ফুটন্ত ব্যাঙ
মিলি ঘোষ
অনেকদিন আগে ফেসবুকে পেয়েছিলাম boiling frog syndrome নিয়ে একটি লেখা।
বিষয়টা হলো একটা ব্যাঙকে যদি জল ভর্তি পাত্রে রেখে তা ক্রমশ উত্তপ্ত করা হয়, তাহলে ব্যাঙটি কী করবে ? লাফ দিয়ে বাইরে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ব্যাঙ তা করে না। সে জলের তাপমাত্রার সঙ্গে নিজের শরীরের তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করে। ফলে তাকে প্রচুর শক্তিও ক্ষয় করতে হয়। এরপর এক সময় ব্যাঙ গরম জলের তাপমাত্রা আর সহ্য করতে পারে না। তখন সে বুঝতে পারে, এবার আমাকে বাইরে লাফাতে হবেই। কিন্তু তখনও সে পাত্র থেকে লাফিয়ে বাইরে আসে না। কারণ, জলের তাপমাত্রার সঙ্গে নিজের শরীরের তাপমাত্রাকে মানিয়ে নিতে নিতে এতক্ষনে তার সমস্ত শক্তি সে নিঃশেষ করে ফেলেছে। লাফ দিয়ে বাইরে পড়ার মতো ক্ষমতা তার আর নেই। ফলে ওই উত্তপ্ত জলেই ব্যাঙটিকে মৃত্যু বরণ করতে হয়।
এই লেখাটা ত্রিশ বা আরও বেশি বছর আগেও যতটা প্রাসঙ্গিক ছিল এখনও ততটাই আছে। আগামী দিনেও থাকবে। আমরা প্রত্যেকে ওই ব্যাঙটির মতো আচরণ করে চলেছি। যতক্ষণ পারি আমরা সহ্য করি। ঘরে বাইরে সর্বত্র। হয়তো চক্ষু লজ্জার ভয়। হয়তো সন্তানের মুখ চেয়ে। আর আছে আমাদের, লোকে কী ভাববে! এই চিন্তা আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। অনেক কিছুই আমরা ইচ্ছা থাকলেও সমাজের ভয়ে, পরিপার্শ্বের ভয়ে করতে পারি না। কে কী ভাববে এই নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিই। অথচ আমার ওইটুকু স্বাধীনতা কিন্তু কারোর কোনও ক্ষতি করত না। তবু আমরা পিছিয়ে আসি। এই করে আমরা কখনও সবার চোখে ভালো হতে পারি না। হওয়া সম্ভব নয়। বিনা কারণে আমরা অন্যের কাছে খারাপ হই। নিজেরাও জানি। তারপরেও ভাবি লোকে কী বলবে! কাজেই মানিয়ে নাও।
🍂শুধু নিজের সামান্য স্বাধীনতা নয়, আরও অনেক কিছুর সঙ্গেই আমরা দিব্য নিজেদেরকে মানিয়ে নিচ্ছি। প্রতিদিন।
জিনিস পত্রের যে দাম বেঁধে দেওয়া হচ্ছে, তাই আমরা দিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ করে বাজারে আগুন লাগে। কে লাগায় জানি না। কিন্তু আমরা সেই আগুন নেভানোর কোনও চেষ্টা না করে আগুনের তাপ সহ্য করি। আমরা আলোচনা করছি। এরপর কী হবে! তারপরেও আমরা সেই দামে কিনছি। কারণ, জিনিসটা আমাদের প্রয়োজন। আমার টাকার ব্যাগ পারমিট না করলেও কিনতে বাধ্য হচ্ছি।
কখনও বাজার থেকে আলু উধাও। কারোর কাছে নেই। যে দু'চারজন সব্জি বিক্রেতা সাহস করে নিয়ে বসেছে, সেও চড়া দাম। পেঁয়াজ, আদা, লঙ্কা এগুলোর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে পালা করে। বারবার এরাই কেন আত্মগোপন করে ? কারণ, এদের ছাড়া আমাদের চলে না। গ্রীষ্মের সব্জি পটোল না পেলে মানুষ ঝিঙ্গে খাবে। ঝিঙ্গে না পেলে আরও অন্য সব্জি নেবে। শীতেও তাই। ফুলকপি না পেলে বাঁধাকপি। কিছু না কিছু থাকবেই রান্না ঘরকে সচল রাখতে। কিন্তু আলু, পেঁয়াজ, আদা, কাঁচা লঙ্কা ছাড়া রান্না ঘর অচল। বিশেষ করে আদা। সে নিরামিষ রান্নাতেও লাগে, আমিষেও লাগে। তাই এদের নিয়েই টানাটানি। কিডন্যাপিং। দল বদলের সময় ময়দানের খেলোয়াড়দের যেমন অবস্থা হয়, এই খাদ্যবস্তুগুলোরও একই অবস্থা। মাছ, মাংস, ডিম সবেতেই একই নিয়ম চলে আসছে।
আমরা সবই জানি। সবই বুঝি। কিন্তু, প্রতিবাদ করি না। করলেও তা ফেসবুকে, নয়তো পাড়ার চায়ের দোকানে। অথবা চার দেওয়ালের মধ্যে আমাদের হম্বিতম্বি। এর বেশি না। আমরা হলাম so called adjustable. জিনিসের দাম আয়ত্তের বাইরে গেলে হয়তো একটু কম কিনি। দু'কেজির জায়গায় এক কেজি। এক কেজির জায়গায় পাঁচশো গ্রাম। কিন্তু, কেনা বন্ধ হয় না। আবার কম কিনলে ফুরিয়েও যায় তাড়াতাড়ি। তখন ব্যাগ হাতে আবার বাজার ছোটা। নয়তো অনলাইনে অর্ডার। এরকম ক'দিন চলার পর ধীরে ধীরে আমরা ওই দামেই অভ্যস্ত হয়ে উঠি। তখন দ্বিগুণ দামেই আগের মতো কেনাকাটা শুরু করি। আলোচনাও ক্রমে ক্রমে থেমে যায়।
