জ্বলদর্চি

কালের অতল তলে কলোরাডো-১৭পর্ব/ চিত্রা ভট্টাচার্য্য

কালের অতল তলে কলোরাডো
১৭পর্ব
চিত্রা ভট্টাচার্য্য

তামাটে মরুর দেশে অস্তগামী বিদায়ী সূর্যের কমলা রাঙা আলো টুকু হুভার ড্যামে ম্লান থেকে ম্লানতর হয়ে মিলিয়ে গেল। দিনান্তের নিঃশেষিত ছায়াময় রশ্মিতে কঠিন পাহাড়ের পথ পেরিয়ে আমরা ও গা ভাসিয়ে দিয়েছি মাত্র 30মাইল দূরের আড়ম্বরপূর্ণ জমকালো শহর নেভাদার প্রমত্ত নগরী রাতের লাস-ভেগাসের দুর্বার হাতছানিতে। আমি পারভীন  RV. তে দেখা  চাইনিজ ডং পরিবার কে নিয়ে অবাক করা   ট্রিপ্লেজ তিন শিশু কন্যার ফুলের মত নিষ্পাপ মুখের বাচ্চা গুলোর আলোচনায় ব্যস্ত ছিলাম। আমাদের গল্পের মাঝে ইতি টানতে ইয়াম মরীয়া হয়ে বেশ জোরেই চেঁচিয়ে বলে  '' হ্যালো গাইস ! লাস-ভেগাস কথার মানে তোমরা জানো? 
 ইতিহাসের পাতার এক গল্প আমার মনে এলে বলি,সময় টা ছিল ১৮২৯ সাল। স্পেনীয় ভূপর্যটক আন্তেনিও আরমিজো তৎকালীন ২০ খচ্ছরে টানা চাকাওয়ালা লৌহ শকটে মালপত্র সাজিয়ে তার দলবল নিয়ে কঠিন মরুভূমি পাড়ি দিলেন। তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল লস এঞ্জেলসে যাওয়ার ব্যবসায়িক রাস্তার অনুসন্ধান করা। তখন গ্রীষ্মের খর রোদের তাপ প্রবাহে মোহাবের মরুভূমির ঝলসে যাওয়া প্রকৃতি। সুদীর্ঘ্য লস আঞ্জেলসের  অচেনা পথের সন্ধানে পর্যটকের দল  শ্রান্তিতে ,ক্লান্তিতে তৃষ্ণার্ত  এই মরু অঞ্চলে জলের খোঁজে বিদ্ধস্থ হয়ে পাগল প্রায়। এক জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে দল টি। সেখানেই অবাক চোখে তাকিয়ে দেখতে পেলেন পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ছলাৎ ছল শব্দে  কলোরাডো নদী ও তার থেকে সৃষ্টি হওয়া ছোট ছোট স্বচ্ছ নীল জলে ভরা টৈটুম্বুর বেশ কয়েকটা লেক। ওরা লেকের পাড়ে শ্রান্ত শরীরে কিছুটা সময় জিরিয়ে নিয়ে তৃষ্ণা মিটিয়ে জলপান করেছিল কিনা জানিনা কিন্তু আন্তেনিওর দলের এক সদস্য সানন্দে এই জায়গার নামকরণ করলো লাসভেগাস। যার অর্থ উর্বর জমি। সেই থেকেই মোহাবের এই মরুভূমির অঞ্চল লাসভেগাস নামে পরিচিত হয়েছিল।  

