কালিম্পং ডায়েরি
পর্ব-৯
সুমিত্রা মাহাত
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বিগত দুদিন ধরে আকাশের মাঝে আমরা যে লাল-কমলা বস্তুটি কে দেখতে পাই তার হদিস পাই নি। তাই জামাকাপড় জলের সংস্পর্শে আনার দুঃসাহস দেখাই নি। কাল যেভাবে গোমড়া মুখ করে দিনটি শেষ হয়েছিল, আজ তার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। বৃষ্টি ধরেছে। তবে সমস্ত প্রকৃতি রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে। যেন হঠাৎ কিছু পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। সূর্য ছাড়া এখানকার মানুষ কীভাবে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয় জানিনা। ছেলেমেয়ের খেলা শেষ হয়ে গেছে কালকেই। আজ আমরা সারাদিন ঘুরতে পারব। কাল যাদের খেলা শেষ হয়নি তারা ভোর থেকে উঠে যথারীতি মাঠে চলে গেছে। আমাদের আজ কোন তাড়া নেই। গাড়ি ভাড়ার চাপ কমানোর আশায় আমরা দু-চারটা পরিবারের সঙ্গে দল বাঁধার চেষ্টা করি। নানান অজুহাত দেখিয়ে সকলেই কেটে পড়ে। হাজব্যন্ড কে আশ্বস্ত করি পার্টনার হিসেবে আমি নেহাত দুর্বল নই। আমকে নিয়ে একা ভ্রমণের দুঃসাহস সে দেখাতেই পারে। বিপদে পড়লে তখন দেখা যাবে।
একটা বিষয় লক্ষ্য করছি। যতদূর চোখ যায় চাষবাসের নাম গন্ধ নেই। রয়েছে পাহাড়ের গায়ে কিছু জংলী ফলের গাছ। মানুষের ঘরবাড়ির পাশে যতটুকু ফাঁকা জায়গা তাও বাহারী ফুলে ভরা। চাষবাসে এঁদের উৎসাহ নেই কেন?নাকি হয় না। হয়ত আমি পাহাড়ের যে পিঠে এসেছি সেদিকে চাষ হয় না অন্য পিঠে হয়। যাইহোক যে কোন ধরনের চাষবাসের আয়োজন কোথাও চোখে পড়ল না। সমতলেও মানুষের চাষবাসের ইচ্ছা ক্রমশ কমে আসছে। সত্যি কথা বলতে একজন চাষীকে আমরা আর কতটুকু অ্যাপ্রিসিয়েট করি ! বরং তুচ্ছ তাচ্ছিল্যই করি। হীনমন্যতায় সেও এই পেশা থেকে সরে আসতে চায়। ছেলেমেয়েকে বাবুয়ানি শিখিয়ে ভাবে এতেই সর্বোচ্চ সম্মান। একজন ভালো ডাক্তার যে কদর পান একজন ভালো চাষী তা পান না। অথচ চাষবাসের গুরুত্ব কিছু কম নয়। চাষবাস ছাড়া তো সমাজ সংসার অচল। আমরা যাই মুখে তুলি না কেন তা কেউ না কেউ ফলিয়েছে। তাই যেকজন মানুষ এই পেশার সঙ্গে যুক্ত, অন্যান্য প্রফেশনের মতো বিজ্ঞানসম্মত ভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে,আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার শিখিয়ে তাদের উৎসাহিত করা উচিত। তা না হলে চাষী চিরকাল গরীব ই থেকে যাবে। সমাজ যদি চাষীকে অ্যাপ্রিসিয়েট করতে না পারে তাহলে আমাদের একদিন না খেতে পেয়ে মরতে হবে। সমাজ ব্যবস্থা এমনই হওয়া উচিত যেখানে একজন চাষী লজ্জিত না হয়ে গর্ব করে বলতে পারবে আমি চাষ করি। যাইহোক আমার মতো সমতলের আনাড়ী চাষীর পাহাড়ি অঞ্চলে এসে ক্ষেত খুঁজে বেড়ানো টা ধৃষ্টতায় পরিণত হল।
🍂কোনো পরিবার কে সঙ্গে না পেয়ে আমরা চারমূর্তি পটাপট রেডি হয়ে নিই। একটা ছোট্ট গাড়ি ভাড়া করি। একদিনের প্যাকেজে ট্যুর এর ও নানারকম বৈচিত্র্য রয়েছে। কেউ চাইলে লাভা যেতে পারে,ঋষভ যেতে পারে,নাহলে আছে চটপটি লোকাল ট্যুর। শেষ অপশনে টিক পড়ল। বৃষ্টি আজ ধরেছে ঠিকই তবে আবহাওয়া বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। বৃষ্টির আশঙ্কায় ড্রাইভার ও ঋষভ,লাভা যেতে ঠিক রাজী নয়। তিনিও তৃতীয়
অপশনেই বিশেষ স্বচ্ছন্দ বোধ করলেন। আসলে বিকেলে লোকাল বাসে আমাদের শিলিগুড়ি নেমে যাওয়ার মতলব আছে। আমার আদরের একটি দেওর এখানে নিভৃতে সংসার পেতেছে। তাদের বাড়িতে পাতপেড়ে না খেয়ে আমি তো মোটেও বাড়ি ফিরছি না। তাদের সুখী গৃহকোণে একবার ঢুঁ মেরে যেতে চাই। দেখাযাক ভাগ্যে কি আছে!
