দেশান্তরী -২৬
হিল্লোল রায়
মিনিয়াপোলিশ বিমানবন্দর অবতরণ !!
মিনিয়াপোলিশ বিমানবন্দরে নামবার পর পরবর্ত্তী ফ্লাইটের সময়টা টেলিভিশনে দেখে নিলাম। ফার্গো থেকে মিনিয়াপোলিশ আসার সময় আমার প্লেন ছিল ডিসি ১০, ফ্লাইট নং ৩৩৬।
মিনিয়াপোলিশ থেকে আবার রওনা হব দুপুর ২টায়। অর্থাৎ ১১-৩৫ থেকে ২টা পর্য্যন্ত । কোনই কাজ নেই। লাউঞ্জে ঢুকে সময় কাটাবার জন্য এদিক-ওদিকে ঘুরলাম, কিনবার জন্য উল্লেখযোগ্য কিছুই পেলাম না। তৃষ্ণা নিবারণের জন্য Vending Machine এ একটা কোয়ার্টার অর্থাৎ ২৫ সেন্ট জমা দিলাম- কোকা -কোলা পানের উদ্দেশ্যে। হা হতোস্মি। পয়সাটা গচ্চা গেল। বেশ কয়েকজন আমেরিকান-কে জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার? ওরাও চেষ্টা করল -” এ্যাম সরি, ক্যান্ট হেল্প য়্যু”- বলেই চলে গেল। পিপাসা নিবারণার্থে পয়সা গচ্চা যাওয়ায় মেজাজ গেল খারাপ হয়ে। ঘড়িতে এখন একটা। এখনও এক ঘন্টা বাকী। সময় কাটাতে হবে। পায়চারী করছি। ক্ষিদেও পেয়েছে বেশ। বাড়ী থেকে বেরুবার সময় সংগে বেশ কিছু বিস্কুট নিয়ে বেরিয়েছিলাম। ওগুলোর সদ্গতি করলাম উপায়ান্তর না দেখে। তবুও ক্ষিদে পাচ্ছে। অন্য একটা Vending Machine এ গিয়ে কিছু সল্টেড নাট (Salted Nuts) কিনলাম ২০ সেন্টের বিনিময়ে। ঘড়িতে বেলা ১-৪০।
মিনিয়াপোলিশ ত্যাগ-মিলাউকির পথে !!
সময় এগিয়ে আসছে। টিকিটে পরবর্ত্তী ফ্লাইট এর জন্য endorse করে নিলাম। মিনিয়াপোলিশ ত্যাগ করব ঠিক ২টায়। এবারের ফ্লাইট নং ৫৪২। নর্থওয়েস্ট ওরিয়েন্ট এয়ারলাইন্সের প্লেন 727 Boeing. লাউঞ্জ থেকে প্লেনে ঢুকবার জন্য প্রস্তুত বেলা ১-৫৫-এ প্লেনে ঢুকে পড়লাম। আমার এবারের সিট নং ৯ A। জানালার পাশেই।
ঘড়ির কাঁটায় ২টো। রানওয়ের উপর প্লেন চলতে শুরু করেছে। গর্জন শুরু হয়ে গিয়েছে। রানওয়ের উপর স্নো জমে রয়েছে। সীট বেল্ট বেঁধে নিয়েছি। ঘোষণা এল মিলাউকি পৌঁছাতে ৫৭ মিনিট লাগবে। এখনও রানওয়ের উপর তর্জন -গর্জন চলছে।। সূর্য্যের প্রখর আলো ঠিকরে পড়ছে চারিদিকে। দুদিকের দৃশ্য দেখছি। যতদূর চোখ যায়, ততদূরই স্নো জমে রয়েছে। প্লেন পাখা নাচাচ্ছে উড়বার জন্য। দশ মিনিট দৌড়াবার পর প্লেনখানা উঠল উপরে। ক্রমশ:ই উঁচুতে উঠছি।
কান কটকট শুরু হয়েছে। জানলা দিয়ে নীচের দৃশ্য দেখছি। ঘরবাড়ি, গাছপালা সমস্তই তুষারাবৃত হয়ে রয়েছে। মিলাউকির পথে উড়ে চলেছি। বাইরের তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট। বাইরের মেঘগুলো দেখে মনে হচ্ছে ঠিক যেন পেঁজা তূলা। আমার পাশের সীটের মহিলা যাত্রী মিলাউকি নামবেন। মেক আপ নিয়ে দিচ্ছেন, চুল আঁচড়াচ্ছেন। একটু ঘুমিয়ে নিই। এখন বেলা ২-৩৫। এয়ার হোস্টেস এসে কোক ও বাদাম দিয়ে গেল। খেয়ে নিলাম সবটুকুই।
মিলাউকি ত্যাগ-ডেট্রয়েট অভিমুখে !!