স্প্যানিশ ভাষায় লাস -ভেগাস  " অর্থাৎ সুদূর ব্যাপী বিস্তীর্ণ সবুজ ঘাসের অঞ্চল। "দ্য মিডোস" , সুন্দরী অপ্সরী শহর লাস-ভেগাস। ক্লার্ক কাউন্টিতে অবস্থিত সিটি অব লাস ভেগাস --,একদিন যে ছিল মোহাভে মরুভূমির সুদূর প্রসারিত বালির সমুদ্রের মাঝে পর্বত শ্রেণী দ্বারা বেষ্টিত একটি বেসিন মাত্র আজ সে জনসাধারণের আদুরে  ডাকে কখোনো শুধুই ''ভেগাস'' কখোনো বা লাস ভেগাস নামে পরিচিত। তার চারদিকে যেমন পর্বত মালায় বেষ্টিত তেমনি মরুভূমির গাছপালা এবং বন্যপ্রাণী সহ বেশীর ভাগ ল্যান্ডস্কেপ শুষ্ক ও পাথুরে।  তবে ভেগাস প্রবল বন্যা বিধ্বস্ত এলাকা। কলোরাডো নদীতে বা তার শাখা নদীতে আকস্মিক প্লাবন এলে সর্ব প্রথম বানভাসি হয়ে আক্রান্ত হয় এ শহর। যদি ও উন্নত নিষ্কাশন ব্যবস্থার মাধ্যমে বন্যার প্রভাব থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য অনেক উন্নততর আধুনিক ব্যাবস্থা নেওয়া হয়েছে। 
 ক্রমশঃ এই জনশূন্য মরুঅঞ্চল কী ভাবে মেট্রোপলিটন শহরে পরিণত হলো ? কি ভাবে নেভাদার অর্থ নীতির মূল ভিত্তি হয়ে উঠলো? অবসর কাটানোর জন্য অসংখ্য রিসোর্ট, রমরমা ক্যাসিনো ব্যাবসা ,ডলারের  ,লেনদেন বিভিন্ন কারণে সমগ্র পৃথিবীর বুকে এই শহরটি বিশেষত্ব লাভ করে সেরা বিনোদনের নগর হলো এবং সারা বিশ্ব এই শহর কে রিসর্ট সিটি নামে চিনতে শুরু করলো। সে আরেক মনোগ্রাহী ইতিহাসের গল্প ।

      পারভীন অন্তরের অন্তঃস্থলের গভীরে চাপা সুপ্ত ক্ষোভে বলে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৮তম জনবহুল তো বটেই এমন কি নেভাদা রাজ্যের ও সর্বাধিক জনবহুল নগরী। বিশ্ব ইতিহাসে এই ভোগ বিলাসে উন্মত্ত শহরটিকে পৃথিবীর অন্যতম পাপের নগর বলা হয়েছে। বেহিসাবী বিলাসী জীবনের প্রবল জোয়ারের স্রোতে ভেসে উৎসাহী জনগণের  বাঁধাহীন গন্ডিহীন উল্লাসে সিটি অব লাস ভেগাস সর্বদা মুখর। যেখানে  নিষিদ্ধ জগতের দেদার স্বাধীনতা,--পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় বৃহত্তর মোহাভে মরুভূমির অঞ্চলের এই বৃহত্তম বিলাসী শহরে নারী পুরুষের ভোগ লালসার ফল স্বরূপ ভুমিষ্ট হয় বংশ পরিচয় হীন অবৈধ শিশুদের। তাদের ক্ষণিকের আমোদের মাসুল দিতে  অনাহুত শিশু জন্মায় এ সসাগরা পৃথিবীতে। তাদের আশ্রয় হয় সরকারি হোমে। কাউকে হয়তো পাওয়া যায় চার্চের সিঁড়িতে। এই যেমন আমি পিতৃমাতৃ পরিচয় হীন এক অবৈধ মানব সন্তান।  

