সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ৪
গৌতম বাড়ই
বসন্তসেনার ঘুম যখন ভাঙ্গলো, উঠে দেখল তার বাবা স্কুলে পড়াতে বেরিয়ে গিয়েছে। আজ তার অবশ্য
অফিস নেই। রান্নার মাসির হাতা- খুন্তির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে রান্নাঘর থেকে। বিভোর হয়ে ঘুমোচ্ছিল সে, হয়ত বাবা সেজন্য তাকে ডেকে ঘুম ভাঙ্গাতে চায়নি। বাবা তো জানে ভালোমতন, একদম শেষ রাতে সে বিছানায় ঘুমোতে গিয়েছিল। তার মা চলে যাবার পর , সুশোভনবাবু যেন মেয়েকে এখন আরো শক্ত করে বুকের মধ্যে আগলে রাখে। একদম একচিমটে আঁচড়ও বসন্তসেনার গায়ে না পড়ে, এরকম আচরণ করে সে এখন। মেয়ে যে অফিস থেকে পরপর তিনদিন ছুটি নিয়েছে, তাতে সুশোভনবাবু ভীষণ খুশি হয়েছে। পরপর তিনদিন মেয়েকে স্কুল থেকে ফিরেই দেখতে পাবে। তারপর, বাবা- মেয়ে মিলে কত কথা কত গল্প হবে। উনি মনে মনে ভেতরে গাইতে থাকেন - মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়---ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়--।
এই পান্নামাসি তাদের বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরেই আছেন। সারাদিন থাকেন, রান্না থেকে ঘর গেরস্থালির সমস্ত কাজ সেরে সেই সন্ধের মুখে ফিরে যান নিজের বাড়িতে। তাদের এই সংসার একাই সামলান তিনি। তাদের বাড়ি থেকে দু'কিলোমিটার দূরের পাড়া চড়কডাঙ্গাতে থাকেন পান্নামাসি নামের মহিলাটি। বসন্তসেনার মা'ও ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। মায়ের স্কুল ছিল বাড়ির কাছেই, তবে সকাল দশটার মধ্যে বরাবর বেড়িয়ে যেতেন তিনি আর তার বাবা নয়টা বাজতে না বাজতেই ছুটতেন, ঘন্টা দেড়েক বা তার বেশি লাগতো তার। দক্ষিণ কলকাতার শেষভাগ থেকে একদম প্রায় উত্তরের শহরতলীর দিকে। পান্নামাসিকে সে যখন ক্লাস টু বা ক্লাস থ্রিতে পড়ে তখন থেকেই দেখছে। তার স্কুল থেকে ফিরে এসে জামাকাপড় ছাড়ানো,খাইয়ে দেওয়া , যত্ন-আত্তি করে ঘুম পাড়ানো সব এই পান্নামাসি করতেন। তার মা ছুটির দিনগুলোতে আর অবসর সময়ে পান্নামাসির সাথে হাতে-হাতে কাজ করতেন । বিশেষ কোনো জলখাবার বা দুপুরে স্পেশ্যাল মেনু তৈরী করলে তার মা বসন্তসেনা আর তার বাবাকে খাইয়ে দিয়ে , নিজে বসে পান্নার সাথে গল্প করতে করতে খেতেন। তাই বসন্তসেনার কখনও মনে হয়নি , পান্নামাসি তাদের কেউ নয়। তিনি তাদের পরিবারের একজন সদস্যই মনে হতো।
🍂সেই পান্নামাসি রান্নাঘর থেকে বললেন-- " হাসনু, এত বেলা করে ওঠো কেন? ওতে তো দিনের পর দিন বেলাগড়ালে না খেতে-খেতে পেটের নাড়িভুড়ি সব শুকিয়ে যাবে। অসুখ করবে গো দিদি। চটপট বাথরুম থেকে ঘুরে এসে সকালের খাবারটা খেয়ে নাও।"
" হ্যাঁ পান্নামাসি আসছি। " - এই বলে বসন্তসেনা তাড়াতাড়ি রিফ্রেশরুমে ঢুকে যায়। এই হাসনু নামে তাকে এখন বাবা আর পান্নামাসি ডাকেন, আর মা তো অবশ্যই ডাকতেন তাকে। শুনেছিল, তিনি তো এই ডাকনামটি দিয়েছিলেন তাকে, খুব আদর ঝরে পড়লে তখন মা বলতেন, 'আমার হাসনুহানা মা এদিকে এসো, আমার কাছে।'
