মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৬৭
সুশীলকুমার ধাড়া (স্বাধীনতা সংগ্রামী, সাংসদ, তমলুক)
ভাস্করব্রত পতি
"ওঠে ঐ জনতার কল্লোল।
গর্জনে সিন্ধু
নহে নহে বিন্দু
সমীরণে বারিকণা হিল্লোল।
ওঠে ঐ জনতার হিল্লোল" ---
তিনি সবসময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজেকে সাবলীলভাবে এগিয়ে রাখতে ভালোবাসতেন। দুর্নীতিমুক্ত গনতান্ত্রিক সরকার গঠনের ওপর জোর দিতেন তিনি। কিন্তু যেই মুহূর্তে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে অন্যান্য নেতৃত্ব ক্ষমতা দখলের জন্য লড়াই করছে, তখন তিনি নিজেকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে নেন স্বেচ্ছায়। নিজেকে যুক্ত করেন মানুষের সেবায়। তিনি মেদিনীপুরের বীর সন্তান বিপ্লবী সুশীলকুমার ধাড়া।
১৯১১ এর ২ রা মার্চ জন্মগ্রহণ করেন তমলুকের টিকারামপুর গ্রামে। বাবা ছিলেন তরেন্দ্র নাথ ধাড়া এবং মা শোভাবতী দেবী। ১৯২৬ সালে সুগায়ক ভবতোষ দাসের সংস্পর্শে এসে সুশীলকুমার ধাড়ার মনে জাগ্রত হয় দেশপ্রেমের ঈপ্সা। তারপর তিনি ঘনিষ্ঠ হন সতীশচন্দ্র সামন্ত, ধীরেন্দ্রনাথ দাস, অজয়কুমার মুখোপাধ্যায়দের সঙ্গে। ১৯২৯ শে তমলুকে এক জনসভায় আবৃত্তি করেন নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতাটি। শ্রোতাদের খুব আকৃষ্ট করে এই কবিতা। ঐ সভায় ডাক্তার প্রতাপচন্দ্র গুহ রায়ের বক্তৃতা আরও বেশি করে ব্রিটিশ বিরোধী হতে তাঁকে অনুপ্রাণিত করে তোলে। এরপর গান্ধীজীর লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সময় তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিজেকে যুক্ত করেন। যা কিনা ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে সুশীলকুমার ধাড়ার প্রথম স্বীকৃত এগিয়ে আসা। আর থেমে থাকেননি তিনি।
জীবনের প্রথম ধাপেই রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে নয় মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। এই সময় তাঁর সঙ্গে সখ্যতা হয় অনুশীলন সমিতির সদস্যদের সাথে। ১৯৩৩ এ মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে এক বছর দুমাস কারাবরণ করেন। এরপরেও কারান্তরালে কাটাতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু বিপ্লবের মন্ত্র তিনি ভোলেননি। লড়াই সংগ্রামকে বুকে নিয়ে সারাজীবন বিয়ে পর্যন্ত করেননি। ২০১১ এর ২৮ শে জানুয়ারি মেদিনীপুরের এই মহান মানুষ রতনটির জীবন বায়ু নির্বাপিত হয়।
প্রবন্ধকার হরপ্রসাদ সাহু সুশীলকুমার ধাড়ার জীবনের আলোকিত দিক তুলে ধরতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, "সুশীলকুমারের জীবনের আরেক ধর্ম ছিল সততা ও সময়ানুবর্তিতা। সত্যের পক্ষে চিরদিনই লড়াই করে গেছেন। কখনো সাংসদ হয়েছেন, কখনো বা মন্ত্রী হয়েছেন, তবে রাজনীতির জটিল আবর্তে যখনই অসততার গন্ধ পেয়েছেন, তখনই সরে এসেছেন। ফলে তাঁকে বেশ কয়েকবার দলবদল করতে হয়েছে, দলবদলের বদনাম নিতে হয়েছে। তবু তিনি লক্ষ্যে স্থির থেকেছেন। কোনো ব্যক্তিস্বার্থের ফাঁদে পা দেননি। এমনকী একসময় তিতিবিরক্ত হয়ে রাজনীতি থেকে সরে এসেছেন। তবে সরে এসে থেমে যাননি"।
১৯৪২ সাল ছিল তাঁর জীবনের এক অন্যতম সূচক। তমলুকের বুকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ ছিলেন যে তিনজন তাঁদের মধ্যে অজয় কুমার মুখোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র সামন্ত এবং তিনি ছিলেন অন্যতম। এই বছরের ২৬ শে সেপ্টেম্বর গঠন করেন 'বিদ্যুৎ বাহিনী'। তিনি ছিলেন এই বাহিনীর G. O. C. in C তথা General Officer Commanding in Chief. তাঁর অধীনে চার থানায় চারজন G. O. C. ছিলেন। তাঁরা হলেন -- নন্দীগ্রামে বঙ্গভূষণ ভক্ত, তমলুকে নরেন্দ্রনাথ জানা, সুতাহাটায় বিধুভূষণ কুইতি এবং মহিষাদলে গোপীনন্দন গোস্বামী। এরপর গঠন করেন 'গরম দল'! ঐতিহাসিক ২৯ শে সেপ্টেম্বর জেলার বিভিন্ন স্থানে থানা দখলের অভিযানে সুশীলকুমার ধাড়া নেতৃত্ব দেন মহিষাদল থানা দখল অভিযানের সময়। