যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ৭৯
আজ অধ্যাপক ইয়াসিন খান ফোন করেছিল। কয়াকদিন আগে দুজনে আলোচনা করছিলাম, পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম লেখিকাদের নিয়ে একটা গ্রন্থ প্রকাশ করলে কেমন হয়।প্রস্তাবটা আমার ছিল। ও সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে বলে, গ্রন্থটি আমাদের দুজনের সম্পাদনায় হবে। আজ সেই কারণেই ফোন করেছিল। হাতে যে লেখাটা আছে, সেটা শেষ করে লেখক খোঁজা শুরু করব।
রাতে প্রতিবেশী রফিক সাহেবের মেয়ে রাইনের বিয়ে ছিল। সবই ভাল ,হাইট খুবই কম বলে কেউ পছন্দ করছিল না। ভদ্রলকের অগাধ সম্পত্তি, দুটি মেয়ে। বড়লোকের মেয়ে, একটু দেমাকি। স্ত্রী হিন্দু বলেও অনেকে আত্মীয়তা করতে রাজি হয়নি। আজও এসব নিয়ে মানুষ মাথা ঘামায়! এই ছেলেটি রাইনের সঙ্গেই কাজ করে, ইকবালপুরে বাড়ি। ছেলে দেখতে সুন্দর, তবে ওসামা বিন লাদেনের মত দাড়ি। এটাতেই এঁদের আপত্তি ছিল। এদিকে মেয়ের বয়স কবে ৩০ পেরিয়ে গেছে। তাই সবদিক ভেবে, চিন্তে মেয়ের পছন্দ করা পাত্রের সঙ্গেই বিয়ে দিচ্ছেন। বাড়িতেই প্যান্ডেল করেছেন। কিন্তু খাওয়ার আয়োজন ভাল ছিল না। শেষে খাবার নিয়ে ঝামেলাও হয়েছে। এগুলো কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, ওরা নিজেরা মানিয়ে চলতে পারলেই হল।
সকালে খান সাহেবকে ডায়ালিসিসে নিয়ে গেছলাম। দুপুরে দীপ ফোন করেছিল, অনেক কথা হল। বিকেলে ‘বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠ থেকে দুজন ম্যাডাম এসে কার্ড দিয়ে গেলেন, ওঁদের স্কুলে তিনদিন ধরে এগজিবিশন, সেমিনার আছে। অনেক করে যেতে বলে গেছেন। কিন্তু যেতে পারব বলে মনে হয় না। বিয়েবাড়ি আছে, শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে এই টুকুই তো যোগাযোগ, বিয়েবাড়ি আর মৃত্যুবাড়ি।
রোজ ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। এরকম হলে গ্রামের বিয়েবাড়িতে যাওয়া যাবে না। শেষপর্যন্ত যাওয়া হলই না। বৃষ্টির জন্য নয়, ড্রাইভার আসেনি। রাজু প্রায় এরকম করে। দূরের ভাড়া পেয়ে গেলে কথা দিয়েও ডুব মেরে দেয়। অন্য ড্রাইভার পেলাম না। তাই স্কুলের অনুষ্ঠানেই গেলাম।
🍂 আজ(২১ মার্চ) কবিতা দিবস। বিজয় পাল অনেক আগে থেকে বলে রেখেছেন, কার্ডও পাঠিয়েছেন। বিকেল ৫টার সময় চন্দ্রিমাকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে পঞ্চুর চকে গেলাম। তখন সবে পদযাত্রা শুরু হয়েছে, অভিনন্দন আমাকে একেবারে সামনে নিয়ে গিয়ে বলল, দিদি আপনি সামনে দাঁড়ান। কবি আরণ্যক বসু আমাকে দেখে আমার হাত ধরে মাথা নিচু করে শ্রদ্ধা জানালেন। প্রশংসা করলেন সংবাদপত্রে লেখা আমার আর্টিকেলের, বললেন, আপনি মেদিনীপুরের গর্ব, মেদিনীপুরের মাটি ধন্য, আপনাদের মত মানুষ এই মাটিতে জন্মেছেন বলে। পাশ থেকে প্রদীপ ঘোষ বললেন, উনি প্রচুর কাজ করেন, পেপার খুললেই ওনার নাম। এসব শুনে আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। আমি নিজে তো জানি আমি কী?