মানুষকে বা তার চিন্তাকে ভিন্ন পথে চালিত করতে কখনও আধার কার্ডের সঙ্গে ভোটার কার্ড যুক্ত করা হয়। কখনও প্যান কার্ড। কখনও তা আপডেট করা। এ চলতেই থাকে। মানুষের তো আর কাজ নেই। সব ফেলে লাইন দিলেই হলো। একটা শেষ করে শান্তি পাবেন ভেবেছেন ? একদিন ঘাম ঝরিয়ে একটা কাজ মিটিয়ে আসুন। দু'দিন যেতে না যেতে আবার আর একটা এসে হাজির হবে। আমরা আবার লাইনে দাঁড়াব। চূড়ান্ত বিরক্ত হব। লাইনে দাঁড়িয়েই নানারকম শব্দ প্রয়োগ করব। যাঁদের বিরুদ্ধে এই শব্দের বাণ নিঃক্ষেপ করা হয়, আবার তাঁদেরই গিয়ে ভোট দিয়ে আসব। কিন্তু এই কাজগুলো আমরা ঠিক করে যাব। তারপর আবার রোজকার জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়ব। নয়তো গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাব। অথবা টিভি সিরিয়াল দেখে মহিলা ভিলেনের মুন্ডুপাত করব। তবু ঘটে চলা অন্যায়ের প্রতিবাদে রাস্তায় নামব না। অর্থাৎ পাত্রের জলের তাপমাত্রার সঙ্গে শরীরের তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষা করতে আমরা সক্ষম হব। এবং নিঃশব্দে প্রচুর শক্তি ক্ষয় করব।
শুধু তো খাদ্যবস্তু নয়। জ্বালানির ওপরও একইরকম দামের বোঝা চাপানো হয়। কেরোসিন, গ্যাস সবেতে। গ্যাসকে এখন আর বড়োলোকের জ্বালানি বলা যায় না। প্রয়োজনীয়তার নিরিখে এটি নিম্নবিত্তের রান্না ঘরের অনায়াস দখল নিয়েছে। যেহেতু খাদ্যই মানুষের প্রথম চাহিদা। তাই সবার আগে কোপটা পড়ে এখানেই। আর আমরা আপামর জনগন বিনা প্রতিবাদে অন্যায়ের সঙ্গে নিজেদের জীবন যাপনের ভারসাম্য রক্ষা করে চলি।
রাস্তায় একজন মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লে আমরা পাশ কাটিয়ে চলি। আমাদের তখন ভীষণ তাড়া। অকারণে কেউ মার খাচ্ছে দেখলে একটু দূর থেকে কৌতূহল মিটিয়ে হাঁটা লাগাই। পাশের বাড়ির মহিলা মদ্যপ স্বামীর হাতে অত্যাচারিত হলে আমরা ঘরে বসে নিন্দা করি। তবু তাঁকে বাঁচাতে যাই না। আমরা সবই বুঝি। তারপরেও মেনে নিই। শুধু এই নীরব দর্শকের দল না, যারা রাস্তায় অসুস্থ হচ্ছেন, অত্যাচারিত হচ্ছেন সর্ব ক্ষেত্রে, তাঁরাও মেনে নিচ্ছেন। মানিয়ে নিচ্ছেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অবিচার, অব্যবস্থা দেখেও আমরা ভোট দিতে যাই। রোদে পুড়ে, লাইনে দাঁড়িয়ে যেন বিশ্ব জয় করে আসি। হাসি হাসি মুখে আঙুলে কালির দাগ দেখিয়ে সেলফি তুলি। তারপরে ফেসবুকে পোস্টাই। তবু ভোট বয়কট করি না। ভোট চাইতে আসা প্রার্থী হাত জোর করলে, আমরাও হাত জোর করি। মুখের ওপর দরজা দিতে পারি না। কারণ, আমাদের সর্বাঙ্গে ভদ্রতার ছাপ। আর তা নিয়েই আমরা সব রকম অন্যায়ের সঙ্গে মানিয়ে চলি। কত সহজে আমরা ভুলে গেছি কোভিডের দিনগুলোর কথা। এক দিকে মিটিং মিছিল। কাতারে কাতারে লোক। গায় গায় ঘেঁষাঘেঁষি। কার মিটিংএ কত লোকের সমাগম তার প্রতিযোগিতা। অন্যদিকে একটা একটা করে প্রাণ চলে যাচ্ছে। বাড়িগুলো খালি হয়ে যাচ্ছে। যারা আপন জনকে হারাচ্ছে, তাদের হাহাকার চাপা পড়ে যাচ্ছে রাজনীতির আঙিনায়। ওই পরিস্থিতিতেও ভোট হলো। এবং আমরা ভোট দিলাম। বয়কট করলাম না।
পাত্রের সেই ব্যাঙটার যেন কী হয়েছিল ? মানিয়ে নিতে নিতে সব শক্তি নিঃশেষ করে ফেলেছিল। যখন ব্যাঙটি বুঝল, এবার আমাকে বাইরে লাফ দিতেই হবে, তখন সেই শক্তিটুকুও তার আর অবশিষ্ট ছিল না। আমাদেরও সেদিন আসছে। যেদিন বুঝব, প্রতিবাদ প্রয়োজন। সেদিন গলা দিয়ে আওয়াজ বের করার ক্ষমতাটুকুও থাকবে না।
0 Comments