সম্পাদক -মৌসুমী ঘোষ
সম্পাদকীয়,
'পরিবেশ' শব্দটির অর্থ কি জানো নিশ্চয়ই? হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ, যাকিছু আমাদের চারপাশে ঘিরে আছে সেগুলিকে নিয়েই আমাদের পরিবেশ। তবে চারপাশে তাকালেই যদি আমরা সবুজ বনানী দেখি তবেই সেটি সুস্থ পরিবেশ। আগের সপ্তাহে ৫ ই জুন তোমরা সকলে একটা করে গাছ লাগিয়েছো তো? প্রচ্ছদের ছবিটা দেখেছো তো? টুংকুড়ি কী সুন্দর সবুজ পাতায় মোড়া গাছেদের সঙ্গে খেলছে। ঋপণ আঙ্কেলকে অনেক ভালোবাসা এই ছবিটা পাঠানোর জন্য। পরিবেশ ভালো রাখতে বেশি বেশি সাইকেলের মতো যানের ব্যবহার বাড়াতে হবে। সম্প্রতি ৩ রা জুন ছিল বিশ্ব সাইকেল দিবস, তা নিয়ে লিখেছে দোলনচাঁপা আন্টি। ছোট্ট বন্ধু অভ্ররাজ লিখেছে সুজয়ের গল্প, যে ছিল পশু পাখিদের বন্ধু। সুন্দর পরিবেশে কে না বেড়াতে ভালোবাসে? বাসবদত্তা আন্টি তাইতো তোমাদের শ্যামদেশ বেড়ানোর গল্প বলেছে। শ্রীকান্ত আঙ্কেল লামাদের দেশে এখনো রহস্য খুঁজে চলেছেন। তোমাদের কেমন লাগছে সেই থ্রিলার উপন্যাস লাচুঙের নেকড়ে? জঙ্গল মহলের লোকগল্প বলেছেন চিন্ময় জেঠু। এখন আমরা চারপাশে তাকালেই সকলের হাতে মোবাইল দেখতে পাই। সেই নিয়ে ছড়া লিখেছে তারাপ্রসাদ জেঠু। আর শ্রেয়সী পাখির ছানাদের এঁকেছে দেখে তো আমার দারুণ আনন্দ হল। সৌনকশৌর্য একটা ঘড়ির দোকান আর আয়ুস্মিতা দাদু ঠাম্মাকে এঁকেছে। ওদের তিনজনকে আমার অনেক আদর। এসো আমরা পরিবেশ বান্ধব হয়ে উঠি। - মৌসুমী ঘোষ।
লাচুঙের নেকড়ে
পর্ব ১৫
শ্রীকান্ত অধিকারী
সামনে লাচুং মনাস্ট্রি।বহু পুরনো লাচুং উপত্যকার বৌদ্ধ গোম্ফা। লাচুং মঠের চারপাশে
পাহাড়ে ঘেরা।গায়ে গলা অব্দি বিশাল উঁচু উঁচু পাইন গাছের ঘন জঙ্গল। কোথাও কোথাও তিব্বতি সাইপ্রেস কিংবা চাইনিজ জুনিপার।তার ওপর পাহাড়ের চূড়া।চূড়ার মাথায় চাঁদির মুকুট।সাদা শুধুই সাদা।অক্টোবর নভেম্বর মাসে পুরু বরফ থাকার কথা নয়,তাই নীচের দিকে না থাকলেও চুড়াগুলো বরফে ঢাকা।এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয় ইয়ুম্থাং ভ্যালি।আরও এগিয়ে গেলে জিরো পয়েন্ট।তারপরেই চিনের বর্ডার।-এই মুহুর্তে সাঙ্গ আর গ্যাটসো দুজনেই ওদের গাইড।সাঙ্গ ওদের বোঝাচ্ছিল,-ভারতবর্ষের একবারে উত্তরে সর্বোচ্চ স্থানে সিল্কি রুটই হল এমন একটা রাস্তা যেটা ব্যবহার করে বাইরে দেশের লোক বিশেষ করে চিন তিব্বত থেকে ভারতবর্ষে এসেছিল। আবার ভারত থেকেও ওদেশে গিয়েছিল। গড়ে উঠছিল আর্থিক ও সাংস্কৃতিক লেনদেন। কিন্তু এখন এই দেশগুলোর মধ্যে কোনো সদ্ভাব নেই।
ছোটমামা ওদের সঙ্গে সঙ্গে চলে।-সাঙ্গ আরো জানায়, ১৯৫০ সালে তিব্বত চীনার দখলে আসার আগে পর্যন্ত এই লাচুং গ্রামে সিকিম তিব্বতের মধ্যে ব্যবসা চলত। কিন্তু ওদের উৎপাতে সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। বলার সময় সাঙ্গের চোখগুলো জ্বলে উঠছিল আর চোয়াল শক্ত করে বলছিল। সেটা রামসির চোখ এড়ায় না।তারপর মাঝে মাঝে কেন যেন রামসির মনে হল সাঙ্গ ফিস ফিস করে নিজের মনেই কিছু বলছে।
বেশ অবাক হয়ে যখন সে ব্যাপারটার কুল কিনারার হদিশ খোঁজার চেষ্টা করছিল তখনই ছোটমামা ইশারা করে সামনের দিকে। মঠের চারপাশে একভাবে ঝোলানো রয়েছে রঙিন লুংদার। মাঝে উড়ছে তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধ্বজা। তারই ওপাশে দেখে একটা মুর্তি।তবে বুদ্ধ নয় বুদ্ধের মত। চোখ খোলা। দৃষ্টিতে শাসন করার কিংবা অভিভূত করার দাপট।
রামসি এখনো পর্যন্ত অনেক বুদ্ধ মূর্তি দেখেছে সিকিমের বিভিন্ন জায়গায়।কিন্তু এমন ভিতর কাঁপানো দৃষ্টিতাড়িত মূর্তি দেখেনি।শিঙিকেও দেখা গেল ওর মায়ের কাছে দাঁড়িয়ে। গ্যাটসো আর সাঙ্গ মূর্তিটার কাছে গিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার বিড়বিড় করে কিছু বলল।
