জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক ক্ষিতিমোহন সেন /নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক ক্ষিতিমোহন সেন

নির্মল বর্মন

 "আমরা ছিলাম মাটির তাল , গুরুদেব আমাদের হাত ধরে গড়ে পিটে তৈরি করে নিয়েছেন ,তিনি না থাকলে    আমরা কিছুই হতাম না "
                         ক্ষিতিমোহন সেন

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাক্তন উপাচার্য ক্ষিতিমোহন সেন অধুনা বাংলাদেশের বিক্রমপুরের সোনার রং গ্রামে পৈত্রিক সম্পত্তি ও নিবাস। ২রা ডিসেম্বর ১৮৮০ সালে জন্মগ্রহণ করেন উত্তর প্রদেশের ভারানসীতে। বাংলাদেশের সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে শিক্ষাবিদ ক্ষিতিমোহন সেনের পরিবার জলপথে কাশির বারানসি তে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছিলেন। বাবার নাম ভুবন মোহন সেন, ডাক্তার ছিলেন। মা দয়াময়ী। ক্ষিতিমোহন সেনের সন্তান অমিতা সেন। ক্ষিতিমোহন সেনের  নাতি অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক অমর্ত্য সেন। ১৯০২ সালে কাশির কুইন্স কলেজ থেকে সংস্কৃত সাহিত্যে এম.এ পাস করেন। শাস্ত্রী উপাধিও লাভ করেন। ১৯৬০ সালে "চম্পা রাজ" এস্টেটের শিক্ষা সচিবের চাকরি পান। ১৯০৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে শান্তি নিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের অধ্যক্ষ হিসাবে যোগদানের জন্য ডেকে নেন। গবেষক শিক্ষাবিদ সেন ১২ই মার্চ ১৯৬০ সালে মারা যান।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ১৯২৪ এ চীন ভ্রমনের সহযাত্রী ও বিশ্বভারতীর বিদ্যাভবনের অধ্যক্ষ ক্ষিতিমোহন সেন প্রাবন্ধিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে পেরেছিলেন। সন্তদের বাণী, বাউল সংগীত এবং সাধন তত্ত্বের উপর সুপণ্ডিত ও গবেষক ছিলেন।
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ও ১৯১৪ সালে প্রকাশিত "One Hundred poems of Kabir"গ্রন্থটি ক্ষিতিমোহন সেনের সংগ্রহ অবলম্বনে রচিত। তার "হিন্দুইজম" গ্রন্থটি জার্মান ,ডাজ, ফরাসি ও বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ক্ষিতিমোহন সেনের প্রকাশিত গ্রন্থ গুলি হল-
  "কবীর" ১৯১১ ; "ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনা ধারা"১৯৩০ ; 
"ভারতের সংস্কৃতি" ১৯৪০ ; "বাংলার সাধনা"১৯৪৫ ; "যুগ গুরু রামমোহন" ১৯৪৫ ; "জাতিভেদ"১৯৪৬ ; "বাংলার বাউল"১৯৪৭ ;  "হিন্দু মুসলমানের যুক্ত সাধনা" ১৯৪৯ ; "যুগ গুরু রামমোহন"১৯৪৫ ;  "প্রাচীন ভারতের নারী"১৯৫০ ;"চিন্ময় বঙ্গ"১৯৫৭ ,"দাদু"; ও "বলাকা কাব্য পরিক্রমা"! তাঁর ইংরেজি ভাষায় রচিত"Medieval Mysticis of India". খুব জনপ্রিয় ছিল একসময়।
ক্ষিতীমোহন সেনের "দাদু" গ্রন্থের ভূমিকা বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন--
"ক্ষিতিমোহন বাবুর কল্যাণে ক্রমে হিন্দুস্থানের আরও কোনও কোনও সাধক কবির সঙ্গে আমার কিছু কিছু পরিচয় হল----------
ক্ষিতিমোহন বাবু ভার নিয়েছেন বাংলাদেশ'র সেই লুপ্ত স্রোতকে উদ্ধার করে আনবার"!
প্রাবন্ধিক ক্ষিতিমোহন সেন 'অখন্ড ভারতের সাধনা' প্রবন্ধে পরাধীন ভারতবর্ষে ইংরেজদের বিদ্বেষী মনোভাব অসাধারণ গল্পের ছলে চিত্রিত করেছেন---
   "এক এক জন মানুষ সারা জন্মই অন্য লোককে জ্বালাইয়া যায়, ছেলেবেলায় এইরকম "এক গ্রাম জ্বালানিয়া"র কথা শুনিয়াছিলাম । মরিবার সময় উপস্থিত হইলে তাহার মনে হইল, --- , ইহার পরে গ্রামের লোককে জ্বালাইয়া অতিষ্ঠ করিবে কে? এই ভাবিয়া সেই দুষ্ট মরিবার কোনমতে গ্রামের নিকটবর্তী বনে গেল। তখন বাঘেরা মানুষ খাইতে জানিত না। তাহারা অন্য জীবজন্তু ধরিয়া খাইত। সেই দুর্বৃত্ত গিয়া বাঘেদের বলিল, "তোমরা আমাকে খাও"! বাঘেরা বলিল, 'সে আবার কি কথা ? বাঘে আবার মানুষ খায় নাকি'! সেই গ্রাম - জ্বালানিয়া বলিল, কখন ও  তো খাও নাই , 'একবার খাইয়া দেখো'। বিস্মিত বাঘের দল মুমূর্ষু লোকের কথায় তাকে খাইয়া দেখিল, অপূর্ব স্বাদ মানুষের মাংসের । তখন তাহারা বলিল, 'চমৎকার মাংস তো, ইহার পর পাইলে আর মানুষকে ছাড়িব না"।
অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন আরো লিখেছেন --"ইংরাজ ও বিধাতার বিধানে বিদায় নিতে বাধ্য হইল । কিন্তু আগুন জ্বালাইয়া দিয়া সে গেল। স্বার্থ ,সংকীর্ণতা ,বিদ্বেষের বিষ বাঘের দর্শন হইতেও দারুণ।সেই বাঘ সে সৃষ্টি করিয়া গেল।  বিদায় লইয়াও সে এখনও  সেইসব বাঘের সহায়তা করিতে কসুর করিতেছে না"!
🍂

