দূরদেশের লোকগল্প
কচ্ছপের পিঠে শক্ত খোল—এঙ্গোলা (পশ্চিম আফ্রিকা)
চিন্ময় দাশ
অনেক অনেক বছর আগের কথা। একদিন বিধাতা পুরুষের সাধ হোল, একটা ভোজসভা আয়োজন করলে হয়। পাঁচজনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হবে। ভোজে বসে, গল্পগাছা চলবে। ভালো-মন্দ খোঁজ-খবর নেওয়া হয়ে যাবে সবার।
আসলে হয়েছে কী, এক্টুও ফুরসত মেলে না বিধাতার। হবে নাই বা কেন? এত বড় দুনিয়ার দেখভাল করতে হয় তাকে। কম ঝক্কির কাজ না কি? কোথাও নজর একটু কম হয়েছে, অমনি কোন না কোনও একটা ঝামেলা বেধে যাবে। মাথা ঠাণ্ডা রেখে সব সামলাতে হয়।
অবশ্য অনেক লোকজন আছে বিধাতার। কেউ এটার দায়িত্বে। কারও ওপর ওটার ভার। একজন এখানে, তো একজন ওখানে। চার দিকেই নজর রাখতে হয়। তাই লোকজনও চার দিকেই ছড়িয়ে রাখতে হয়েছে।
একটা ভোজসভার আয়োজন হলে, সবাইকে ডেকে পাঠানো হবে। কাজকর্মের খোঁজ-খবর নেওয়া যাবে। কার কী সুবিধা অসুবিধা—শোনা যাবে সেসবও।
যেমন ভাবনা তেমন কাজ। দূত পাঠিয়ে দেওয়া হোল চার দিকে। ভোজসভার নেমন্তন্ন নিয়ে চলে গেল তারা।
ভোজের দিন। সকাল হতেই, কয়েকজনকে পাঠানো হোল, গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে ভালো জাতের ছাগল আর ভেড়া নিয়ে আসবে তারা। মাংসের পদ রাখতেই হবে থালায়।
বুড়ো মন্ত্রী বলল—এত বড় ভোজের বাড়ি। সাথে একটু পানীয় না হলে, মানায় না, প্রভু।
বিধাতা বললেন—ঠিক বলেছ। জোগাড় করো।
মন্ত্রী বলল—যেমন তেমন জিনিষ হলে চলবে না। সেরা জিনিষটি আনাতে হবে।
বিধাতা বললেন—সে তোমার ব্যাপার। যেটা ভালো মনে হয়, করো। তবে, সবাই যেন ধন্য ধন্য করে, এটা মনে রাখতে হবে আমাদের।
অনেক দিন আগের ঘটনা এটা। অনেক দিন, মানে অনেকই দিন কিন্তু। কত দিন আগের? একটা কথা বললে, পরিষ্কার বোঝা যাবে হিসাবটা। যেমন, কচ্ছপের কথাই ধরা যাক। সেসময় এখনকার মতো ছোট্ট আর পুঁচকে চেহারা ছিল না কচ্ছপের। দশাসই তাগড়াই চেহারা ছিল তার। যেমন বলবান, তেমনি চটপটে।
পানীয়ের কথায় তালের রস-এর কথা মনে এলো মন্ত্রীর। সাগর পারের দেশ এঙ্গোলা। সেখানে গাঁ-গঞ্জে প্রচুর তালগাছ। সেখানেই পাওয়া যাবে ভালো মানের তালের রস।
কচ্ছপকে ডেকে কাজ বুঝিয়ে দিলেন বিধাতা। হুঁশিয়ার করে দিলেন—দেখো বাপু, দেরি করে ফেলো না যেন। ভোজসভা শুরুর আগে এনে পৌঁছে দেবে। হয়রাণ হতে না হয়।
স্বয়ং বিধাতা পুরুষ তাকে ডেকে কাজের ভার দিয়েছেন। আনন্দে গর্বে তার তখন যেন মাটিতে পা পড়ে না। কচ্ছপ বুক চিতিয়ে বলল—সে আপনাকে ভাবতে হবে না, প্রভু। আমি যাবো আর আসবো। বলেই চটপট রওণা হয়ে গেল সে।
সাগরের প্রায় গায়ে লাগোয়া একটা গ্রাম সুম্বে। সেদিকেই চলল কচ্ছপ। বিধাতার প্রাসাদ থেকে বেশ কিছুটা দূরেরই পথ। তবে, তেমন অসুবিধা হোল না তার।
গাঁয়ে পৌঁছে, মোড়লের বাড়িতে গিয়ে হাজির হোল কচ্ছপ। মানুষটা তখন জলখাবার খাচ্ছে বসে বসে।
বেশ খাতির করেই বসাল অতিথিকে। আলাপ-পরিচয় হোল দুজনের। ভালো-মন্দের খোঁজ-খবর নেওয়া হোল। এবার মোড়ল বলল—তা, এত দূরের পথ, কী মনে করে এলে?
