জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা -৭৭/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৭৭

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 তরুণ নরেন্দ্রনাথের প্রতিভা বিষয়ে নানা জনে নানা মন্তব্য করেছেন। জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশনের ( অধুনা স্কটিশ চার্চ কলেজ ) অধ্যক্ষ উইলিয়ম হেস্টি সাহেব বলেন --“Narendranath is really a genius. I have travelled far and wide but I have never yet come across a lad of talents and possibilities, even in German Universities, amongst philosophical students.” বস্তুতপক্ষে এই হেস্টি সাহেবের মুখেই নরেন্দ্রনাথ প্রথম শুনেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কথা। ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাসে সেদিন তিনি ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘দ্য এক্সকার্শন’ কবিতাটি পড়াচ্ছিলেন। কবির অতীন্দ্রিয়বাদ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন ‘পবিত্রতা ও ধ্যানপরায়ণতার মাধ্যমে এই অতীন্দ্রিয় স্তরে উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব, অধুনা যা দুর্লভ।’ এরপর তিনি বলেন, এই সময়ে এইরকম একজনের কথা জানেন যিনি এই স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছেন। “I have known only one person,  who has realized that blessed state, and he is Ramakrishna of Dakshineswar, you will understand it better if you visit this saint.” (God lived with them, by Swami Chetanananda, Advaita Ashram, Kolkata)
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
নরেন্দ্রনাথের আত্মীয় রামচন্দ্র দত্ত ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পরম ভক্ত। তিনি নরেন্দ্রনাথের ঈশ্বর অনুসন্ধানের ব্যাকুলতা বিষয়ে সম্যকভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন, তাই নরেন্দ্রনাথকে বলেন, “যদি আন্তরিকভাবে অধ্যাত্মজগতের সন্ধান চাও, তাহলে দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ কর।” নরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ করেন ১৮৮১ সালে, কলকাতায়, শ্রীরামকৃষ্ণের বিশেষ গৃহীভক্ত সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে। সুরেন্দ্রনাথ ধর্মকথার আয়োজন করেছিলেন, আমন্ত্রণ করেছিলেন বিভিন্ন ভক্তজনকে। আমন্ত্রিত ছিলেন তরুণ নরেন্দ্রনাথও। গায়ক হিসাবে। শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে ভক্তিগীতি শুনিয়ে প্রীত করতে। নরেন্দ্রনাথকে দেখে ও তাঁর গান শুনে বিশেষভাবে চমৎকৃত হন শ্রীরামকৃষ্ণ। সামান্য কিছু কথাবার্তা হয় তাঁর সঙ্গে ও দক্ষিণেশ্বর যাওয়ার আহ্বান জানান তাঁকে। দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে প্রথম মিলনের অসামান্য বিবরণ সারদানন্দ-কৃত ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ’ গ্রন্থটিতে পাওয়া যায়। সারদানন্দজী জানিয়েছেন, এই প্রসঙ্গে ঠাকুর যেভাবে বলেছিলেন সেই কথাই তিনি লিখেছেন মার্জিত ভাষায়। সেটি এইরকম --“পশ্চিমের ( গঙ্গার দিকের ) দরজা দিয়া নরেন্দ্র প্রথম দিন এই ঘরে ( দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের ঘরে ) ঢুকিয়াছিল। দেখিলাম নিজের শরীরের দিকে লক্ষ্য নাই, মাথার চুল ও শরীরের বেশভূষার কোন পারিপাট্য নাই। বাহিরের কোন পদার্থেই ইতরসাধারণের মতো একটা আঁট নাই; সবই যেন তার আলগা এবং চক্ষু দেখিয়া মনে হইল, তাহার মনের অনেকটা ভিতরের দিকে কে যেন সর্বদা টানিয়া রাখিয়াছে। দেখিয়া মনে হই‌ল, বিষয়ী লোকের আবাস কলকাতায় এত বড় সত্ত্বগুণী আধার থাকাও সম্ভব?
 মেঝেতে মাদুর পাতা ছিল, বসিতে বলিলাম। যেখানে গঙ্গার জালা ছিল তাহার নিকটেই বসিল। তাহার সঙ্গে সেইদিন দুই-চারিজন আলাপী ছোকরাও ছিল। বুঝিলাম, তাহাদের স্বভাব সম্পূর্ণ বিপরীত -- সাধারণ বিষয়ী লোকের যেমন হয়; ভোগের দিকেই দৃষ্টি।