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেদিন। সেই অভিযানে চলে গিয়েছিল ১৩ টি প্রাণ। তাঁরা হলেন -- সুরেন্দ্রনাথ মাইতি (সুন্দরা), সুরেন্দ্রনাথ মাইতি (গোপালপুর), রাখালচন্দ্র সামন্ত, সুধীর চন্দ্র হাজরা, যোগেন্দ্রনাথ দাস, আশুতোষ কুইলা, শ্রীহরিচরণ দাস, গুণধর হ্যান্ডেল, দ্বারিকানাথ সাহু, পঞ্চানন দাস, প্রসন্নকুমার ভুঁইয়া, ভোলানাথ মাইতি এবং ক্ষুদিরাম বেরা। ১৯ শে অক্টোবর সুতাহাটার দ্বারিবেড়িয়া গ্রামে উদ্বোধন করেন ভগিনী সেনা। এর অধিনায়িকা পদে নিয়োগ করলেন সুবোধবালা কুইতিকে। আর বিখ্যাত তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গঠনের পর এই বছরের ১৭ ই ডিসেম্বর শপথ নেন এই সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এবং সমর মন্ত্রী হিসেবে। ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশ সরকার সুশীলকুমার ধাড়াকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরে দেওয়ার জন্য দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে।
১৯৪৭ এর ২১ শে জুলাই সুশীলকুমার ধাড়ার কারামুক্তি ঘটে। প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে মহিষাদল কেন্দ্রে কংগ্রেসের প্রার্থী হন ১৯৫২ তে। কিন্তু নির্দল প্রার্থী দেবপ্রসাদ গর্গের কাছে হেরে যান। কিন্তু এই নির্বাচনে জয়ী হন সুশীল ধাড়ার অপর দুই সহযোগী যোদ্ধা সতীশচন্দ্র সামন্ত এবং অজয় মুখোপাধ্যায় বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হন। ১৯৬২ র নির্বাচনে কিন্তু সুশীলবাবু বিশাল ব্যবধানে জয়ী হন। কিন্তু পরবর্তীতে অজয় মুখোপাধ্যায়ের প্রতি কংগ্রেস নেতৃত্বের অবিচারের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৬ র ১ লা মে গঠন করলেন 'বাংলা কংগ্রেস'। তিনি নতুন এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬৭ তে বাংলা কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হন। গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট সরকার। সেই প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রীসভায় শিল্প ও বানিজ্য মন্ত্রী হন তিনি। ১৯৬৯ এর বিধানসভা নির্বাচনেও জয়ী হন তিনি। যদিও এই বাংলা কংগ্রেস দ্বিধাবিভক্ত হয় ১৯৭১ এর ৬ ই জুন। এরপর সুশীল বাবু যোগ দেন জয়প্রকাশ নারায়ণের নতুন গঠিত জনতা দলে। তখন কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকারের নির্দেশে অন্যান্য অনেকের মতো তাঁকেও কারাবদ্ধ করা হয়। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ১৯৭৭ এর লোকসভা নির্বাচনে জনতা দলের প্রার্থী হয়ে তমলুক কেন্দ্রে পরাজিত করেন সতীশচন্দ্র সামন্তকে। ১৯৭৮ সালে লোকসভায় জনতা দলের মুখ্য সচেতক হন এই মানুষটি। কিন্তু ফের ১৯৮০ র লোকসভা নির্বাচনে তিনি হেরে গিয়ে রাজনীতি থেকে সরিয়ে নেন নিজেকে।
নানা গঠনমূলক কাজে থাকতে ভালোবাসতেন সুশীল বাবু। ১৯৮১ তে তিনি গঠন করেন তাম্রলিপ্ত স্বাধীনতা সংগ্রাম ইতিহাস কমিটি। স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর নানা ধরনের বই প্রকাশ করে ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস ছিল মূল লক্ষ্য। এছাড়াও তিনি তাম্রলিপত জনকল্যাণ সমিতির সভাপতি হন। এই সমিতির উদ্যোগে তমলুকের নিমতৌড়িতে তৈরি হয় চারতল বিশিষ্ট 'স্মৃতিসৌধ'। ১০৭ ডেসিমাল জায়গায় গড়ে ওঠা এই ভবনটি আসলে জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যাবতীয় তথ্যভাণ্ডার হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ১৯৯২ এর ১ লা মার্চ এর দ্বারোদ্ঘাটন হয়।