কচ্ছপ তাকে সব কথা খুলে বলল। জানাল—বিধাতা ঠাকুর নিজে আমাকে পাঠালেন তোমার কাছে। কিছু তালের রস লাগবে ভোজসভায়। তোমাদের তালের রসের ভারি সুনাম আছে। তাই এখানে আসা।
কথা শুনে, মোড়লের মুখ গম্ভীর। হাসি উবে গিয়েছে। বলল—শোন, বাপু। আমি হলাম পাঁচ গ্রামের মোড়ল। কিছু নিয়ম-কানুন আছে আমাদের। সেটা আমাকেও মেনে চলতে হয়।
কচ্ছপ বলল—তাতে কী হোল?
--আমাদের নিয়ম, অতিথি কেউ এলে, যত চাই তালের রস খেতে দেব। কিন্তু বাইরের কাউকে সে জিনিষ বিক্রি করি না আমরা। সে তুমিই হও, বা বিধাতা পুরুষ।
কচ্ছপের তো আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায়। কী হবে এখন। ওদিকে আবার হুকুম দেওয়া আছে, ভোজের আসর বসার আগেই, ফিরে যেতে হবে। সেবলল—তাহলে উপায়? কোন উপায় কি নাই, জিনিষটা পাওয়ার?
মোড়ল বলল—আছে তো। তালের রস বাইরে নিয়ে যাওয়ার বিধানও আছে।
কচ্ছপের আর ধৈর্য ধরে না। সে বলল—তাহলে আর কী? বলে ফেলো, কী তোমাদের বিধান।
মোড়ল জবাব দিল— তালের রস নিতে হলে, আমার সাথে লড়তে হবে তোমাকে। যদি তুমি জিতে যাও, যত যত চাও তালের রস নিতে পার। শুধু কি তাই? গাঁয়ের যত তালগাছ, সব তখন তোমার। তবে, তার আগে লড়াইয়ে হারাতে হবে আমাকে।
গায়ে অনেক শক্তি কচ্ছপের। সে এক কথায় রাজি হয়ে গেল—খুব ভালো কথা। এসো তাহলে, হয়ে যাক লড়াই।
মোড়লও রোগা-পটকা নয়। সেও বেশ বলবান পুরুষ। ফলে, তাকে হারাণো সহজ হোল না কচ্ছপের। তিন-চার ঘন্টা চলল দুজনের লড়াই। শেষমেষ অবশ্য কচ্ছপেরই জয় হোল।
সবচেয়ে বড় একখানা জালা জোগাড় হোল গ্রাম থেকে। সেটা কানায় কানায় ভরে যাওয়ার পরেও, অনেক রস রয়ে যাচ্ছে। কী করা যায়, কী করা যায়?
বোকাহাঁদার মতো, কচ্ছপ করল কী, বাকী রস পুরোটা নিজের গলায় ঢেলে দিল। লড়াই করে জেতা জিনিষ। ছেড়ে দেওয়া যায় না কি?
তালের রস বলে কথা। পেটে যেতেই ঠাহর হোল, ভারি মজার জিনিষ তো। এতক্ষণ লড়াই করার কষ্ট কোথায় যেন উবে যাচ্ছে। মনও কেমন একটা বেশ ফুরফুরে।
রওণা দেবার আগে, বেশ কতকগুলো তালগাছও পিঠে তুলে নিল কচ্ছপ। মনের ভাব, গাছগুলো নিজেদের এলাকায় থাকলে, এ থেকেই রস পাওয়া যাবে। তালগাছ আর তালের রস ভর্তি জালা নিয়ে ফিরে চলল কচ্ছপ।
পিঠে ভারি বোঝা। পেট তো রসে টইটুম্বুর। চোখেও ঘুম ঘুম ভাব আসছে। বেশি জোরে হাঁটা সাধ্যে কুলোচ্ছে না বেচারার। তার উপরে বাড়তি ঝামেলা। বৃষ্টি এলো ঝমঝমিয়ে। রাস্তা পিছল হয়ে উঠল তাতে। পা ফেলা-তোলা দায় হয়ে উঠেছে এবার।
শেষমেষ বিধাতার প্রাসাদে এসে পৌঁছলো যখন, কী বিড়ম্বনা বেচারার! প্রাসাদের দেউড়ি বন্ধ হয়ে গেছে। পাহারাদাররা ধরেই নিয়েছে, এতো দেরিতে আসবার আর কেউ নাই।
ভিতরে তখন ভোজসভা চলছে জোর কদমে। নাচ-গান, হই-হুল্লোড় কমতি নাই কোন কিছুরই। আওয়াজে কান পাতা দায়। বাইরে যে কপাট চাপড়াচ্ছে কচ্ছপ, কানে গেল না কারুরই। দরজা খোলা তো দূরের কথা, কেউ কোন সাড়াই দিল না তাকে।
পেট ভর্তি তালের রস। পিঠে বেদম ভারি বোঝা নিয়ে, দাঁড়িয়ে আছে কচ্ছপ। বেমালুম বেকুব বনে গিয়েছে বেচারা!
