স্মৃতি ডট কম ২০
শঙ্খ ঘোষ // ঈশিতা ভাদুড়ী
‘বলিনি কখনো? / আমি তো ভেবেছি বলা হয়ে গেছে কবে। / এভাবে নিথর এসে দাঁড়ানো তোমার সামনে / সেই এক বলা / কেননা নীরব এই শরীরের চেয়ে আরো বড়ো / কোনো ভাষা নেই / কেননা শরীর তার দেহহীন উত্থানে জেগে / যতদূর মুছে নিতে জানে / দীর্ঘ চরাচর, / তার চেয়ে আর কোনো দীর্ঘতর যবনিকা নেই / কেননা পড়ন্ত ফুল, চিতার রুপালি ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম / সকলেই চেয়েছে আশ্রয় / সেকথা বলিনি? তবে কীভাবে তাকাল এতদিন / জলের কিনারে নিচু জবা? / শূন্যতাই জানো শুধু? শূন্যতার ভিতরে এত ঢেউ আছে / সেকথা জানো না?’ – গড়িয়াহাটে আইডিয়াল বুক স্টোরে দাঁড়িয়ে অনেকের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র শঙ্খ ঘোষকেও আমার আবিষ্কার।
আমার আবিষ্কারের অনেক আগেই অবশ্য ‘বাবরের প্রার্থনা’ সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়ে গেছে। আমি পড়ে চলেছি – ‘…ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর / আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক’। শোনা যায় তাঁর কন্যার অসুস্থাবস্থায় ‘বাবরের প্রার্থনা’র মূল কবিতাটি লিখেছিলেন। এই কবিতায় বাবরের তাঁর পুত্রের সুখের জন্যে নিজের জীবন উৎসর্গের এক অদ্ভূত চিত্র এঁকেছিলেন। সেই চিত্রের মাধ্যমে সকল পিতার স্পর্শকাতর প্রার্থনার শব্দ ছুঁয়ে যায় পাঠকের হৃদয়। ‘কৃত্তিবাস' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতা 'দিনগুলি রাতগুলি'। ১৯৫৬ সালে ওই শিরোনামেই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
‘মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়’, ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ পড়ে ফেলেছি ততদিনে। কন্ঠস্থ করে ফেলেছি তাঁর অনেক কবিতা, যেমন ‘ঘরে ফিরে মনে হয় বড়ো বেশি কথা বলা হলো? / চতুরতা, ক্লান্ত লাগে খুব? / মনে হয় ফিরে এসে স্নান করে ধূপ জ্বেলে চুপ করে নীলকুঠুরিতে / বসে থাকি? / মনে হয় পিশাচ পোশাক খুলে পরে নিই / মানব শরীর একাকার? / দ্রাবিত সময় ঘরে বয়ে আনে জলীয়তা, তার / ভেসে ওঠা ভেলা জুড়ে অনন্তশয়ন লাগে ভালো? / যদি তাই লাগে তবে ফিরে এসো। চতুরতা, যাও। / কী-বা আসে যায় / লোকে বলবে মূর্খ বড়ো, লোকে বলবে সামাজিক নয়!’ অথবা ‘কোনো যে মানে নেই, এটাই মানে। / বন্য শূকরী কি নিজেকে জানে? / বাঁচার চেয়ে বেশি বাঁচে না প্রাণে…’ অথবা ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, রক্তে জল ছলছল করে…’ – এইসব লাইন দাগ কেটে গেছে ততদিনে।
আটের দশকে একটি ছড়ার সংকলন করতাম ‘ছড়া টড়া’ নামে। তখন ছোট ছোট ছড়ার সংকলন খুব হত। এই ‘ছড়া টড়া’ও অনেকের কাছে পৌঁছাত। চিঠি লিখে বা ফোন করে ছড়া সংগ্রহ করতাম। শঙ্খ ঘোষকেও চিঠি লিখেছিলাম ছড়া দেওয়ার জন্যে। তিনি উত্তরে লিখেছিলেন, “সুচরিতাসু, আপনার দাবি ছিল ‘অপ্রকাশিত, ভালো এবং ছোটো’ ছড়ার। এর মধ্যবর্তী দাবিটি মেটানো খুব শক্ত...”। আমি শঙ্খ ঘোষের কাছে এইসব দাবী করেছিলাম দেখে নিজেই নিজের স্পর্ধায় বিস্মিত আজ। তিনি নিশ্চয়ই আমার ছেলেমানুষী বুঝতে পেরেছিলেন, যতই তিনি লিখুন “...আপনাদের আর কাজে যদি না লাগে, তাহলে অনুগ্রহ করে একটু জানাবেন”।
