জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৮৬/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৮৬
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

নরেন্দ্রনাথের তীব্র বৈরাগ্য -- এক অভূতপূর্ব অধ্যায়

 কাশীপুর উদ্যানবাটীতে কঠিন কর্কট রোগাক্রান্ত শ্রীরামকৃষ্ণের সেবাকার্যের নেতৃত্ব দান করেছিলেন নরেন্দ্রনাথ। তিনি তখন বি.এল. পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, তাছাড়া তাঁর পৈতৃক বসতবাটী নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা চলছিল। ফলে তাঁর কলকাতায় থাকা জরুরি ছিল। কিন্তু তিনি স্থির করেন কাশীপুরেই থাকবেন এবং সেখানেই সুবিধামতো আইন পরীক্ষার প্রস্তুতি নেবেন। এই সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে নরেন্দ্র আইন-এর কয়েকটি বই নিয়ে এলেন উদ্যানবাটীতে। কিন্তু এই আইন‌ পড়া তাঁর আর হয়ে ওঠে নি! এই প্রসঙ্গে ‘কথামৃত’ অনুযায়ী মাস্টারমশাইয়ের ( শ্রীম ) সঙ্গে তাঁর কথোপকথন এইরকম ---“আজ সকালে বাড়ী গেলাম। সকলে বকতে লাগল, আর বললে---‘কি হো হো করে বেড়াচ্ছিস? আইন একজামিন ( পরীক্ষা ) এত নিকটে, পড়াশুনা নাই, হো হো করে বেড়াচ্ছ!’ মাস্টার মহাশয় জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তোমার মা কিছু বললেন?’ নরেন্দ্র উত্তর দিলেন, ‘না, তিনি খাওয়াবার জন্য ব্যস্ত। হরিণের মাংস ছিল, খেলুম, কিন্তু খেতে ইচ্ছে ছিল না।’ তিনি আরও বলিয়া যাইতে লাগিলেন, ‘দিদিমার বাড়ীতে সেই পড়বার ঘরে পড়তে গেলাম। পড়তে গিয়ে পড়াতে একটা ভয়ানক আতঙ্ক এল -- পড়াটা যেন‌ কী ভয়ের জিনিস! বুক আটু-পাটু করতে লাগল। অমন কান্না কখনও কাঁদি নাই। তারপর বইটই ফেলে দৌড়। রাস্তা দিয়ে ছুট! খড়ের গাদার কাছ দিয়ে যাচ্ছিলাম, গাময় খড়। আমি দৌড়াচ্ছি কাশীপুরের রাস্তায়! ‘বিবেক-চূড়ামণি’ শুনে আরও মন খারাপ হয়েছে! শঙ্করাচার্য বলেন, এই তিনটি জিনিস অনেক তপস্যায়, অনেক ভাগ্যে মেলে -- ‘মনুষ্যত্বং, মুমুক্ষুত্বং, মহাপুরুষসংশ্রয়ঃ’। ভাবলাম, আমার তিনটিই হয়েছে -- অনেক তপস্যার ফলে মনুষ্যজন্ম হয়েছে, অনেক তপস্যার ফলে মুক্তির ইচ্ছা হয়েছে, আর অনেক তপস্যার ফলে এরূপ মহাপুরুষের সঙ্গলাভ হয়েছে। ... সংসার আর ভাল লাগে না, সংসারে যারা আছে তাদেরও ভাল লাগে না, দুই একজন ভক্ত ছাড়া।”
🍂