মিলাউকির কাছাকাছি এসে পড়েছি বলে মনে হচ্ছে। প্লেন ক্রমশঃ নীচুতে নামছে। ঘরবাড়ীগুলো পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি। কোথাও বিন্দুমাত্র স্নো নেই। একটু দূরে আকাশে একটা সরল আলোরেখা দেখতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে যেন আমার প্লেনের সংগে সমান্তরালভাবে কেউ রেখা টেনে দিয়েছে। এটা আর কিছুই নয়। জেট প্লেনের যাত্রা পথের সৃষ্টি। নীচে পরিস্কার ঘরবাড়ি দেখতে পাচ্ছি। কান কটকট করছে। প্লেন ক্রমশ:ই নীচুতে নামছে। প্লেন ভীষণ দুলছে। পাখার ঝটপটানি শুরু হয়েছে নামবার জন্য। কান কটকটানির জন্য কোন কথাই শুনতে পারছি না এখন। মিলাউকি শহরের ঘরবাড়িগুলো বেশ সাজানো মনে হচ্ছে। স্কাই-স্ক্রেপার বিল্ডিং অবশ্য দেখতে পাচ্ছি না। বেলা ২-৫৩-এ মিলাউকি রানওয়ে স্পর্শ করে প্লেন ছুটে চলেছে শান্ত হবার জন্য। আমার প্লেন এখন অনেকটা হাল্কা হয়ে গিয়েছে। বহুসংখ্যক যাত্রী মিলাউকি নেমে যাচ্ছেন । দুপুর ২-৫৭ তে মিলাউকি এসে পৌঁছালাম। ক্ষণিক বিশ্রাম নেবে আমার প্লেনটাই। আমার ডায়েরি লেখায়-ও ক্ষণিক বিরতি! মিলাউকি থেকে অবশ্য প্লেন বদলাতে হবে না। এই প্লেনেই সোজা ফিলাডেলফিয়া গিয়ে পৌঁছাবে সন্ধ্যা ৭-১০ নাগাদ। মিলাউকি বিমানবন্দর-এ নেমে চারিদিক ঘুরে দেখলাম। কোথাও স্নো নেই।।
🍂ডেট্রয়েটের পথে !!
আমার প্লেন বিকাল ৩-৩০ মিলাউকি ত্যাগ করবে। এখান থেকে অনেক যাত্রী উঠেছে। কোথাও সিট ফাঁকা নেই। চোখ খুলছি আর বন্ধ করছি মাঝে মাঝে। মিলাউকি বিমানবন্দর বেশ ছোট। চারিদিকের উল্লেখযোগ্য অবশ্য কিছুই চোখে পড়ল না। ঘড়িতে বিকাল ৩-৩০ প্লেন এখন রানওয়েকে স্নেহ চুম্বন জানাচ্ছে। গর্জন শুরু করেছে। ঘোষণা অনুযায়ী ৫২ মিনিট পর ডেট্রয়েট পৌঁছাবার কথা। প্লেন দুলছে, পাখা নাচাচ্ছে আকাশে উড়বার জন্য। শেষবারের মত স্নেহচুম্বন জানাল মিলাউকি বিমানবন্দরকে ঠিক বেলা ৩-৩৫ নাগাদ। জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছি। কোথাও স্নো নেই। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নীলাকাশ।
প্লেন এখন অনেক উঁচুতে সাদা ঘন মেঘের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বাইরের কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। সবই মেঘে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। এখন অর্থাৎ মিনিট দশেকের মধ্যেই অনেকটা পথ অতিক্রম করে এসেছি। আমরা এখন ২৩০০০ feet উপর দিয়ে উড়ে চলেছি। এয়ার হোস্টেস এসে কোক ও 'Pea Nut' দিয়ে গেল। সময় কাটাবার জন্য কোক এর গ্লাসটাকে সামনে রেখে দিয়েছি। পী নাট অবশ্য নিমেষের মধ্যেই শেষ করে ফেললাম। নীচের দৃশ্য বিশেষ করে ঘরবাড়িগুলো খুব কাছাকাছি মনে হচ্ছে। মোটরগাড়ীগুলো মনে হচ্ছে যেন খুবই ব্যস্ত। আমার পাশের মার্কিণী মহিলা যাত্রী খুব মনযোগ সহকারে “BICENTENNIAL REVOLUTION OF USA” পড়ছেন।
ডেট্রয়েট বিমানবন্দরে অবতরণ !!
আমার ঘড়িতে এখন বিকাল ৪টে। প্লেন ক্রমশ:ই নীচুতে নামছে, পাখা দোলাচ্ছে। ঘোষণা এল ডেট্রয়েটের কাছাকাছি এসে পড়েছি। নীচের দৃশ্য ক্রমশ:ই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। ঘরবাড়ির আকৃ্তিও বেশ বৃ্দ্ধি পেয়েছে মনে হচ্ছে। ডেট্রয়েটে কোথাও স্নো দেখতে পাচ্ছি না। দিনের আলো ক্রমশ:ই কমে আসছে। আমার প্লেনও যেন ওর পাখায় দিনান্তের শেষ সূর্য্যালোক মাখিয়ে নিচ্ছে। একটু দূরে রামধনু দেখতে পাচ্ছি। ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। হাবড়া হাইস্কুলে যখন আমি দশম শ্রেনীর ছাত্র, তখন পদার্থবিদ্যায় রামধনু সৃষ্টির কারণ পড়েছিলাম। রামধনু দেখে মনটাও কেমন যেন রঙীন হয়ে ওঠে। মেঘগুলো এখন ধোঁয়াসার মতই মনে হচ্ছে। প্লেনের গতি ক্রমশ:ই কমছে, নীচের দিকে নামছে ডানা ও ওঠানামা করছে। ঘড়িতে এখন ৪-১০ । আমার প্লেন ডেট্রয়েট বিমানবন্দরের রানওয়ে স্পর্শ করল। ছুটছে বেশ। যাত্রীরা ও নামবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শান্ত হল ৪-১৫ মিনিটে। আমার ঘড়ির কাঁটা এখন অবশ্য একঘণ্টা পেছিয়ে পড়েছে। কারণ আগেই বলেছি ফার্গো ও ফিলাডেলফিয়ার মধ্যে সময় পার্থক্য ১ ঘণ্টা। ফার্গো হচ্ছে আমেরিকার CENTRAL PART আর ফিলাডেলফিয়া একেবারে পূবে। যাত্রীরা নামছেন সবাই। আমি সবাইকে দেখছি স্বপ্নালু ভাবাবেশে। ডেট্রয়েট বিমানবন্দর মিলাউকি থেকে বেশ বড়।
ক্রমশঃ
0 Comments