তিনি ছিলেন একাধারে বৈপ্লবিক মন্ত্রে দীক্ষিত সন্ন্যাসী। অপরদিকে ছিলেন সুলেখক। ছিলেন ভালো সংগঠক, সমাজসেবী এবং বাগ্মী। রাজনীতির আবর্তেও তিনি ছিলেন আদ্যপান্ত একজন সৎ নেতৃত্ব। সুশীলকুমার ধাড়ার লেখা বইগুলি হল -- ১. রাষ্ট্রভাষা হিন্দী-বাংলা ব্যাকরণ, ১৯৪৮, ২. রাষ্ট্রভাষা (হিন্দী-বাংলা ট্রানশ্লেসন ও কম্পোজিশন), ১৯৪৮ ৩. মালা, ১৯৮৩ ৪. প্রবাহ (প্রথম খণ্ড), ১৩৮৯, ৫. প্রবন্ধগুচ্ছ, ১৯৯০, ৬. প্রবাহ (দ্বিতীয় খণ্ড), ১৯৯৫, ৭. জনতা সরকারের পতনের শিক্ষা, ১৯৮১, ৮. কৃষি বিপ্লব, ১৯৮১, ৯. গ্রামীণ অর্থনীতি, ১৯৯৫, ১০. কাব্য সঞ্চয়, ১৯৯৭ এবং ১১. পটচিত্র গীতি, (যুগ্ম সম্পাদনা, সুশীল কুমার ধাড়া এবং গোপীনন্দন গোস্বামী)। এই বইগুলি আজও পড়লে সেদিনের আগুনঝরা দিনের সন্ধান পাওয়া যায়।
কেমন ছিলেন ব্যক্তি সুশীলকুমার ধাড়া? আদ্যন্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিচরণ করে চলা মানুষটির একান্ত নিজস্ব চলাচলের ছন্দ সম্পর্কে গবেষক হরপ্রসাদ সাহু উল্লেখ করেছেন, "ব্যক্তি সুশীলকুমার সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির এবং অশেষ গুণের অধিকারী। তিনি যখন মাইনর স্কুলের ছাত্র এবং ক্লাসের ফার্স্ট বয়, তখন অনায়াসে তাঁর বৃত্তি পাওয়ার যোগ্যতা ছিল। কিন্তু সরকারি টাকা নেবেন না বলে দৃঢ়চেতা সুশীলকুমার মাইনর বৃত্তি পরীক্ষায় বসেননি। এমনকী হ্যামিলটন স্কুলে পড়বার সময় স্কাউট ট্রেনিং নিতে অস্বীকার করেছিলেন। কারণ, সেই ট্রেনিং এ তাঁকে ‘গড সেভ দি কিং' গানটি গাইতে হবে। আবৃত্তি, বক্তৃতা, গান সব কিছুতেই অসাধারণ দক্ষতা ছিল। বিভিন্ন মঞ্চে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’, ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার' কিংবা রবীন্দ্রনাথের ‘এবার ফিরাও মোরে' কবিতা আবৃত্তি করে প্রশংসিত হয়েছিলেন। ফুটবল খেলায় গোলকিপার হতেন, ব্যাডমিন্টন ও হকি খেলতে পারতেন। লাঠিখেলা, ছোরাখেলা, যুযুৎসু প্রভৃতি তাঁর করায়ত্ত ছিল। এবং অনেক বিপ্লবীকে এ সব প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তাসখেলাও তাঁর অজ্ঞাত ছিলনা। অথচ, ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করেছেন, বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে আই. এ. পাশের পর বি. এ. পড়েছিলেন। কিন্তু তা আর শেষ করতে পারেননি। ততদিনে তিনি যোগ দিয়েছেন স্বাধীনতা সংগ্রামের মুখ্য সৈনিকের ভূমিকায়। পিছন ফিরে আর তাকাননি। অকৃতদার থেকে গেলেন। জীবন কাটিয়ে গেলেন অতি সাধারণভাবে। বিলাসিতা নামমাত্র নেই। পোশাক বলতে খদ্দরের ধূতি জামা। অর্থের অভাবে ছাত্রাবস্থায় টিউশন করেছেন, পরে চানাচুরের ব্যবসা করেছেন, এমনকী মন্ত্রী থাকাকালীনই রাস্তার ধারের সেলুন ব্যবহার করেছেন। সাইকেল ছিল তাঁর যাতায়াতের প্রধানতম বাহন। একসময় দিনে পনেরো ষোলো ঘন্টা সাইকেলে ঘুরে সংগঠনের কাজ করেছেন। ক্লান্তি এলে তিনি সাইকেলের উপর বসে মাটিতে পা ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতেন। সত্যিই আশ্চর্য এক জীবন"।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৮ তে পেয়েছিলেন সাম্মানিক ডি. লিট. উপাধি। এরপর ২০০৩ তে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও পান ডি. লিট. উপাধি। এই মহান মানুষটি আজও বেঁচে আছেন তাঁর কর্মগুণে। তাঁর জীবনের চলার পথ ছিল আমাদের সবার পাথেয়।
"হে উদার মাটি
আমাকে সম্পূর্ণ সেবক করার আগে
তোমার নির্মম শাসনে যোগ্য করে তোলো আমায়
সব সৌন্দর্যের আকর,
আবার সুনিবিড় আত্মসমর্পণ নিও,
তোমার পদতলে জানাতে দিও
আমার সমস্ত হৃদয়ের প্রণতি"।
0 Comments