না এখানে ছবি তোলা মানা নেই।ছবি তুলতে তুলতে রামসির মা বড়মামির কাছে গিয়ে ফিস ফিস করে জানায়,এই সেই মহাজ্ঞানীর মূর্তি যিনি এক সময় নালন্দায় বৌদ্ধ যোগাচার তন্ত্র ধর্মীয় আচার বিষয়ে পড়াতেন।গুরু রিন-পো-চে।
-এই মূর্তির সঙ্গে বুদ্ধদেবের অনেকটা মিল আছে না?রামসির বাবা সোমেশ্বর বেশ অবাকই হয়। এই বিষয়ে পূর্বে কোনো ধারণা ছিল না ওর।আসলে ধর্মটর্ম নিয়ে তেমন মাথা ব্যথা নেই এমন কি সাহিত্য নিয়েও।সোমেশ্বর স্কুলে অঙ্ক পড়ায়।রামসি আর শিঙিকে বোঝায় জীবনে অঙ্ক ছাড়া কিছু নেই। অঙ্কই জীবনকে সঠিক দিশা দেখায়।কিন্তু এখানে এই উন্মুক্ত সুউচ্চ পাহাড়ি দেশে আসা অব্দি তার অঙ্ক কিছুতেই মেলে না। অথচ প্রকৃতির এই সুন্দর সাজানো রহস্যের মাঝে তো কোনো না কোনো অঙ্ক তো আছেই। বৌদ্ধ গুম্ফায় এক ভিন্ন রকম বৌদ্ধ গুরুমূর্তি দেখে সোমেশ্বর ভীষণ আশ্চর্য হয়। সাঁ সাঁ করে ছুটে আসা ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়ায় কেবলই সে তার ছেলে মেয়েকে চোখে হারায়। এই বুঝি বাকি লোকজন তার নির্দিষ্ট প্ল্যান পরিকল্পনা ভেস্তে দেবে।এমনিতে গত কালকের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কোনো কারণ খুঁজে পায় না। এদিকে বন্ধুদের ব্যাপারটা জানানো হয়ে গেছে।ওরা অবশ্য তেমন আমল না দিলেও কলকাতা পুলিশের সাউথ-ইস্ট ব্রাঞ্চে কর্মরত দীপক অভয় দিয়ে জানিয়েছে সাবধানে থাকিস। যতই হোক রাজ্যের বাইরে তো বটে।ভূটান নেপাল আর তিব্বত আই মিন চিন প্রশাসন কিন্তু সিকিমের ওপর সব সময় লোলুপ চোখ রাখে। সুযোগ পেলেই থাবা বসাতে পিছপা হবে না।এক একটা সব ক্ষুধার্ত নেকড়ে।শুনিস নি গোর্খা,ভোট আর ‘চ্যাঙ চুঙ’ সব সমান।ওদের ভয়েই তো সিকিমের রাজা থেকে সাধারণ মানুষও রক্ষা কবচ হিসেবে ভারতবর্ষকে বেছে নেয়। তবে ওসব নিয়ে তোর মাথা ব্যথার কারণ নেই।এমনিতে সিকিমের আদি বাসিন্দা লেপচা নেপালি বা ভুটিয়ারা বেশ অতিথি বৎসল।ওরা পর্যটকদের দেবতার মত দেখে। দরকার পড়লে ফোন করিস।
শিঙি কাছেই ছিল। ও তখন জোড় হাত বুকে রেখে সামনের সেই অদ্ভুত মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকে। সিঙির মা ওর হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে বুদ্ধের ধ্যানমুদ্রার আকারে রেখে বলে, বাবু এইভাবে ওনাকে স্মরণ করতে হয়।উনি এই পাহাড়-দেশের দেবতা।সবার মনে শান্তি ভক্তি বিশ্বাস ভালোবাসা এনে দিয়েছিলেন বলেই তো আজ পাহাড় এতো শান্ত। বাইরে থেকে কত কত মানুষ এসেছে শুধুমাত্র শান্তি পেতে।দেখ এখানে সবাই কেমন চুপ করে আছে। দরকারে কথা বললেও কত ধীরে ধীরে নিঃশব্দে।আসলে কি জানো এই বিশাল শৈলশ্রেণী মাথায় রজত মুকুট,থেকে থেকে সজল মেঘের উত্তরীয় গায়ে গভীর ঘন বনের পদমূলে যে শান্তি বিরাজ করছে তা তো আর এমনি এমনি আসে না।শান্ত হতে হয়।তবে না সে মহান।ধ্যানস্থ না হলে যে ভিতরের শক্তি কখনোই জাগ্রত হবে না, তাতে নতুন নতুন সৃষ্টি হবে না।প্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষের মুনিঋষিরা এই শান্ত উদার প্রকৃতির মাঝেই তো বছরের পর বছর দেহ মন এক করে ধ্যান করে গেছেন।বিধ্বস্ত মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন শান্তির বাণী।তাই তো আজ তাঁরা গুরু।জগৎ গুরু।
বাকরুদ্ধ শিঙি মায়ের পাশে থাকলেও এই মাকে তার বড্ড অচেনা লাগল। বাড়িতে সব সময় কিছু না কিছু নিয়ে ওকে ব্যস্ত থাকতে বললেও কোনো দিন চুপ করে বসে ধ্যান করার কথা বলে নি। আর এমন ভাবে ভেসে ভেসে উড়ে যাওয়া মেঘেদের মত বৃষ্টি ভেজা মনের খোঁজ তো কোনো দিন পায় নি। এই মা কি তার সেই এতদিনের চেনা মা! সেও যেন আপেল বাগান ছাড়িয়ে এলাচ জমি পেরিয়ে ওই দূরে আবছা দেখা যায় ছোট ছোট দু একটা ঘর, কিংবা ঘরের ছবি সেখানেই চলে গিয়েছিল কখন।ওখানেও হয়তো কেউ এই রকম কোনো ধ্যানী ধ্যান করছেন। হঠাৎ চমকে ওঠে বড়মামির কথা শুনে।–নিবু এই গুরুদেব কী বুদ্ধদেব নন?