ড্রাইভার লোকাল ট্যুর এর বলয়ে নটি বিন্দু স্পর্শ করার কথা জানান। অমায়িক ভদ্রলোক তিনি। অল্প সময়েই আমাদের একান্ত আপন হয়ে উঠলেন। তাঁর একছেলে পুলিশ আর এক ছেলে গাড়ি ব্যবসা দেখাশোনা করে। এই গাড়ি তাঁর নিজের। কালিম্পং এর মধ্যেই পাহাড়ের কোলে কোলে ঘুরে নটি জায়গা ঘুরে দেখব আমরা। এইসব ড্রাইভার পাহাড়ি ঢালু-খাড়া রাস্তায় ভীষণ চোস্ত। প্রতি মুহূর্তেই তার নমুনা দিতে থাকলেন। এমনকি তেল ভরতে গিয়েও গাড়ি খাড়াভাবে কাত হয়ে রইল। এখন মনে হচ্ছে একা এসেই বেশি লাভবান হয়েছি। নিজের বদগুণগুলো ইচ্ছেমতো প্রকাশ করতে পারছি। কোনো মনভোলানো ফুল দেখে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা কিংবা পাহাড়ি ধুতুরার ডাল ধরে টানাটানি করা। স্টেডিয়াম, বাজার , বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে গাড়ি সোজা উপরে উঠতে থাকে। একজায়গাতে এসে দাঁড়ায়। বামদিকে সুবিস্তৃত গলফ খেলার মাঠ। নকশা করা একটুকরো সবুজ রুমালের মতো। গলফ এর মাঠ দেখার সৌভাগ্য ইতিপূর্বে হয়নি। আমরা সমতলের সামান্য চাষাভুষা মানুষ, গলফ খেলা আমাদের কাছে বিলাসিতা। সদলবলে হামলে পড়ে গলফ মাঠের জ্যামিতিক নকশা বোঝার চেষ্টা করি। উল্টোদিকে মর্গ্যান হাউস। ভুতুড়ে বদনাম থাকলেও মানুষ ছাড়ছে কোথায়। আগাম বুকিং করে এসে দিব্যি রাত্রি কাটাচ্ছে এখানে। বুকিং করা না থাকলে ভেতরে ঢোকা যাবে না। একসময় মর্গ্যান সাহেব তাঁর স্ত্রীর জন্য বানিয়েছিলেন এই বন বাংলো। দূর থেকেই অনুধাবন করার চেষ্টা করি,নরম মেঘ ও রহস্যময় পাহাড়ের কোলে রোমান্টিক মর্গ্যান সাহেব ও তাঁর সুন্দরী স্ত্রীর কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলি। মাটিতে কান পাতলেই যেন তাদের হৃদয়ের স্পন্দন শোনা যায়। স্ত্রীর মৃত্যুর পর সাহেব এ বাড়ি ছেড়ে চলে যান। আর তখন থেকেই হন্টেড হাউসের কনসেপ্ট চালু হয়েছে। সে আজ বহুবছর আগেকার কথা। আশি-নব্বই বছর আগে পাহাড়ের এত ওপরে বিল্ডিং মেটেরিয়াল সংগ্রহ করে সৌখিন সাহেব স্ত্রী কে এত সুন্দর বন বাংলো উপহার দিয়েছিলেন কীভাবে তা আশ্চর্যের বিষয়। তাঁর অকৃত্রিম প্রেম তো অস্বীকার করা যায় না। সেই সঙ্গে একটা বিষয় ভেবেও আশ্চর্য হয়েছি ভারতবর্ষের সমস্ত সুন্দর জিনিসের ই শেষ বিন্দু পর্যন্ত নিংড়ে উপভোগ করেছে ইংরেজরা। সমতল, পাহাড়, নদী,সমুদ্র সর্বত্র দাপিয়ে বেড়িয়েছে তারা। কি সাহস!