বসন্তসেনার জলখাবার খেতে- খেতে মনে পড়ে একটি দিনের কথা। বাবা সেদিন তখনও বাড়ি ফিরে আসেননি স্কুল থেকে, সে আর তার মা বসে রয়েছে ব্যালকনিতে। বিকেলের গোধূলি আলোয় কর্পোরেশনের ল্যাম্পপোস্টগুলির বাতি সদ্য জ্বলে উঠেছে। লোকেরা সামনের রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছে, দুদিক দিয়েই, তবে সকালের সেই ব্যাস্ততা নেই তাদের, শ্লথ তাদের গতি । তার মা আর বসন্তসেনা সেদিকে চেয়ে রয়েছেন । বিকেলের এই আলোতে সব মানুষই সারাদিনের কাজের শেষে, বরাবর খুব নস্টালজিক হয়ে পড়ে। মাঠে বিচরণ করা গোরু- ছাগল- মোষ গবাদি পশুদেরও হাবভাবে পরিবর্তন আসে। সবাই কেমন হা করে তাকিয়ে থাকে। মনের মাধুরী, মনের সজ্জায় সবসময়ে এই বিভিন্ন আলো এবং অন্ধকার খেলা করে। আর তার সাথে আছে প্রকৃতি। মা তখনও দিব্যি সুস্থ, কোনো অসুখ তার শরীরে গ্রাস করেনি, বসন্তসেনা আর তার বাবা তো কিছুই টের পাননি তখনও। তার মা হঠাৎ বলে উঠলেন- " হাসনু- মা, এই যে মানুষগুলো সব শ্রান্ত- ক্লান্ত দেহে এখন পথে চলেছে, ভালো করে সামনে গিয়ে দেখলে দেখবি, সবার চোখে- মুখে তবুও এক চিলতে আশা জিয়ানো , কেন জানিস, সবাই নির্দিষ্ট এক ঠিকানায় ফিরছে এখন। এইভাবে একদিন মানুষ সব ঠিকানা হারিয়ে ফেলে কোন সুদূরে চলে যায়। ওটাই বোধহয় মৃত্যু। তখন আশা- নিরাশার এই দোলাচল থেকে আরও উপরে তাদের অবস্থান। সেই অনন্ত সীমাহীন জগত হলো মানুষের চির বাসস্থান। এইভাবে আমিও হয়ত একদিন আমার এই ক্ষণস্থায়ী ঠিকানা হারিয়ে ফেলে তোদের রেখে ঐ সুদূরে পাড়ি দেব!" বসন্তসেনা মায়ের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকায়। সে বলেছিল- " মা তোমায় আগে তো কোনদিন এরকম উপলব্ধির, এরকম ধরণের গভীর চেতনার কথা, এমন সহজ সরলভাষায় বলতে শুনিনি।" দীপশিখা শুধু বলেছিলেন - " আসলে কী জানিস বয়স আমাদের দর্শনের জন্ম দেয়, দর্শন মানে তো দেখা, যত দেখবি তত তোর জ্ঞান বাড়বে। তার থেকেই তোকে বললাম।" বসন্তসেনা আজ এখন মনে করে তার মা এইসব সাতপাঁচ বলে তার ভেতরের কষ্টটাকে তখন থেকেই লুকিয়ে রাখতে চাইছিল। একদম সত্যি অনুভব টা সেদিন আগাম বলে ফেলেছিল।
পান্নামাসি তাকে খেতে দিয়ে নিজে খেতে খেতে বলল- " আর তোমাদের বাড়িতে কাজে আসতে ইচ্ছে করে না গো ! দিদিমণি চলে যাওয়ার পর থেকে একদম মন লাগে না এই বাড়িতে কাজ করতে। আমি তো সেই কবে থেকে তোমাদের বাড়িতে কাজে ঢুকেছিলাম। তুমি তখন খুব ছোট্টটি। এই একমাত্র বাড়ি আমার কাজের। আমি আর অন্য কোথাও কাজ ধরতে যাইনি। দাদাবাবু আর দিদিমণি আমায় কোনদিনও সামান্যতম অসুবিধা বা বিপদে- আপদে একা ছেড়ে দেয়নি, পাশেই থেকেছে তারা। আমার এই এতটা জীবন বাঁচিয়ে রেখেছে ওনারাই। কী করে ভুলে যাব এদেরকে? আমাদের পাড়ায় আয়া, ঝি, ঠিকে-ঝি, কেটরিং এর জোগালি, কত কাজের মেয়েছেলে বাস করে বলো দিকিনি! আমি কোথাও নড়িনি, এখানেই সেঁটে রয়েছি চিরটাকাল। কেন? আমার হয়েছে জ্বালা। রাতে ঐ ঘরে ফিরে মনে হয় আমি আমার নিজের ঘর ফেলে এসেছি, আর এখানে তোমাদের বাড়িতে এলে মনে হয় আবার বাড়ি ফিরতে হবে। দাদাবাবু আর তোমার মুখের দিকে তাকালে খুব কষ্ট লাগে হাসনু-মা। কষ্ট! কিছুই ভালোটি লাগে না। তাই আর আসতে ইচ্ছে করে না। তোমাদের ছেড়ে পালিয়েও যেতে পারি না , আবার তোমাদের কাছে, এই দুঃখের কাছে, বেদনার কাছে এসে দাঁড়াতেও ইচ্ছে করে না। বড্ডো জ্বালা ! "
