জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৭৮/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৭৮

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন ঈশ্বরের অবতার। তিনি এই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন শাশ্বত ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করতে। নরেন্দ্রকে তিনি এমনভাবে তৈরি করেছিলেন যাতে তাঁর বার্তা সে জগতের মানুষের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছে দিতে পারে। আধুনিক জগতের কাছে সর্বধর্মসমন্বয়ের বার্তা তিনি পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। যার যোগ্য ঋত্বিক হিসেবে নির্মাণ করেছিলেন নরেন্দ্রনাথকে -- বিবেকানন্দরূপে! হুগলি জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের ( কামারপুকুর ) ‘মুখ্যু বামুন’ কলকাতা শহরে এসে নানা ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে এক অদ্ভুত আধ্যাত্মিক শক্তির উন্মেষ ঘটিয়ে ঈশ্বরপুরুষে পরিগণিত হলেন! তিনি কলকাতার তথাকথিত আলোকিত ও শিক্ষিত সমাজের ভিতর থেকে তাঁর শ্রেষ্ঠ বার্তাবাহককে নির্বাচিত করে ফেললেন। যাঁর সবল স্কন্ধের উপর ভর করে তাঁর আধ্যাত্মিক বার্তা ক্রমে জগতে ভাবের প্লাবন ঘটিয়ে দিল। যে প্লাবনের রেশ আজও চলেছে সবলভাবে। ভবিষ্যতেও চলবে সুদীর্ঘকাল। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নিত্যধামে প্রবেশের পর যে কঠোর ত্যাগ, বৈরাগ্যময় জীবন যাপন করছিলেন তাঁর ত্যাগী সন্তানেরা তা জানলে বা পাঠ করলে বিস্ময়াবিষ্ট হতে হয়। যার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন নরেন্দ্রনাথ। কারণ ঠাকুর তাঁকেই ‘লিডার’ বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রথম মঠ স্থাপিত হয় বরাহনগর বা বরানগরে, দক্ষিণেশ্বরের অদূরেই। এই বরানগর মঠের প্রারম্ভিক দিনগুলির বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে শ্রীম-কথিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে। সেই অপূর্ব বর্ণনার কিয়দংশ এইররকম -- “বরাহনগরের মঠ। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের অদর্শনের পর নরেন্দ্রাদি ভক্তেরা একত্র হইয়াছেন। সুরেন্দ্রের সাধু ইচ্ছায় বরাহনগরে তাঁহাদের থাকিবার একটি বাসস্থান হইয়াছে। সেই স্থান আজি মঠে পরিণত। ঠাকুরঘরে গুরুদেব ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের নিত্যসেবা। নরেন্দ্রাদি ভক্তেরা বলিলেন, আর সংসারে ফিরিব না, তিনি যে কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ করিতে বলিয়াছেন, আমরা কি করে আর বাড়িতে ফিরিয়া যাই। শশী নিত্যপূজার ভার লইয়াছেন। নরেন্দ্র ভাইদের তত্ত্বাবধান করিতেছেন। ভাইরাও তাঁহার মুখ চাহিয়া থাকেন। নরেন্দ্র বলিলেন সাধন করিতে হইবে, তাহা না হইলে ভগবানকে পাওয়া যাইবে না। তিনি নিজে ও ভাইরাও নানাবিধ সাধন আরম্ভ করিলেন। বেদ, পুরাণ ও তন্ত্রমতে মনের খেদ মিটাইবার জন্য অনেক প্রকার সাধনে প্রবৃত্ত হইলেন। কখনও কখনও নির্জনে বৃক্ষতলে, কখনও একাকী শ্মশানমধ্যে, কখনও গঙ্গাতীরে সাধন করেন। মঠের মধ্যে কখনও বা ধ্যানের ঘরে একাকী জপ-ধ্যানে দিন যাপন করেন। আবার কখনও ভাইদের সঙ্গে একত্র মিলিত  হইয়া সংকীর্তনানন্দে নৃত্য করিতে থাকেন। সকলেই, বিশেষতঃ নরেন্দ্র, ঈশ্বরলাভের জন্য ব্যাকুল। কখনও বলেন প্রায়োপবেশন কি করিব? কি উপায়ে তাঁহাকে লাভ করিব?
লাটু, তারক ও বুড়োগোপাল ইঁহাদের থাকিবার স্থান নাই, এঁদের নাম করিয়াই সুরেন্দ্র প্রথম মঠ করেন। সুরেন্দ্র বলিলেন, ‘ভাই! তোমরা এই স্থানে ঠাকুরের গদি লইয়া থাকিবে, আর আমরা সকলে মাঝে মাঝে এখানে জুড়াইতে আসিব।’ দেখিতে দেখিতে কৌমারবৈরাগ্যবান ভক্তেরা যাতায়াত করিতে করিতে আর বাড়িতে ফিরিলেন না। নরেন্দ্র, রাখাল, নিরঞ্জন, বাবুরাম, শরৎ, শশী, কালী রহিয়া গেলেন। কিছুদিন পরে সুবোধ ও প্রসন্ন আসিলেন। যোগীন ও লাটু বৃন্দাবনে ছিলেন, একবৎসর পরে আসিয়া জুটিলেন। গঙ্গাধর সর্বদাই মঠে যাতায়াত করিতেন। নরেন্দ্রকে না দেখিলে তিনি থাকিতে পারিতেন না। তিনি ‘জয় শিব ওঁঙ্কারঃ’ এই আরতির স্তব আনিয়া দেন। মঠের ভাইরা ‘বা গুরুজী কা ফতে’ এই জয়জয়কার ধ্বনি যে মাঝে মাঝে করিতেন, তাহাও গঙ্গাধর শিখাইয়াছিলেন। তিব্বত হইতে ফিরিবার পর তিনি মঠে রহিয়া গিয়াছিলেন। ঠাকুরের আর দুটি ভক্ত হরি ও তুলসী, নরেন্দ্র ও তাঁহার মঠের ভাইদের সর্বদা দর্শন করিতে আসিতেন। কিছুদিন পরে অবশেষে তাঁহারা মঠে থাকিয়া যান।” এই বর্ণনা থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় নরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ভাবী সঙ্ঘজীবন কীভাবে গড়ে উঠছিল। নরেন্দ্রর মহত্ত্ব বিষয়ে ঠাকুর অনেক কথা বলেছেন। তিনি বলছেন -- “নরেন্দ্রর খুব উঁচু ঘর। পুরুষের সত্তা। এত ভক্ত আসছে, ওর মতো একটিও নাই।
🍂