শিঙির মা নিবেদিতা। আদুরে ডাক নিবু। শিঙির মা নিবিষ্ট মনে তখন মূর্তির দিকে তাকিয়ে। স্থির ধীর বুদ্ধের আলোকে আলোকিত আবেশিত যেন।ধীরে ধীরে অস্ফুট স্বরে বলে,- ইনি পদ্মসম্ভব।বৌদ্ধভিক্ষু।ইনিই বুদ্ধদেবের পর বৌদ্ধধর্মের র্ন্যিং মা ধারার স্রস্টা। পদ্ম থেকে জন্ম। তাই তিনি পদ্মসম্ভব। তিব্বতের বুদ্ধ। হে মহামানব পদ্মসম্ভব। দূর আকাশে অস্পষ্ট পাহাড়ের চূড়ার দিকে চেয়ে অষ্ফুটভাবে উচারণ করে ,-
পাহাড়ের এই শেষ চূড়া
এইখানে এসে দাঁড়িয়েছ আজ ভোরবেলা
তোমার পায়ের নীচে পদ্মসম্ভবের
মূর্তি,গুম্ফার উপরে আছো তুমি
বর্ণচক্র ঘোরে চারপাশে
ঘৃতপ্রদীপের থেকে তিব্বতি মন্ত্রের ধ্বনি
মেঘের মতন উঠে আসে
ধ্বনির ভিতরে তুমি অবলীন মেঘ হয়ে
আছো
যতদূর দেখা যায় সমস্ত বলয় জুড়ে
পাষাণের পাপড়ি মেলে দেওয়া
দিগন্তে দিগন্তে ওই কুয়াশামথিত শিখরেরা
পরিধি আকুল করে আছে
তার কেন্দ্রে জেগে আছো তুমি
আর এই শিলামুখে বহুজনমুখরতা থেকে
আবেগের উপত্যকা থেকে
মুহূর্তের ঘূর্ণি থেকে চোখ তুলে মনে হয় তুমিই পদ্মসম্ভব
তোমার নিরাশা নেই তোমার বিরাগ নেই
তোমার শূন্যতা শুধু আছে।
(ক্রমশ)
ধারাবাহিক ভ্রমণ
শ্যাম দেশ থেকে ফিরে
পর্ব ১
বাসবদত্তা কদম
রাত তিনটে বাজেনি তখনও, লোহার পাখি ঠং শব্দে নেমে পড়ল সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরে। তার পিঠে বন্ধী আমাদের দরজা খুলে দিতেই স্কুলের বাচ্চাদের মত ওপরের বাঙ্ক থেকে ব্যাগ, সুটকেস নামানোর ধুম পড়ে গেল। সে ধুম দেখলে কে বলবে আমরা সবাই স্কুল ছেড়ে আসা ধেড়ে শিশুর দল। অনেক,অনেক, বছর আগে স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছি সবাই।
বছর গেলে কি হবে, ছুটির ঘন্টা শুনলে হুড়োহুড়ি করতে হয় সে আমাদের মজ্জায় গেঁথে গেছে। গেঁথে যায় সেই স্কুল জীবন থেকে। আর এ স্বভাব পৃথিবীর সব দেশের মানুষের মজ্জাগত। সে আমি যতবার যেখানেই ঘুরতে গেছি, ততবার ঠিক সেটাই দেখি।
এরপর নিয়মমাফিক, চেকিং, ভিসা পরীক্ষার লাইন পেরিয়ে বাইরে এসে বেল্টের ওপর থেকে ব্যাগ নিয়ে একটু বসলাম। এক কাপ কফি নিয়ে বসে, চারিদিকটা ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। একবার বেরিয়ে গেলে আবার এর ভিতরে ঢুকতে পারবো সেই ফেরার দিনে। দেখলাম ভেতরে রেল লাইনও আছে। সেইখান থেকে ট্রেন ধরে যেতে হয় ক্রাবি তে যাবার প্লেন ধরতে। এছাড়া আছে অজস্র দোকান। যেমন থাকে যে কোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ভোর তখন চারটে, ফোন এলো আমাদের গাড়ি এসে গেছে।
আমাদের যেতে হবে বেশ খানিক দূরে। তোমাদের আঙ্কেলের অফিস যে জায়গায় তার নাম রিয়াং। রিয়াং এ থাকার জায়গা খুব একটা নেই তাই থাকবার ব্যবস্থা যেখানে হয়েছে, সে জায়গার নাম পাটায়া। সমুদ্র সৈকতের এক ছোট্ট শহর কিন্তু তার সোনা রঙা বেলাভূমি আর স্বচ্ছ আকাশী নীল জলের টানে সারা পৃথিবীর ভ্রমণ পিপাসী মানুষ সেখানে ভিড় জমান।
হোটেলে পৌঁছাতে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার রাস্তা যেতে হবে আমাদের।
ওঃ! দে--ড়শো কিলোমিটার! তার মানে কম করে তিন সাড়ে তিন ঘন্টা তো লাগবেই। এখন একটা ঘুম দেওয়া যেতেই পারে।
-ধাক্কা মারছো কেন? একটু চোখটা বন্ধ করেছি ...।
-নামো। হোটেল এসে গেছে।
-হোটেল! কটা বাজে?
-পৌনে ছটা।
পৌঁছে তো গেলাম, কিন্তু হোটেলের রিসেপসন ডেস্ক জানালো, আমরা ঘরে ঢুকতে পারবো সেই বেলা বারোটার সময়।
-তাহলে এখন কি করবো?
