে বদলি হয়ে চলে গিয়েছিলেন লাহেরিয়াসরাই, তাঁর ডাকে অজয় হালদার সেখানে পৌঁছে, ঘরজামাই-প্রার্থী পরিবারের এক কর্তাকে ইনটারভিউ দিলেন। দ্বারভাঙ্গায় একজন বাঙালি ঘিয়ের হোলসেল ব্যাবসাদার তাঁর একমাত্র মেয়ের জন্য ঘরজামাই পাত্র খুঁজছিলেন। মেয়ের রঙ কালো । মেয়ের বাবা বিজয় ব্যানার্জি বড়ো ব্যবসাদার জানতে পেরে পাত্রী কেমনতর জানার দরকার হয়নি অজয়ের। অজয়ের মামাশশুর হবেন বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় শুনে যদিও যৎসামান্য ভয় হয়েছিল অজয় আর সমীরের, কেননা অজয়ের পরিবারের কারোর সঙ্গে যোগাযোগ করাতে চায়নি পিসতুতো-মামাতো ভাইজুটি। দেখতে-শুনতে ভালো আর ব্যবসাদারের মতন সড়গড় কথাবার্তা শুনে অজয়কে পছন্দ হয়ে গেল আর দ্রুত বিয়ের তারিখ নিশ্চিত করে ফেলা হলো।
বরকর্তা বা অজয়ের পরিবারের একজনের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য সমীরের পরিচিত টাকমাথা যুবক মিলন চক্রবর্তীকে রাজি করানো হলো, যদিও অজয় খাঁটি কলকাতিয়া আর মিলন ছিলেন কাঠবাঙাল। হুইস্কির পরিমাণ বেশি হয়ে যাওয়ার ফলে বিয়ের আসরে মিলন চক্রবর্তী অবিরাম নিজের ঢাকার বুলিতে কথা বলে গেলেন। আহিরিটোলার কলকাত্তাই ছেলের বাঙাল বরকর্তা দেখে বিভূতিভূষণ গোলমাল ধরে ফেলতে, সমীরকে পুরো ব্যাপারটা খোলোসা করতে হলো। ফুলশয্যার রাতে অজয়ের দাঁতের পাটি ঘুমন্ত অবস্হায় যথারীতি বেরিয়ে গিয়েছিল, আর অজয়ের নতুন বউ মাঝরাতে উঠে টয়লেটে যাবার সময়ে যথারীতি গুঁড়িয়ে ফেলেছিল। শশুরের ব্যবসায় গ্যাঁট হয়ে বসে কালক্রমে প্রায়-বিহারি আড়তদারে রূপান্তরিত হলো অজয় হালদার। নামের বিহারিকরণে অজয় উত্তর বিহারের ঘিয়ের বাজারে পরিচিত হলো হলধর বা হলধর শেঠ নামে। হলধর শেঠ আর আহিরিটোলামুখি হয়নি জীবনে । ওনার বাবা ছেলের হিল্লে হয়ে গেছে শুনে আনন্দিত হলেও মা কমলা বেশ চটে গেলেন ভাইপো সমীরের ওপর। বলেছিলেন, ‘এটা কেমন বিয়ে ? মা-বাপ জানতে পারলো না!’ যাই হোক, হলধর শেঠের দুই ছেলে হলো যারা কলকাত্তাই বা ঢাকাই কোনো বাংলা শিখল না, কথাও বলতে লাগলো মৈথিলিতে, স্হানীয় ভাষায়।
.
অজয় হালদার বড়ো ছেলেকে এনেছিল একবার । ছেলে, নাম ভুলে গেছি, আমাকে জিগ্যেস করল, ‘কেহন ছী কাকা?’
.
আমি বললুম, ‘হম নীক ছী, অহাঁ কোন ক্লাস মে পঢ়ি রহল ছি ?’
.
বলল, নৌ ঘরি পঢ়নে ছী। আব হম নেপাল মে ঘী কে বিতরক ছী ।
🍂
0 Comments