মলয় রায় চৌধুরী
ঢাকার সম্পাদককে আমার লেখা ছাপতে বারণ করেন কলকাতার কবিরা।
ঢাকা থেকে মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা নামে একটা পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হতো। মীজানুর রহমান আমাকে বললেন হাংরি আন্দোলন নিয়ে লিখতে। লিখেছিলুম ১৯৮৬ সালে।
ওনার কথাই তুলে দিচ্ছি এখানে —-
ষোলো বছরের গাঁটছড়া ।
এই গাঁটছড়ার পুরোহিত শিবনারায়ণ বাবুর 'জিজ্ঞাসা'-এর ১৯৮৫ কি ১৯৮৬ এর কোনও এক সংখ্যায় 'হাংরি জেনারেশন' মানে 'ক্ষুৎকাতর আন্দোলনের' ওপর একটা লেখা বেরিয়েছিল । পড়তে-পড়তে ষাটের দশকের দোরগোড়ায় চলে গেলুম । মাঝেমধ্যেই কলকাতার কতিপয় ক্ষিপ্ত যুবকের তীব্র ক্ষিধের খবর ঢাকয় এসে পৌঁছোত । সবকিছু তছনছ করে দেয়ার, শেকড় উপড়ে ফেলার মোচ্ছব । ওরা মনে করত ঘেয়ো সমাজটার সঙ্গে তাদের দুতিন হাজার বছরের জেনারেশন গ্যাপ, কাজেই ঘা দাও বিংশ শতাব্দীর পাতে বসা ঘেয়ো এই রেয়ো ভাটদের, র্যাঁদা বুলিয়ে দাও -- চৈতন ফক্কাদের বুঝিয়ে দাও চুচকো নই আমরা, আমরা সবকিছু "ভেঙে তছনছ করে দিয়ে যাবো/শিল্পের জন্যে সক্কোলকে ভেঙে খান-খান করে দেবো।"
তখন, আমাদের ওই যুবাকালে 'হাংরি জেনারেশন' সম্বন্ধে জানবার বুঝবার ভারি আগ্রহ হয়েছিল । এ যে দেখছি সেই প্লেটোর নীতিবাগিশের দল, যাঁরা মনে করতেন --- যে-মানুষ ইন্দ্রিয়সুখ অন্বেষণ করে না, সে অবশ্যি সমস্ত সুখ এড়িয়ে চলে । কিংবা এভাবে বলা চলে -- একজন মানুষের জীবনযাপনের কোনও অর্থই হয় না, যার কোনও সুখানুভূত নেই এবং শারীরিক সুখে যার কোনও অংশগ্রহণ নেই ।
কিন্তু উড়ুক্কু খবর, চই চইয়ে কাজ দেয় না । কিছু ছিটেফোঁটা ছাড়া জানা যায় না ওরা কী লিখছে বা ভাবছে বা করছে ।শুধু জানলুম তারাশঙ্কর, আবু সয়ীদ আইয়ুবসহ তাবৎ কবি সাহিত্যিক এবং তা বড় সব কাগজগুলা ও গোটা এসট্যাবলিশমেন্ট এসব ত্যাঁদোড়দের খুব করে ডেঁটে দিয়েও যখন ঢিট করতে পারলে না, তখন এক বগ্গামলয়কে পুরে দিলে জেলে । যাদের ছোট ভেবে কাজটা করলে তারা কিন্তু আর ছোট রইল না --- খবরটা মস্ত হয়ে গেল যখন মার্কিন মুলুকের 'টাইম' হাতে এল, India বিভাগে The Hungry Generation শিরোনামে । চমকে উঠলাম ।
🍂টাইমের লেখনীতে ভারতে পত্রিকার প্রতিনিধি লুই ক্রার যখন 'হাংরি জেনারেশন' -এর পরিচয় দিতে গিয়ে লেখেন : Born in 1962, with an inspirational assist from visiting US Beatnik Allen Ginsberg, Calcutta's Hungry Generation is a growing band of young Bengali with tiger in their tanks. Somewhat unoriginally they insist that only in immediate physical pleasure do they find any meaning in life and they blame modern society for their emptiness...' তখন, আমাদের ওই যুবাকালে 'হাংরি জেনারেশন' সম্বন্ধে জানবার বুঝবার ভারি আগ্রহ হয়েছিল । এ যে দেখছি সেই প্লেটোর নীতিবাগিশের দল, যাঁরা মনে করতেন --- যে-মানুষ ইন্দ্রিয়সুখ অন্বেষণ করে না, সে অবশ্যি সমস্ত সুখ এড়িয়ে চলে । কিংবা এভাবে বলা চলে -- একজন মানুষের জীবনযাপনের কোনও অর্থই হয় না, যার কোনও সুখানুভূত নেই এবং শারীরিক সুখে যার কোনও অংশগ্রহণ নেই ।
