শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ১০ / সালেহা খাতুন
আজন্ম ছোটোকাকার স্নেহধন্য আমি। আমার যখন ছমাস বয়স মায়ের সঙ্গে মামার বাড়িতে আছি, তখন আমাকে দেখতে গিয়ে মাকে ছাড়াই আমাকে কোলে নিয়ে ট্রেনে চেপে বাগনান থেকে বাউড়িয়ায় বাড়িতে নিয়ে আসেন। আমার কান্নাকাটি শুরু হতে আবার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসেন। আমার বিয়ের গহনা কেনা থেকে বিয়ের পর আমাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে আনা সমস্ত কাজেই ছোটোকাকা। আমাকে ছোটোবেলায় ঝাঁকড়ি বুড়ি বলে ডাকতেন। ১৯৮৪ এর ১০ আগস্ট ছোটোকাকার ছেলে সোহাগ জন্মাল। ওর দিদা ওকে বলতেন সোহাগ চাঁদ। সোহাগ আমাদেরও খুব আদরের। ও ভীষণ স্টাইলিস্ট। ওর বর্ণ পরিচয় হয় আমার মায়ের হাতে।আমার কোঁচকানো চুল সোজা করবে বলে একদিন সারাদিন আমার চুল টেনে ধরে বসেছিল।
বাবা আমাকে খুব একটা কারোর সঙ্গে ছাড়তেন না। দাদু, তিন কাকা আর খোকা দাদা এই লিস্টের বাইরে ছিলেন। ছোটোকাকা বাবাকে বললেন “মণিকে আমরা রাঁচিতে বেড়াতে নিয়ে যাবো”। বাবা অমত করেন নি। আমাদের এলাকার তাজমহল লাইব্রেরি থেকে বাস ছেড়েছিল সেবার। ফলে দীর্ঘ প্রায় সাতদিন ছিল এই বাস জার্নি। যাত্রাপথে প্রথম রাতে এক জায়গায় একটি গাড়ির দুর্ঘটনা ঘটে। জ্যাম হয়ে যায়। সেই রাতে হাইওয়ের উপর থাকতে হয়। বাসের তলায় বিছানা পেতে আমরা রাত্রি যাপন করি। আমাদের বাসের সামনে পেছনে অজস্র গাড়ি সার বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ে। রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। রাতের অন্ধকারে অন্য রাস্তার সন্ধানও পাওয়া যায় না। এখনকার মতো গুগলের সহায়তা নেবার উপায় ছিল না। বাসের তলায় শুয়ে শুয়ে ছোটোকাকাকে বলছি আমাদের ওপর দিয়ে বাসটা চলে যাবে না তো? ছোটোকাকা বারবার প্রবোধ দেয় “দূর বোকা এটাতো আমাদের বাস।সবাইকে নিয়ে তবে যাবে”।
যদি আমাদের কথা ভুলে যায় আর আমরা ঘুমিয়ে থাকি কিছুই তো জানতে পারবো না। এক একটা গাড়ি আসছে আর তার তীব্র জোরালো আলোতে কেঁপে কেঁপে উঠে আমি ছোটো কাকাকে আঁকড়ে ধরি। সোহাগ তো ভীষণ ছোটো। ভোর হতে ছোটো কাকিমা স্টোভ জ্বালিয়ে সোহাগের জন্য দুধ বানালো আর আমাদের জন্য ডিম সেদ্ধ। ব্রাশ করে খেয়ে দেয়ে সকাল নটার পর মাঠের উপর দিয়ে আমাদের বাস চলতে শুরু করলো, ভিন রাস্তার সন্ধানে। ছোট্ট শুকনো শরীরে তখন জঠরাগ্নি প্রবল। বড়োরা বুঝতে পারে না আমার কতটা খিদে। এই ভ্রমণে মাঝে মাঝেই আমি ক্ষুধার তাড়না অনুভব করেছি। বিশেষ করে আমি ভাত ছাড়া থাকতে পারিনা। বিভিন্ন বিয়ে বাড়িতে গিয়ে সকালে ভাত খাবো বলে মাকে বিব্রত করেছি। খাওয়ার কথা থাক বেড়ানোর কথায় ফিরি।
নেতারহাট পাহাড়ে যখন উঠছি ওই ছোট্ট বয়সে খাদের দিকে ভয়ে তাকাতে পারছি না। উপর থেকে নিচে রাস্তা দেখতে পাচ্ছি। সন্ধেতে পাহাড়ের উপর উঠে প্রচণ্ড শীত করতে লাগলো। সকাল সকাল উঠে পাইন এর ফুল কুড়োলাম। কুয়াশায়-মোড়া পাহাড় আচ্ছন্ন করে দিল আমায়। সেই আচ্ছন্নতা আজও কাটেনি। ছোটোবেলাকে ফিরে পেতে ২০১৭ সালে মেয়েকে নিয়ে রাঁচি নেতারহাটের সেই সব জায়গা ছুঁয়ে এসেছি। নেতারহাটের স্কুলটাকে ছোটোবেলায় যেমন ঝা চকচকে দেখেছিলাম এবার গিয়ে মাওবাদী কার্যক্রমের কারণে অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়তে দেখেছি।