এখান থেকে মেদিনীপুর কলেজে গেলাম। আমাকে দেখতে পেয়ে বিমলদা (মেডিক্যাল অফিসার বিমল গুড়িয়া) একেবারে সামনের সারিতে বসালেন। স্মারক প্রদান করলাম, কবিতা পাঠও করলাম।বিমলদা পিছন থেকে বললেন, কবিতা খুবভাল হয়েছে।সুতপা(শিক্ষি্কা), ফিল্ম মেকার পার্থ বলল, এই বয়সে এমন কবিতা!ভাবা যায় না।
সেদিন দোলের ছুটি ছিল, রেহেমানের সঙ্গে কথা হল, বলল, ওর শ্যালক এ মাসেই ছুটি নিয়ে মেয়ে দেখতে আসবে। পছন্দ হলে তাড়াতাড়ি বিয়ে সেরে নেবে। রেহেমান আমার পূর্ব পরিচিত, বিয়ের যোগাযোগ হয়েছে বিজ্ঞাপন দেখে। ও রানীর সঙ্গেও কথা বলল, ওর খুব ভাল লেগেছে। দেখা যাক, মেয়েটার কপালে কী আছে।
বিকেলে ব্লাইণ্ড স্কুলে গেছলাম, আমি আর চন্দ্রিমা। ছাত্রদের জন্য খাতা-পেন, পেনসিল, কেক, বিস্কুট লাড্ডু নিয়ে গেছলাম, এরা দুস্থ পরিবারের ছেলে, তবে অন্ধ নয়, অন্ধদের জন্যই জনৈক আইনজীবী এই স্কুলটি তৈরি করেছিলেন। তাঁর অকালমৃত্যু ঘটলে তাঁর স্ত্রী এই স্কুলটির ভার নিজের কাঁধে তুলে নেন। তারপর কাঁসাই নদীতে বহু জল গড়িয়েছে। বর্তমানে সরকার থেকে এই বাচ্চাগুলিকে দেওয়া হয়। নিয়ম মেনে এরা ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত এখানে থাকতে পারে। এভাবেই স্কুলটি চলছে। আমাদের মত অনেকেই আসেন এই বাচ্চাদের সংগ দিতে।
সেদিন রাত ১১টার দিকে হঠাৎ খান সাহেবের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। আমাকে এ্যাম্বুলেন্স ডাকতে নিষেধ করলেন, নার্সিংহোমে যাবেন না। কষ্ট বাড়তে টোটো ডাকতে বললেল। ময়না, যে আমাদের নার্সিংহোমে নিয়ে যায়, তাকে ফোন করলাম। এতরাতে সে যেতে রাজি হল না। এ্যাম্বুলেন্স ডাকব ভাবছি, হঠাৎ পাশের বাড়ির নাজিমকে দেখতে পেলাম, ওকে বলতে, আমাদের স্পন্দনে পৌঁছে দিল। ওরা সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেন দিল, ব্লাড নিল টেস্টের জন্য। তারপর আই সি ইউ তে ভর্তি করে সারারাত নীচে বসে রইলাম। কয়েকজন পেশেন্টের বাড়ির লোক ঘুমিয়ে আছে। হয়ত দূরের কোন গ্রাম থেকে এসেছেন। আর কয়েকজন ওয়ার্ডবয়, সিকিউরিটি গার্ড ঘোরাঘুরি করছে। এখানেই একটা চেয়ারে বসে রইলাম। আমাকে বাড়ি চলে যেতে বলা হয়েছিল, আমি বললাম ওনাকে এই অবস্থায় রেখে যেতে পারব না। চন্দ্রিমা ছাড়া কাউকে খবর দিইনি। বসে থাকতে থাকতে ভোর হয়ে গেল। খবর নিয়েছি, উনি ঠিক আছেন। এই সময় একজনকে মেসেজ করে আমার অবস্থা জানালাম। সকাল হতে না হতেই ছেলেরা ২/১ জন করে প্রায় ১০/১২জন এসে হাজির। ওদের সঙ্গে সঙ্গে জানাইনি বলে ওরা রাগ অভিমান করে বলতে লাগল, আপনি একা কেন নার্সিংহোমে রাত কাটালেন? আমাদের কেন খবর দিলেন না? এখন ডাক্তার বললেন আগামিকাল রিলিজ করে দেবেন, তবে এবার থেকে সপ্তাহে তিনবার ডায়ালিসিস করাতে হবে। বাড়ি নিয়ে আসার পর অনেকেই দেখতে আসছেন।
শুধু ওনাকে দেখা নয়, সাংসারিক সব কাজই তো করতে হচ্ছে। কে করবে না হলে? সকালের জলখাবার, দুপুরের রান্না করে স্নান করলাম। তারপর ব্যাঙ্কে গেলাম।প্রথমে BGVB ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকা তুললাম। তারপর গেলাম SBI ব্যাঙ্কে। লাইন দিয়ে নতুন পাশবুক নিলাম। বাড়ি ফিরে সবাইকে খেতে দিলাম, নিজেও খেলাম। আমার দৈনন্দিন জীবনটা এভাবেই কাটছে। হয় নার্সিংহমে, নয় ব্যাঙ্কে, বাজারে, হাসপাতালেও যেতে হচ্ছে, সেইসঙ্গে বাড়ির কাজ তো আছেই।