এদিকে রসের গুণে, শরীর দুর্বল হয়ে আসছে। পিঠে ভারি বোঝা। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারা যায়? এক সময় পড়েই গেল কচ্ছপ। পিঠের তালগাছগুলো একেবারে পিষে গুঁড়ো করে দিল তাকে। এমন অবস্থা, বুকের ধুকপুকানিটুকুও বোধ হয় বন্ধ হয়ে যাবে। মাটির জালা ভেঙে, ধুলো-কাদায় মাখামাখি হয়ে একাকার।
সেই বৃষ্টি কিন্তু সেদিন থামেনি। তার পরের দিন, বা তার পরের দিনও না। থেমেছিল বেশ কয়েক দিন পরে। অতিথির দল সবাই আটকে ছিল ভেতরেই।
বৃষ্টি যেদিন থামল, দেউড়ি খোলা হল বেরুবার জন্য। কিন্তু কপাট খুলে, সকলেরই চোখ উঠে গেল কপালে। দরজা জুড়ে সামনে স্তুপটা কিসের? তার উপর অবাক ব্যাপার, এতগুলো তালগাছ এখানে এলো কোথা থেকে? কপাট বন্ধ করবার সময় তো এসব জঞ্জাল ছিল না এখানে।
🍂জঞ্জাল সরানো শুরু হোল। জোয়ান-মদ্দ সেপাইরা এসে প্রথমে তালগাছগুলো সরালো। তখন দেখা গেল, ভাঙা জালার খোলামখুচি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারদিকে। সব কিছুর তলায় মাটিতে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে কচ্ছপের দেহটা।
থেঁতলে ছোট হয়ে গেছে শরীর। তার চেয়ে বড় কথা, রসমাখা মাটি জমাট বেঁধে গেছে। পড়ে গিয়েছিল উপুড় হয়ে। পিঠের উপর এমনই শক্ত হয়ে গিয়েছে মাটি যে শরীর থেকে তুলে ফেলা গেল না।
তাড়াতাড়ি বৈদ্য ডেকে আনা হল। বেশ ক’দিনের চেষ্টায়, বুকের ধুকপুকানি ফিরে এলো কচ্ছপের। একটু একটু করে সেরে উঠতে লাগল বেচারা।
কিন্তু সেরে উঠল, এই টুকুই যা! আগের বড়সড় সেই চেহারা আর রইল না। কেমন একটা গোল্লা পাকিয়ে গিয়েছে। তার উপর, পিঠের উপর মোটা আর শক্ত একটা খোল। একেবারে উলটানো একটা কড়াই যেন। রইল না খাড়া হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতাটুকুও। সেই থেকে খুদে খুদে চারখানা পায়ে টুকটুক করে হেঁটে বেড়াতে হয় কচ্ছপকে।
বিধাতা কিন্তু এক্টুও রাগ করেননি কচ্ছপের উপর। বরং খুশিই হয়েছিলেন তার মেহনতের কাজ দেখে। খুশি হয়ে, অনেক লম্বা জীবন দিয়েছিলেন ছোট্ট হয়ে যাওয়া জীবটাকে। হাতি-ঘোড়া, বাঘ-সিংহ, কিংবা ধরা যাক মানুষ থেকে একেবারে পোকামাকড়—কতজনই তো আছে জীবকুলে। কিন্তু আজও দেখা যায়, সকলের চেয়ে লম্বা আয়ু কচ্ছপকেই দিয়েছেন বিধাতা পুরুষ।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী
0 Comments