তারপর এল ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ – ‘আমাদের শেষ কথাগুলি গড়িয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের দিকে / আমাদের শেষ কথাগুলি / মৃত মানুষদের চোখে ভরে গেছে অর্ধেক আকাশ / আমাদের শব্দের ওপারে…’ – শঙ্খ ঘোষ স্থায়ী হয়ে গেলেন আমার হৃদয়ে। তবুও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে দেখা হলেও কখনও কথা হয়নি। আমি তো এমনিতেই অন্তর্মুখী মানুষ, তার ওপর তাঁকে দেখে কাছে গিয়ে কথা বলার সাহসও আমার কখনও হয়নি। তাঁকে আমার খুবই রাসভারী মানুষ বলে মনে হত। বকে-টকে দিতে পারেন বলেও মনে হত। আমার তাঁকে চেনা হয়নি তখন। আমি তাঁর ছাত্রী ছিলাম না, কখনও তাঁর বাড়িতে কবি-লেখকের আড্ডায়ও যাইনি। ভিড়ের মধ্যে আমি খুবই সঙ্কোচ-বোধ করি চিরকাল। আমি সত্যিই এযুগের এক অচল সিকি, চল্লিশ বছর লেখালিখি করেও শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে কখনও যাইনি, একথা কেউ বিশ্বাস করবে!
আমি যখন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমি থেকে অনীতা-সুনীলকুমার বসু পুরস্কার পেলাম, মঞ্চে ছিলেন তিনি, তখনও আমার কথা বলা হয়নি। অনেক পরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরে তাঁর স্মৃতিতে এক অনুষ্ঠানে আমি সুনীলকে নিয়ে আমার কুড়ি-একুশ বছর বয়সে লেখা একটি কবিতা পড়েছিলাম, সেই কবিতা আমার কাছে অত্যন্ত লঘু বলে মনে হয়, তার ওপর মঞ্চে শঙ্খ ঘোষ বসে আছেন। যেহেতু সুনীলকে নিয়ে আর কোনও লেখা নেই আমার, তাই আমি খুবই ভয়ে ভয়ে সেই কবিতাটিই পড়েছিলাম, পড়বার আগে বলেওছিলাম সেই লঘুর কথা। কিন্তু পড়ার পর শঙ্খ স্যার খুবই মৃদুস্বরে বললেন, ‘কবিতাটি লঘু নয় মোটেই’। কী আনন্দ যে হল আমার!
আমাদের চারপাশে এত অনাচার, বারংবার তাঁর কলম গর্জে উঠেছে। প্রতিক্ষণ তিনি সমসাময়িক রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে সজাগ ছিলেন। প্রতিবাদে বরাবরই শাণিত ছিল তাঁর লেখনী। তাঁর ‘সবিনয় নিবেদন’ আজও প্রাসঙ্গিক, বারবার ফিরে ফিরে আসে লাইনগুলি – ‘আমি তো আমার শপথ রেখেছি / অক্ষরে অক্ষরে / যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন / দিয়েছি নরক করে। / দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল / অন্যে কবে না কথা / বজ্র কঠিন রাজ্যশাসনে / সেটাই স্বাভাবিকতা। / গুলির জন্য সমস্ত রাত / সমস্ত দিন খোলা / বজ্র কঠিন রাজ্যে এটাই / শান্তি শৃঙ্খলা। / যে মরে মরুক, অথবা জীবন / কেটে যাক শোক করে— / আমি আজ জয়ী, সবার জীবন / দিয়েছি নরক করে’।