মর্গ্যান হাউসের ভেতরে ঢুকতে না পেরে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে গাড়িতে এসে বসলাম। গাড়ি ছুটে চলল। সোজা উপরে উঠছে আবার গড়গড়িয়ে নীচে নামছে। এবার গাড়ি একটি বৌদ্ধ মন্দিরে প্রবেশ করল। সুন্দর সাজানো গোছানো। মন্দির খোলা। প্রার্থনা , পড়াশোনা চলছে। গুরু মাঝে বসে,দুদিকে সারি দিয়ে শিষ্যরা বসে রয়েছে। শিষ্যদের সামনে বই অথবা খাতা কিছু একটা খোলা। প্রার্থনা র ফাঁকে ফাঁকে বাদ্যযন্ত্রে আওয়াজ তুলছে তারা। অদ্ভূত এক সংগীতের আবহ তৈরি হয়েছে। আমিই সকলের ছবি তুলছি তাই বাদ পড়ছি। একটি স্থানীয় পরিবার কে পেয়ে , ইশারায় যোগাযোগ করে,অনেক কষ্টে একটিমাত্র ফুল ফ্রেম পাই। দেওয়ালের গায়ে একহাত মতো লম্বা গোলাকার ধাতব কারুকার্য খচিত বস্তু সারি দিয়ে মন্দিরের চারপাশে লাগানো রয়েছে। সেগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আর দেওয়ালের গায়ে মাথাকুটে শত শত প্রার্থনা করি। জগতের মঙ্গল কামনা করি। দেওয়ালের গায়ে ঘুরন্ত বস্তুগুলি থেকে উৎপন্ন শব্দ, মন্দিরের ভেতর গুরু-শিষ্যের মন্ত্রোচ্চারণ ধ্বনির সঙ্গে মিলিত হয়ে মনে আধ্যাত্মিক ভাবের উদয় ঘটায়। এই পরিবেশ আমার কাছে একেবারেই নতুন। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের দিকে তাকালেই এক অদ্ভূত বৈরাগ্য মনকে গ্রাস করে। সমস্ত কিছু ত্যাগ করে , একটুকরো গেরুয়া কাপড় শরীরে জড়িয়ে এনারা পৃথিবীর সর্বোচ্চ আনন্দ লাভ করছেন। আর সমস্ত কিছুর মাঝে থেকেও আমাদের মনে কত হতাশা। স্বর্গীয় ভাবাবেগে বিভোর হয়ে পুনরায় এগিয়ে চলি। গন্তব্য ডেলো পার্ক। রাস্তার নামল অঝোরে বর্ষা। পিছল রাস্তায় গাড়ির অবাধ গতি দেখে বুক দুরুদুরু করতে থাকে। ডেলো পার্ক যাওয়ার পথে রাস্তার দুধারে পাহাড়ের ওপর থেকে নীচ ফুটে রয়েছে গোলাপী রং এর রেইন লিলি। বেশ বড়ো সাইজের। কোথাও স্ট্রবেরী,ব্ল্যাক বেরী। আপনা আপনিই জন্মে বেড়ে উঠে , প্রকৃতির শোভা বর্ধন করছে। মাঝে মধ্যেই দু-একটা বাড়ি,খুচ্-খাচ্ দোকান চোখে পড়ছে। বাড়িগুলোর উঠোনে ফুলের গালিচা পাতা। দেখে তো নার্সারি মনে হচ্ছে। গাড়ির ড্রাইভার ভুল ভাঙ্গান। ডেলো পার্ক পর্যন্ত এমন বৃষ্টি পড়ছে মন খারাপ হয়ে যায়। আজ ছুটির দিন। পার্কের বাইরে গাড়ির লাইন পড়ে গেছে। পার্কিং এর যথেষ্ট অসুবিধা। আমাদের ড্রাইভার বেশ অভিজ্ঞ। অন্যান্যদের ডিরেকশন দিয়ে সুকৌশলে গাড়ি পার্ক করে নেন। গেটের পাশে একটা ছোট্ট হোটেলের পাশে গাড়ি থামান। লাঞ্চ সেরে নিতে বলেন। আর সময় হবে না বা দোকানপাট তেমন পাওয়া যাবে না। হোটেলে ঢুকে দেখি খাবার শেষ। অপেক্ষা করতে হবে। পাহাড়ি মাঝবয়সী মহিলা হোটেল সামলাচ্ছেন । একটা ছোট কাঠের বাড়ি তার এককোণে রান্না বাকীটা তে খাওয়ার ব্যবস্থা। একটি টেবিলে গিয়ে আমরা অপেক্ষা করি। তার উল্টোদিকে মহিলার দুই গুণধর পুত্র মোবাইল গেমিং এ ব্যস্ত। এখানে এসেও এই দৃশ্য দেখতে হবে ভাবিনি। রাইস কুকারে ভাত হচ্ছে। ততক্ষণ আমরা একপ্লেট মোমো খেতে থাকি।
0 Comments