বসন্তসেনা মন দিয়ে শুনছিলো তার পান্নামাসির কথা। তারপর বললো সে- " প্লীজ মাসি তুমি এমন ভাবনা আর মাথায় কখনও আনবে না। আমরা তবে কার কাছে গিয়ে দাঁড়াব? কী করে বাঁচব এখন তোমায় ছাড়া? মা চলে গেলেন, তুমি ছেড়ে গেলে আমি এ জীবনে আর বেঁচে থাকবার মানে খুঁজে পাবনা। প্লীজ মাসি----!" এরপর পান্নামাসির গায়ে হাত বুলিয়ে দিল বসন্তসেনা। দেখল পান্নামাসি অঝোরে কেঁদে চলেছে। দুচোখ জলে ভরে গিয়েছে। বসন্তসেনার বুকে মাথা গুঁজে দিল পান্নামাসি। ডুকরে কেঁদে উঠে বলল- " তোরা ছাড়া আমার আর কে আছে বল? যে কটাদিন বাঁচব সে তোদের নিয়েই।"
বাবা ফিরে এসেছেন সময় মতন। রাতে বাবার সাথে কথা হচ্ছিল অনেকদিন পর ইতিহাসের পথ ধরে। বাবা বলছিলেন- " হাসনু- মা, তুই আজকাল আমাকে মাঝে- মধ্যে জিজ্ঞাসা করিস না , সেই রাঢ়ের জনপদ অঞ্চল নিয়ে । আজ তোকে সেই রাঢ় অঞ্চল নিয়ে কিছু বলছি, তবে রাঢ়ের জনপদে যেতে হলে আমাকে তো সেই পৌরাণিক যুগের মানচিত্র থেকে শুরু করতে হবে। বঙ্গ ছিল বর্তমান বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে, সমুদ্র থেকে শুরু করে ব্রহ্মপুত্র নদী পর্যন্ত বিস্তৃত জনপদ বঙ্গ। বঙ্গ থেকে শুরু করে ভুবনেশ্বর পর্যন্ত বিস্তৃত জনপদ গৌড় বলে বর্ণিত হলেও, পরবর্তীতে গৌড়ের আয়তন অনেক ছোটো হয়ে এসেছে। কলিঙ্গ একটি উপকূলীয় রাজ্য। উত্তরে সুবর্ণরেখা ও দক্ষিণে গোদাবরী নদী পর্যন্ত এর সীমানা। সুবর্ণরেখার উত্তর ভূভাগ সুহ্ম ছিল পূর্বে বঙ্গ, পশ্চিমে মগধ আর উত্তরে অঙ্গ দ্বারা গঠিত। এখনকার মেদিনীপুর , হাওয়া, হুগলী, বীরভূম প্রভৃতি এই ভূভাগের অন্তর্গত। পুণ্ড্র উত্তরবঙ্গ। পৌরাণিক যুগ শেষ করে ঐতিহাসিক যুগে এসে সে কলিঙ্গ যেমন নেই, তেমনি সুহ্ম তার বহু আগে অঙ্গের একাংশ গ্রাস করে বর্দ্ধিত জনপদ রাঢ়ে পরিণত হয়েছিল। তাহলে ঐতিহাসিক যুগে এসে আমরা রাঢ়ের জনপদের সন্ধান পেলাম। এই রাঢ়ের জনপদ আর সুসীমার স্বল্প আলোচিত পৌরাণিক যুগ আর ঐতিহাসিক যুগ-সন্ধিক্ষণের সেই গল্পকথা তোকে আমি বলেছি অনেকবার। আজ আরও একবার তার কিছুটা শোন না হয় একবার। "
বাবা আর মেয়ে সেই কল্পকথায় মেতে উঠলো সেই রাতে। এবারে তারা আরও গল্পের গভীরে ডুবে যাবে। একজন সুন্দর করে গল্প শুনিয়ে যাবে, আর একজন শ্রোতা হয়ে নীরবে হা করে রয়ে যাবে মুখোমুখি। যেন গিলছে প্রতিটি শব্দ আর কথা। শুধুমাত্র কখনও একটা দুটো জিজ্ঞাসা বা প্রশ্ন থাকবে তার। বসন্তসেনা জানে, তার বাবা বুক বোসম্ড আর অমনিলেজেন্ট। তার মা'ও এ ব্যাপারে কম কিছু নয়। আর বসন্তসেনা উত্তরাধিকার সূত্রে তার কিছুটা তো পাবেই!
ক্রমশ
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇
0 Comments