তাদের ক্লোক রুমে সুটকেস আর ব্যাগ রেখে মুক্তহস্ত হওয়া গেল।
ক্লোকরুম তোমরা সবাই জানো, তবু বলি টুরিস্টদের মালপত্র রাখার জন্য বহু হোটেলেই এরকম ঘর থাকে। বড় স্টেশন বা বাসস্ট্যান্ডেও থাকে। এখানে তালাবন্ধ ঘরে মালপত্র রেখে একটা নম্বরের টোকেন বা চিরকুট দিয়ে দেওয়া হয়। মালপত্র নেওয়ার সময় যেটা দেখেই ওরা আবার জিনিসগুলো ফেরৎ দেবেন।
এরপর কি করা যায়!
ওনারা বললেন, হোটেলের বাগান পেরোলেই সমুদ্র সৈকত, আমরা ঘুরে আসতেই পারি।
আমরা এসেছি সামনের রাস্তা দিয়ে। এটা পিছনের দিকের রাস্তা।
পিছন দিকে গিয়ে দেখি অপূর্ব সুন্দর বাগান। কত রকমের যে অর্কিড আর পাম গাছ।
কিন্তু তখন বাগান দেখতে গেলে বীচে যাওয়া যাবে না। আর দেরি করলে, সূর্যের তাপ যত বাড়বে ততই বালি গরম হতে থাকবে। যদিও তখন ফেব্রুয়ারি মাস কিন্তু ওদেশে শীত প্রায় পড়েই না বলা যায়। বিশেষত সমুদ্রের ধারে। তোমরা জানো এই আবহাওয়াকেই বলা হয় নাতিশীতোষ্ণ।
পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়েই দেখি অসীম নীল। সে যে কি অপূর্ব সুন্দর রঙ বলে বোঝাতে পারবো না। হয়ত ছবিতে দেখলে তোমরাও খানিকটা বুঝতে পারবে। তবে কিনা চোখের ক্যামেরার যে ছবি দেখা যায়, যন্ত্র ক্যামেরা কখনোই তুলতে পারে না।
রাস্তা চলে গেছে সমুদ্রের ধার ধরে ডানদিকে, বাঁদিকে।
বাঁদিকের রাস্তা চলে গেছে ‘প্রা তমনক হিল’ পর্যন্ত। পরে দেখেছি সে পাহাড়ের ওপর থেকেও পাটায়া শহর আর সৈকত এবং সমুদ্র মিলিয়ে এক অপূর্ব সৌন্দর্য।
পুরো পাটায়া শহরের একটা বেশ বড় অংশ সমুদ্রের ধার ঘেঁষে বানানো হয়েছে। এ শহরের মূল আকর্ষণ সমুদ্র সৈকত।
সেদিন রাস্তা পার হয়ে সমুদ্র সৈকতে পৌঁছালাম। হেঁটে চলেছি, বালি মাড়িয়ে।
(ক্রমশ)
সৌনকশৌর্য দাস
অষ্টম শ্রেণী, বিদ্যাসাগর শিশু নিকেতন, পশ্চিম মেদিনীপুর
মুঠোফোন /তারাপ্রসাদ সাঁতরা
একটা রাজা একটা রানী
রাজপুত্র রাজার সেপাই
পার হয়েছে সেই সব দিন
চোখ ভরে যায় ধোঁয়ায় ।
সন্ধ্যা আকাশ চাঁদের হাসি
ফুলের গন্ধে মো মো
এক ঝটকায় হারিয়ে গেছে
এখন শুধু ভো ভো
মুঠোফোন আর ইন্টারনেটে
মুখ ডুবে রয় অন্তহীন
চোখ দেখে না সবুজ শ্যামল
সবকিছুতেই উদাসীন।
ফিরতে চাইছে মন যদিও
রাস্তা সবই বন্ধ
সকল কাজে যুক্ত যন্ত্র
বলবে কে তার মন্দ
হেডফোনেতে মনে রেখে সব
রাস্তা দিয়ে হাঁটি
হোঁচট খেলেও কেউ বলি না মুঠোফোনের ত্রুটি ।
জঙ্গল মহলের লোকগল্প
চালাক বউ
চিন্ময় দাশ
একদিন এক বউ এসেছে কূয়ায় জল নিতে। কূয়াটা বাড়ি থেকে একটু দূরে। গাঁয়ের একেবারে শেষ মাথায়। সবে এক বালতি জল তুলেছে, চারজন লোক সেখানে এসে হাজির।
একজন লোক কূয়ার কাছে এগিয়ে এলো। বউটিকে বলল—ভারি তেষ্টা পেয়েছে। এক আঁজলা জলে দেবে, বাছা?
একটু দোনামনা করল বউটি। একে তো অপরিচিত লোক। মানুষটাই বা কেমন, তাও জানা নাই। তার উপর, ঘটি-বাটি কিছু নাই সাথে। জল দেবে কী করে? পুরো বালতি তো আর ধরে দেওয়া যায় না। যা গভীরে জল কূয়ায়! কম মেহনতের কাজ না কি? এক বালতি জল তুলতেই, হাঁফ ধরে যায়। এদিকে, তৃষ্ণার্ত মানুষকে তো জল দেব না, এ কথা বলা যায় না। বিশেষ করে এই গরমের সময়।
একটা অজুহাত দেখাবার জন্য, বউটি বলল—তুমি কে, সেটা জানতে পারি?
লোকটা বলল—কে আবার? আমি একজন পথিক।
বউটি বলল—এ জগতে পথিক হয় মাত্র দু’জন। তুমি তাদের মধ্যে কোনটি?
জবাব দেবে কী, প্রশ্নটা ধরতেই পারল না লোকটি। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল শুধু। মওকা বুঝে, বউ বলল—আমার কথার জবাব না পেলে, আমি কিন্তু জল দিতে পারব না। এই বলে, সে আবার জল তুলতে লাগল।
এবার দ্বিতীয় লোকটি এসে, বউকে জল চাইল। বউ জিজ্ঞেস করল—তুমি কে?
লোকটি বলল—আমি আবার কে? একজন গরীব মানুষ।
--জগতে মাত্র দু’জন গরীব আছে। তুমি কোনটি?