 গান গাহিবার কথা জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, বাঙ্গালা গান তখন সে দুই-চারিটি মাত্র শিখিয়াছে, তাহাই গাহিতে বলিলাম। তাহাতে সে ব্রাহ্ম সমাজের ‘মন চল নিজ নিকেতনে’ গানটি ধরিল এবং ষোল আনা মন প্রাণ ঢালিয়া ধ্যানস্থ হইয়া যেন উহা গাহিতে লাগিল -- শুনিয়া আর সামলাইতে পারিলাম না -- ভাবাবিষ্ট হইয়া পড়িলাম। পরে সে চলিয়া যাইলে তাহাকে দেখিবার জন্য প্রাণের ভিতরটা চব্বিশ ঘণ্টা এমন ব্যাকুল হইয়া রহিল যে, বলিবার নহে। যেন কে গামছা নিঙড়াইবার মতো জোর করিয়া নিঙড়াইতেছে। তখন আপনাকে আর সামলাইতে পারিতাম না, ছুটিয়া বাগানের উত্তরাংশে যেখানে কেউ বড় একটা দেখা যায় না, যাইয়া ‘ওরে তুই আয় রে, তোকে না দেখে আর থাকতে পারচি না’ বলিয়া ডাক ছাড়িয়া কাঁদিতাম। খানিকটা এইরূপ কাঁদিয়া তবে আপনাকে সামলাইতে পারিতাম। ক্রমান্বয়ে ছয়মাস ঐরূপ হইয়াছিল। আর সব ছেলেরা যাহারা এখানে আসিয়াছে কাহারও কাহারও জন্য কখন কখন মন কেমন করিয়াছে, কিন্তু নরেন্দ্রর জন্য যেমন হইয়াছিল তাহার তুলনায় সে কিছুই নয় বলিলে চলে।” ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ অনুযায়ী এইদিন নরেন্দ্র দু'টি গান গেয়েছিলেন, ‘মন চল নিজ নিকেতনে।/ সংসার বিদেশে বিদেশীর বেশে/ ভ্রম কেন অকারণে?...’ এবং অপরটি ‘যাবে কি হে দিন আমার বিফলে চলিয়ে?/ আছি নাথ দিবানিশি আশাপথ নিরখিয়ে।...’
 আর এই দিনের ঘটনার কথা নরেন্দ্রনাথও জানিয়েছিলেন সারদানন্দজীকে। সেই কথা পাওয়া যায় ‘লীলাপ্রসঙ্গে’ এইরূপ -- “গান তো গাহিলাম, তাহার পরেই ঠাকুর সহসা উঠিয়া আমার হাত ধরিয়া তাঁহার ঘরের উত্তরে যে বারান্দা আছে, তথায় লইয়া গেলেন। শীতকাল; উত্তরে হাওয়া নিবারণের জন্য উক্ত বারান্দায় থামের অন্তরালগুলি ঝাঁপ দিয়া ঘেরা ছিল, সুতরাং উহার ভিতরে ঢুকিয়া ঘরের দরজাটি বন্ধ করায় ভাবিলাম, আমাকে বুঝি নির্জনে কিছু উপদেশ দিবেন। কিন্তু যাহা বলিলেন ও করিলেন, তাহা একেবারেই কল্পনাতীত। সহসা আমার হাত ধরিয়া দরদরিতধারে আনন্দাশ্রু বিসর্জন করিতে লাগিলেন এবং পূর্বপরিচিতের ন্যায় আমাকে পরম স্নেহে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘এতদিন পরে আসিতে হয়? আমি তোমার জন্য কিরূপ প্রতীক্ষা করিয়া রহিয়াছি তাহা একবার ভাবিতে নাই? বিষয়ী লোকের বাজে প্রসঙ্গ শুনিতে শুনিতে আমার কান ঝলসিয়ে যাইবার উপক্রম হইয়াছে; প্রাণের কথা কাহাকেও বলিতে না পাইয়া আমার পেট ফুলিয়া রহিয়াছে’ -- ইত্যাদি কত কথা বলেন ও রোদন করেন। পরক্ষণেই আবার আমার সম্মুখে করজোড়ে দণ্ডায়মান হইয়া দেবতার মতো আমার প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক বলিতে লাগিলেন, ‘জানি আমি প্রভু, তুমি সেই পুরাতন ঋষি, নররূপী নারায়ণ, জীবের দুর্গতি নিবারণ করিতে পুনরায় শরীরধারণ করিয়াছ’ -- ইত্যাদি।
 আমি তো তাঁহার ঐরূপ আচরণে একেবারে নির্বাক -- স্তম্ভিত! মনে মনে ভাবিলাম, এ কাহাকে দেখিতে আসিয়াছি? এতো একেবারে উন্মাদ। না হইলে বিশ্বনাথ দত্তের পুত্র আমি -- আমাকে এইসব কথা বলে? যাহা হউক, চুপ করিয়া রহিলাম, অদ্ভুত পাগল যাহা ইচ্ছা বলিয়া যাইতে লাগিলেন। পরক্ষণেই আমাকে তথায় থাকিতে বলিয়া তিনি গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন, এবং মাখন, মিছরি ও কতকগুলি সন্দেশ আনিয়া আমাকে স্বহস্তে খাওয়াইয়া দিতে লাগিলেন। আমি যত বলিতে লাগিলাম, ‘আমাকে খাবারগুলি দিন, আমি সঙ্গীদের সঙ্গে ভাগ করিয়া খাইগে’ তিনি তাহা কিছুতেই শুনিলেন না। বলিলেন, ‘উহারা খাইবে এখন, তুমি খাও’ বলিয়া সকলগুলি আমাকে খাওয়াইয়া নিরস্ত হইলেন। পরে হাত ধরিয়া বলিলেন, ‘বল, তুমি শীঘ্র একদিন এখানে আমার নিকট একাকী আসিবে?’ তাঁহার ঐরূপ একান্ত অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া অগত্যা ‘আসিব’ বলিলাম এবং তাঁহার সহিত গৃহমধ্যে প্রবেশপূর্বক সঙ্গীদের নিকট উপবিষ্ট হইলাম।”

Post a Comment

0 Comments