জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক নলিনীকান্ত গুপ্ত/নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক নলিনীকান্ত গুপ্ত
            
নির্মল বর্মন

বাংলা, ইংরেজি, গ্রিক, ল্যাটিন ও ফরাসি ভাষায় দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ সাহিত্যিক নলিনীকান্ত গুপ্ত । ১৮৮৯ সালে ১৩ ই জানুয়ারি অধুনা বাংলাদেশে ফরিদপুরে জন্ম। পিতা- রজনীকান্ত । রজনীকান্তের রংপুরের নীলফামারীতে স্কুল শিক্ষা লাভ করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন ১৯০৪ সালে। ১৯০৭ সালে বিপ্লবী গুপ্ত সমিতির সংস্পর্শে এসে কলেজে পড়াশোনা ত্যাগ করে বারীন্দ্রকুমার ঘোষের মানিকতলা বোমা তৈরি কেন্দ্রে যোগদান করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯০৮ সালে ২ রা মে আলিপুর বোমা মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন । এক বছর পরেই ছাড়া পেয়ে যান।
স্বদেশী আন্দোলনের দক্ষ, নিষ্ঠ ও  কর্মী যোগসাধনা ও সাহিত্য রচনায় সিদ্ধহস্ত গুপ্তবাবু  প্রাবন্ধিক হিসাবে সর্বজনধন্য। প্রাবন্ধিক নলিনীকান্ত গুপ্ত সাহিত্য রচনার বিষয়বস্তুর ব্যাপ্তিও বিশাল---সাহিত্য , শিল্প,  বিজ্ঞান,  ধর্ম, দর্শন, যোগ ও সমাজনীতি।
আলিপুর জেলেই অরবিন্দের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। পরবর্তীকালে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে শ্রী অরবিন্দের "ধর্ম"ও "কর্মযোগিন" পত্রিকার সাব এডিটর হিসাবে কাজ করার সুবাদে অরবিন্দের সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৯৯০ সালের নভেম্বর মাসে "ধর্ম" নামক পত্রিকায় "স্বদেশী দীক্ষা" প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে শোরগোল পড়ে যায়। অরবিন্দ পন্ডিচেরী যাবার পর নলিনীকান্ত ছয় মাস পরেই মনীন্দ্রনাথ রায় ছদ্মনামে পন্ডিচেরীতে গিয়েছিলেন। নলিনীকান্ত গুপ্ত পন্ডিচেরীতে গিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি অর্থাৎ সাহিত্য সাধনা এবং যোগ সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। প্রাবন্ধিক নলিনীকান্ত গুপ্ত শ্রীঅরবিন্দের "সাবিত্রী" কাব্যটি অনুবাদ করে সর্বজনধন্য হয়েছিলেন। ১৯২৬ থেকে আজীবন পন্ডিচেরি আশ্রমের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। নলিনীকান্ত গুপ্ত মহোদয়ের প্রবন্ধ গুলি --'সাহিত্য', 'বিচিত্রা', 'সবুজপত্র', 'উদ্বোধন', 'প্রবাসী' , 'পরিচয়' ও 'ভারতবর্ষ' ইত্যাদি পত্রিকায় রীতিমতো প্রকাশিত হয়েছিল।
🍂

১৯৮৪ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি বর্তমান পুদুচেরিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রাবন্ধিক নলিনীকান্ত গুপ্ত বাংলায় ৫২ টি ,ইংরেজিতে ৩৮ টি ও ফরাসিতে পাঁচটি গ্রন্থ রচনা করে সুযশ লাভ করেছেন।