 এক-একবার বসে বসে আমি খতাই। তা দেখি, অন্য পদ্ম কারুর দশদল, কারুর ষোড়শদল, কারুর শতদল, কিন্তু পদ্মমধ্যে নরেন্দ্র সহস্রদল।
 অন্যেরা কলসী, ঘটি এ-সব হতে পারে, নরেন্দ্র জালা।
 ডোবা পুষ্করিণীর মধ্যে নরেন্দ্র বড় দীঘি। যেমন হালদার-পুকুর।
 মাছের মধ্যে নরেন্দ্র রাঙ্গাচক্ষু বড় রুই, আর সব নানারকম মাছ -- পোনা, কাঠি-বাটা এই সব।
 খুব আধার, -- অনেক জিনিস ধরে। বড় ফুটোওলা বাঁশ। 
 নরেন্দ্র কিছুর বশ নয়। ও আসক্তি, ইন্দ্রিয়সুখের বশ নয়। পুরুষ পায়রা। পুরুষ পায়রার ঠোঁট ধরলে ঠোঁট ছিনিয়ে লয় -- মাদী পায়রা চুপ করে থাকে।” ( শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রীম-কথিত, অখণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয় )
 বস্তুতপক্ষে আচার্য বিবেকানন্দ হয়ে ওঠার পূর্বে এক অভূতপূর্ব সাধন ভজনের মাধ্যমে বিপুল আধ্যাত্মিক শক্তিতে শক্তিমান হয়ে উঠেছিলেন নরেন্দ্রনাথ। এই বিষয়ে তিনি গুরুর কথা ও ভাবকে অনুসরণ করেছেন। একবার ( ১৮৮৪ সালে রথযাত্রার দিন ) কলকাতায় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে পণ্ডিত শশধরের সাক্ষাৎ হয়। নরেন্দ্র সেই সাক্ষাৎকালে উপস্থিত ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ পণ্ডিতকে বলেন, “তুমি লোকের মঙ্গলের জন্য বক্তৃতা করছ, তা বেশ। কিন্তু বাবা, ভগবানের আদেশ ব্যতিরেকে লোকশিক্ষা হয় না। ওই দুদিন লোক তোমার লেকচার শুনবে তারপর ভুলে যাবে। হালদার-পুকুরের পাড়ে লোক বাহ্যে করত; লোক গালাগাল দিত কিন্তু কিছুই ফল হয় নাই। অবশেষে সরকার যখন একটি নোটিস মেরে দিলে, তখন তা বন্ধ হল। তাই ঈশ্বরের আদেশ না হলে লোকশিক্ষা হয় না।” এই কারণেই নরেন্দ্র সংসারত্যাগী হয়ে নিভৃতে বহু তপস্যান্তে লোকশিক্ষাব্রতর কাজে নেমেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ পূর্বেই বলেছিলেন -- ‘জয়রাধে পৃমমোই নরেন শিক্ষে দিবে জখন ঘুরে বাহিরে হাঁকা দিবে।’ এটি তিনি একটি কাগজে লিখেছিলেন, ( ১৮৮৬ সালে ) কাশীপুরে পীড়িত অবস্থায়।
 তিনি যে শ্রীরামকৃষ্ণের দাসমাত্র, তাঁর দূত হয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন শাশ্বত, সনাতন ধর্মের বার্তা একথা স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন স্পষ্টভাবে। মাদ্রাজি ভক্তদের কাছে পত্রে লিখছেন --“It was your generous appreciation of Him whose message to India and whole world. I, the most unworthy of His servants, had the privilege to bear, it was your innate spiritual instinct which saw in Him and His message the first murmurs of that tidal wave of spirituality which is destined at no distant future to break upon India in all its irrestible powers.” ( Reply to Madras Address )

Post a Comment

0 Comments