পর্ব ৮১
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
প্রীতম সেনগুপ্ত
১৮৮৫ সালের এপ্রিল মাসে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের গলরোগের শুরু। সেইসময় যা ছিল প্রাথমিক অবস্থায়, তা ক্রমশ বাড়তে থাকে। গলদেশ থেকে একসময় রক্ত নির্গমন শুরু হল। স্বভাবতই ভক্তদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ল। চৈত্র-বৈশাখ মাসে দেখা গিয়েছিল রোগের আভাস, ভাদ্রমাসে তা সঙ্কটের চেহারা নিল। এই রোগ যে ক্যান্সার হতে পারে সেকথা অনুমান করেছিলেন নরেন্দ্রনাথ। ডাক্তারির বই পড়ে এবং ডাক্তার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে তাঁর এই সন্দেহ হয়। এমতাবস্থায় নরেন্দ্র, গিরিশ, রামচন্দ্র, মাস্টারমশায়, দেবেন্দ্রনাথ প্রভৃতি ভক্তগণ পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেন কলকাতায় এনে ঠাকুরের চিকিৎসা করার। কলকাতায় আনার প্রস্তাবে ঠাকুরও সম্মত হন। ৫৫ নং শ্যামপুকুর স্ট্রিটে অবস্থিত গোকুলচন্দ্র ভট্টাচার্যের ‘বৈঠকখানা’ ভবন তাঁর জন্য ভাড়া নেওয়া হয়। ঠাকুর সেখানে আসেন আশ্বিন মাসের মধ্যভাগে। সেখানে সুপ্রসিদ্ধ হোমিওপ্যাথ ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার ঠাকুরের চিকিৎসা শুরু করলেন। ঠাকুরের সেবার জন্য স্থায়ীভাবে সেখানে থেকে গেলেন শ্রীশ্রীমা, লাটু, কালী, শশী, ছোট গোপাল প্রমুখরা। নরেন্দ্রনাথও সেখানে রাত্রিযাপন করতে লাগলেন। আন্যান্য যুবক ভক্তেরা মাঝে মাঝে সেখানে থেকে কিংবা বাড়ি থেকে যাতায়াত করে সেবাকার্যে অংশ নিতে থাকলেন। এই সময় নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপে ও ভাববিনিময়ে ডাক্তার সরকার চমৎকৃত হন। তিনি একদিন নিজগৃহে নরেন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ করে খাইয়েছিলেন ও সঙ্গীতবিদ্যায় পারদর্শী নরেন্দ্রনাথের কাছ থেকে ভজন-গান শুনতে চেয়েছিলেন। এর কিছুদিন পর শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে দেখতে আসলে প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে নরেন্দ্রনাথ ডাক্তার সরকারকে দু-তিনঘণ্টা ভজন শুনিয়েছিলেন। গান শুনে ডাক্তার অসম্ভব প্রীত হন। বিদায়ের সময় গায়ক নরেন্দ্রনাথকে আদর ও চুম্বন করে ঠাকুরকে বলেন যে, নরেন্দ্রর মতো ছেলে ধর্মলাভ করতে এসেছে দেখে তিনি বিশেষ আনন্দিত, নরেন্দ্র একটি রত্ন, যেটাতে হাত দেবে সেই বিষয়েই উন্নতিসাধন করবে। ঠাকুর এর উত্তরে নরেন্দ্রর প্রতি স্নেহ দৃষ্টি আরোপ করে বলেন, “কথায় বলে, অদ্বৈতের হুঙ্কারেই গৌর নদীয়ায় আসিয়াছিলেন; সেইরূপ ওর ( নরেন্দ্রের ) জন্যই তো সব গো।” ( যুগনায়ক বিবেকানন্দ, স্বামী গম্ভীরানন্দ )।
যুবক ভক্তদের প্রবল বৈরাগ্যের অনুপ্রেরণাদান করতে থাকলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। নরেন্দ্র তাঁর সর্বাপেক্ষা প্রিয়। কিন্তু সেই নরেন্দ্রর আকস্মিক পিতৃবিয়োগ হয়েছে। মা, ভাইয়েরা রয়েছে। তাঁদের দেখতে হবে তাঁকে। এমতাবস্থাতেও ঠাকুর তাঁকে বৈরাগ্যে উৎসাহদান থেকে বিরত থাকছেন না। ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ অনুসরণ করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। কথামৃতে লিখিত রয়েছে এইরকম --
“নরেন্দ্রর পিতার পরলোকপ্রাপ্তি হওয়াতে বড়ই ব্যতিব্যস্ত হইয়াছিলেন। মা ভাইয়েরা আছেন, তাঁহাদের ভরণপোষণ করিতে হইবে। নরেন্দ্র আইন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইতেছেন। মধ্যে বিদ্যাসাগরের বৌবাজারের স্কুলে কয়েক মাস শিক্ষকতা করিয়াছিলেন। বাটীতে একটা ব্যবস্থা করিয়া দিয়া নিশ্চিন্ত হইবেন -- এই চেষ্টা কেবল করিতেছেন। ঠাকুর সমস্তই অবগত আছেন; নরেন্দ্রকে একদৃষ্টে সস্নেহে দেখিতেছেন।