প্রাবন্ধিক নলিনীকান্ত গুপ্ত প্রণীত গ্রন্থ গুলি হল--
  "সাহিত্যিকা" ১৯২০;  ''রূপ ও রস'' ১৯২৮; "শিল্পকথা" ১৯৪৭ ;  "বাংলার প্রাণ" ১৯২৪ ; "স্বরাজ গঠনের ধারা" ১৯২৪, "ভারত রহস্য" ১৯২৭; "রবীন্দ্রনাথ" ১৯৪২;  "নব্য বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মঞ্জান"১৯৫৫;  "কবি  মনীষী" ১৯৫৯ ;  "স্মৃতির পাতা" ১৯৬৩ ও "শতাব্দীর প্রণাম" ১৯৭৩।
প্রাবন্ধিক নলিনীকান্ত গুপ্ত'র "শিল্পকলার কথা" প্রবন্ধটি কাব্য ভাস্কর্য ও সংগীত সম্পর্কিত আলোচনা মননশীলতা ও শিল্পবোধে অনন্যতা লাভ করেছে। নলিনীকান্ত গুপ্ত' র বক্তব্যের সূত্রগুলি নিম্নরূপ---
 ১."সংগীত, চিত্র, ভাস্কর্য আর কাব্য-- মানুষের একই সৌন্দর্যবোধের সৃষ্টি- প্রত্যেকটিই আপন আপন ধরণের সেই সৌন্দর্য সৃষ্টির চরম পরাকাষ্ঠা দেখাইয়াছেন , সকলেই সকলের সমান'।
২. নলিনীকান্ত গুপ্ত মহোদয় শিল্পের সংজ্ঞা ও বিভিন্ন শিল্পের পারস্পরিক পার্থক্য সম্বন্ধে সুচিন্তিত বক্তব্য পরিষ্কার ভাবে ব্যক্ত করেছেন--"ভেতরের অন্তরের উপলব্ধিতে পাওয়া একটি সত্য সুন্দরকে, বাহিরে রূপ দিয়া সৃষ্টি করার নামই কলা , শিল্প বা আর্ট। আর্টে আর্টে পার্থক্য এই বাহিরের রুপের উপকরণ বা মালমশলার পার্থক্য"। ফলতঃ গুপ্ত' র ভাবনা-চিন্তায় নয়া সৃষ্টির মূল - আবেগ ও চঞ্চলতার ওপর নির্ভরশীল ছিল।
৩. প্রাবন্ধিক চারটি শিল্পকলার মধ্যে সংগীতকে আদি শিল্পকলা রূপে ব্যাখ্যা করেছেন । কাব্যের সঙ্গে অন্যান্য শিল্পের পার্থক্য হল--"কাব্যের মধ্যে যতখানি চিন্তার বুদ্ধিবৃত্তির  খেলা আছে অন্যত্র তাহা নাই, তাই কাব্যে মানুষ যেমন আপনাকে খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করিতে পারে আর কোথাও তেমনটি পারে না"।
৪. নলিনীকান্ত গুপ্ত'র বিভিন্ন প্রবন্ধে সমাজে জাতিগত স্তর ভেদের মতো শিল্পেরও গুরুত্ব কত স্তর ভেদ করেছেন। যেমন-- ব্রাহ্মণ ,ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র যথাক্রমে কাব্য, চিত্র, ভাস্কর্য ও গান‌। এই তুলনার কারণে শূদ্র যেমন সর্বস্তরের জনসমাজকে ধারণ করে তেমনি গান সর্বস্তরের শিল্প বিদ্যার আদি উৎস স্থল। সেজন্য প্রবন্ধের উপসংহারই প্রাবন্ধিক গানের সুরের গুরুত্ব পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছেন---"এই সুরকে গানকে হারাইয়া যদি বস্তু লইয়াই সে থাকে, তবে আর্ট তাহার প্রাণও হারাইয়া শুধু দেহটিকে লইয়া থাকে। কাব্য তখন হয় বাক্যসংগ্রহ, চিত্র হয় রঙেরও রেখার সমষ্টি, স্থাপত্য ও  ভাস্কর্য হয় পাথরের পুঞ্জ"।
নালিনীকান্ত গুপ্ত'র  শিল্প বিচারে উপরিউক্ত অভিমত মান্যতাও যুক্তিযুক্ত বলেই বুদ্ধিজীবী মহলে দাগ কাটতে পেরেছিলেন। তাঁর প্রবন্ধগুলির ভাষারীতি, সরলতা ও বক্তব্য বিষয়ের প্রাণঞ্জলতা, ভাব - ভাষার যুক্তবেণী রচনা করেছিলেন। প্রাবন্ধিক নলিনীকান্ত গুপ্ত কিন্তু " নব্য বিজ্ঞান ও আধ্যাত্ম্যজ্ঞান"কে পাথেয় করে প্রবন্ধ রচনার মাধ্যমে বিজ্ঞানমনস্কতা ও অধ্যাত্ম উপলব্ধির স্বরূপ প্রকাশে বদ্ধপরিকর। প্রাবন্ধিকের অধিকাংশ প্রবন্ধই সাধু ভাষায় লেখা কিছু কিছু চলিত ভাষায় রচনা করেছিলেন। ফরাসি গদ্য ভাষার দ্বারা তিনি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। নলিনীকান্ত গুপ্ত'র  সংহত প্রকাশভঙ্গি ও সুললিত গদ্যরীতি প্রশংসার জন্য বিশ্ব প্রবন্ধ সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।।

Post a Comment

1 Comments

  1. অসাধারণ লেখা পড়লাম

    ReplyDelete