দ্বিতীয় লোকটিও এ কথার জবাব দিতে পারল না। ফলে, সেও জল পেল না।
এবার এল তৃতীয় জন। জল চাইতে, তাকেও একই প্রশ্ন করল বউটি। লোকটি বলল—আমি একজন মুর্খ লোক।
বউ বলল—দু’ রকমের মুর্খ আছে জগতে। তুমি কোন দলের?
তৃতীয় জনও চুপ করে রইল। সেও জল পেল না। বউটি জল তুলতে লাগল।
সব শেষে এল চতুর্থ জন। বউটির প্রশ্নের জবাবে, সে বলল—আমি একজন বোকা।
বউটি বলল—জগতে দু’ রকমের বোকা আছে। তুমি কোন দলের?
সে লোকটিও জবাব খুঁজে পেল না। ততক্ষণে জল তোলার কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে বউয়ের। কলসি তুলে নিয়ে সে বলল—তোমাদের চারজনেরই দেখছি পিপাসা লেগেছে। তা, তোমরা যদি আমার সাথে আমার বাড়িতে আসো, আমি জল দিতে পারি।
লোকগুলো তো এক কথায় রাজি। কলসি নিয়ে বউটি চলেছে আগে আগে। পিছনে চারজন অচেনা দূরদেশী মানুষ। গাঁয়ের লোকজন চেয়ে চেয়ে দেখছে।
ঘরে পৌঁছে, লোকগুলোকে দাওয়ায় বসাল মেয়েটি। ভেতরে গিয়ে কাপড় বদল করল। তার পর চারজনকে পরিপাটি করে জল খাওয়াল সেই মেয়ে। লোকগুলোও বেদম খুশি। ধন্যবাদ দিতে দিতে নিজেদের পথে রওণা হয়ে গেল আবার।
উলটো দিকের দাওয়ায় বসে ছিল মেয়েটির শ্বশুর। বসে বসে সব দেখছিল বুড়োমানুষটা। বউমার ব্যাপার-স্যাপার আদৌ ভালো লাগেনি তার। কোথাকার লোক, কেমন লোক, কিছুই নাই জানা। চার-চারটে অচেনা মানুষকে একেবারে ঘরে এনে তোলা। যত্ন করে জল খাওয়ানো। মোটেই পছন্দ হয়নি তার।
লোকটা মনে মনে ভাবল, আমার ছেলে ঘরে নাই। আর বউমার এই কাণ্ড! মোটেই ভালো কাজ নয় এটা। আর, আমারও নিজের চোখে এমন সব বেমক্কা কাজ দেখে, চুপ করে থাকা যায় না। কিছু একটা বিহিত করা দরকার।
মাথায় গামছা জড়িয়ে, সোজা রাজার দরবারে গিয়ে হাজির হোল সেই লোক। বউমার নামে নালিশ ঠুকে দিল বুড়ো।
নালিশ শুনে, রাজার মুখ গম্ভীর। মন্ত্রী ছিল পাশেই। তার সাথে গুজগুজ করে কিছু বলে নিল দুজনে। একটা সেপাইকে ডেকে রাজামশাই বলল—যাও, মেয়েটিকে ডেকে আনো এখানে।
রাজার সেপাইকে গ্রামে দেখে, গোটা গ্রাম ভয়ে কেঁপে উঠল। কেউ চেয়ে রইল চোখ বড় বড় করে। সুড়ুৎ করে ঘরে ঢুকে পড়ল কেউ কেউ।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল মেয়েটির শ্বাশুড়ির। সে প্রথমেই ভেবে নিল, নির্ঘাত জল তুলতে গিয়ে, কারও সাথে ঝগড়া করে এসেছে বউমা। বার বার করে জানতে চাইল, আমাকে বল মা, কার সাথে কী ঘটেছে।
জবাব দেবে কী, মেয়েটিরও তো মাথায় কিছু ঢুকছে না। রাজার সেপাই তাকে ধরে নিয়ে যেতে এল কেন? ব্যাপারটা কী?
তবে, এক্কেবারেই ভয় পেল না সেই মেয়ে। সে সেপাইকে বলল—তুমি বাপু আর একবার ফিরে যাও রাজবাড়িতে। তোমাদের রাজামশাইকে গিয়ে বলো, তিনি আমাকে মেয়ে, না কি বউমা—কী হিসেবে ডেকে পাঠিয়েছেন?
একটি কথাও বলল না সেপাই। রাজবাড়িতে ফিরে চলল। গিয়ে রাজাকে সব বলল।
এবার হোল কী, রাজা রাগল না। ফুঁসে উঠল না। মেরে ফেলতে বলল না। ধরে আনতে বলল না। মুখে রাগ নাই রাজার। বরং যেন আলো জ্বলে উঠল এক্টুখানি। হাসি মুখ করে, ফিসফিস করে কিছু বলে দিল সেপাইকে। লম্বা একখানা কুর্নিশ ঠুকে, বেরিয়ে গেল লোকটা।
আবার গাঁয়ে ফিরে এসেছে সেপাই। এবার তার সাথে ঝলমলে একটা পালকি। বলল—বউমা হিসাবেই রাজসভায় তোমার ডাক পড়েছে, বাছা। সঙ্গে এই পালকিও এনেছি। এতে চেপেই যাবে তুমি।
শ্বাশুড়ি বুড়ির তো ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থা। এতক্ষণ সাত-সতেরো বিপদের কথা ভেবে, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ছিল বুড়ির। রাজার সেপাইকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। এবার না শূলে চড়তে হয় হতভাগীকে। সংসারের মাথাতেও কী না কী বিপদ নেমে আসবে, তার নাই ঠিক!