“শ্রীরামকৃষ্ণ ( মাস্টারকে ) -- আচ্ছা, কেশব সেনকে বললাম ‘যদৃচ্ছালাভ’। যে বড় ঘরের ছেলে তার খাবারের জন্য ভাবনা হয় না -- সে মাসে মাসে মাসোহারা পায়। তবে নরেন্দ্রর এত উঁচু ঘর, তবু হয় না কেন? ভগবানে মন সব সমর্পণ করলে তিনি জোগাড় করে দিবেন।
“মাস্টার -- আজ্ঞা, হবে; এখনও তো সময় যায় নাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ -- কিন্তু তীব্র বৈরাগ্য হলে ওসব হিসাব থাকে না। বাড়ীর সব বন্দোবস্ত করে দিব, তারপর সাধনা করব -- তীব্র বৈরাগ্য হলে এরূপ মনে হয় না। ( সহাস্যে ) গোঁসাই লেকচার দিয়েছিল; তা বলে দশ হাজার টাকা হলে ঐ থেকে খাওয়া- দাওয়া এইসব হয়, তখন নিশ্চিন্ত হয়ে ঈশ্বরকে বেশ ডাকা যেতে পারে। কেশব সেনও ইঙ্গিত করেছিল। বলেছিল -- মহাশয়, ‘যদি কেউ ঠিকঠাক করে ঈশ্বর চিন্তা করে, তা পারে কিনা? তার তাতে কিছু দোষ হতে পারে কি?’ আমি বললাম -- ‘তীব্র বৈরাগ্য হলে সংসার পাতকুয়া, আত্মীয় কালসাপের মতো বোধহয়। তখন টাকা জমাব, বিষয় ঠিকঠাক করব -- এসব হিসাব আর আসে না। ঈশ্বরই বস্তু আর সব অবস্তু -- ঈশ্বরকে ছেড়ে বিষয়-চিন্তা! একটা মেয়ের ভারী শোক হয়েছিল। আগে নথটা কাপড়ের আঁচলে বাঁধলে, তারপরে ‘ওগো, আমার কি হলো গো!’ বলে আছড়ে পড়ল, কিন্তু খুব সাবধানে নথটা না ভেঙ্গে যায়।
“সকলে হাসিতেছেন। নরেন্দ্র এইসকল কথা শুনিয়া বাণবিদ্ধের ন্যায় একটু কাত হইয়া শুইয়া পড়িলেন। মাস্টার তাঁহার মনের অবস্থা বুঝিয়াছেন।”
সেদিন অপরাহ্ণ দুইটায় নরেন্দ্রনাথ যে কয়টি গান গাহিলেন, সবই বৈরাগ্যপূর্ণ--
“যাবে কি হে দিন আমার বিফলে চলিয়ে”-- ইত্যাদি,
“অন্তরে জাগিছে ওমা অন্তরযামিনী”-- ইত্যাদি
“কি সুখ জীবনে মম ওহে নাথ দয়াময় হে,/ যদি চরণসরোজে পরাণমধুপ চিরগমন না রয় হে” ইত্যাদি।
এই বৈরাগ্য থেকেই উদ্ভূত ভাবীকালের বিবেকানন্দ। বৈরাগ্য থেকে তিনি অর্জন করেছিলেন অপরিসীম শক্তি। বৈরাগ্যসম্ভূত ত্যাগ-তপস্যা তাঁকে শক্তিমান করে তুলেছিল। তাই তো তিনি বললেন --“Above all, be strong, be manly! I have a respect even for one who is wicked, so long as he is manly and strong; for his strength will make him some day give up his wickedness, or even give up all work for selfish ends, and will then eventually bring him into truth.”
🍂 ফরাসি মনীষী রোম্যাঁ রোলাঁ এই বিবেকানন্দ বিষয়ে লিখছেন --“His athletic form was opposite of the fragile tender, yet wiry body of Ramakrishna. He was tall ( five feet eight and half inches ), square shouldered, broad-chested, stout, rather heavily built, his arms were muscular and trained to all kinds of sports. He had an olive complexion, a full face, vast forehead, strong jaw, a pair of magnificient eyes, large, dark and rather promised, with heavy lids, whose shape recalled the classic comparison to a lotus petal. Nothing escaped the magic of his glance, capable equally of embracing in into irrestible charm, or of sparkling with wit, irony, or kindness, of losing itself in ecstasy, or of plunging imperiously to the very depths of consciousness and of withering with its fury. But his pre-eminent charecteristic was kingliness. He was a born king and nobody ever came near him either in India or America without paying homage to his majesty.”( The Life Of Vivekananda And The Universal Gospel by Romain Rolland )
0 Comments