      অতনু ,ব্রতীন তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলে please stop it here । তোর জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে আমাদের বিন্দু মাত্র উৎসাহ নেই। প্রথমতঃ তুই নিজে  জানিস না তাঁরা কে ছিলেন ? তাঁদের সম্পর্ক কি ছিল ? বৈধ অবৈধর প্রশ্ন উঠতেই পারে না। তুই আধুনিকা। রাবেয়া মায়ের মেয়ে , প্রলাপ বকা তোকে মানায় না। আমি ,সস্নেহে বলি, মানুষ জন্মের পরিচয়ে বড়ো হয় না পারভীন। যে নব জাতক এই সুন্দর পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হলো সে তো প্রকৃতির সৃষ্টি। সে কি করে জানবে তার জন্মের কি দায় ? মানুষ বড়ো হয় তাঁর কীর্তির পরিচয়ে। তুমি নিজেই তোমার উজ্জ্বল পরিচয় গড়বে। ইয়াম বলে অতীত ধূসর হয়ে চাপা পরে গেছে। আমরা নতুন যৌবনের দূত ,আজকের পথিক।  অতনু বিজ্ঞের মত বলে ''যস্মিন দেশে যদাচার।'' এই রাতের আবহাওয়ায় বসন্ত বাতাস বইছে , তোর মেঘমেদুর বৃষ্টি ভেজা মন বড়ো বেমানান। পারভীন হেসে ফেলে ; অতনু কে বলে সর্বজ্ঞ গ্র্যান্ড পা এলেন ।  

 সাড়ে আটটা নাগাদ হোটেল গ্যালাক্সির নির্দিষ্ট রুমে পৌঁছে এক ঘন্টার মধ্যে রেডি হয়ে ডিনারে বেরিয়েছি। আসল উদ্দেশ্য জমজমাট শহরের বুকে বেড়ানো। অনেক দূর থেকেই দেখি সান্ধ্য অন্ধকারে কৃত্রিম আলোর রোশনাইয়ে সেজেছে ভেগাস।  দুরুদুরু বুকে এসে পৌঁছলাম বিশাল বড়ো বড়ো অট্টলিকায় সমৃদ্ধ আলোর মালায় সাজা এই আজব পৃথিবীর আন্তর্জাতিক মহানগরে। শহরের মূল রাস্তার পাশেই দেখছি বিশাল উঁচু উঁচু ক্যাসিনো বিলডিং গুলো বৈদ্যুতিক আলোয় ঝলমল করছে। বিলাস বহুল পাঁচ তারা মানের হোটেল মোটেল রিসর্ট পায়ে পায়ে ছড়িয়ে আছে। আগে থেকে বুকিং না করলে অনস্পট কোথাও জায়গা পাওয়া যাবে না। অধিকাংশ -গাড়ি জ্যামে ফেঁসে আছে শহরে ঢোকার মুখে। এতো গাড়ি ,মানুষের ভীড় রেস্তোরাঁ ,ফুডপ্লাজা , গায়ে গায়ে লাগানো ক্যাসিনো, শপিংমল আমেরিকার পথে প্রান্তরে শহরে নগরে এত দিন যে ঘুরে বেড়ালাম কোথাও এমন রমরমা  চোখে পড়েনি।  