কিন্তু এ যে একেবারে উলটো ব্যাপার! কোথায় বিপদ, কোথায় কী? রাজার পালকি চড়ে, দরবারে যাবে তার বউমা। বেশ একটু গর্বও হতে লাগল বুড়ির।
বউটি পালকি চেপে রাজবাড়িতে চলল। গাঁশুদ্ধ সবাই হাঁ করে চেয়ে দেখল, রাজার পাঠানো পালকি চেপে চলেছে তাদেরই এক বউমা। পেছন পেছন বল্লম বাগিয়ে চলেছে রাজার সেপাই! সকলেরই বেশ একটা গর্ব হতে লাগল তাতে।
ভরা দরবার। ভেতর মহল থেকেও অনেকেই উঁকিঝুঁকি মারছে আড়াল থেকে। ব্যাপারটা পুরো দেখতে চায় সবাই। সকলেরই কৌতুহল।
বউটি এসে হাজির হোল। রাজা প্রশ্ন করলেন—তুমি চারজন বাইরের অচেনা লোককে ঘরে ডেকে এনেছিলে। একথা সত্যি?
বউটি বলল—হ্যাঁ, রাজামশাই। সত্যি।
--কেন করেছিলে এমন কাজ?
--পিপাসার্ত মানুষকে জল দেওয়া, যে কোনও গেরস্তের বউমার কর্তব্য। সেটাই আমি করেছি।
--জল তো কূয়াতলাতেই দেওয়া যেত। ঘরে ডেকে আনতে হোল কেন?
বউটি বলল—সেসময় আমার কাপড়-চোপড় ভেজা ছিল। তারাও বাইরের লোক। সাথে ঘটিবাটিও ছিল না। ভরা বালতি দিতে পারি না। এদিকে জল দেব না, একথা তো আর বলা যায় না। তাই তাদের লোক ঠকানো প্রশ্ন করে বোকা বানিয়েছিলাম, সময় নেওয়ার জন্য। জল তোলা শেষ করে, তার পরে ঘরে এনেছিলাম। এমন প্রশ্ন করেছিলাম, যার উত্তর দেওয়ার উপায় ছিল না তাদের।
রাজামশাই একটু খুশিই হলেন এমন জবাবে। বললেন—কী তোমার প্রশ্ন, চার-চারজন লোক যার উত্তর দিতে পারেনি? বলো তো, শুনি।
ভরা দরবার। বউটি সবার উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিল। বলল—বলতে পারি, যদি কেউ জবাব দিতে পারে আমার প্রশ্নের।
রাজা বললেন—তোমার সবগুলো প্রশ্নেরই জবাব দেওয়া হবে এখানে। বলো তুমি।
পর পর চারটি প্রশ্নই বলে গেল বউটি। মজার ব্যাপার হোল, একজনও কেউ একটা প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারল না। অবাক ব্যাপার হোল, রাজামশাই নিজেও মাথা চুলকে ফেললেন।
রাজা বললেন—স্বীকার করলাম, আমরা তোমার একটি প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারলাম না। কিন্তু, তুমি নিজে কি পারবে? না পারলে কিন্তু শাস্তি পাবে।
একথা শুনে, বউটির মুখে একটু হাসি। বলল—অবশ্যই পারব। মাপ করবেন রাজামশাই, উত্তর জানা না থাকলে কি কেউ প্রশ্ন করে?
রাজা খুশি খুশি মুখ করে বললেন—বাহ, বেশ কথা। তাহলে শোনাও তো দেখি তোমার জবাব।
এবার এক এক করে বউটি বলে চলল—আমার প্রথম কথা হোল, সারা দুনিয়ায় পথিক হোল মাত্র দু’জন। একজন হোল সূর্য। আর, অন্যজন হোল চন্দ্র। তাদের চলা অবিরল। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর, সবার চেয়ে গরীব হোল, দুধেল গাই আর তার বাছুর। সব থেকেও তাদের কিছু নাই। আমার তৃতীয় প্রশ্ন-- মুর্খ কে? দুনিয়ায় মুর্খ কোন দু’জন? তারা হোল জল আর বাতাস। মুর্খদের স্বভাব হোল এরকমই। সবার কাছে গিয়ে হাজির হয়ে যায় তারা। সবার জন্য বিলিয়ে যায়। কোন বাদবিচার করে না।
একটা জবাব শুনছেন, আর মাথা নাড়ছেন রাজামশাই। মুখেও আরও আলো আলো ভাব ফুটে উঠছে। এবার জিজ্ঞেস করলেন—আর, তোমার শেষ কথার জবাবটা কী?
মেয়েটি বলল—চতুর্থ লোকটি বলেছিল, সে এজন নির্বোধ। আমি তাকেও বলেছিলাম, দু’ধরণের নির্বোধের মধ্যে, সে কোন ধরণের? ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়ে গেছল লোকটা। জবাব দেয়নি।
শুনে, রাজার মনে বেশ কৌতুহল। বললেন—তাহলে, তুমি বলতে চাও, মাত্র দু’ধরণের ্নির্বোধ বা বোকা আছে দুনিয়ায়?
বউটি বলল—হ্যাঁ, রাজামশাই। একেবারে ঠিক তাই। দু’রকমই।
জবাব শুনে তো রাজার ধৈর্য ধরে না। বললেন—বলো তো শুনি, কারা সেই নির্বোধ?
বউটি মুখ নামাল। মাথা চুলকাল। চুপ করে রইল জবাব না দিয়ে। দেখে রাজা অবাক। বললেন— হোলটা কী? জবাব দাও।
সেই তেজিয়াল মেয়ে হাত জড়ো করে বলল—বলতে আমার ভয় করছে, রাজামশাই। শুনে, আপনারা সবাই না রেগে যান।
রাজা গম্ভীর গলায় বললেন—তুমি নির্ভয়ে বলো। আমার দরবারে ন্যায্য কথা বললে, কেউ রেগে যায় না।
বউটি বলল—বেশি দূরে যেতে হবে না। এই মূহুর্তে দুজন নির্বোধ আমি দেখতেই পাচ্ছি। এই দরবার ঘরেই।
রাজা অবাক—বলো কী তুমি? দু’-দুজন নির্বোধ! আমার এই রাজসভাতেই? কারা গো তারা?