কন্তু জানবার আগ্রহ থাকলেই বা, তখন পাকিস্তান আমল -- খবরের কাগজে খবর হতে পারে ওই 'সর্বনেশে ক্ষুৎকাতরদের' কথা । 'যোনিকেশরে কাচের টুকরোর মতো ঘামের সুস্হতা' বিষয়ে ঢাকা তখনও প্রস্তুত ছিল না । আমরা জানতে পারিনি মলয়ের দুঃসাহসী সব কবিতার কথা, হারাধন ধাড়া তথা দেবী রায়, সুবিমল বসাক, ফালগুনী রায়, ত্রিদিব মিত্র, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত এবং সর্বোপরি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ -- এই সব সারি সারি উজ্জ্বল নক্ষত্রের আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তির কথা । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বিশ্বাসঘাতকতার কথা । উৎপলের হৈচৈ ফেলা 'পোপের সমাধি'-ও পড়া হয়নি আমাদের । পড়া হয়নি 'হাংরি বুলেটিন', 'জেব্রা' প্রভৃতি অসংখ্য ছোটো জেদি কাগজ । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ক্ষুৎকাতর মলয় রায়চৌধুরীকে তাঁর কর্মকাণ্ড দেখে 'মনে হয় খুব একটা সর্টকাট খ্যাতি পাবার লোভ তোমার' -- এ ধরনের যে মন্তব্য করেছিলেন, তার খবরও রাখিনে । অ্যালেন গিন্সবার্গ মলয়ের হয়ে যে চিঠি লিখেছিলেন, তাতে জ্যোতি দত্ত, খুশবন্ত সিং প্রমুখ সাহায্যের হাত বাড়ালেও আবু সয়ীদ চটে গিয়ে চিঠিতে জানালেন : I do not agree with you that it is the prime task of the Indian Committee for Cultural Freedom to take up the cause of these immature imitators of American Beatnik Poetry'-- এ সবও কি জানতুম আমরা ? হঠাৎ করেই 'জিজ্ঞাসা'র প্রবন্ধটি পড়ে যোগাযোগ করলুম ওঁর লখনউ-এর ঠিকানায় । আর্জি ছিল একটা লেখা দেবার, মানে সুন্দরীভবনে জমাপড়া মহাফেজখানা থেকে ধুলো ঝেড়ে ছয়ের দশকে যা আঘাত দিয়েছিল সমাজকে, বহু কিছু পালটে যাওয়ার পর আজকের নিরিখে যা ডালভাত, সেই ঝড়ো দিনগুলোর একটা পূর্ণাঙ্গ হিসেব-নিকেশের আর্জি আর কি ।
প্রথমে রাজি হননি । ভবি ভুলবার নয় । বোঝালুম, একটা ডাকাবুকো আন্দোলনের ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ধোঁয়াটে হয়ে থাকবে, এটা ভাবা যায় না। একটা সময় আসবে যখন ডিঙি মেরেও ওপাশটার কিছু আঁচ করা যাবে না । কাজেই, সব কিছু গোড়া থেকে শেষ অব্দি, ঢাকের বাঁয়া সমেত চাই যে । জবাবে মলয় জানালেন, এক কিস্তি গেল, যদি পছন্দ হয়, তাহলে পরের কিস্তিতে হাত দেব । এসে গেল পাণ্ডুলিপি। ফুলস্কেপ সাইজে রুলটানা কাগজে মুক্তোর হরফে কোনও কাটাছাঁটা নেই --- নদীর মতো অবিরল । আর ভাষার শরীরে সেকালের, সেই ক্ষুধিত কালের কোকেন এলএসডি মারিহুয়ানা চরস খাওয়া চেহারাটা কিনা জ্বলজ্বল করছে । ধারালো গতিময় শব্দের কী তেজ। খুব ভাল লাগল । আমার কাগজের এপ্রিল-জুন (১৯৮৬) সংখ্যায় ছাপা হতেই খুব হৈচৈ পড়ে গেল । 'কিংবদন্তি' পড়ে শক্তি-তারাপদ-সুনীল খুব চটেছেন -- কলকাতা থেকে এমন উড়ো খবর পাচ্ছিলাম । বোধ করি আমার প্রতি সদয় হওয়া সত্ত্বেও, আমারই কাগজে তাঁদের ওপর বিরূপ লেখাজোখা বেরোচ্ছে, এই বিবেচনায় আমার ওপর খাপ্পা হয়ে থাকবেন । আমার কবি বন্ধুবান্ধবদের দিয়ে (শামসুর রাহমান), যাতে 'হাংরি কিংবদন্তি' প্রকাশনা বন্ধ রাখা হয় এমন পরোক্ষ অনুরোধও আসে ওঁদের তরফ থেকে । এ প্রসঙ্গে আমার কাগজের ৪র্থ বর্ষ ২য় সংখ্যা, ১৯৮৬তে 'হাংরি কিংবদন্তি' শিরোনামে সম্পাদকের কড়চায় লিখলুম:
"স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মলয়বাবু তাঁর লেখায় যে অবাধ স্বাধীনতা গ্রহণ করেছেন তাতে আমি ইচ্ছে করেই কলম চালাইনি । কোনও লেখকের রচনায় অনাহুত প্রবেশ কাম্য নয় । এই স্মৃতিচারণায় অনেকের প্রতি কটাক্ষ আছে, কটুক্তি আছে, মর্মঘাতী ভাষাতেই আছে, ভবিষ্যতেও হয়তো থাকবে । এঁদের মধ্যে আছেন লব্ধপ্রতিষ্ঠ কবি ও সাহিত্যিক । এঁদের মধ্যে কেউ কেউ বন্ধু না হতে পারেন, ব্যক্তিগতভাবে আমার পরিচত বটে। সকলেই আমার শুভানুধ্যায়ী, আমি নিজেও গুণমুগ্ধ তাঁদের । আঘাত দেয়া যেমন আমার স্বভাব নয়, আঘাত পাওয়াটাও কাম্য নয় । হাংরি কিংবদন্তি' সম্পর্কে কিছু বলার পূর্ণ অধিকার তো তাঁদের থাকলই । তাঁরাও বলবেন তাঁদের কথা, তাঁদের মতো করেই । মাঝে তাঁরা যদি আমায় ভুল না বোঝেন তাহলেই আমি খুশি ।"
0 Comments