         সামনেই  একটি বেশ লম্বা সাজানো ক্যাসিনো বিল্ডিঙ দেখে তার ভিতরে ঢুকে পড়লাম। পুরো বিল্ডিঙ টি দামী কাঠের আসবাবে ইন্টেরিয়র ডেকোরেশানে সাজিয়ে তোলা। অপূর্ব মোহময় কারুকার্য্য --হস্ত শিল্পের স্বাক্ষর বহন করে আছে। মেহগিনী কাঠের কালো বার্নিশ করা প্রশস্ত চকচকে সিঁড়ি বেয়ে পুরু নরম কার্পেটে পা ডুবিয়ে তিনতলায় প্রবেশ করে বিস্মিত হয়ে যাই। এই ফ্লোর টির আগাগোড়া ক্যাসিনো মেশিন বসানো। আদি বা অন্ত কোথায় কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা ,যেন একেকটি ফ্লোর নিজেরাই একেক টা পাড়া। অতনু হিসেব করে বলে কম করে ও ৫০০মেশিন বসানো রয়েছে এবংএকটি স্লট ও খালি নেই। সিলিং থেকে হাজার বাতির ঝাড় লণ্ঠন ঝুলছে বিভিন্ন জায়গায় ,সে আলোর প্রভায় রাত যেন দিন। কোথাও বা শেডের আলোর কারসাজিতে রহস্যময় মদীরতা। মিউজিক বাজচ্ছে ,সর্বত্র অদ্ভুত এক উন্মাদনা।  
                                                                            জুয়ার আসর জমে উঠেছে ,স্বল্প পোশাক পরিহিতা নগরের সুন্দরী নটীরা সব ক্যাসিনোর মেশিন গুলোতে বসা জুয়াড়ি দের পাশে মৌমাছি দের মত ভনভন করে ঘুরছে। ঘুরে ফিরে উত্তেজক  পানীয় --মদ   তাদের গ্লাসে ফ্রীতে সার্ভ করছে। সিগারের ধোঁয়ায় মাদকতা বাড়ছে। হার জিতের খেলাতে কেউ জিতছে কারো বা চরম হার। আশ্চর্য্য হয়ে দেখছি এই সর্বনাশের খেলায় হেরে গিয়ে কেউ কপাল চাপড়ায় না , হা হুতাশ করে স্লট ছেড়ে যাচ্ছে  না। জুয়াড়িরা মাতাল হয়ে যত হারছে তত ডলার উড়িয়ে চলেছে। এমন  স্বপ্নময় পরিবেশ এ খেলায় জিতলেই পকেট ভর্তি উপচে পড়া টাকা তার লোভ সামলানো যে অপ্রতিরোধ্য। বিনোদন এবং নৈশপ্রমোদে গোছা গোছা ডলার উড়িয়ে নিঃস্ব হতেই বুঝি ভেগাসে আসা। যত রাত বাড়ছে আগন্তকের সংখ্যাও তত বাড়ছে। সুন্দরী অপ্সরী  ''লাস ভেগাস ''! এখানে সব বৈধ। এ শহর সম্পর্কে একটি কথা আবহমান কাল ধরে প্রচলিত আছে ,এখানে যা কিছু ঘটে সেগুলো কখনো বাইরে প্রকাশ পায় না। আইনের কড়া চোখ রাঙানির প্রহরা মুক্ত এ শহরে মূলত জীবন উপভোগের পূর্ণ স্বাধীনতার এক ব্যতিক্রমী স্থান।      

          ঠান্ডা নেই বললেই চলে ,তবে বসন্তের বাতাস উদ্ভাসিত যৌবন জীবনের নিগূঢ় তত্ত্ব খুঁজে বেড়ায়।সামনেই ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট night queen দেখে লাইনে দাঁড়ালাম। পাঁচমিনিটের মধ্যেই জায়গা পেলাম একটা six seat এর টেবিল খালি পাওয়া গিয়েছে। গলায় স্কার্ফ সাদা শার্ট মেরুন লঙ স্কার্ট পরা লম্বা কালো চুলের স্টাইলিষ্ট সুন্দরী মেয়েটি মিষ্টি হেসে Welcome জানালো।  ভারতীয় আভিজাত্যে ভরা মুখ খানি , টানা টানা কালো চোখ মেন্যু কার্ড হাতে টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ালো অর্ডার নিতে। ব্রতীনরা মেন্যুতে মন দিয়েছে ,আমি শুধুই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে স্মৃতির পাতা উল্টে চলেছি। অমন  শান্ত স্নিগ্ধ মুখ খানি কিছুতেই ভোলার নয় ও যে আমার খুব চেনা। মনেপড়ে আমার ব্যাঙ্গালোরের বন্ধু উজ্জয়িনীর কন্যা অবন্তিকা কে। ও আমাদের সেই মুনমুনিয়া। চকিতে মনে হলো আমার চেনা প্রিয় মুনিয়াই যেন সামনে দাঁড়িয়ে আছে।     