ক্ষিতিমোহন সেন সংস্কৃত, বাংলা ,ইংরেজি ,গুজরাটি রাজস্থানী , আরবি ও ফার্সি ভাষা জানতেনও বলতেন।
সাধু সন্ত বাংলার বাউল তার হরিহর আত্মা। তিনি বেদ উপনিষদ তন্ত্র ও স্মৃতিশাস্ত্রে বিস্ময়কর সুপন্ডিত। এ যেন প্রাবন্ধিক গবেষক ও সাহিত্যিককে "বিস্মৃতপ্রায়" বলা অনুচিত। তা সত্ত্বেও ক্ষিতিমোহন সেন সম্পর্কে আধুনিক প্রজন্মচিত্র প্রায় জানে না বললেই চলে ,তাই বিস্মৃতপ্রায় প্রাবন্ধিক হিসেবে গণ্য করলে যদি কিছু আধুনিক প্রজন্ম চিত্র জানতে পারে সেই আশায় এই আলোচনা।
অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন সম্পর্কে জনৈক্য সমালোচক জয় সাহা'র মন্তব্য প্রণধানযোগ্য-----
"হিন্দু মুসলমান সহ নানা জাতি, নানা ধর্মের যৌথ কর্ম সাধনার  তত্ত্বকে বাস্তবিক রূপদেন সংস্কৃতঞ্জ পন্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন"।
পরিশেষে দ্বিজেন্দ্রনাথ বলেছিলেন--
"এক নব রতন ক্ষিতিমোহন
ভক্তি রসের রসিক
কবীর কামধেনু করি দোহন
তোষণ তৃষিত পথিক "!

Post a Comment

0 Comments