বউটি হেসে ফেলল ফিক করে—হ্যাঁ, হুজুর। এই রাজসভাতেই। একজন হলেন আমার শ্বশুরমশাই। ব্যাপারটা কী, সেটা ঘরেই যাচাই করা যেত। বউমা তো নিজের মেয়েরই মতো। তা করলেন না তিনি। সোজা দরবারে চলে এলেন। বাড়িরই বউমার নামে নালিশ ঠুকে দিলেন। বোধবুদ্ধি থাকলে, এমন কাজ করে কেউ? আপনিই বিচার করে বলুন।
মেয়েটির কথা ভারি মনে ধরেছে রাজার। ভারি খুশি। চোখমুখ উজ্বল। বললেন—বল তো মা, এই সভায় দ্বিতীয় নির্বোধটি কে?
মেয়েটি মুখ নামাল না। মাথা চুলকাল না। ভয়ও পেল না। থেমেও রইল না। বলল—মাপ করবেন, রাজামশাই। দ্বিতীয় জন আপনি নিজে।
শুনে সভাশুদ্ধ লোক চমকে উঠল। বাজ পড়ল যেন দরবারে! এতো সাহস এই মেয়ের। রাজা নিজেও চমকে উঠলেন মেয়েটির কথায়। বলে উঠলেন—বলো কী তুমি? আমি নির্বোধ?
এবারেও গলা কাঁপল না মেয়ের। সে বলল—নিজে রাজা হয়েও, একজন পুত্রবধুর সম্মানের কথাটা মাথাতেই এল না আপনার? সেপাই পাঠিয়ে দিলেন গ্রামে, তাকে ধরে আনবার জন্য? একেবারে দরবারে হাজির করবার ফরমান দিয়ে দিলেন?
দরবার শুদ্ধ কারও মুখে কথা নাই। শ্বশুর মানুষটার তো বুক ঢিপঢিপ। এবার নির্ঘাত শূলে চড়বে এই মেয়ে! কী সর্বনাশই না হবে সংসারের!
সারা দরবার নীরব। নিঃশ্বাস পড়বার শব্দটিও শোনা যায় যেন। প্রথম কথা বললেন রাজাই—তুই শুধু বুদ্ধিমতি নয় রে, মা। সাহসীও বটে। যা, মা। বাড়ি ফিরে যা। কথা দিলাম, এমন ভুল আর হবে না আমার।
এমন রায় শুনে, গোটা দরবার থ হয়ে গেল। কথা নাই কারও মুখে। শুধু মেয়েটির মুখে হাসি। ধড়ে প্রাণ ফিরে এল তার শ্বশুরের। রাজামশাই বললেন—তবে একটা কথা। যেদিনই তোকে মনে পড়বে, পালকি পাঠিয়ে দেব। একটি বার চলে আসবি এখানে।
আবার পালকি চাপল সেই মেয়ে। এবার চার বেহারার সাথে, আগে পিছে চারজন সেপাইও চলেছে পালকির সাথে।
পালকি ওঠানো হবে, ছুটতে ছুটতে রাজবাড়ির খাজাঞ্চি এসে হাজির— আরে থামো,থামো।
এক মুঠো মোহর গুঁজে দিল মেয়েটির হাতে। বলল—রাজামশাই নিজে দিলেন তোমাকে।
হুম-না, হুম-না করে পালকি উঠল। রাজার পালকি চড়ে, বাড়ি চলল গ্রামের এক বুদ্ধিমতী আর সাহসী বউমা
(দলমা পাহাড়-এর মাথা—তার এ পারে বাংলা, আর ও পারে ঝাড়খণ্ড। এ পারের গ্রাম ঢাঙিকুসুম, জেলা ঝাড়গ্রাম জেলা থেকে সংগৃহীত)
শ্রেয়সী ঘোষ
চতুর্থ শ্রেণী, সাহাপুর বিবেকানন্দ শিক্ষা নিকেতন, পূর্ব বর্ধমান
সুজয়ের ইতিহাস
অভ্ররাজ লোহার
চতুর্থ শ্রেণি
ব্যান্ডেল বিদ্যামন্দির
হুগলি
সুজয় নামে একটি ছেলে ছিল। সে খুব মেধাবী এবং ভীতু ছিল কিন্তু তার মনে পশু-পাখিদের জন্য দয়া ছিল। তার মনে সুপ্ত বাসনা ছিল যে সে কোনোকিছু জয় করবে তারজন্য ওকে ট্রফি দেওয়া হবে। সবাই তাকে নিয়ে আনন্দ এবং গর্ববোধ করবে।
এবারের কালীপুজোর ভূত-চতুর্দশীর রাতে সুজয় বিছানায় ঘুমাচ্ছিল তখন রাত বারোটা বেজে গেছে তখনই একটি কঙ্কাল এসে দাঁতে কটকট করে আওয়াজ করছিল। তখন কঙ্কালের কটকট আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেছিল সুজয়ের। সে তার চোখ খুলতেই দেখেছিল কঙ্কালটিকে, আর সে ভয়ে হতভম্ব হয়ে গেছিল। কঙ্কালটি তা দেখে আরও জোরে জোরে বলছিল যখন আমি বাগানে বসেছিলাম তখন তুই আমার গায়ে থুতু ফেলেছিলি তাই আমি তার প্রতিশোধ নিতে এসেছি। সুজয় তখন ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল আর বলছিল, আমাকে ছেড়ে দাও তুমি যা চাও আমি তাই দেব।
কঙ্কাল বলল, আমি অনেকদিন ধরে কিছু খাইনি, আমার খুব খিদে পেয়েছে। আমাকে তুই দশটা কাঁচা মাছ দে, তাহলে আমি তোকে ছেড়ে দেব।
সুজয় বলল, ঠিক আছে, কালকে আমি তোমাকে দশটা কাঁচা মাছ দেব।
কঙ্কাল সুজয়ের কথা শুনে সেদিন চলে গেল। আর পরেরদিন আবার এসে মাছ খেয়ে গেল। সেই থেকে ভূতটা সুজয়ের বন্ধু হয়ে গেল।
এর দুদিন পর সুজয় স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল তখন একটা কুকুর এসে তার ঘরের সামনে বসেছিল। কুকুরটিকে দেখে মনে হচ্ছিল তার খুব খিদে পেয়েছে। তা দেখে সুজয় তাকে দুটো বিস্কুট খেতে দিল। তারপর থেকে সেই কুকুরটা সুজয়ের বন্ধু হয়ে গেল। সুজয় ওর নাম দিল রকি। আর রকি রোজ সুজয়ের পিছু পিছু তার স্কুল অবধি যেতে লাগল।
একদিন স্কুল যাওয়ার পথে রাস্তায় কিছু টাকা আর দরকারি কাগজ পড়ে থাকতে দেখল। সুজয় দেখল রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে বসে থাকা মনোহর দাদু এসে সেই টাকা আর কাগজগুলো তুলতে যাচ্ছে। সুজয় তখন মনোহর দাদুকে জিজ্ঞেস করল, এই টাকা আর কাগজগুলো কি আপনার দাদু?