আজ ডায়ালিসিসের পর ওনাকে আইরন ইঞ্জেকসন দিতে হল। এটা এখন চলবে। নিজের শরীরও মাঝে মাঝে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। অসুস্থ বোধ করছি, কিন্তু উপায় নেই। এই কঠিন পরীক্ষায় আমাকে উত্তীর্ণ হতেই হবে।
আজ আমাদের জারা সোনার জন্মদিন। এখানের থেকে প্রায় ৫ঘণ্টা দেরিতে ওদের দিন শুরু হয় বলে ওকে ভালবাসা ও আদর জানাতে দেরি হল। ওরা সবাই ভাল থাকুক, সুস্থ থাকুক, এই কামনা সবসময়ই করি। আজ স্কুল আছে, তাই সামনের শনিবার বার্থডে পার্টি হবে। সুহানার খুব মনখারাপ, ওকে হস্টেলে চলে যেতে বলেছি বলে। আজ ওকে বুঝিয়ে বললাম, কেন ওকে হস্টেলে যেতে বলেছি। আমারও কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু উপায় নেই। এই রকম একজন অসুস্থ মানুষকে নিয়ে আমার কীভাবে দিন কাটছে, তা এদের বাবা মা বুঝেও বোঝে না। আমি এতদিন তো অনেক বোঝা বয়েছি, এখন আর সম্ভব নয়। ছোটভাই আমার কাছে থেকে কলেজ পাশ করেছে, বোনঝি করতে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে আমি কী করে পারব? ওর বাবা মা যা খুশি ভাবতে পারে, আমি নিরুপায়। ছোটভাইয়ের কাছে রাখতে পারে, কিন্তু সেটা বলবে না। কারণ ওরা রাখবে না।
আজ একটু বের হতে হবে। মেদিনীপুর কুইজ কেন্দ্র তলকুয়ে অরিন্দমের স্কুলে একটি ‘হেলথক্যাম্প’ এর আয়োজন করেছে। ৫জন ডাক্তার আসবেন। তার মধ্যে একজন স্বপ্নার স্বামী মাইতি বাবু। ওখানে গিয়ে খুব একটা ভাল লাগল না। সবই হল, দুপুরের খাওয়াও হল। এরপরেই আমি চলে এসেছি। যেখানে যাই,যা করি মন পড়ে থাকে বাড়িতে, উনি কেমন আছেন? কি করছেন? শরীর ঠিক আছে তো? জীবনে কোনও আনন্দ নেই।
ছোটবেলার কথা খুব মনে পড়ে। সংসারে অভাব ছিল,তবুও আনন্দ ছিল,সবাই কত খুশি ছিলাম। ছোট বেলায় অভাব কাকে বলে বুঝতাম না।পরে বুঝেছি মা কত কষ্ট করে সংসার চালাতেন। খাওয়া পরার কষ্ট ছিল না। কিন্তু ৬৯/৭০ সালের দিকে সংসারে বেশ অভাব দেখা দিল। দাদা স্কুলের মাইনের জন্য মা কানের টাপ খুলে বাবার হাতে দিয়েছেন বিক্রি করতে দিয়ে বলেছিলেন, আমার সোনা পরে কি হবে?ছেলে মেয়েরা মানুষ হলে ওরাই মুখ উজ্জ্বল করবে। আমাদের চোখের আড়ালে এক এক করে বিক্রি হয়েগেছে সমস্ত কাঁসা-পিতলের বাসন। ঘরের চাল ফুটো হয়ে ঘরের মেঝেতে বৃষ্টির জল পড়ত। মা যত বালতি হাঁড়ি সেখানে পেতে রাখতেন। তবুও এই বর্ষায় উঠোন জুড়ে যখন সন্ধ্যাবেলা হলুদ রঙের ঝিঙ্গেফুল ফুটত। মন জুড়িয়ে যেত। ঝম ঝম বৃষ্টিতে মা খিচুড়ি রান্না করতেন, ডিমের অমলেট দিয়ে খাওয়া হত। ডিম কিনতে হত না। মায়ের অনেক হাঁস ছিল। মা বাবার পুরনো ধুতি মেদিনীপুর থেকে ছাপিয়ে এনে পরেছেন। মেজদা তখন মেদিনীপুরের কে ডি কলেজে রাতে পড়ত। সেজকাকা সমবায় দপ্তরের বড় অফিসার ছিলেন, পড়ার খরচের জন্য কোয়াপারেটিভ কঞ্জুমার স্টোরে ম্যানেজারের পোস্টে মেজদাকে বহাল করে দেন। দিনে কাজ আর রাতে ডিউটি। এতে অনেকটা অভাব নিয়ন্ত্রণে আসে। তবুও আমরা অনেক হাসিখুসি ও সুখি ছিলাম।
রেহেমান ফোন করে জানিয়েছে ১৫ এপ্রিল(১লা বৈশাখ)ওরা রানীকে দেখতে আসবে। আরও জানিয়েছে, সকালের দিকে এসে শুধু চা মিষ্টি খেয়ে মেয়ে দেখে ফিরে যাবে। তবুও আমরা লাঞ্চের ব্যবস্থা রাখলাম। রেহেমান, ওর শ্যালক (পাত্র), আর ওর শ্বশুর শাশুড়ি ১০ টার দিকে এসে পৌঁছালেন। ছেলের বাবা রানীর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললেন। ছেলের বাবা-মা রানীর বাবা মায়ের খোঁজ করছিলেন। ফিরে গিয়ে ওরা জানাল, মেয়ের মা কেন ছিলেন না? তাই পাত্রের আপত্তি। আমার এটা যুক্তিগ্রাহ্য কারণ বলে মনে হল না।
(ক্রমশ)
0 Comments