ক্লাস সেভেনের আর একটা বড় প্রাপ্তি মেজো মামার বিয়ে। বিয়ে বাড়ি এলেই আত্মীয়-স্বজনের মান-অভিমান যেন পাল্লা দিয়ে বেড়ে যায়। সেবার মান করেছিলেন দাদুর ছোটো জামাই। ফলে বাবা ছাড়াই মায়ের সঙ্গে আমরা তিন ভাইবোন মামার বিয়েতে গেলাম। বড়োমাসি মেজোমাসি আর মা এবং আমরা সমস্ত কাজিনরা এক জায়গায় হলাম। খাটে মেঝেতে বিছানা পাতা হলো। গল্পে গল্পে রাত কাবার।
উলুবেড়িয়া থেকে ট্রেনে বাগনানে যাওয়ার সময় বড়োমেসোর পিকপকেট হয়ে গেল। ট্রেনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলেন। ফলে ডান হাত ছিল হ্যান্ড হোল্ডারে আর বাম হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছিলেন। বাম পকেটেই টাকা ছিল। পকেটমারের বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়। মেসোর মাথায় সজোরে টোকা দিল আর মেসো বাম হাত তুলে মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। ইতোমধ্যেই পকেট ফাঁকা হয়ে গেল। পরে ট্রেনে যখন নিত্য যাতায়াত করতাম পকেটমার ছিনতাইবাজদের কার্যকলাপ কত চোখে পড়েছে। নিজেও ভুগেছি কখনো কখনো।
যাক সে কথা। বিয়ে বাড়িতে ফেরা যাক। সকালে সেজেগুজে কাজিনরা সবাই মিলে হুল্লোড় করতে করতে মামার সঙ্গে বরযাত্রী হয়ে চললাম। সাঁকরাইল বা নলপুর থেকে সারেঙ্গার পথে বিখ্যাত ইটভাটার মালিক পরিবারের কন্যা মামিমা। রাজা কোম্পানি খুব বিখ্যাত তখন। খুব আদর আপ্যায়ন লাভ করে একেবারে সন্ধেতে ফিরে এলাম। পরের দিন সকালে পুকুরের বড়ো বড়ো মাছ ভাজা হতে লাগলো আর আমরা একটার পর একটা মাছ ভাজা খেতে লাগলাম। এরকম অফুরন্ত মাছ ভাজা আর কখনো খাইনি। একেই বলে মামার বাড়ির মজা।
শুধু বেড়ানো আর মজায় মেতে থাকলে হবে? স্কুলেও তো যেতে হবে। বন্ধু বান্ধবের সংখ্যা বাড়ছে। শঙ্করী সনকা অসীমা প্রশান্ত অরুণ রফিকুল আসলাম সন্দীপ হায়দার নাসিমবানু রিজিয়া অনেকে আমরা জোটবদ্ধ হচ্ছি। দিদিমণি আমাদের প্রেয়ারের জন্য গান নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন ---
“আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর ॥
মহিমা তব উদ্ভাসিত মহাগগনমাঝে,
বিশ্বজগত মণিভূষণ বেষ্টিত চরণে ॥
গ্রহতারক চন্দ্রতপন ব্যাকুল দ্রুত বেগে
করিছে পান, করিছে স্নান, অক্ষয় কিরণে ॥
ধরণী’পরে ঝরে নির্ঝর, মোহন মধু শোভা
ফুলপল্লব-গীতবন্ধ-সুন্দর-বরনে ॥
বহে জীবন রজনীদিন চিরনূতনধারা,
করুণা তব অবিশ্রাম জনমে মরণে ॥
স্নেহ প্রেম দয়া ভক্তি কোমল করে প্রাণ,
কত সান্ত্বন করো বর্ষণ সন্তাপহরণে ॥
জগতে তব কী মহোৎসব, বন্দন করে বিশ্ব
শ্রীসম্পদ ভূমাস্পদ নির্ভয়শরণে ॥“
বন্ধুরা মিলে গানের প্যারোডি বানিয়ে ফেললাম। আমাদের হেডমাস্টারমশাই বিশ্বনাথ কোলে এবং স্কুলের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম স্যার মাননীয় দিবাকার ধোলে এঁদের পদবী এবং বন্ধুদেরও কারো কারো কোলে ধোলে পদবী ছিল তাই যোগ করে গানটি রূপ ধারণ করল “আনন্দ কোলে মঙ্গলা ধোলে ....”
আসতে আসতে আমরা বড়ো হচ্ছি, কিছু এঁচড়ে পাকার তখন যদি প্রেম পেয়েও থাকে দিদিমণি তা সমূলে উৎপাটন করে দিতেন। স্কুলড্রেস পরে না গেলে কড়া শাস্তি দিতেন। এক দুদিন ছাড়ছিল স্কুল ড্রেসটি কাচার জন্য। বাউড়িয়া কটন মিলের আউটলেট থেকে পিস কিনে সাদা শার্ট ও নেভি ব্লু স্কার্ট বানিয়ে এনে দিতেন খোকা দাদা। ছোটোবেলায় ছমাস অন্তর ব্রংকাইটিসে ভুগতাম আর এদিকে ছমাস অন্তর হাফ ইয়ারলি ও অ্যানুয়াল পরীক্ষা। অ্যানুয়াল পরীক্ষা পুজোর ছুটির পর হতো। দম ধরে পড়াশোনা করতাম। কেননা বাৎসরিক পুরস্কারটা তো পেতে হবে। সেভেন থেকে এইটে উঠার সময় পেলাম মীর মশারফ হোসেনের “বিষাদ সিন্ধু”।
( ক্রমশ )
0 Comments