মনোহর দাদু বলল, না এগুলো আমার নয়। তবে আমি বা তুমি এগুলো না তুলে নিলে, অন্য কেউ তুলে নেবে।
সুজয় বলল, তাহলে চলুন আমরা এই টাকা আর কাগজগুলো পুলিশ স্টেশনে জমা করে আসি।
পুলিশ স্টেশনে সেগুলো জমা দিয়ে স্কুলে যেতে সুজয়ের দেরি হয়ে গেল।
তার স্কুলে যেতে দেরি হওয়ায় বিজয় স্যারের কাছে সে খুব বকুনি খেল। স্যার ক্লাসের ফার্স্ট বয় রমেশকে দেখিয়ে বলল, একে দেখ। এ কখনো স্কুলে আসতে দেরি করে না তাই সব প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়। তার প্রথম হওয়ার ট্রফিগুলোও সুজয়কে দেখালেন স্যার।
সুজয় সেদিন বকুনি খেয়ে আর ক্লাস না করে বাড়ি ফিরে এল। এই সময় সর্বক্ষণ রকি তার পাশে রইল। আর বিকেলে বিজয় স্যার বাড়ি ফিরলে তার বাড়ি গিয়ে রকি, সুজয়ের স্কুলে দেরিতে যাবার আসল কারণ জানিয়ে এল।
এরপর একটা রোবট বানানোর কম্পিটিশানে সুজয় অংশগ্রহণ করল। এই রোবট বানানোর জন্য তাকে সাহায্য করল বন্ধু ভূতটা। সুজয়ের বানানো রোবট দেখে বন্ধুরা এমনকি বিজয় স্যারও খুব অবাক হল। তার রোবট প্রতিযোগিতায় প্রথম হল। সে ট্রফি পেল। এইভাবে সুজয়ের স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল।
স্মরণীয় দিবস
বিশ্ব সাইকেল দিবস
(৩রা জুন)
কলমে - দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে
তেসরা জুন বিশ্ব সাইকেল দিবস। প্রতিবছর বিশেষ এই দিনটি বিশ্বজুড়ে পালন করা হয়। এই উপলক্ষে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সাইকেল রাইড সংগঠনগুলো বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করে। এর মধ্যে রয়েছে র্যালি এবং বিভিন্ন ধরনের সাইকেল রাইড দেওয়া।
এখন আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে সাইকেল দিবসটি কেন হল? তার উত্তরে বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন অধ্যাপক লেসজেক সিবিলস্কি তিনি বাইসাইকেল নিয়ে একটি প্রচার অভিযান শুরু করেন। তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল, জাতিসংঘ বিশ্বে সাইকেলের সমর্থনে একটি দিন যেন নির্দিষ্ট করে।
২০১৫ সালে সিবিলস্কি একটি একাডেমিক প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেন। এই প্রকল্পটি পরবর্তীকালে একটি বড় আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত বাইসাইকেলের জন্য জাতিসংঘ একটি নির্দিষ্ট দিন নির্ধারণ করে।
২০১৮ সালের ১২ই এপ্রিল জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ১৯৩ টি সদস্য রাষ্ট্র সর্বসম্মতিক্রমে ৩রা জুনকে বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস বলে ঘোষণা করে। এ প্রস্তাবে তুর্কমেনিস্তান ব্যাপক সমর্থন জানিয়েছিল, শুধু তাই নয় ৫৬ টি দেশ এর পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল।
বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস সাইকেলের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। এটি এমন একটি যানবাহন যা সমাজের ধনী থেকে গরিব পর্যন্ত সকলেই ব্যবহার করে।
বাইসাইকেলের উপকারিতা অনেক আছে, যেমন বর্তমান দিনে উত্তরোত্তর যানবাহনের জন্য, যে বায়ু দূষিত হচ্ছে তার হাত থেকে পরিবেশকে বাঁচায়। শুধু তাই নয় রাস্তার ট্রাফিক যানজটের অনেকটা নিরসন হয় বাইসাইকেলের জন্য। এছাড়াও বাইসাইকেল চালালে শরীরের উপকার হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে সাইক্লিং একটি সুন্দর ওয়ার্ক আউট যা ব্যক্তি কে সুস্থ রাখে শারীরিক এবং মানসিকভাবে। সাইক্লিং মানুষের অতিরিক্ত মেদ ঝরাতেও কাজে লাগে। এমনকি মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।বলা যায়, সমাজের বিভিন্ন দিকে বাইসাইকেলের ইতিবাচক দিকটি ধরা পড়ে।
অবশেষে বলা যায়, জাতিসংঘ বাইসাইকেল কে শান্তি, সহনশীলতা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও জলবায়ুর জন্য সঠিক যানবাহন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
সাইকেল দিবসের মূল লক্ষ্য হলো, মানবতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। বর্তমানে বিশ্বের মানুষের কাছে বাইসাইকেলের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। বিশেষ করে উন্নত দেশের মানুষদের কাছে বাইসাইকেলর গুরুত্ব অনেক বেড়েছে।
0 Comments