          আজ থেকে আট বছর আগে মুনের বিয়ে হয়েছিল সম্বন্ধ করেই সানফ্রান্সিসকোর  NRI ইঞ্জিনিয়ারের সাথে। রাজপুত্রের মত দেখতে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করে স্কলারশিপ নিয়ে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির পোষ্ট ডক্টরেট করা  সুজিত এক কথায় লোভনীয় জামাই। সুন্দর চেহারা একেবারে রাজযোটক। ,লম্বা ফর্সা টিকলো নাকের এক মাথা ঝাঁকড়া চুলের সুজিত কে দেখে রূপকথার ডালিম কুমার বলেছিলাম। কিন্তু মুন আজ কেন এখানে ? আমার মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রাপাত ঘটলো। মন কে বোঝাই যদি মুন না হয় ? ডাকলে যদি সাড়া না দেয় ? কোনো রকমে ডিনার সারলাম। আমার কৌতূহলী মনে খাবার ইচ্ছে নেই যেমন , কৌতূহল দমন করার ও বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই। ওয়াশরুমে যাবার নামে সোজা ওর কাছে গিয়ে ওর সতত ব্যস্ততার মাঝে ওকে জিজ্ঞেস করি মুনমুনিয়া আমাকে চিনতে পারছো ? ' ও হেসে বলে ঠিক বুঝেছিলাম , তুমি মুনিয়া বলে ডাকবেই । তোমার হাতে সময় আছে মণিমা ? মিনিট ২০র মত রিসেপশনে ওয়েট করো ; আমি কাজ সেরে আসছি।সেই মিষ্টি হাসি ,সেই সুন্দর ব্যবহার ওকে কখোনো ভোলা যায় না।  
                                                                               ব্রতীনরা শহর ঘুরতে বেরিয়েছে ,রাত এগারোটা মনে হচ্ছে যেন এই মাত্র সন্ধ্যে নেমেছে। আমেরিকার বিখ্যাত শহর নিউইয়র্ক সম্পর্কে শুনেছি সে শহর কখনো ঘুমায় না কারণ সেখানে মধ্যরাতে ও মানুষের পদ চারণায় পথ মুখরিত থাকে।পাব্লিক পরিবহনের সুব্যবস্থায় সারা রাত ধরে পাতাল রেল চলে তাই শহর জাগে।  কিন্তু এখানে সারা রাত জেগে চলে মৌজ মস্তি খানা পিনা দেদার মজার হুল্লোড়ে। '' ঠিক ২০ মিনিটেই মুন এলে ওকে নিয়ে এলাম গ্যালাক্সির রুমে। মুনের বিয়ের পরে উজ্জয়িনীর সাথে প্রথম দিকে দুই একবার দেখা হয়েছিল তারপর আর নয়। কিছুটা সময় চুপ করে কেটে গেল ,ওর হাত দুটো ধরে বলি কি হয়েছে মুন আমাকে বলা যায় ? তোকে এভাবে দেখবো স্বপ্নে ও ভাবিনি --সুজিত কোথায় ? ও করুণ হেসে বলে দাঁড়া ও,সে বিশাল লম্বা গল্প। সব যদি বলি তোমার কম করে ও ৫০০পাতার নতুন উপন্যাস লেখা হয়ে যাবে। ওর ঘন চোখের পাতা ভিজে ভারী হয়ে উঠেছে।   