শঙ্খ ঘোষের উদার মনের এবং ব্যতিক্রমী স্বভাবের পরিচয় আমরা বারেবারে পেয়েছি। আমরা পড়েছি বুদ্ধদেব বসু ‘কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদনা করতেন যখন, কবিতা নির্বাচিত হবার পরেও একটি-দুটি শব্দ নিয়ে, বা, বিশেষ কোনও পঙক্তির ছন্দ নিয়ে তার ভাবনার শেষ ছিল না, খুবই খুঁতখুঁতে ছিলেন। সাধারণত বুদ্ধদেব বসু কবির সঙ্গে যোগাযোগ করে নিতেন পরিবর্তনের জন্যে। তবে সেই সময় বুদ্ধদেবের সংশোধনের প্রস্তাব অনেক সময়েই অনেক তরুণ কবির পছন্দ হত না, অনেকে মেনেও নিতেন না বুদ্ধদেবের সংশোধনী। কিন্তু শঙ্খ ঘোষ সর্বদাই ব্যতিক্রমী মানুষ ছিলেন। তাঁর ‘পাথেয়’ নামে একটি কবিতা ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর অজ্ঞাতসারেই কবিতাটির তৃতীয় লাইনের একটি শব্দ এবং পঞ্চম ও ষষ্ঠ লাইন পু্রোটাই পরিবর্তিত করে বুদ্ধদেব বসু ছেপেছিলেন। প্রকাশিত কবিতাটি দেখে তাৎক্ষণিকভাবে শঙ্খ ঘোষের প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকলেও পরে তিনি মেনে নিয়েছিলেন, ভেবেছিলেন, নতুন লেখকের লেখায় একটু-আধটু কলম চালানোর অধিকার রয়েছে সচেতন বিবেকবান সম্পাদকের, বুদ্ধদেব বসু যে ওই কবিতাটির ভালোই চেয়েছিলেন, তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই্, হয়তো তাড়াহুড়োয় তাঁকে সামনে ডেকে বলা হয়ে ওঠেনি, এইভাবে ভেবেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। এখানেই সম্পাদকের সিদ্ধান্ত ও পূর্বজের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার পরিচয় পেয়েছি আমরা।
আমার একটি হাইবুনের বই ‘শূন্য থেকে শূন্য’ আমি তাঁকে উৎসর্গ করেছিলাম, এই বইটি আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি বই, সন্তানের মধ্যেও যেমন কম-বেশি প্রিয় থাকে। বইটি তাঁর হাতে দেওয়ার ইচ্ছে। অথচ ততদিনে তিনি অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর বাড়ির আড্ডাও বন্ধ। এমন সময় পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায় আমাকে জানালেন যে তাঁর কন্যারা ফেসবুকে জানিয়েছেন তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে ৪ঠা ও ৫ই জানুয়ারি সন্ধেতে তাঁর বাড়িতে কেউ যেতে পারেন চাইলে। ২০২০ সাল তখন। আমিও আর সেই সুযোগ ছাড়তে চাইলাম না, অফিসের পরে গেলাম তাঁর বাড়িতে ‘শূন্য থেকে শূন্য’ দিতে। সুস্থ ছিলেন না, তাই ড্রইং রুমে আসতে পারেননি। আমি তাঁর ঘরে গিয়ে তাঁর হাতে বইটি তুলে দিতে পেরেছিলাম, এ’ আমার সৌভাগ্য। হাইবুন সম্বন্ধে জানতে চাইছিলেন। তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে পায়েস খাওয়ালেন বৌদি। ভাগ্যিস সেদিন গিয়েছিলাম! এর পরেই কোভিড এসে গেল।
এরপরেও আরেকদিন গিয়েছিলাম তাঁর কাছে, কোভিডের প্রথম ঢেউ চলে যাওয়ার পর, যশোধরা রায়চৌধুরী আর পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সেদিন তিনি সুস্থ ছিলেন। ড্রয়িং রুমে এসে বসে অনেক গল্প করেছিলেন। তাঁর রসবোধ অতুলনীয়। তিনি খুব গল্প করতে ভালোবাসেন, অনেক কিছু বলতে চাইছিলেন। কিন্তু সময় তো শেষ হয় একসময়। ফিরে আসার সময় দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে গেলেন। বড় আপশোষ হয়, লজ্জা কুন্ঠা কাটিয়ে তাঁর কাছে যেতে অনেক দেরি করে ফেললাম আমি। এই শেষবেলায় এসে তাঁকে চিনলাম, এর চেয়ে দুঃখের কিছু হয় না।
0 Comments