জ্বলদর্চি

সমরেশ মজুমদার // ঈশিতা ভাদুড়ী

স্মৃতি ডট কম ১৮
সমরেশ মজুমদার // ঈশিতা ভাদুড়ী


“মাধবীলতা তাকে দেখছে। এতক্ষণে সে একবারও চোখ ফেরায়নি। অস্বস্তি হচ্ছিল অনিমেষের, বলল, ‘কেমন আছেন?’
‘চমৎকার’। কথা বলল মাধবীলতা। শব্দের উচ্চারণে অনিমেষের মনে হল কথাটার মানে খুব খারাপ আছি, খুব।
‘এখানে কখন এসেছেন?’
‘এসেছি।’
কথাটা যেন পেরেক ঠোকার মত, নিশ্চিত কিন্তু অবহেলায়। অনিমেষ মাধবীলতার মুখের দিকে তাকাতে পারছিল না। এই দুদিন মেয়েটির কথা সক্রিয়ভাবে চিন্তা করেনি কিন্তু তার প্রতিটি মুহূর্তে মাধবীলতা জড়িয়েছিল সে টের পায়নি। বুকের মধ্যে রিমরিম শব্দ, চোখ খুললেই নিজেকে সম্রাট মনে হয়।”
--সমরেশ মজুমদারের হাত ধরেই আমাদের প্রজন্ম স্বপ্ন দেখেছিল। ষাটের দশকের উত্তাল বাম রাজনীতির প্রভাব সমরেশ মজুমদারের লেখায় পাওয়া যায়। সংস্কার, রাজনীতি, সমাজ নিয়ে তাঁর লেখা আমাদেরকে ভাবতে শিখিয়েছিল।
গত কয়েক দশকে খুব কম লেখক-কবি আছেন, যাঁদের সঙ্গে আমার দেখা বা কথা হয়নি কখনও। সমরেশ মজুমদার এমন একজন লেখক, তাঁকে আমি দু-একবার দেখে থাকলেও তাঁর সঙ্গে আমার কখনও আলাপ হয়নি, কথা হয়নি। তবে যদি লিখি সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না, তাহলে ভুল বলা হবে, কেননা তিনি তো রয়েছেন পাঠকের মনে, তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে তো ধরা আছে আমার কৈশোর, আমার যৌবন। লেখা তো আসলে একটা মাধ্যম, যে মাধ্যমের সাহায্যে পাঠকের হৃদয়ের অন্তস্তলে পৌঁছে যান লেখক। সেক্ষেত্রে সমরেশ মজুমদার সার্থক ছিলেন, একথা মানতেই হয়। চন্দননগরে বসে বসে উত্তরবঙ্গকে চিনেছি তো আমি তাঁর লেখা পড়েই।
সেই আটের দশকে তাঁর দৃষ্টি দিয়েই তো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সমাজকে দেখেছি, প্রেমকে জেনেছি। সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকার পৃষ্ঠায় আবেগে ভেসেছি। সেই যে অনিমেষ মাধবীলতার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, তোমাকে না-ভালবাসলে মরে যেতাম, কিন্তু মুখে কিছু বলল না সে…! 
তাঁর ত্রয়ী উপন্যাস ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ থেকে তো আজও বাঙালি পাঠক বার হতে পারেনি। তাঁর এই ত্রয়ী উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার নিখুঁত চিত্র এঁকেছিলেন। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র অনিমেষ, মাধবীলতায় বাঙালি পাঠক আবেগে আক্রান্ত আজও। তিনি নকশাল পিরিয়ডের এক জীবন্ত চরিত্র সৃষ্টি করে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে বুঁদ করে রাখতে পেরেছেন সেই সময়ের আন্দোলন সম্পর্কে একটা ধারণার মধ্যে দিয়ে, এ বড় কম কথা নয়। তারপর সেই সাতকাহন, গর্ভধারিণীর মতন উপন্যাস? অর্ক, অর্জুনের মতন চরিত্রেরা?
তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’? যে উপন্যাসে টান টান এবং ধারালো গদ্যের মধ্যে মনুষ্য চরিত্রের ভালোবাসা ও নির্মমতার অন্তর্বর্তী টানাপোড়েন টের পেয়েছিলাম আমরা। কলকাতা শহর হয়ে ওঠার পেছনে যে শঠতা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, চতুরতা–ইত্যাদি কাজ করেছে তার গল্প পেয়েছিলাম আমরা,  যেখানে উঠে এসেছিল মফস্বলের ছেলের দৃষ্টিতে শহর কলকাতার এক অদ্ভুত ব্যাপ্তি। এক সাধারণ ঘরের ছেলে রাকেশ চাকরি করে কলকাতায়। হঠাৎ একদিন চলে যায় তার চাকরি। নতুন চাকরির আশায় চলে আসে পুরনো পরিচিত সুহাসদার কাছে, তিনি ওকে নিয়ে যান কলকাতার এক অচেনা জায়গায়, ঘোড়দৌড়ের মাঠে। সেইখান থেকেই সৃষ্ট এক অভিনব উপন্যাস পড়েছে বাঙালি পাঠক। তাঁর ‘অগ্নিরথ’ বলেও একটি ভালো উপন্যাস ছিল, যেখানে ব্লাড-ক্যান্সারে আক্রান্ত সায়ন আর পরহিতৈষী বিদেশিনী এলিজাবেথের কথা ছিল। তারপর তাঁর ‘গর্ভধারিণী’ উপন্যাসে কয়েকজন ছেলেমেয়ের বাড়ি থেকে পালিয়ে ‘বিপ্লব’ সাধনের চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে 'অ্যাডোলেসেন্স' বয়সের অনুভূতিগুলোও তিনি কেমন অদ্ভূতভাবে দেখিয়েছিলেন। এরকম একাধিক উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে সমরেশ মজুমদার আমাদের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন।
সাহিত্যে তাঁর অনন্য অবদানের জন্য তিনি বিভিন্ন সময়ে আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কার ইত্যাদি নানা পুরস্কার পেয়ে থাকলেও তাঁর লেখা যাবতীয় পুরস্কারের ঊর্ধ্বে। তাঁর লেখার প্রতি মুগ্ধতা যে অতিক্রম করতে পারেনি আজও বাঙালি পাঠক।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇



Post a Comment

0 Comments