 ‘যুগনায়ক বিবেকানন্দ’ গ্রন্থটিতে গম্ভীরানন্দজী এই দিনটিরই প্রসঙ্গে লিখছেন --- “ঐ ৪ঠা জানুয়ারি অপরাহ্ন চারিটার সময় নরেন্দ্র আসিয়া শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট বসিয়াছিলেন, তখন ঠাকুর মাস্টার মহাশয়ের দৃষ্টি নরেন্দ্রর প্রতি আকৃষ্ট করিয়া সঙ্কেতে বলিয়াছিলেন --- ‘কেঁদেছিল ... কাঁদতে কাঁদতে বাড়ী থেকে এসেছিল।’ কিয়ৎক্ষণ পরে নরেন্দ্র জানাইলেন, তিনি সেই রাত্রে দক্ষিণেশ্বরে বেলতলায় ধুনি জ্বালাইয়া তপস্যা করিতে যাইবেন। ঠাকুর বলিয়াছিলেন, বেলতলায় আগুন জ্বালাইলে নিকটবর্তী বারুদখানার কর্তৃপক্ষ বাধা দিবেন; পঞ্চবটীই ভাল, কিন্তু বড় শীত, আর অন্ধকার। আবার তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘পড়বি না?’ নরেন্দ্র উত্তর দিলেন, ‘একটা ঔষধ পেলে বাঁচি, যাতে পড়া-টড়া যা হয়েছে সব ভুলে যাই।’ শ্রীযুক্ত কালীপদ ঘোষ আঙ্গুর আনিয়াছিলেন। ঠাকুর নরেন্দ্রকে প্রথম দিয়া ভক্তদের মধ্যে হরিলুটের মতো ছড়াইয়া দিলেন ( ৩/২৩/১ )। নরেন্দ্র দুই-একজন ভক্তসহ সে রাত্রে দক্ষিণেশ্বর চলিয়া গেলেন। ঐ কালে তিনি প্রায়ই দক্ষিণেশ্বরে তপস্যা করিতে যাইতেন। ‘কথামৃতে’ ( ২/২৬/১ ) ইহার আরও উল্লেখ আছে।”
 কী প্রবল মানসিক টানাপোড়েনের ভিতর দিয়ে সেইসময় নরেন্দ্রনাথকে যেতে হয়েছিল‌ তা লক্ষণীয়। এই বিষয়ে গম্ভীরানন্দজী তাৎপর্যপূর্ণভাবে আরও লিখছেন -- “আমরা এই বিবরণে একদিকে যেমন পাই নরেন্দ্রর তীব্র বৈরাগ্য এবং ঈশ্বরলাভের ব্যাকুল আগ্রহ, তেমনি অন্যদিকে দেখি তাঁহার অত্যাশ্চর্য মাতৃভক্তি। এই হৃদয়বিদারক দ্বন্দ্ব তাঁহার জীবনে দীর্ঘকাল, হয়তো শেষ পর্যন্ত চলিয়াছিল। তবে এইকালে উহা চরম অবস্থায় পৌঁছাইয়াছিল। ফলতঃ তাঁহার মাতৃভক্তির পটভূমিকায় ঈশ্বরভক্তি আমাদের নিকট আরও জাজ্বল্যমান হয়, এবং আমরা বুঝতে পারি, নরেন্দ্রনাথের ন্যায় বীর ও‌ হৃদিমান সন্ন্যাসীই এইরূপ কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে পারেন।
 পরদিন ( ৫ ই জানুয়ারি ) বিকালে নরেন্দ্র জানাইলেন, তিনি আবার বাড়ী যাইবেন --- এক বন্ধু তাঁহাকে একশত টাকা ধার দিতে রাজী ছিলেন, আর নরেন্দ্র আশা করিতেছিলেন যে, ঐ অর্থে তিন মাসের মতো বাড়ীর ব্যবস্থা হইয়া যাইবে, এবং তখন তিনি নিশ্চিন্তমনে সাধনা করিবেন ( ‘কথামৃত’, ৩/২৩/৩ )। ইহারও পরে আমরা আবার দেখি, তিনি বলিতেছেন, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নূতন বিদ্যালয়ে কাজ না করিয়া বরং গয়াতে গিয়া একটা ম্যানেজারের কাজ করিবেন ( ‘কথামৃত’, ৪/৩৩/৩ )। বাড়ীর দুর্দশা মনে জাগরূক থাকিয়া সর্বদা অশান্তি উৎপাদন করিতেছিল বলিয়া এই প্রকার জল্পনা কল্পনা হয়তো সময় সময় উদিত হইত; কিন্তু ইহা সত্ত্বেও ভগবানের আকর্ষণের চিরবর্ধমান প্রাবল্য সে-সব অভিপ্রায়কে ভাসাইয়া দিতেছিল --- ইহাই হইল তাঁহার তখন মানসিক অবস্থা। সত্যি বলতে গেলে, তিনি তখন ত্যাগের হস্তে আত্মসমর্পণ করিয়াছেন। ১৫ ই মার্চের কথাবার্তা ইহাই প্রতিপন্ন করে। সেদিন নরেন্দ্র বলিলেন‌, ‘কেউ কেউ রাগে আমার উপর, ত্যাগ করিবার কথায়।‌’ অমনি ঠাকুর  কহিলেন, ‘ত্যাগ দরকার। ... একটা না সরালে কি আর একটা পাওয়া যায়?’ নরেন্দ্র সায় দিলেন, ‘আজ্ঞা হাঁ!’ ঠাকুর আবার কহিলেন, ‘সেই-ময় দেখলে কি আর কিছু  দেখা যায়? সংসার-ফংসার আর কিছু দেখা যায়?’ নরেন্দ্র প্রশ্ন করিলেন, ‘সংসার ত্যাগ করতে হবেই?’ ঠাকুর উত্তর দিলেন, ‘যা বললুম, সেই-ময় দেখলে কি আর কিছু দেখা যায়? সংসার-ফংসার আর কিছু দেখা যায়?’ একটু পরেই ঠাকুর সস্নেহে নরেন্দ্রকে দেখিতে দেখিতে ভক্তদের দিকে তাকাইয়া কহিলেন, ‘খুব!’, নরেন্দ্র সহাস্যে জানতে চাহিলেন, ‘খুব কি?’ ঠাকুর উত্তর দিলেন, ‘খুব ত্যাগ হয়ে আসছে’ (ঐ,২৩/২৪/)।“
 বাস্তবিকই নরেন্দ্রনাথের এই বৈরাগ্য, ত্যাগ ও ঈশ্বরপ্রেম আধ্যাত্মিকতার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সেই ইতিহাস নির্মাণের মূল হোতা ছিলেন অবশ্যই শ্রীরামকৃষ্ণ।

Post a Comment

0 Comments