                   একটু  সময় নিয়ে  স্বাভাবিক হয়ে ও সহজেই বলে আমার জীবনে এ পৃথিবীতে সেই স্বপ্নে দেখা রাজপুত্রের, তোমার ডালিম কুমারের কোনো অস্তিত্ব নেই। আছে কাপড়ের তলায় চামড়ার ওপর সিগারেটের ছ্যাকা দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার ক্ষত চিহ্ন। আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি।একটা জীবন সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়ার অভিশাপ।  কি শুনছি ? এই  শান্ত ধীর স্থির মিষ্টি স্বভাবের মেয়ের জীবনে বিধাতার এ কি পরিহাস ! ওকে সান্ত্বনা দেবো কি আমি স্তব্ধ। ও বলে চোখের জল কঠিন বাস্তবের টানাপোড়নে  কবেই শুকিয়ে গিয়েছে। ''তোমার স্নেহের পরশে অনুভূতিরা বুঝি আজ প্রাণ ফিরে পেলো।''                                                                                                                                                                   মুন বলতে শুরু করে , ''সানফ্রান্সিসকোতে সংসার করতে এসে দুই মাসের মধ্যেই প্রমান পেলাম আমেরিকার NRI মস্ত শিক্ষিত আমার বর -- বাবা ,মার গর্বের ইঞ্জিনিয়ার জামাই কেমন ? যে বিস্তর সুখের স্বপ্ন সৌধ গড়ে আমার ধুমধাম করে বিয়ে হলো তার আদ্যপ্রান্ত সবটাই ফাঁকি ! ভুলে ভরা ,ঘোর আঁধারের নাগপাশে জর্জরিত জীবন আমার সাধের ভাবিকাল। সুজিত ড্রাগ এডিক্টেড এবং ওর জগতে ভালবাসার  কিছু সংখ্যক বন্ধু বান্ধবীর মাঝে আমার এক তিল ও জায়গা নেই। দূর থেকে দেখা উজ্জ্বল সবুজ ঘাসের সামনে এসে দেখলাম সব ছাই চাপা বিবর্ণ ধূসর। সুজিত কে ড্রাগ নিতে বাঁধা দিয়ে মূলস্রোতে ফেরাতে চেয়েছিলাম। পারলাম না। বরং চরম অপমান কপালে জুটলো। ওর বাড়িতে সব ঘটনা বিস্তারিত জানিয়ে শুনলাম ,'' তোমার ঘর ,তোমার বর ! না যদি সামলাতে পারো তুমি অপদার্থ । '' 

      একটা শিক্ষিত মানুষ ড্রাগের নেশায় জানোয়ারের মত আচরণ করে, ধীরে ধীরে গভীর পাঁকে জড়িয়ে যেতে থাকে। মাঝে মাঝেই  মদ্যপ হয়ে এসে গায়ে হাত তোলে পিটিয়ে ঘর থেকে বার করে দেয়। অকথ্য ভাষায় গালি তো চলতোই ,শুধুই অপমান সহ্য করেছি। এক রাতে ঘরের বাইরে রক্তাক্ত দেহে অচেতন  হয়ে ব্যালকনিতে পড়েছিলাম। এই অচেনা পৃথিবীতে কোথাও কেউ নেই। আমার পাশের এপার্টমেন্টে ওরই কলিগ মিসেস ভার্গিস বেশ স্নেহ করতেন।তিনি দেখতে পেয়ে সুশ্রষা করলেন ,আশ্রয়  দিলেন এবং ওর পরিচিত আমেরিকান জেকবের নাচের স্কুলে কাজের ব্যাবস্থা করে দিলেন। ওনার ই পরামর্শে আমি আগেই ডিভোর্স ফাইল করেছিলাম। 
🍂

                                                                               ড্রাগের নেশায় কর্ম ক্ষেত্রে প্রায়ই ভুলভ্রান্তি করে ,অফিসের ক্যাসে প্রায় ৭০হাজার ডলারের গন্ডগোল ধরা পড়লে সুজিত কে জেলে যেতে হলো। শুনেছি এক মাসের মাথায় জেলেই সুইসাইড করে। আমার বিয়ের বছর ঘুরতেই  ঘর বাঁধার স্বপ্ন তাসের ঘরের মত হুরমুর করে ভেঙে গুড়িয়ে গেল।  ২৪ বছরের জীবনে নেমে এলো এক ধ্বংসের স্তূপ--মরুভূমির শূন্যতা। বাবা হার্টফেল করলেন। মা ছোট ভাইয়ের কাছে। ঠিক করলাম আর ইন্ডিয়া তে ফিরবোনা। খুব আতান্তরে পড়েছিলাম। নাচ টা জানতাম ,এবং এতো ধাক্কা সয়েও রূপযৌবন পুঁজি ছিল বলে আমার থেকে দশ বছরের বড়ো মিষ্টার জেকবের সাথে আলাপ পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হলো। ঘর সংসার স্বামী নিয়ে গরবিনী স্ত্রী হতে চেয়েছিলাম ,হলোনা ।.জেকবের  ড্যান্স স্কুলে নাচ শেখাতে গিয়ে দুই বছরে হয়ে গেলাম নাইট ক্লাবের নর্তকী। আজ ওয়েষ্টার্ন ব্যালে, বেলি ,সালসা ড্যান্সার হিসেবে প্রচুর কাজ পাই। মধ্যরাত পার হয়ে কখোনো শেষ রাত পর্যন্ত শো চলেছে।জীবন দিয়ে এ জীবন কে বুঝে নিলাম।  অবন্তিস'নাইট নামে ক্লাব গুলো হাউসফুল যায় ,টাকাও প্রচুর জমে উঠেছে ।    

অবশেষে  রিমো ও টিউলিপ পুত্র কন্যা সহ জেকব কে বিয়ে করে ভালোই আছি। সানফ্রান্সিসকোর থেকে চার বছর হলো লাসভেগাসে এসেছি। এখানে night queen রেস্তোরাঁ নতুন খুলেছি। নিজেরাই মালিক এবং প্রয়োজনে কর্মচারী ও। জিজ্ঞেস করি উজ্জয়িনী জানে সব ? ও বলে ''সব টা জেনেই --মা পণ করেছে আমার এ পোড়া মুখ দেখবে না। আমি দেখাতে ও চাই না। '' ভাগ্য যখন এখানেই বিরূপ হয়েছে তখন তাকে ফেরাতে লড়াই চলবে। মা ছেড়ে যাওয়া দুই ও চার বছরের বাচ্চা দুটো রিমো ও টিউলিপ আমাকে দেখলেই ঝাঁপিয়ে চলে আসতো। মন বললো ঠিকানা খুঁজে পেয়েছি কলুষতা নির্মুক্ত পবিত্র শিশুদের এই পৃথিবী -- ওরাই আমার শেষ আশ্রয় স্থল। জেকব কে না বিয়ে করলে ভিসার প্রবলেমে আমেরিকা থেকে পাট গুটোতে হতো।  আচ্ছা বলতো মণিমা ,আমার এ পোড়া মুখের জন্য কে দায়ী ? জানিনা শেষের পথে আর কি অপেক্ষা করে আছে ? তবে যা পেয়েছি তাই দিয়ে বর্তমান অবশ্যই সুন্দর করে সাজাতে চাই। 

      অবাক হয়ে যাই দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মেয়েরা বোধহয় এমনি শক্ত পোক্ত হয়ে যায়। আমি যেন বোবা হয়ে গিয়েছি। ভাবছি এ জীবনে কত কি ঘটে রোজ ! আমরা তার কত টুকু খবর পাই। ওপর থেকে কত কিছু মানুষের চরিত্র সম্বন্ধে ধারণা করি। কঠিন বাস্তবের রূঢ় বন্ধুর পথ চলায় যে সংগ্রাম তাকে প্রতিনিয়ত করে টিকে থাকতে হয় তার নেপথ্যের নির্মম কাহিনী কে ই বা জানতে চায়। দেখতে দেখতে রাতের আকাশ ফিকে হয়ে আসছে। প্রমোদ নগরী এখন ক্লান্ত। মুন পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে আমার বিছানায়। এক ফালি চাঁদের আলো পর্দার ফাঁক দিয়ে ওর মুখের ওপর ত্যারছা হয়ে শরীরে পড়েছে। ওর অনিন্দ্য সুন্দর মুখ খানি চাঁদের হালকা আলোর ছোঁয়ায় দারুণ মোহময়ী লাগছে। চোখের কোন থেকে গড়িয়ে পড়া নোনা জলের দাগ ফর্সা গালের ওপর শুকিয়ে কালচে হয়ে গিয়েছে। ওকে লাগছে শান্ত স্নিগ্ধা নির্মলা জলের সেই স্বচ্ছ নদীটি র মত।                                                                                      ক্রমশঃ

Post a Comment

0 Comments